Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

মিসরের প্রেসিডেন্টের জামাতা যেভাবে হলেন ইসরায়েলের শ্রেষ্ঠ গুপ্তচর

১৯৭৩ সালের ৫ অক্টোবর, রাত ১১টা। লন্ডনের একটি সেফ হাউজে বসে আছেন ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের পরিচালক জাভি জামির। অপেক্ষা করছেন মোসাদের অত্যন্ত বিশ্বস্ত এবং গুরুত্বপূর্ণ মিসরীয় গোয়েন্দা ‘দ্য এঞ্জেল’ এর জন্য। তখনো অবশ্য জামিরের কোনো ধারণাই ছিল না, আর মাত্র ১৫ ঘণ্টার মধ্যেই মিসর এবং সিরিয়া দু’দিক থেকে একযোগে আক্রমণ করতে যাচ্ছে ইসরায়েলের উপর, শুরু হতে যাচ্ছে চতুর্থ আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ, বা ইওম কিপুর যুদ্ধ

আগের দিনও জাভি জামির ছিলেন ইসরায়েলের রাজধানী তেল-আবিবে। কিন্তু রাত আড়াইটার সময় কাঁচা ঘুম থেকে জাগিয়ে তার সেক্রেটারি জানায়, মোসাদ হেডকোয়ার্টার থেকে ফোন এসেছে। ‘দ্য এঞ্জেল’ ছদ্মনামে মিসরীয় গোয়েন্দা প্যারিস থেকে মোসাদের লন্ডন হেডকোয়ার্টারে ফোন করে জানিয়েছে, পরের দিনই তিনি লন্ডনে মোসাদ প্রধানের সাথে সরাসরি দেখা করতে চান। ফোনে এঞ্জেল বলেছে, বিষয়টি খুবই জরুরী, কারণ এটি ‘কেমিক্যালস’ সম্পর্কিত।

মোসাদের সাবেক প্রধান জাভি জামির, ২০০০ সালে ; Source: Haaretz

কেমিক্যালস‘ শব্দটি শুনেই সচকিত হয়ে উঠলেন জামির। কারণ এঞ্জেলের সাথে মোসাদের নির্ধারিত সাংকেতিক ভাষা অনুযায়ী ‘কেমিক্যালস’ শব্দটি ব্যবহৃত হওয়ার কথা কেবলমাত্র যুদ্ধের সম্ভাবনা বোঝাতে। তিনি বুঝতে পারলেন, এঞ্জেলের কাছে নিশ্চয়ই মিসরের যুদ্ধ বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ কোনো তথ্য আছে। কারণ এর আগে এঞ্জেল কখনোই নিজে থেকে সরাসরি তার সাথে দেখা করতে চায়নি। পরদিন ৬ অক্টোবর ছিল ইসরায়েলের পবিত্র ধর্মীয় দিবস, ইওম কিপুর। দিবসটি উপলক্ষে আগে থেকেই জামিরের বিভিন্ন পরিকল্পনা ছিল, কিন্তু সব পরিকল্পনা বাদ দিয়ে সকালের প্রথম ফ্লাইটেই তিনি লন্ডনের উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন।

‘দ্য এঞ্জেল’ সেফ হাউজে এসে পৌঁছল রাত সাড়ে ১১টা বাজে। এটি ছিল সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহের পর জামিরের সাথে তার প্রথম যোগাযোগ। সে সময় লিবীয় নেতা মোয়াম্মার আল-গাদ্দাফীর পরিকল্পায় সংঘটিত হতে যাওয়া ইসরায়েলের বিরুদ্ধে একটি অপারেশনকে শেষ মুহূর্তে ব্যর্থ করে দিয়ে প্রায় চারশো ইসরায়েলি নাগরিকের প্রাণ বাঁচিয়েছিল এই মিসরীয় মোসাদ গোয়েন্দা। [সে অপারেশন সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা জানতে দেখুন এখানে।]

কুশল বিনিময়ের পর প্রথমেই জামির জানতে চাইলেন, সেপ্টেম্বরের ঐ ঘটনার পর তার কোনো বিপদ হয়েছিল কিনা। লিবিয়ান বা মিসরীয় কর্তৃপক্ষ তার ভূমিকা সম্পর্কে কিছু সন্দেহ করেছিল কিনা। এঞ্জেল তাকে আশ্বস্ত করলো, না, তার কোনো বিপদ হয়নি কিংবা তাকে কেউ সন্দেহও করেনি। কিন্তু তার উত্তর দেওয়ার ধরন থেকেই বোঝা যাচ্ছিল, সে এই ব্যাপারে আর আলোচনা করতে আগ্রহী নয়। সে এসেছে এর চেয়ে অনেক জরুরী কিছু বলতে।

