Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

যেভাবে আবিষ্কৃত হয় ট্রয় নগরী

রানী হেলেনের নাম প্রায় সবারই জানা। বিশেষ করে যারা ইতিহাস ও সাহিত্য অনুরাগী তারা হেলেন এবং ট্রয়ের যুদ্ধ সম্পর্কে সামান্য হলেও জানেন। গ্রিক মহাকবি হোমার তার অমর সৃষ্টিকর্ম ‘ইলিয়াড’ এবং ‘ওডিসি’তে রানী হেলেন এবং তাকে ঘিরে গ্রিস ও ট্রয়ের মধ্যকার বিখ্যাত যুদ্ধের বর্ণনা দিয়েছেন। ইতিহাসে এই যুদ্ধের নাম ‘ট্রোজান ওয়ার’ বা ‘ট্রয়ের যুদ্ধ‘। এই যুদ্ধে গ্রিকদের হাতে ধ্বংস হয় ট্রয় নগরী।

হোমারের ইলিয়াড ও ওডিসি থেকে জানা যায়, হেলেন ছিলেন গ্রিসের স্পার্টার রাজা মেনিলাসের স্ত্রী। স্পার্টার পাশেই ছিল ট্রয়। রাজা প্রিয়াম ছিলেন ট্রয়ের অধিপতি। তার দুই ছেলে হেক্টর ও প্যারিস ব্যবসা-বাণিজ্যের কাজে স্পার্টা সফরে আসেন। মেনিলাস তাদের সম্মানে নৈশভোজের আয়োজন করেন। সেই নৈশভোজেই রানী হেলেনের সাথে পরিচয় হয় প্যারিসের। হেলেনের সৌন্দর্য পুরোপুরি সম্মোহিত হন ট্রয়ের যুবরাজ প্যারিস। এরপর তারা দুজন গোপনে দেখা করতে থাকেন। এবং অল্প দিনের মধ্যে হেলেন ও প্যারিস গভীর প্রেমে আবদ্ধ হন।

শিল্পীর তুলিতে ট্রয় যুদ্ধের বিখ্যাত সেই ঘোড়া © Giovanni Domenico Tiepolo

স্পার্টা থেকে ফেরার পথে প্যারিস পোপনে রানী হেলেনকে সাথে করে ট্রয়ে নিয়ে আসেন। এই খবর স্পার্টায় ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে মেনিলাস প্রতিশোধ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তার ভাই আগামেনন ছিলেন মাইসিনি রাজ্যের রাজা এবং গ্রিক সেনাপতি। তার নেতৃত্বে বিশাল সৈন্যবহর নিয়ে ট্রয় আক্রমণ করে গ্রিকরা। গ্রিকদের প্রাথমিক আক্রমণে নিজের বন্দর হারালেও মূল শহরকে অক্ষত রাখেন ট্রয়ের যোদ্ধারা। দীর্ঘ দশ বছর যুদ্ধ করেও গ্রিকরা ট্রয়ের সেনাদের হারাতে ব্যর্থ হন। সবশেষে তারা প্রতারণার আশ্রয় নেন। ট্রয়ের মানুষদের বোকা বানিয়ে ‘ট্রোজান হর্স’ নামক বিশাল এক কাঠের ঘোড়ার মধ্যে লুকিয়ে হাজার হাজার সৈন্য মূল শহরে প্রবেশ করে। এবং রাতের অন্ধকারে তারা ট্রয় নগরী আগুন জ্বালিয়ে পুরোপুরি ধ্বংস করে দেয়।

ইতিহাস বিখ্যাত ট্রয়ের যুদ্ধ; Image Source: ancientgreecefacts.com

ইতিহাস বিখ্যাত এই ‘ট্রয়ের যুদ্ধ’ নিয়ে শত শত বই থেকে শুরু করে হলিউডের সিনেমা পর্যন্ত তৈরি হয়েছে। অথচ ঊনিশ শতকের শেষ দিকে এসে সাহিত্য ও ইতিহাস অনুরাগীরা জানতে পারেন ‘ট্রোজান ওয়ার’ কোনো কাল্পনিক গ্রিক মিথোলজি নয়। বরং এই যুদ্ধের ঘটনা পুরোপুরি সত্য। আর এই অসাধ্য সাধন করেন জার্মান প্রত্নতত্ত্ববিদ হেনরিক শ্লিম্যান। তিনি সর্বপ্রথম প্রাচীন ট্রয় নগরীকে খুঁজে বের করেন, যার বর্তমান অবস্থান তুরস্কের হিসারলিকে।

কে এই হেনরিক শ্লিম্যান?

