পৃথিবীজুড়ে লাখো মানুষের বেদনা আর মৃত্যুর করুণ এক ইতিহাস তৈরি করে শেষ হয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। বলা হয়, পৃথিবীতে এখন পর্যন্ত যত ভয়াবহ এবং নৃশংস ঘটনা ঘটেছে, তার কোনোটিই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতা ছাড়িয়ে যেতে পারেনি। পৃথিবীর নানা প্রান্তে আজও রয়ে গেছে মানব সভ্যতাকে ধ্বংসের মুখে ফেলে দেওয়া এই যুদ্ধের চিহ্ন। ৭৫ বছর পরও অনেক অঞ্চল এখনো যেন কাটিয়ে উঠতে পারেনি যুদ্ধের ভয়াবহতা।
যুদ্ধ-বিগ্রহ যতই বেদনার স্মৃতি বয়ে আনুক না কেন, তার সমাপ্তি, জয়ী পক্ষের জন্য বয়ে আনে চরম খুশির বার্তা এবং পরাজিত পক্ষের জন্য বয়ে আনে চরম দুঃসময় ও অনিশ্চিত এক ভবিষ্যত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তিতেও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। অক্ষশক্তির পরাজয় তাদের ঠেলে দিয়েছিল এক করুণ পরিণতির দিকে। অপরদিকে মিত্রশক্তি যুদ্ধে জয়লাভের মাধ্যমে, বদলে দিতে শুরু করে পুরো বিশ্বের গতিরেখা।
অধিকাংশ যুদ্ধেই পরাজিত পক্ষের আত্মসমর্পণ বা নিঃশেষিত হয়ে যাবার দিনটিকে 'বিজয় দিবস' ঘোষণা করে বিজয়ী পক্ষ। ঐ একটি দিনকে তারা প্রতি বছর উদযাপন করে থাকে। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম ছিল। মিত্রশক্তির বিজয় এসেছে দুটি ধাপে। তাই দুটি আলাদা দিনকে তারা বিজয় দিবস হিসেবে উদযাপন করে। একটি হলো V-E Day বা ‘ভিক্টোরি ইন ইউরোপ দিবস’ এবং অপরটি হলো V-J Day বা ‘ভিক্টোরি ওভার জাপান দিবস’।
ভিক্টোরি ইন ইউরোপ দিবসটি পালিত হয় মে মাসের ৮ তারিখ। ১৯৪৫ সালের এই দিনে আনুষ্ঠানিকভাবে জার্মানির আত্মসমর্পণের কথা ঘোষণা করা হয়। জার্মানির পতনের মধ্য দিয়েই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইউরোপ পর্ব সমাপ্ত হয়। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ আনুষ্ঠানিকভাবে তখনো শেষ হয়নি।
অক্ষশক্তির অন্য দেশগুলো আরো আগেই আত্মসমর্পণ করে ফেললেও, জাপান তখনো যুদ্ধের ময়দানে তাদের কর্তৃত্ব বজায় রেখে চলছিল। অবশেষে জাপানের হিরোশিমা এবং নাগাসাকিতে দুটি শক্তিশালী পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণের মধ্য দিয়ে শেষ হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের জাপান পর্ব। অবশেষে একই বছরের ১৫ আগস্ট জাপানের আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে সমাপ্ত হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ।
যুদ্ধ শেষ হয়ে গেলেও, সামনে যে এক অজানা ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে বিশ্ববাসীর জন্য, তা সবাই জানতো। বিশ্বনেতারাও বারবার বৈঠকে বসছিলেন ভবিষ্যৎ বিশ্বের রূপরেখা কেমন হবে তা নিয়ে। কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে একটি দিন বিশেষভাবে জায়গা করে নিয়েছিল গোটা ইউরোপবাসীর মনে। সেটি হলো, ১৯৪৫ সালের ৮ মে, যেদিন আত্মসমর্পণ করেছিল জার্মানি।