ইওম কিপুর যুদ্ধে সুয়েজ খাল পাড়ি দিয়ে ইসরায়েলে প্রবেশ করছে মিসরীয় ট্যাংক বহর; Source: Wikimedia Commons

মনে মনে কথাগুলো গুছিয়ে নিল এঞ্জেল। এরপর ধীরে ধীরে বলতে শুরু করল,

আজ আমি এখানে এসেছি শুধুমাত্র যুদ্ধের ব্যাপারে কথা বলতে, অন্য কিছু না। আমার আসতে একটু দেরি হয়েছে, কারণ পুরো বিকেলটা আমি কাটিয়েছি কেনসিংটনের মিসরীয় কনসুলেটে। আমি কায়রোর সাথে যোগাযোগ করে সর্বশেষ তথ্য নিশ্চিত করেছি। আগামীকালই সাদাত ইসরায়েল আক্রমণ করছে।

এঞ্জেলের কথা শুনে বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে গেলেন জামির। তিনি জানতেন মিসর এবং সিরিয়া তাদের সীমান্তে সৈন্য সমাবেশ করছে, হয়তো আক্রমণ করার প্রস্তুতিও নিচ্ছে, কিন্তু সে আক্রমণ যে এত তাড়াতাড়ি হতে যাচ্ছে, সে বিষয়ে তাদের কোনো ধারণাই ছিল না। আর সে কারণে তাদের মাত্র ২০ শতাংশ সৈন্য ছিল সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোতে, বাকি ৮০ শতাংশ সৈন্য ছিল ব্যারাকে, সংরক্ষিত বাহিনী হিসেবে।

এঞ্জেলের দেওয়া সংবাদের ভিত্তিতেই জামির যোগাযোগ করেন সামরিক গোয়েন্দা বিভাগ, আমানের প্রধান এলি জেইরা এবং প্রতিরক্ষামন্ত্রী মোহশে দায়ানের সাথে। আর সে তথ্যের উপর ভিত্তি করেই পরদিন সকালে প্রধান মন্ত্রী গোল্ডা মায়ারের উপস্থিতিতে ইসরেয়েলি মন্ত্রীসভার জরুরী বৈঠক বসে। বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সংরক্ষিত বাহিনীকে প্রস্তুত করে প্রেরণ করা হয় সুয়েজ খালের উদ্দেশ্যে। আর এর ফলেই সম্ভবত ইসরায়েল রক্ষা পেয়ে যায় নিশ্চিত পরাজয়ের হাত থেকে!

ইওম কিপুর যুদ্ধ চলাকালে প্রধানমন্ত্রী গোল্ডা মায়ার এবং তার পাশে প্রতিরক্ষামন্ত্রী মোহশে দায়ান; Source: GPO

মিসরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত এবং সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট হাফেজ আল-আসাদের যৌথ উদ্যোগে ইসরায়েলের উপর যে আক্রমণটি হওয়ার কথা ছিল, শুধুমাত্র ‘দ্য এঞ্জেল’ এর গুপ্তচরবৃত্তির কারণেই অন্তত ১৫ ঘন্টা আগে ইসরায়েল তা জেনে গিয়েছিল। এঞ্জেলকে তাই অনেকে ইসরায়েলের ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ গোয়েন্দা হিসেবে অভিহিত করে থাকেন।

কিন্তু কে এই এঞ্জেল? তিনি ছিলেন স্বয়ং মিসরের সাবেক প্রেসিডেন্ট গামাল আবদেল নাসেরের মেয়ে মুনা নাসেরের স্বামী এবং পরবর্তীতে প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাতের সিনিয়র উপদেষ্টা, আশরাফ মারোয়ান!