হেনরিক শ্লিম্যান ১৮২২ সালে জার্মানিতে জন্মগ্রহণ করেন। দরিদ্র পরিবারের সন্তান হওয়ায় তিনি স্কুলের গণ্ডি পার হওয়ার আগেই পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যায়। পড়াশোনা ছাড়ার পর তিনি ব্যবসা শুরু করেন। কিন্তু নিজ দেশে ব্যবসায় সুবিধা করতে পারেননি শ্লিম্যান। জার্মানি ছেড়ে তিনি রাশিয়ার মস্কোতে পাড়ি জমান। সেখানে তিনি ‘ইমপেরিয়াল রাশিয়ান আর্মি’র কাছে গোলাবারুদের কাঁচামাল বিক্রি করে নিজের ভাগ্যের চাকা বদল করেন। এরপর তিনি আবারো পড়াশোনা শুরু করেন। পাশাপাশি তিনি বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ শুরু করেন। তাকে সবসময় প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের চেয়ে ইতিহাস বেশি আকর্ষণ করতো। সেই কারণে তিনি বিশ্বের বিভিন্ন ঐতিহাসিক স্থানসমূহে ঘুরতেন। বিভিন্ন দেশে ঘুরতে ঘুরতে তিনি ১৫টি বিদেশী ভাষা রপ্ত করেন। এবং নিজেকে একজন পেশাদার প্রত্নতত্ত্ববিদ হিসেবেও প্রতিষ্ঠিত করেন।

রংতুলিতে হেনরিক শ্লিম্যানের খননকালের একটি মুহূর্ত; Image Source: Getty Images

হেনরিক শ্লিম্যানের ব্যক্তিগত ডায়েরি ও তার লেখা বই থেকে জানা যায়, তার বয়স যখন মাত্র আট বছর তখন তার বাবা ট্রয়ের যুদ্ধের গল্প তার কাছে বর্ণনা করেন। সেই গল্প শোনার পর থেকেই তার মনে এক সুপ্ত বাসনা জাগে। সেই বয়স থেকে তিনি ঐতিহাসিক ট্রয় নগরীকে খুঁজে বের করার স্বপ্ন দেখতে থাকেন।

১৮৬৮ সালে শ্লিম্যান এক শিক্ষাসফরে গ্রিসের ইথাকা দ্বীপে যান। সেখানে তিনি ইউলিসিস প্রাসাদ( রোমান ভাষায় ওডিসিস) দেখার সুযোগ পান। সেখান থেকে তিনি সরাসরি মর্মর সাগর পাড়ি দিয়ে তুরস্কে আসেন। তার এই যাত্রার মূল উদ্দেশ্য ছিল প্রাচীন ট্রয় নগরীকে খুঁজে বের করা। আর এই সফরে তার একমাত্র সঙ্গী ছিল হোমারের ইলিয়াড। ট্রয় নগরী খুঁজে বের করার জন্য শ্লিম্যানের কাছে মূল পথনির্দেশক ছিল এই ইলিয়াদ।

যেভাবে আবিষ্কৃত হয় ট্রয় নগরী

হেনরিক শ্লিম্যান যখন হোমারের বর্ণিত ট্রয় নগরী খুঁজে বের করার জন্য চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন তখন তিনি মোট তিনটি স্থানকে চিহ্নিত করেন। এর মধ্যে সবচেয়ে এগিয়ে রাখা হয় বুনারবাসিকে (পিনারবাসিও বলা হয়)। এর সাথেই ছিল বালি-দাগ। আর সবচেয়ে পিছিয়ে ছিল হিসারলিক। তবে বেশ কয়েকজন পুরনো লেখক ও ইতিহাসবেত্তা হিসারলিককে হোমারের বর্ণিত ট্রয় নগরী হিসেবে উল্লেখ করেন। আর শেষ স্থানটি ছিল আলেকজান্দ্রিয়া ট্রোয়াস।

