আঞ্চলিক বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিরোধের কারণে বিংশ শতাব্দীর সত্তরের দশকের শুরু থেকেই হন্ডুরাস এবং এল সালভাদর এই দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। দুই দেশের মধ্যে যখন রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামরিক ক্ষেত্রে পারস্পরিক হুমকি এবং উত্তেজনা বৃদ্ধি পাচ্ছিল, ঠিক তখনই তারা কনকাকাফ অঞ্চল থেকে নবম বিশ্বকাপ ফুটবলের বাছাইপর্বে পরস্পরের মুখোমুখি হয়। বিশ্বকাপ ফুটবল বাছাইয়ের প্লে-অফের সেই ম্যাচের পর দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনার মাত্রা তীব্র থেকে তীব্রতর হয়েছিল।
বৈশ্বিক ফুটবলে সবচেয়ে মর্যাদার প্রতিযোগিতা ফিফা বিশ্বকাপ ফুটবলের নবম আসরের আয়োজন করা হয় ১৯৭০ সালে মেক্সিকোতে। উত্তর আমেরিকার প্রথম কোনো দেশে আয়োজিত ফুটবলের বিশ্ব আসর সেই বছরের ৩১ মে থেকে ২১ জুন পর্যন্ত চলে।
সেই বিশ্বকাপের চূড়ান্ত পর্বের লড়াইয়ে অংশ নিতে কনকাকাফ অঞ্চল থেকে বাছাইপর্বের একটি ম্যাচে মুখোমুখি হয় হন্ডুরাস ও এল সালভাদর। দুটো দেশই বাছাইপর্বে ভালো খেলেছিল, ফলে উভয়ের পক্ষেই বিশ্বকাপ ফুটবলের সেই আসরের চূড়ান্ত পর্বে অংশগ্রহণের সুযোগ তৈরি হয়। প্রথমবারের মতো ফুটবলের বিশ্বমঞ্চে অংশ নেওয়ার লক্ষ্য নিয়ে দুটো দেশই সমানতালে এগিয়ে চলছিল।
বিশ্বকাপ ফুটবল বাছাইয়ের নিয়মানুসারে 'হোম এন্ড অ্যাওয়ে' এর ভিত্তিতে প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হত। ১৯৬৯ সালের ৮ জুন দুটো দলের মধ্যে প্রথম লেগের ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয় হন্ডুরাসের রাজধানী তেগুচিগালপা শহরে। চরম উত্তেজনাকর এবং তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ সেই ম্যাচে স্বাগতিক হন্ডুরাস ১-০ গোলের ব্যবধানে এল সালভাদরের বিপক্ষে জয়লাভ করে।
এই ম্যাচ চলাকালে স্টেডিয়ামে দুই দলের সমর্থকদের মধ্যে হাতাহাতির ঘটনাও ঘটে। প্রথম লেগে জিতে হন্ডুরাস বিশ্বকাপের চূড়ান্ত পর্বে খেলার লড়াইয়ে একধাপ এগিয়ে গিয়েছিল। এরপর এল সালভাদর এর রাজধানী সান সালভাদর-এ হন্ডুরাস এবং এল সালভাদরের মধ্যকার ফিরতি লেগের ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয় সেই বছরের ১৫ জুন। এই ম্যাচ ঘিরে পুরো শহরে উত্তেজনাকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল।
দ্বিতীয় লেগের ম্যাচের পূর্বে হন্ডুরাসের ফুটবল দলের অবস্থানরত হোটেলে এল সালভাদরের কয়েকজন বিশৃঙ্খল সমর্থক হামলা চালানোর চেষ্টা করে। একপর্যায়ে পুলিশের সাথে তাদের সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটে। দ্বিতীয় লেগের ম্যাচের সময়ও স্টেডিয়াম থেকে হন্ডুরাসের খেলোয়াড়দের বিরুদ্ধে বিষোদগার করা হতে থাকে, এমনকি ম্যাচে এল সালভাদরের খেলোয়াড়দের বিরুদ্ধে ইচ্ছাকৃত ফাউল করার অভিযোগ আনা হয়েছিল। সেই প্রতিকূল অবস্থার ম্যাচে হন্ডুরাস ফুটবল দল এল সালভাদর এর কাছে ৩-০ গোলের ব্যবধানে পরাজিত হয়। সেই ম্যাচের পরও এল সালভাদর এবং হন্ডুরাসের সমর্থকদের মধ্যে তীব্র সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে এবং সেই ঘটনায় এল সালভাদরের তিনজন সমর্থক নিহত হয়।