আশরাফ মারোয়ানের জন্ম ১৯৪৪ সালে, মিসরের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে। বাবা ছিলেন একজন সেনা কর্মকর্তা। মিসরের প্রেসিডেনশিয়াল ব্রিগেডে চাকরি করতেন তিনি। অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র মারোয়ান ২১ বছর বয়সে কায়রো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফার্স্ট ক্লাস অনার্স ডিগ্রি সহ কেমিকাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পাশ করেন। এরপর যোগ দেন মিসরীয় সেনাবাহিনীতে।

১৯৬৫ সালের শেষ দিকে মারোয়ান যখন কায়রোর হেলিওপোলিসে নিয়মিত টেনিস খেলতে যেতেন, তখন সেখানে তার পরিচয় হয় তৎকালীন প্রেসিডেন্ট গামাল আবদেল নাসেরের মেয়ে মুনা নাসেরের সাথে। ১৭ বছর বয়সী কিশোরী মুনা সহজেই প্রেমে পড়ে যান সুদর্শন এবং বুদ্ধিদীপ্ত মারোয়ানের। তারা দু’জনেই বিয়ে করার জন্য পরিবারের উপর চাপ দিতে থাকেন।

আশরাফ মারোয়ান এবং মুনা নাসেরের বাদগান অনুষ্ঠান; Source: Pinterest

যদিও মারোয়ান সব দিক থেকেই যোগ্য পাত্র ছিলেন, কিন্তু নিরাপত্তার খাতিরে নাসের তার চিফ অফ স্টাফকে নির্দেশ দেন মারোয়ানের উপর তদন্ত করার জন্য। তদন্ত রিপোর্ট দেখে মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ে নাসেরের। কারণ রিপোর্টে উঠে আসে মারোয়ানের উচ্চাভিলাষ, ক্ষমতার লোভ, অর্থের লোভ, সমাজের উচ্চ স্তরে পৌঁছার তীব্র আকাঙ্ক্ষা প্রভৃতি। রিপোর্টে মুনার প্রতি মারোয়ানের প্রকৃত ভালোবাসা এবং অঙ্গীকারের প্রতিও সন্দেহ প্রকাশ করা হয়।

নাসের এ বিয়েতে রাজি ছিলেন না। কিন্তু মেয়ের জেদের কাছে শেষ পর্যন্ত হার মানতে হয় তাকে। ১৯৬৬ সালে মারোয়ান এবং মুনার প্রেম পূর্ণতা পায়, বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হন তারা। বিয়ের পরেও প্রথম দুই বছর মারোয়ান সেনাবাহিনীতে ছিলেন। সেখানে তিনি দ্রুত উন্নতি করতে থাকেন। কিন্তু উচ্চাকাঙ্ক্ষী অফিসারদেরকে সেনাবাহিনীতে রাখা যে ঝুঁকিপূর্ণ, সেটা সেনাবাহিনী থেকে বিপ্লব করে ক্ষমতায় আসা নাসের খুব ভালো করেই জানতেন। তিনি মারোয়ানকে সেনাবাহিনী থেকে বদলি করে প্রেসিডেন্টের অফিসে নিয়ে আসেন, যেন তাকে চোখে চোখে রাখা যায়।

বিয়ের অনুষ্ঠানে মারোয়ান এবং মুনা; Source: Getty Images

প্রেসিডেন্টের অফিসের দিনগুলোতে মারোয়ানের সাথ নাসেরের সম্পর্ক ছিল অত্যন্ত শীতল। নাসের মারোয়ানকে বিশ্বাস করতেন না, অন্যদিকে শ্বশুরের বিশ্বাস অর্জন করতে না পেরে মারোয়ান ছিলেন হতাশ এবং ক্ষুদ্ধ। এরকম অস্বস্তিকর পরিবেশ এড়ানোর জন্য তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, লন্ডনে গিয়ে কেমিস্ট্রিতে মাস্টার্স করবেন। তার এ সিদ্ধান্তে নাসেরও অখুশি ছিলেন না। তিনি সানন্দে অনুমতি দিলেন।

সমস্যা আরেকটি ছিল। মারোয়ানের জাঁকজমকপূর্ণ, বিলাসবহুল জীবনযাপনের তীব্র বাসনা ছিল, যার প্রমাণ তার পরবর্তী জীবনে দেখা যায়। কিন্তু সে সময় প্রেসিডেন্টের অফিসে চাকরির জন্য নাসের তাকে বেতন দিতেন খুবই সামান্য। অতিরিক্ত খরচ জোগাড় করতে গিয়ে সে সময় মারোয়ান এক ধনী কুয়েতি শেখের স্ত্রীর সাথে পরকীয়ার সম্পর্ক গড়ে তোলেন, যার কাছ থেকে তিনি বিভিন্ন অযুহাতে নিয়মিত অর্থ সাহায্য নিতেন।