হেনরিক শ্লিম্যান; Image Source: IBL

১৮৬৮ সালের গ্রীষ্মে বুনারবাসিতে খনন শুরু করেন শ্লিম্যান। সেই সাথে তিনি হিসারলিকসহ তুরস্কের অন্যান্য জায়গাগুলোও পরিদর্শন করেন। গ্রীষ্মের শেষে হিসারলিকে শ্লিম্যানের সাথে ফ্রাঙ্ক ক্যালভার্ট নামে এক ব্রিটিশ প্রত্নতত্ত্ববিদের দেখা হয়। ক্যালভার্ট তখন তুরস্কের ব্রিটিশ দূতাবাসে চাকরি করতেন। পাশাপাশি তিনি প্রত্নতত্ত্ব খুঁজে বেড়াতেন। ক্যালভার্ট শ্লিম্যানেরও আগে হিসারলিককে খুঁজে বের করেন। এবং তার বিশ্বাস ছিল হিসারলিকই হলো ইতিহাস বিখ্যাত ট্রয়। কিন্তু তিনি সেটা ব্রিটিশ মিউজিয়ামকে বোঝাতে ব্যর্থ হন।

১৮৬৫ সালে ক্যালভার্টই প্রথম হিসারলিকে খননকাজ শুরু করেন এবং তার দাবির স্বপক্ষে যথেষ্ট প্রমাণও পান। কিন্তু খননকাজ চালিয়ে নেওয়ার জন্য প্রচুর অর্থের প্রয়োজন ছিল। ক্যালভার্ট সেই অর্থের ব্যবস্থা করতে ব্যর্থ হন। ১৮৬৮ সালের আগস্টে তিনি শ্লিম্যানকে নৈশভোজের আমন্ত্রণ জানান। ক্যালভার্ট তখন তার উদ্ধার করা প্রত্নতত্ত্বসমূহ শ্লিম্যানকে দেখান। এবং অর্থের অভাবে তার বন্ধ হয়ে যাওয়া কাজগুলো শ্লিম্যানকে করার অনুমতি দেন।

বিখ্যাত ট্রয় নগরীর ধ্বংসাবশেষ; Image Source: ZB

একই বছর শ্লিম্যান প্যারিস যান। সেখানে তিনি ট্রয় ও মাইসিনি নিয়ে প্রচুর গবেষণা করেন। প্যারিসে থাকাকালে ক্যালভার্টের কাছে অসংখ্য চিঠি লেখেন। এবং খনন করার জন্য হিসারলিকের কোন স্থানটি সবচেয়ে আদর্শ হবে সেসব সম্পর্কে জেনে নেন। শ্লিম্যান তার প্যারিস ভ্রমণ এবং সেখানকার যাবতীয় কাজকর্ম নিয়ে একটি বইও লেখেন। কিন্তু তিনি সেখানে একবারও ক্যালভার্টের কথা উল্লেখ করেননি। ১৮৭০ সালে ফ্রাঙ্ক ক্যালভার্টের অনুমোদন এবং তার লোকজন নিয়ে খনন কাজ শুরু করেন শ্লিম্যান।

১৮৭১ সালে শ্লিম্যান ও তার লোকজন মানুষের তৈরি করা এক প্রাচীন দুর্গের দেয়াল আবিষ্কার করেন। কিন্তু তার ধারণা ছিল হোমারের বর্ণিত ট্রয় আরো নিচে থাকবে। তখন তিনি নিচের দিকে খনন শুরু করেন। ১৮৭৩ সালে তিনি একটি দুর্গ খুঁজে পান। সেই সাথে পান বিপুল পরিমাণ গুপ্তধন। এসব গুপ্তধন তিনি গোপনে তুরস্ক থেকে জার্মানিতে পাচার করেন। তার বিশ্বাস ছিল তিনি ট্রয় নগরী আবিষ্কার করেছেন। কিন্তু পরবর্তীতে গবেষণা করে দেখা যায় সেখানে মোট নয়টি ট্রয় নগরীর ধ্বংসাবশেষ রয়েছে। এর মধ্যে ষষ্ঠ ট্রয়ই ইতিহাস বিখ্যাত হোমারিক ট্রয়, যার নির্মাণকাল খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০-১০০০ অব্দে। প্রতিবার আগের ট্রয় নগরী ধ্বংসের পর নতুন করে তৈরি করা হয়েছিল।

