Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website. The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

অমরকোটে মুঘল সম্রাট হুমায়ুন: সম্রাটের সিন্ধু অভিযান

১৫৪২ সালের ২২ আগস্ট রাজস্থানের মরুভূমির ভেতর দিয়ে অনেকটা ধুকতে ধুকতে সম্রাট হুমায়ুন তার পরিবার আর সহযোদ্ধাদের নিয়ে অমরকোট যেয়ে পৌঁছান। যোধপুর থেকে অমরকোটের দূরত্ব প্রায় ২০০০ কিলোমিটারেরও বেশি। যাত্রাপথের দৈর্ঘ্য আর দুর্গমতার জন্য সম্রাট ও তার বহরকে এই যাত্রায় অবর্ণনীয় কষ্ট আর ত্যাগ স্বীকার করতে হয়।

অমরকোট পৌঁছালে অমরকোটের রাণা পারসাদের পক্ষ থেকে সম্রাটকে রাজকীয় অভ্যর্থনা জানানো হয়। সেই সাথে সম্রাটের পরিবারকে দুর্গের ভেতরে আশ্রয় দেয়া হয়। লোকসংখ্যা দুর্গের ধারণ ক্ষমতার চেয়ে বেশি হওয়ার সম্রাটের সৈন্যদের দুর্গের বাইরে অস্থায়ী আবাসস্থল তৈরি করে দেয়া হয়।

উমকরকোট দুর্গের একাংশ; Image Source: emergingpakistan.gov.pk

রাণা পারসাদকে তার আতিথেয়তার কৃতজ্ঞতাস্বরূপ সম্রাট হুমায়ুন তাকে ও তার এক পুত্রকে মুক্তা ও কারুকার্য খচিত তরবারি রাখার কোমরবন্ধনী উপহার দেন। সাথে আরও দেয়া হয় রত্নখচিত খঞ্জর আর রাজকীয় খেলাত।

সম্রাট হুমায়ুন যোধপুরে শের শাহের তড়িৎ প্রতিক্রিয়ার কারণে মালদেবের নিকট থেকে কোনো সহায়তাই নিতে পারেননি। নিরুপায় হয়ে প্রায় খালি হাতেই সম্রাটকে অমরকোটে আশ্রয় নিতে হয়েছিলো। সেসময় সম্রাটের নিকট উল্লেখযোগ্য কোনো সম্পদও ছিলো না। ফলে নামমাত্র যা-ই একটা সেনাবাহিনী ছিলো, সেই বাহিনীর যোদ্ধারাও বেশ কয়েক মাস ধরে বেতন পাচ্ছিলেন না। সম্রাট নিজেকে বেশ জটিল এক পরিস্থিতির মাঝে আবিষ্কার করলেন। অবশ্য আমিরদের নিকট থেকে অর্থ ধার নিয়ে সম্রাট এই সমস্যার সাময়িক সমাধান করেছিলেন।

কাজেই অমরকোটে এসে সম্রাট একটা দিনও নষ্ট করতে চাইলেন না। দ্রুতই তিনি রাণা পারসাদের সাথে খোলাখুলি আলোচনার টেবিলে বসলেন। রাণাও আন্তরিকভাবে সম্রাটের প্রতি সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিলেন। কারণ রাণা পারসাদের চোখে তখন ছিলো শুধুই পিতৃহত্যার প্রতিশোধ নেয়ার আগুন।

সম্রাট হুমায়ুন প্রথমেই সিন্ধু অধিকার করতে চাচ্ছিলেন। অভিযানের জন্য রাণা পারসাদ সম্রাটকে নিজস্ব দুই হাজার সৈন্য দিয়ে সহায়তা করলেন। এই বাহিনীর সাথে স্থানীয় সাদমা ও সামিচা নামক উপজাতীয় গোত্র থেকে আরো কিছু সংখ্যক যোদ্ধা ধার নিয়ে পারসাদ সম্রাটকে দিলেন।

অমরকোটে যাওয়ার কিছুদিনের মাঝেই সব গুছিয়ে সম্রাট সিন্ধুর থাট্টার জূনের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়ে গেলেন।