নাসেরের কানে যখন এ সংবাদ এসে পৌঁছায়, তখন তিনি মারোয়ানকে মিসরে ডেকে পাঠান এবং মুনাকে ডিভোর্স দেবার জন্য উপর চাপ দিতে থাকেন। কিন্তু মারোয়ানকে তো বটেই, মুনাকেও ডিভোর্সের ব্যাপারে রাজি করাতে ব্যর্থ হন তিনি। তারা নিজেদের মধ্যেই ব্যাপারটির মীমাংসা করে ফেলেন। প্রবল পরাক্রমশালী প্রেসিডেন্ট নাসের আবারও মেয়ের কাছে হার মানতে বাধ্য হন। তবে তিনি শর্ত দেন, মারোয়ান আর লন্ডনে থাকতে পারবে না। তাকে মিসরেই অবস্থান করতে হবে, শুধু সময় হলে লন্ডনে গিয়ে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ কিংবা গবেষণাপত্র জমা দিয়ে আসতে পারবে। মারোয়ানের রাজি না হয়ে কোনো উপায় ছিল না।

লন্ডনে থাকাকালীন সময়ে, কিংবা লন্ডন থেকে ফেরার পরেও প্রেসিডেন্টের অফিসে মারোয়ানের চাকরি বহাল ছিল। নাসের প্রথম দিকে মারোয়ানকে পছন্দ না করলেও মারোয়ানের বিভিন্ন গুণাবলি ধীরে ধীরে তাকে আকৃষ্ট করছিল। মারোয়ান ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী; বিভিন্ন জটিল বিষয়ে তড়িৎ সিদ্ধান্ত নেওয়া, সুচিন্তিত পরামর্শ দেওয়া সহ অন্যান্য ক্ষেত্রে তার অনন্য দক্ষতা লক্ষ্য করে নাসের তাকে কাজে লাগাতে শুরু করেন। ধীরে ধীরে মারোয়ানের সাথে নাসেরের সম্পর্ক কিছুটা সহজ হয়ে আসতে থাকে। প্রেসিডেন্টের অফিসে চিফ অফ স্টাফের অধীনে হিসেবে চাকরি করার সুবাদে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সাথেও তার সুসম্পর্ক গড়ে উঠতে থাকে।

বিয়ের অনুষ্ঠানে মারোয়ানের সাথে হাত মেলাচ্ছেন প্রেসিডেন্ট নাসের; Source: AP

কিন্তু অত্যন্ত উচ্চাভিলাষী মারোয়ান সেখানেই থেমে থাকার পাত্র ছিলেন না। ১৯৭০ সালের গ্রীষ্মের এক সকালে লন্ডনের এক ফোনবুথ থেকে মারোয়ান ফোন করলেন লন্ডনের ইসরায়েলি দূতাবাসে। অপারেটরকে বললেন, তিনি ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিনিধির সাথে কথা বলতে চান। মোসাদের লন্ডন প্রতিনিধি সেই মুহূর্তে অফিসে ছিলেন না, কাজেই অপারেটর কলটি ফরোয়ার্ড করে দিল ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী, আইডিএফের মিলিটারি অ্যাটাশের কাছে। মারোয়ান নিজের বিস্তারিত পরিচয় না জানিয়ে শুধু নাম জানালেন এবং বললেন, তিনি শুধুমাত্র গোয়েন্দা সংস্থার সাথেই কথা বলতে চান।

সে সময় মারোয়ান খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ কেউ ছিলেন না, ফলে মিলিটারি অ্যাটাশে তার নাম শুনেও তাকে চিনতে পারেনি। তাছাড়া পরদিনই তার মিসরে ফিরে যাবার কথা ছিল, তাই তিনি পাল্টা যোগাযোগের জন্য কোনো ফোন নাম্বার বা ঠিকানাও দেননি, শুধু বলেছিলেন পরে তিনি নিজেই আবার যোগাযোগ করে খবর নিবেন। স্বভাবতই মিলিটারি অ্যাটাশে মারোয়ানের কথাকে খুব বেশি গুরুত্ব দিলেন না। তিনি একটি চিরকুটে মারোয়ানের নাম এবং সংক্ষিপ্ত নোট লিখে তার ডেস্কের উপর একটি আউটবক্স ফোল্ডারে গুরুত্বহীনভাবে ফেলে রাখলেন।