হন্ডুরাস এবং এল সালভাদরের বাছাইপর্বের দুই লেগের লড়াইয়ে গোল ব্যবধানে এল সালভাদর এগিয়ে থাকলেও তৎকালে বিশ্বকাপ ফুটবলের বাছাইপর্বে গোল ব্যবধানের ব্যাপারটি বিবেচনা করা হত না। ফলে একটি নিরপেক্ষ ভেনুতে দল দুটোর মধ্যে একটি প্লে-অফ ম্যাচের আয়োজন করা হয়, যার মাধ্যমে সেই লড়াইয়ের চূড়ান্ত নিষ্পত্তি করা হয়। হন্ডুরাস এবং এল সালভাদরের মধ্যকার প্লে-অফ ম্যাচটি সেই বছরের ২৭ জুন মেক্সিকোর রাজধানী মেক্সিকো সিটিতে অনুষ্ঠিত হয়।
ম্যাচটি নিয়ে দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে তীব্র রাজনৈতিক ও কূটনীতিক উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। এমনকি হন্ডুরাসে বসবাসকারী এল সালভাদরের অভিবাসীদের উপর বিদ্বেষপূর্ণ আচরণের অভিযোগ করে এল সালভাদর একপর্যায়ে হন্ডুরাসের সাথে সব ধরনের কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে এবং দুটো দেশই মেক্সিকো সিটিতে অনুষ্ঠিত প্লে-অফ ম্যাচটি নিজেদের রাষ্ট্রীয় মর্যাদার লড়াই হিসেবে অভিহিত করে।
মেক্সিকো সিটির আজটেকা স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত সেই প্লে-অফ ম্যাচে দুটো দলের মধ্যে তীব্র প্রতিযোগিতা হয়। আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণে ম্যাচটি এগিয়ে যেতে থাকে, মাঠে দুই দলের খেলোয়াড়দের মধ্যে তীব্র শারীরিক লড়াইয়ের ঘটনাও ঘটে। সেই ম্যাচ চলাকালে বিশৃঙ্খলা ও সহিংসতা এড়ানোর জন্য মেক্সিকো সরকার প্রায় ১,৭০০ পুলিশ সদস্য মোতায়েন করে। শেষ পর্যন্ত প্লে-অফের লড়াইটি নির্ধারিত ৯০ মিনিট পর্যন্ত ২-২ গোলে অমীমাংসিত থাকে। এরপর শুরু হয় অতিরিক্ত সময়ের লড়াই। সেই লড়াইয়ে অতিরিক্ত সময়ের ১১ মিনিটের মাথায় ম্যারিসিও রদ্রিগেজ ১টি গোল করে এল সালভাদরকে এগিয়ে নেন। গোলদাতা রদ্রিগেজকে এল সালভাদরের জাতীয় বীর হিসেবে অভিহিত করা হয়েছিল। এরপর অতিরিক্ত সময়ের অবশিষ্টাংশে হন্ডুরাস গোল পরিশোধের অবিরাম প্রচেষ্টা চালায়। কিন্তু এল সালভাদরের রক্ষণভাগ এবং গোলরক্ষকের দৃঢ়তায় তারা সফল হতে পারেনি। অবশেষে এল সালভাদর ৩-২ গোলের ব্যবধানে হন্ডুরাস দলকে হারিয়ে বিজয় অর্জন করে। এর মধ্য দিয়ে সেবারের মতো হন্ডুরাস ও এল সালভাদরের মধ্যকাল ফুটবলীয় লড়াইয়ের ইতি ঘটে।
কিন্তু এই ঘটনার রেশ তখনও শেষ হয়ে যায়নি, বরং এই ঘটনা দুটো দেশের মধ্যকার লড়াইয়ের ভয়ঙ্কর পরিণতির দিকে যাওয়ার ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছিল। অবশ্য ফাইনাল প্লে-অফ ম্যাচে হাইতি ফুটবল দলকে হারিয়ে এল সালভাদর কনকাকাফ অঞ্চল থেকে ১৯৭০ সালের মেক্সিকো ফুটবল বিশ্বকাপের চূড়ান্ত পর্বে অংশগ্রহণের যোগ্যতা অর্জন করে। হন্ডুরাস অবশ্য তাদের ফুটবল দলের সাথে দ্বিতীয় লেগের ম্যাচে বৈষম্যমূলক আচরণের অভিযোগ তুলে সেই ম্যাচের ফলাফল প্রত্যাখান করে। প্লে-অফ ম্যাচে এল সালভাদরের জয় হন্ডুরাস ও এল সালভাদরের মধ্যকার প্রায় এক দশক ধরে চলমান উত্তেজনাকে আরও উসকে দিয়েছিল।