এই দিন, অর্থাৎ ভিক্টোরি ইন ইউরোপ দিবসের উন্মাদনা অনেকক্ষেত্রে ছাড়িয়ে যায় ভিক্টোরি ওভার জাপান-এর দিনটিকেও। জেনে নেওয়া যাক, পৃথিবীজুড়ে কেমন ছিল দিনটি এবং মনে রাখার মতো কী এমন ঘটেছিল সেই দিনে।
পরাজয় নিশ্চিত বুঝতে পেরে ৩০ এপ্রিল আত্মহত্যা করেন জার্মানির রাষ্ট্রনেতা অ্যাডলফ হিটলার। পরবর্তীকালে তার স্থলাভিষিক্ত হন কার্ল ডোনিজ। জার্মানির ভবিষ্যৎ এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছে জার্মান সেনাদের আটক হওয়া নিয়ে, মিত্র শক্তির প্রধান দেশগুলোর শীর্ষ নেতাদের সাথে বৈঠকে বসেন এই নয়া জার্মান রাষ্ট্রপ্রধান।
এই বৈঠকে জার্মানির আত্মসমর্পণের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় এবং ঠিক করা হয়, যুদ্ধ পরবর্তী জার্মানিকে ৪টি খণ্ডে ভাগ করে ব্রিটেন, ফ্রান্স, যুক্তরাষ্ট্র এবং তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছে সেসবের কর্তৃত্ব হস্তান্তর করা হবে। এই সিদ্ধান্তের ফলে জার্মানির একেক অঞ্চলে একেক রকমের অর্থনৈতিক এবং সামাজিক পরিস্থিতি লক্ষ করা যায়। সে ইতিহাস অবশ্য অন্য আলোচনা।
আত্মসমর্পণের শর্ত মোতাবেক, ৪ মে হামবুর্গে ব্রিটিশ ফিল্ড মার্শাল বার্নার্ড মোন্টগোমেরির প্রধান কার্যালয়ে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের দলিল জমা দেয় একদল জার্মান প্রতিনিধি। সেখানেই মোন্টগোমেরি এই দলিল গ্রহণ করে তাতে স্বাক্ষর করেন। ৭ মে ফ্রান্সের কাছে আত্মসমর্পণের দলিল দাখিল করেন জার্মান জেনারেল আলফ্রেড জোল। তাদের আত্মসমর্পণপত্র গ্রহণ করেন জেনারেল আইসেনহাওয়ার।
সোভিয়েত ইউনিয়নের রাষ্ট্রনেতা জোসেফ স্ট্যালিন চেয়েছিলেন নিজ থেকেই তাদের আত্মসমর্পণ-দলিল গ্রহণ করতে। তাই ৮ মে বার্লিনে বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। সেখানে আত্মসমর্পণের চুক্তিপত্রে সোভিয়েত ইউনিয়নের পক্ষে স্বাক্ষর করেন জোসেফ স্ট্যালিন এবং জার্মানির পক্ষে সই করেন ফিল্ড মার্শাল উইলিয়াম কেইটেল।
এই আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে নতুন জার্মান রাষ্ট্রনেতা কার্ল ডোনিজ একভাবে জিতে গিয়েছিলেন। তার লক্ষ্য ছিল, জার্মান সেনারা যাতে অন্য রাষ্ট্রের কাছে আটক না থাকে, তা নিশ্চিত করা। আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে সেটি করতে সক্ষম হয়েছিলেন তিনি।
পুরো বিশ্ববাসী জানতো, জার্মানি শীঘ্রই আত্মসমর্পণ করতে যাচ্ছে। কেননা যুদ্ধের সকল রসদ তাদের ফুরিয়ে গিয়েছিল ততদিনে, আত্মসমর্পণের ঘোষণা এখন কেবল সময়ের ব্যাপার। ৭ মে বিবিসি রেডিও-যোগে সংবাদ প্রচার করা হয়, ইউরোপে যুদ্ধ শেষ হয়ে গিয়েছে, জার্মানি আত্মসমর্পণের দলিলে সই করছে। ফলে ৮ মে ‘ভিক্টোরি ইন ইউরোপ’ উদযাপনে সকল দেশে ছুটি পালিত হবে। দৈনিক পত্রিকাগুলো অল্প সময়ে যত দ্রুত সম্ভব, বিশেষ সংখ্যা ছাপানোর কাজ শুরু করে দেয়। দীর্ঘ ছয় বছর ধরে চলতে থাকা যুদ্ধ শেষ হচ্ছে বলে কথা।