পাঁচ মাস পর, ১৯৭০ সালের শেষ দিকে মারোয়ান আবারো লন্ডনে গেলেন। ততদিনে অবশ্য মিসরের রাজনীতিতে অনেক কিছু ঘটে গেছে। মারোয়ানের শ্বশুর, মিসরের প্রেসিডন্ট গামাল আবদেল নাসের মৃত্যুবরণ করেছেন, আর তার স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন আনোয়ার সাদাত। মারোয়ান সাদাতের খুবই প্রিয়পাত্র ছিলেন, ধীরে ধীরে তিনি হয়ে উঠতে থাকেন প্রেসিডেন্টের অফিসে তার অন্যতম প্রধান সহকারী। কিন্তু এতকিছুর পরেও তার মূল লক্ষ্য পরিবর্তিত হয়নি। লন্ডনে এসে তিনি আবারও যোগাযোগ করেন ইসরায়েলি দূতাবাসে।

ডান থেকে মারোয়ান, মুনা, নাসেরের স্ত্রী, নাসের, নাসেরের বড় মেয়ে, বড় মেয়ের স্বামী; Source: MAHER ATTAR/SYGMA/CORBIS

এবারও তার ফোন ধরেন আইডিএফ প্রতিনিধি; তবে পূর্বের প্রতিনিধি না, নতুন প্রতিনিধি মেজর জেনারেল শ্যামুয়েল ইয়াল। এবার মারোয়ান তার হোটেলের ফোন নাম্বার দিলেন, কিন্তু তার পরেও বেশ কয়েকদিন পর্যন্ত মোসাদ বা অন্য কারো পক্ষ থেকে তার সাথে কোনো যোগাযোগ করা হলো না। বাস্তবে আগের প্রতিনিধির মতোই ইয়ালও মারোয়ানকে চিনতে পারেনি। এবং আগের প্রতিনিধির মতোই তার সাথেও মোসাদের লন্ডন প্রতিনিধি শ্যামুয়েল গোরেনের খুব একটা সুসম্পর্ক না থাকায় তিনিও মেসেজটিকে গুরুত্ব না দিয়ে ফেলে রেখেছিলেন।

কিন্তু পরিস্থিতি পাল্টে যায়, যখন ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে দু’জন সিনিয়র মোসাদ প্রতিনিধি লন্ডনে আসেন। গোরেন এবং ইয়েল মিলে একদিন গাড়িতে করে কোথাও যাচ্ছিলেন, তখন কথায় কথায় ইয়েল মোসাদ প্রতিনিধিদের সাথে মারোয়ানের কথা উল্লেখ করে বলেন যে, আরবদের মতো উচ্চারণ বিশিষ্ট এক ব্যক্তি এ পর্যন্ত কয়েকবার ফোন করেছে। সে মোসাদের সাথে কথা বলতে চায়, কিন্তু নিজের বিস্তারিত পরিচয় জানাতে চায় না, বা সরাসরি দূতাবাসেও আসতে চায় না।

মোসাদের একজন লোকটির নাম জানতে চাইলে ইয়াল যখন বললেন ‘আশরাফ মারোয়ান’, সাথে সাথেই গাড়ির পরিবেশ পুরোপুরি পাল্টে গেল। মোসাদ প্রতিনিধিরা যেন নিজেদের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। তারা অবাক দৃষ্টিতে একে অন্যের দিকে তাকাতে লাগলেন। আইডিএফ না চিনলেও মোসাদ আশরাফ মারোয়ানকে খুব ভালো করেই চিনত। মারোয়ানের উপর তাদের একটা ফাইলও ছিল, সেখানে মারোয়ানের বিয়ের দিনের একটা ছবিও রাখা ছিল।

মারোয়ানের প্রথম সন্তানকে কোলে নিয়ে প্রেসিডেন্ট নাসেরের স্ত্রী; Source: AP

শত্রু রাষ্ট্রগুলোর প্রায় প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি সম্পর্কে খোঁজ-খবর রাখা মোসাদের জন্য ছিল রুটিন কাজ। তারা সব সময়ই অনুসন্ধান করতো শত্রুদেশের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের মধ্য থেকে কাউকে ব্ল্যাকমেইল করে, ফাঁদে ফেলে, কিংবা লোভ দেখিয়ে নিজেদের কাজে লাগানো যায় কি না। প্রেসিডেন্টের আত্মীয় হওয়ায় এবং রাষ্ট্রের সব গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জানার সুযোগ থাকায় মারোয়ানও মোসাদের লিস্টে বেশ উপরের দিকেই ছিল। কিন্তু তারা কল্পনাও করতে পারেনি সেই মারোয়ান নিজে থেকেই এসে তাদের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করবে।