প্রশান্ত মহাসাগরের উপকূলবর্তী এল সালভাদর মধ্য আমেরিকার সবচেয়ে জনবহুল ও ঘনবসতিপূর্ণ দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম। অন্যদিকে এল সালভাদরের চেয়ে হন্ডুরাস আয়তনে প্রায় পাঁচ গুণ বড় হলেও ১৯৬৯ সালের দিকে হন্ডুরাসের জনসংখ্যা এল সালভাদরের জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেকের মতো ছিল। এই দুটো দেশের মধ্যে সীমান্তে ততটা কড়া প্রহরা ছিল না, ফলে প্রতিবেশী এল সালভাদর থেকে অনেক মানুষ কাজের সন্ধানে হন্ডুরাসে পাড়ি জমায়। এভাবে বিংশ শতাব্দীর সত্তরের দশক নাগাদ এল সালভাদরের প্রায় তিন লক্ষ নাগরিক হন্ডুরাসে পৌঁছেছিলেন। এর ফলে হন্ডুরাসের নাগরিকদের জন্য কৃষি জমিতে কাজের সুযোগ সংকুচিত হতে থাকে এবং সেদেশের মানুষের মধ্যে এল সালভাদর থেকে আসা অভিবাসীদের বিরুদ্ধে ক্ষোভ সৃষ্টি হতে থাকে।
একপর্যায়ে তৎকালীন হন্ডুরাস সরকার ১৯৬২ সাল থেকে ভূমি সংস্কার আইন প্রণয়ন করে এল সালভাদর থেকে আসা অভিবাসীদের সেদেশ থেকে বিতাড়িত করার পরিকল্পনা করে। ফলে হন্ডুরাস সরকার অভিবাসীদের ফেরত নিতে এল সালভাদর সরকারকে চাপ দিতে থাকে এবং জোরপূর্বক অনেক অভিবাসীকে সীমান্তে পুশ ব্যাক করতে শুরু করে। সীমান্তের ছোটখাট বিরোধ সবসময়ই দেশ দুটোকে মুখোমুখি অবস্থানে দাঁড় করিয়েছিল। দুটো দেশের গণমাধ্যমে পরস্পরবিরোধী এবং বিদ্বেষমূলক সংবাদ প্রচারিত হতে থাকে। এছাড়াও দুই প্রতিবেশীর মধ্যে বাণিজ্য এবং সমুদ্রসীমা নিয়ে বিরোধ ছিল।
হন্ডুরাস সরকার ১৯৬৭ সাল থেকে ভূমি সংস্কার আইন পুরোপুরিভাবে কার্যকর করা শুরু করে। এই আইনের মাধ্যমে হন্ডুরাসে অবস্থানকারী এল সালভাদরের অধিবাসীদের কাছ থেকে জমি জোরপূর্বক অধিগ্রহণ করে স্থানীয়দের মধ্যে বণ্টন করা হয়। এর ফলে এল সালভাদরের বিপুল সংখ্যক অধিবাসীকে হন্ডুরাস থেকে বহিষ্কার করা হয়।
এল সালভাদরের সরকার হন্ডুরাস থেকে ফেরত পাঠানো বিপুল সংখ্যক অভিবাসীকে নিয়ে ভয়াবহ সংকটের মুখে পড়ে এবং হন্ডুরাসের বিরুদ্ধে সামরিক পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ফিদেল সানচেজ হার্নান্দেজের উপর চাপ বৃদ্ধি পেতে থাকে। এরপর সেই বছরের ১৪ জুলাই এল সালভাদরের সামরিক বাহিনী প্রতিবেশী হন্ডুরাসে সর্বাত্মক বিমান হামলা শুরু করে। তারা টনকন্টিন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বোমাবর্ষণ করতে থাকে, যেটি সেই সময়ে হন্ডুরাস বিমান বাহিনীর ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছিল। এমনকি এল সালভাদরের সৈন্যরা হন্ডুরাসের স্থলভাগের মধ্যেও প্রবেশ করে হামলা করতে থাকে।