শ্লিম্যানের আবিষ্কৃত একটি প্রাচীন গ্রিক মুখোশ; Image Source: alliance 

১৮৭৪ সালে শ্লিম্যান তার আবিষ্কার নিয়ে একটি বই প্রকাশ করেন। তিনি তার বইতে তার আবিষ্কারের স্বপক্ষে বিভিন্ন যুক্তি উপস্থাপন করেন। কিন্তু এরপরও অধিকাংশ প্রত্নতত্ত্ববিদ শ্লিম্যানের আবিষ্কারকে পুরোপুরি বিশ্বাস করেননি। তবে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইলিয়াম গ্লাডস্টোন হেনরিখ শ্লিম্যানের আবিষ্কারকে গ্রহণ করেন। গ্লাডস্টোন নিজেও প্রত্নতত্ত্বেও বেশ সিদ্ধহস্ত ছিলেন। ১৮৭৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে শ্লিম্যান আবারো হিসারলিকে খননকাজ চালানোর প্রস্তাব করেন। কিন্তু অটোমান সরকার তাকে অনুমতি প্রদানে অনীহা প্রকাশ করেন। অবশেষে তিনি ১৮৭৬ সালে আবারো খননের অনুমতি পান।

শ্লিম্যান ট্রয় নগরীর সন্ধানে মোট চারবার হিসারলিকে খনন করেন। তার সর্বশেষ খননকাজে উইলহেম ডরফেল্ড সহায়তা করেন। ডরফেল্ড এর আগেও প্রাচীন নির্দশন খুঁজে বের করেছেন। তার অভিজ্ঞতার সহায়তা নিয়ে হিসারলিককে প্রাচীন ট্রয় নগরী হিসেবে প্রমাণ করতে সক্ষম হন। তবে ট্রয় ছাড়াও তিনি মাইসিন রাজ্যও আবিষ্কার করেন। তবে ট্রয় তাকে জগদ্বিখ্যাত করেছে।

ট্রয়ের আবিষ্কারক নিয়ে দ্বন্দ্ব

প্রাচীন ট্রয় নগরীর আবিষ্কার হিসেবে হেনরিক শ্লিম্যান সারাবিশ্বে যশখ্যাতি পেয়েছেন। কিন্তু তার এই আবিষ্কারের সিংহভাগ দাবিদার ফ্রাঙ্ক ক্যালভার্ট। শ্লিম্যানের পাঁচ বছর আগে হিসারলিকে খনন কাজ শুরু করেছিলেন ক্যালভার্ট। এবং তিনিই প্রথম নিশ্চিত হয়েছিলেন যে, প্রাচীন ট্রয় নগরীর ধ্বংসাবশেষ হলো হিসারলিক। ক্যালভার্ট প্রাচীন ইতিহাসকে খুঁজে বের করার জন্য শ্লিম্যানকে সহায়তা করলেও, জার্মান প্রত্নতত্ত্ববিদ তার প্রাপ্য সম্মান নিশ্চিত করেননি। তিনি তার সকল লেখাতেই ট্রয় আবিষ্কারকে তার একক কৃতিত্ব হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। যা অনেক প্রত্নতত্ত্ববিদই গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানান।

হেনরিক শ্লিম্যান; Image Source: Getty Images

গুপ্তধনের লোভে শ্লিম্যান ট্রয় আবিষ্কারের জন্য বিপুল অর্থ ব্যয় করেন বলে ধারণা করা হয়। খননেন পর প্রাপ্ত অনেক ধনসম্পদ তিনি পাচারও করেন। তবে ফ্রাঙ্ক ক্যালভার্ট সত্যিকার অর্থেই ইতিহাসকে ভালোবাসতেন। কিন্তু তিনি সরল মনে হিসারলিককে শ্লিম্যানের হাতে তুলে দিয়ে ভুল করেন। জীবনের শেষভাগে এসে শ্লিম্যান বিভিন্ন রোগে ভোগেন। কানের সমস্যা নিয়ে ইউরোপের বিভিন্ন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে যান। কিন্তু তিনি তার রোগ থেকে মুক্তি পাননি। শেষ বয়সে তিনি শরীরে প্রচণ্ড ব্যথা নিয়ে একাকী ভুগতে থাকেন। এবং অবশেষে ১৮৯০ সালের ২৫ ডিসেম্বর মৃত্যুবরণ করেন।

This Bangla article is about 'How Archaeologist Found The Troy?'

Necessary references have been hyperlinked.

Featured Image Source: Rex/Shutterstock

Related Articles