মারোয়ান তখনও লন্ডনে ছিলেন কি না, মোসাদ প্রতিনিধিরা তা জানতেন না। কিন্তু তারা আর বিন্দুমাত্র দেরি করতে চাইলেন না। গাড়ি ঘুরিয়ে সোজা চলে এলেন অফিসে। সেখান থেকে ফোন করলেন মারোয়ানের দেয়া ফোন নম্বরে। মোসাদের ভাগ্য ভালো, মারোয়ান তখনও লন্ডন ছেড়ে যাননি। তারা তাকে নির্দিষ্ট সময়ে লন্ডনের একটি হোটেলে এসে তাদের সাথে দেখা করতে বললেন।

ফাঁদ হতে পারে, এমন আশঙ্কায় মোসাদের এজেন্টরা আগে থেকেই হোটেলের প্রবেশ পথ, লবি সহ বিভিন্ন জায়গায় সাদা পোশাকে অবস্থান নিল। যথাসময়ে হাতে একটি ব্রিফকেস নিয়ে হোটেলে হাজির হলেন মারোয়ান। লবিতে দাঁড়িয়ে মিনিট পাঁচেক কুশল বিনিময় এবং প্রাথমিক পরিচয় নিশ্চিত করার পর তাকে নিয়ে উপরের একটি কক্ষে চলে গেলেন মোসাদের এক প্রতিনিধি, যার আসল নাম এখন পর্যন্ত প্রকাশিত হয়নি, কিন্তু ছদ্মনাম ‘দুবি’।

হোটেলের রুমে গিয়ে মারোয়ান নিজের বিস্তারিত পরিচয় এবং গুরুত্ব তুলে ধরলেন এবং জানালেন, তিনি মোসাদের জন্য কাজ করতে চান। মিসরের রাষ্ট্রীয় এবং সেনাবাহিনী সম্পর্কিত গোপন তথ্য দিয়ে তিনি সাহায্য করতে চান ইসরায়েলকে।  দুবি যখন জানতে চাইলেন, ঠিক কী ধরনের তথ্য তিনি দিতে পারবেন, তার উত্তরে মারোয়ান জানালেন, সকল তথ্য। কারণ প্রেসিডেন্টের অফিসে রাষ্ট্রীয় সকল গুরুত্বপূর্ণ তথ্যই তার হাতের উপর দিয়ে যায়। যেকোনো দেশের সরকার প্রধানের সাথে সাদাতের গোপন বৈঠকের আলোচ্য বিষয়, মিসরের সেনাবাহিনীর যেকোনো সামরিক মহড়া, অস্ত্র ক্রয়, যুদ্ধের প্রস্তুতি, সব ধরনের তথ্যই মারোয়ানের হাতের নাগালে।

নিজের যোগ্যতার প্রমাণ দেওয়ার জন্য মারোয়ান ব্রিফকেস খুলে একতোড়া কাগজ বের করে দুবির হাতে দিলেন। কাগজগুলো দেখে দুবি নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। সেগুলো ছিল আরবিতে হাতে লেখা উচ্চ পর্যায়ের সামরিক বৈঠকের মেমোরেন্ডাম, যেখানে স্থান পেয়েছিল মিসরের যুদ্ধ পরিকল্পনা সম্পর্কে চরম গোপনীয় বিভিন্ন তথ্য। দুবি আরবিও জানতেন, তার সামরিক শিক্ষাও ছিল; কাজেই নথিগুলোর গুরুত্ব বুঝতে তার তেমন কোনো অসুবিধা হলো না। তারপরেও কয়েক ঘন্টা ব্যাপী তিনি মারোয়ানের কাছ থেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে প্রতিটি তথ্য বিস্তারিত জেনে নিলেন।

সেদিনের মতো বিদায় নিয়ে চলে গেলেন মারোয়ান। কিন্তু এরপরেই শুরু হলো মোসাদের অভ্যন্তরীণ বিতর্ক। মারোয়ানকে কি বিশ্বাস করা উচিত হবে? বা তার দেয়া তথ্যগুলো কি আসলেই সঠিক? কিন্তু বিশ্বের অন্যতম সেরা গোয়েন্দা বাহিনীর কাছে এটা খুব বড় একটা সমস্যা না। মারোয়ানই মিসরে ইসরায়েলের একমাত্র গুপ্তচর ছিল না। তারা মারোয়ানের দেয়া তথ্যগুলো বিভিন্ন উপায়ে যাচাই বাছাই করে দেখলো, সেগুলোই আসলেই সত্য। পরবর্তীতে শ্যামুয়েল গোরেন মন্তব্য করেছিলেন, এ ধরনের তথ্য হাজার বছরে একবার পাওয়া যায়।