৭ তারিখ ঘোষণার সাথে সাথেই দলে দলে ব্রিটেনের লোকজন রাস্তায় বেরিয়ে আসে। যে যার মতো করতে থাকে আনন্দ-উল্লাস। দীর্ঘ ছয় বছর ধরে যুদ্ধে মধ্যে থেকে, খাবার এবং পোশাকের অনিশ্চয়তার মধ্যে থেকে, দিন-রাত কেবল গুলি এবং বোমার শব্দের মাঝে থেকে মানুষজন দিশেহারা হয়ে গিয়েছিল। হঠাৎ এমন আনন্দের সংবাদ তাদের এনে দিয়েছিল বাঁধভাঙ্গা উল্লাসের উপলক্ষ।
৮ মে বেলা ৩টায় ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী চার্চিল রেডিও-যোগে সবার কাছে একটি বার্তা পাঠান। তিনি সবাইকে ভিক্টোরি ইন ইউরোপ দিবসের শুভেচ্ছা জানান এবং একই সাথে মনে করিয়ে দেন, সামনে কী কঠিন সময় তাদের জন্য অপেক্ষা করছে। বিশ্ববাসীর ওদিকে অত ভ্রুক্ষেপ নেই, তারা মেতেছিল যুদ্ধাবসানের খুশিতে। তাই অনেক দেশের রাষ্ট্রপ্রধানদের বরং নিশ্চিত করতে হচ্ছিল, তাদের গুদামে যথেষ্ট মদ মজুদ আছে কিনা।
ব্রিটিশ রাজ-পরিবারকে সেদিন মোট ৮ বার বারান্দায় বেরিয়ে এসে জনগণের ডাকে সাড়া দিতে হয়েছিল। দুই রাজকন্যা এলিজাবেথ এবং মার্গারেটকে সেদিন অনুমতি দেওয়া হয়েছিল সর্বসাধারণের বাঁধভাঙ্গা উল্লাসের সাথে শামিল হওয়ার জন্য। রানি হওয়ার পর এলিজাবেথ সেদিনের কথা স্মরণ করে বলেন,
আমরা দুজন রাজ প্রাসাদের বাইরে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম এবং চিৎকার করছিলাম, "রাজাকে আমরা চাই"... আমি কখনো এই রাতের কথা ভুলবো না।
রাতভর সেদিন গোটা ইউরোপ জুড়ে চলেছিল জমকালো উদযাপন। পানাহারের নানা আয়োজনের পাশাপাশি অনেক রেস্তোরাঁ আবার আলাদা করে 'বিজয় দিবস'-এর মেন্যু নিয়ে এসেছিল!
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আবার উল্লাসের পাশাপাশি ছিল শোকের ছায়া। যুদ্ধের প্রায় শেষ পর্যন্ত আমেরিকাকে নেতৃত্ব দিয়ে আসা থিওডোর রুজভেল্টের মৃত্যুতে চলছিল মাসব্যাপী শোক। রুজভেল্টকে স্মরণ করে বিজয়ের এই দিনটি তাকেই উৎসর্গ করেন নতুন রাষ্ট্রপতি হ্যারি এস ট্রুম্যান। সেদিন অর্ধনমিত রাখা হয় যুক্তরাষ্ট্রের পতাকা।
কিন্তু এই শোকের মাঝেও আটকে রাখা যায়নি জনতার স্বতঃস্ফূর্ত উল্লাস। জনতার স্রোত সামাল দেওয়ার জন্য সেদিন নিউ ইয়র্কে ১৫ হাজার পুলিশ কর্মী নিয়োগ দেওয়া হয়।
তবে যুদ্ধের ইউরোপ-পর্ব সমাপ্তিতে অস্ট্রেলিয়া এবং এশিয়া অঞ্চলে তেমন কোনো আনন্দ দেখা যাচ্ছিল না। কারণ যুদ্ধের জাপান পর্ব তখনো ফুরোয়নি। এই অঞ্চলগুলোর অনেক নাগরিক তখনো যুদ্ধের ময়দানে রাত পার করছিল। তাছাড়া যুদ্ধে যারা প্রাণ হারিয়েছেন, তাদের শোকে সবাই ছিলেন ব্যথিত। বিশেষ করে যেসব পরিবারের সদস্যরা যুদ্ধে শহীদ হয়েছেন, তাদের তো আনন্দ বলতে কিছুই ছিল না। অনেকেই সব সহায়-সম্বল হারিয়ে ছিলেন একেবারেই নিঃস্ব। তাই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইউরোপ বিজয়ের দিনটি ছিল মিশ্র প্রতিক্রিয়ায় পূর্ণ।
This is a Bengali article about V-E Day.
All the references are hyperlinked in this article.
Feature image: Flashbak