এমন পরিস্থিতিতে এল সালভাদরের সামরিক পদক্ষেপের বিষয়ে হন্ডুরাসের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট এনরিক লোপেজ অ্যারিলানো মার্কিন প্রশাসনের সাথে আলোচনা করেন। হন্ডুরাসের সামরিক বাহিনী সেই হামলা প্রতিহত করে জবাব দিতে শুরু করে। তাদের বিমান বাহিনী এল সালভাদরের এলোপাঙ্গো বিমান ঘাঁটি এবং প্রধান জ্বালানি কেন্দ্র একাজাল্টা বন্দরে হামলা চালায়। এভাবে দুটো দেশ সর্বাত্মক রক্তক্ষয়ী সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে। যুদ্ধের একপর্যায়ে নিকারাগুয়া সরকারের সহায়তায় এল সালভাদরের সামরিক বাহিনী হন্ডুরাসের রাজধানী তেগুচিগালপা অভিমুখে অগ্রযাত্রা শুরু করে।
অবশেষে হন্ডুরাস সরকারের আহবানে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উদ্যোগে ১৮ জুলাই উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশের দেশগুলোর পারস্পরিক সহযোগিতা সংস্থা Organisation of American States (OAS) এর জরুরি বৈঠক আহবান করা হয়ে। সেই বৈঠকে এই দুটো দেশ ১৮ জুলাই মধ্যরাত থেকে পারস্পরিক যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়।
যুদ্ধে প্রায় তিন হাজার মানুষ মৃত্যুবরণ করে, যাদের বেশিরভাগ ছিলেন হন্ডুরাসের সাধারণ নাগরিক এবং দুই পক্ষেরই ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি সাধিত হয়। একে শত ঘণ্টার যুদ্ধ হিসেবেও অভিহিত করা হয়। এই সংঘাতের ফলে দুই দেশের অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব পড়ে। এল সালভাদর সরকার সেই বছরের আগস্ট মাস নাগাদ হন্ডুরাস থেকে সব সৈন্য প্রত্যাহার করে নেয়। ১৯৮০ সালের ৩০ অক্টোবর পেরুর রাজধানী লিমায় হন্ডুরাস ও এল সালভাদরের মধ্যে একটি শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, যেখানে সীমান্ত সমস্যা সমাধানের ব্যাপারে উল্লেখ করা ছিল।
১৯৭০ সালে নবম বিশ্বকাপ ফুটবলের বাছাইপর্বে ম্যাচে এল সালভাদরের অধিনায়ক সালভাদর ম্যারিওনা শুধু ফুটবল ম্যাচটির কারণে যে যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল, সেটি মনে করেন না। তার অভিমত, দুই দেশের রাজনৈতিক নেতারা উগ্র জাতীয়তাবাদী মানসিকতা থেকে সেই ফুটবল ম্যাচটিকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করে দুটো জাতিকে সংঘাতের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেন।
যদিও বিশ্বকাপ ফুটবল বাছাইপর্বের ম্যাচের ফলাফল হন্ডুরাস এবং এল সালভাদরের মধ্যকার রক্তক্ষয়ী সংঘাতের একমাত্র কারণ ছিল না। সেই উত্তেজনাকর ম্যাচটি দুটো দেশের মধ্যে যুদ্ধ শুরুর ক্ষেত্রে একটি নিয়ামক হিসেবে ভূমিকা রেখেছিল মাত্র, দুটো দেশের মধ্যে চলা এক দশকের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং ভৌগোলিক বিরোধ সংঘাতের গতিপ্রকৃতি নির্ধারণ করে এবং একটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের সূচনা করে।
This Bengali article describes the war between El Salvador and Honduras in the '70s where a football match played as a positive catalyst behind that war.
Reference:
2. The Football War — How a Soccer Game Led to Conflict Between El Salvador and Honduras in 1969
3. Soccer War
4. Has football ever started a war?
5. The Real Football War! When El Salvador Invaded Honduras Over a Soccer Game