গাদ্দাফী এবং সাদাতের পেছনে আশরাফ মারোয়ান; Source: The Angel

দীর্ঘ যাচাই-বাছাই এবং পরীক্ষা শেষে মোসাদ শেষ পর্যন্ত নিশ্চিত হয়েছিল, মারোয়ান আসলেই মোসাদের জন্য কাজ করতে চায়। তারা মারোয়ানকে বিশ্বাস করেছিল, আর মারোয়ানও তাদের বিশ্বাসের মর্যাদা রেখেছিল। ১৯৭০ সাল থেকে শুরু করে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ২৮ বছর পর্যন্ত তিনি সবার অজান্তে মোসাদের জন্য কাজ করে গেছেন, মিসরের রাষ্ট্রীয় এবং সামরিক গোপন তথ্যগুলো সবার অজান্তে পাচার করে দিয়েছেন তাদের সবচেয়ে বড় শত্রুর কাছে।

ইসরায়েলের জন্য মারোয়ানের সবচেয়ে বড় দুটি অবদানের একটি ছিল গাদ্দাফীর উদ্যোগে ইসরায়েলি বিমান ধ্বংসের পরিকল্পনা নস্যাৎ করে দেয়া। আর তার চেয়েও বড় অবদান ছিল ১৯৭৩ সালের ইওম কিপুর যুদ্ধের সংবাদ আগেভাগেই ইসরায়েলকে জানিয়ে দিতে পারা। অনেকেই মনে করেন, সেই সংবাদ যদি মারোয়ান সঠিক সময়ে না দিতে পারত, তাহলে হয়তো ইসরায়েল রাষ্ট্রের অস্তিত্বই বিপন্ন হয়ে যেত।

কিন্তু যে প্রশ্নটা সবাইকেই ভাবায়, তা হচ্ছে আশরাফ মারোয়ানের মতো এক যুবক, যিনি ছিলেন আরব বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং প্রভাবশালী নেতার জামাতা, যিনি বেড়ে উঠেছেন দেশপ্রেমিক পরিবারে, বাবার মতো যিনি নিজেও ছিলেন দেশ সেবায় দেশের প্রতিরক্ষা বাহিনীতে চাকরিরত, কেন তিনি নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে শত্রু রাষ্ট্রের জন্য স্বেচ্ছায় গোয়েন্দাগিরি করার মতো সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন? এ প্রশ্নের নিশ্চিত কোনো উত্তর নেই, তবে অনেক ইতিহাসবিদ, অনেক বিশ্লেষক এর অনেক রকম ব্যাখ্যা দিয়েছেন।

পরিণত বয়সে আশরাফ মারোয়ান; Source: jewishbookcouncil.org

অধিকাংশ ইসরায়েলি কর্মকর্তা ধারণা করেন, মারোয়ান মূলত অর্থের লোভেই মোসাদে যোগ দিয়েছিলেন। প্রথম দিনের সাক্ষাতের শেষে দুবিকে কাগজপত্রগুলো দিয়ে বিদায় নেওয়ার আগেই মারোয়ান তাকে বলেছিলেন, তারা সেগুলো যাচাই-বাছাই করে দেখুক, কিন্তু পরবর্তীতে যখন তিনি নতুন কোনো তথ্য নিয়ে আসবেন, তখন তাকে দিতে হবে ১ লাখ ডলার! ১৯৭০ সালে এটি ছিল বিশাল অঙ্কের টাকা। কিন্তু মোসাদ তার গুরুত্ব বুঝেছিল। তারা ঠিকই তার প্রাপ্য পরিশোধ করেছিল। এই ১ লাখ ডলার ছিল শুধু শুরু, পরবর্তী জীবনে বিভিন্ন সময়ে মারোয়ান মোসাদের কাছ থেকে পেয়েছিলেন অন্তত ৩০ লাখ ডলার!

এই বিপুল পরিমাণ অর্থ মারোয়ান ব্যবসার পেছনে ব্যয় করেছিলেন। তার ছিল আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্ন। তার মূল ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নামই ছিল ‘কাবরা’, যে আরবি শব্দটির অর্থ বৃদ্ধি পাওয়া। তিনি সারাজীবন সেই চেষ্টাই করে গেছেন, কীভাবে সম্পদ আরো বৃদ্ধি করা যায়, কীভাবে আরো বিলাসবহুল জীবন যাপন করা যায়। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তার সম্পত্তির পরিমাণ হয়েছিল প্রায় ৪০০ মিলিয়ন ডলার! ব্রিটিশ ফুটবল ক্লাব চেলসির ৩.২ শতাংশ মালিকানাও ছিল তার।

মারোয়ানকে নিয়ে ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিও অবশ্য আছে। প্রথম দিনের সাক্ষাতে মারোয়ানকে যখন মোসাদের এক প্রতিনিধি জিজ্ঞেস করেছিল, তিনি কেন নিজের দেশের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে চান, উত্তরে মারোয়ান জানিয়েছিলেন, একজন সৈনিক হিসেবে তার পরাজিত হতে ভালো লাগে না। ১৯৬৭ সালের যুদ্ধে ইসরায়েলের কাছে মিসরের পারাজয় তাকে হতাশ করেছিল। তিনি বুঝতে পারছিলেন, ভবিষ্যতে হয়তো মিসরের পক্ষে কখনোই ইসরায়েলের বিরুদ্ধে জয়লাভ করা সম্ভব হবে না। তাই তিনি বিজয়ী দলের পক্ষেই অবস্থান নিতে চেয়েছিলেন।

২০১৮ সালে আসন্ন দ্য অ্যাঞ্জেল চলচ্চিত্রের প্রচারণামূলক চিত্র; Source: Variety

আশরাফ মারোয়ানের মোসাদে যোগ দেওয়ার আরেকটি ব্যাখ্যা দিয়েছেন ইসরায়েলি ইতিহাসবিদ ইউরি বার জোসেফ, মারোয়ানের গোয়েন্দা জীবনের উপর লেখা তার The Angel: The Egyptian Spy Who Saved Israel শিরোনামের বইয়ে। এ বইটি অবলম্বনে নেটফ্লিক্স থেকে বর্তমানে নির্মিত হচ্ছে The Angel নামের একটি চলচ্চিত্র। এ বইয়ে ইসরায়েলি কর্মকর্তাদের উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি সেখানে উল্লেখ করেন, অর্থলিপ্সা, শ্বশুরের কাছ থেকে যথাযথ মর্যাদা না পাওয়ার প্রতিশোধস্পৃহার পাশাপাশি মারোয়ানের এই ভূমিকার পেছনে দায়ী ছিল তার মনস্তাত্ত্বিক গঠন। তিনি ছিলেন প্রচণ্ড রকমের অ্যাডভেঞ্চার প্রিয়। তার এই গোপন ভূমিকা, যেখানে প্রতি মুহূর্তে ঝুঁকি, প্রতি মুহূর্তে ধরা পড়ার ভয়, এই জীবনটাই ছিল তার পছন্দের জীবন

কিন্তু আসলেই কি তাই? সবাই কি এরকমই মনে করে? মোটেও না। মিসরীয়রা তো বটেই, স্বয়ং সে সময়ের ইসরায়েলির সামরিক গোয়েন্দা বাহিনীর প্রধান, জেনারেল এলি জেইরাও দাবি করেন, আশরাফ মারোয়ান ছিলেন আসলে মিসরের ডাবল এজেন্ট। পুরো সময়টা তিনি ইসরায়েলকে ধোঁকা দিয়ে আসলে মিসরের পক্ষ হয়েই কাজ করে গেছেন। আশরাফের ফাঁদে পড়ার জন্য তিনি নিজের ভুলও স্বীকার করেন।

কিন্তু কেন তিনি এরকম মনে করেন? আসলে মারোয়ান কার এজেন্ট ছিল? এই প্রশ্নের এবং আশরাফ মারোয়ানের মৃত্যু রহস্য সম্পর্কে জানতে হলে পড়ুন এই সিরিজের আগামী এবং সর্বশেষ পর্ব

এই আর্টিকেলটি ভালো লাগলে পড়তে পারেন একই বিষয়ের উপর এই লেখকের লেখা বই “স্পাই স্টোরিজ: এসপিওনাজ জগতের অবিশ্বাস্য কিছু সত্য কাহিনি“।

বইটি সংগ্রহ করতে পারেন এখান থেকে: roar.cm/spy-stories

Related Articles