সম্মিলিত সেনাবাহিনী নিয়ে সম্রাট যখন অমরকোট থেকে প্রায় ৫০ কিলোমিটার দূরে অবস্থান করছিলেন, তখন তিনি এমন একটি সংবাদ পেলেন যা তার এই দীর্ঘ কষ্টকর অভিজ্ঞতাকে সাময়িক সময়ের জন্য হলেও ভুলিয়ে দিয়েছিলো। অমরকোটের দুর্গে সম্রাটের তরুণী পত্নী হামিদা বানু সম্রাটকে একটি পুত্র সন্তান উপহার দিয়েছেন।

সম্রাট হুমায়ুন ব্যাপক আনন্দিত হলেন। প্রথমেই তিনি আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞতা জানালেন। মুঘল রীতি অনুযায়ী পুত্রের জন্মসংবাদ শোনা মাত্র সম্রাট তার অধস্তন সকলকে উপহার দিতেন। কিন্তু এই মরুভূমির মাঝে উপহার দেয়ার মতো কোনো সম্পদ সম্রাটের নিকট ছিলো না। সম্রাট তখন জওহরকে একটি কস্তুরী (মৃগনাভী) নিয়ে আসতে বললেন। জওহর কস্তুরী এনে দিলে সম্রাট তার আমিরদের মাঝে এটি ভাগ করে দিতে দিতে দোয়া করলেন, ‘আল্লাহ, আমার এই পুত্রের নাম ও যশ যেনো এই কস্তুরীর সুগন্ধির ন্যায় চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে।’

১৫৪২ সালের ১৫ অক্টোবর উমরকোট দুর্গের এ স্থানটিতেই জন্মগ্রহণ করেন হিন্দুস্তানের অন্যতম শক্তিশালী সম্রাট জালালউদ্দিন মুহাম্মদ আকবর; Image Source: emergingpakistan.gov.pk

সম্ভবত সম্রাট হুমায়ুনের এই দোয়া কবুল হয়েছিলো (আল্লাহই ভালো জানেন)। সম্রাট হুমায়ুন তার এই পুত্রের নাম রেখেছিলেন জালালউদ্দিন মুহাম্মদ আকবর। একদিন সত্যিই আকবর তার নাম আর যশ চিরদিনের জন্য পৃথিবীর পাতায় স্থায়ী করে লিখে রাখবেন।

পুত্র জন্মের সংবাদে সম্রাট চরম খুশি হলেন সত্য, তবে তার কারণে নিজের দায়িত্ব ভুলে যাননি। যাত্রা শুরুর মাত্র ৫ দিনের মাথায় তিনি জূন নগরীর আশেপাশে পৌঁছে যান। এ সময় তার সাথে প্রায় ১০ হাজার সৈন্যের এক বিশাল সেনাবাহিনী ছিলো।

সম্রাটকে বাঁধা দিতে শাহ হুসেন আরগুনের গভর্নর জানী বেগকে একটি শক্তিশালী সেনাবাহিনী নিয়ে এগিয়ে আসলেন। তবে তিনি খুব দ্রুতই শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়ে কোনোমতে জীবন নিয়ে পালালেন। জূন সম্রাট হুমায়ুনের দখলে চলে এলো। সম্রাট তার আমিরদের মাঝে জূন ও এর আশেপাশের এলাকা ভাগ করে দিলেন।

এর কিছুদিন পরেই তিনি অমরকোট থেকে তার স্ত্রী-পুত্র, হেরেমের সদস্য আর অন্যদের জূনে ডেকে আনলেন।

১৫৪১ সালের সময়গুলোতে সম্রাট হুমায়ুনের যখন ইয়াদগার নাসির মির্জাকে সবচেয়ে বেশি দরকার ছিলো, সেই সময়ই ইয়াদগার নাসির মির্জা সিন্ধুর শাসক শাহ হুসেনের দেখানো লোভের ফাঁদে পড়ে সম্রাটের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেন। ফলশ্রুতিতে সম্রাটকে বাধ্য হয়ে যোধপুরের দিকে যেতে হয়েছিলো।

এদিকে সম্রাট সিন্ধু ত্যাগের মাস দুয়েকের মাঝেই ইয়াদগার নাসির মির্জা সিন্ধুর শাহ হুসেনের প্রতারণার ব্যাপারটি বুঝে যান। তাকেও বাধ্য হয়ে তখন সিন্ধু ছাড়তে হয়। সম্রাটের কাছে তিনি ফিরতে চাচ্ছিলেন। কিন্তু নিজের অতীত কৃতকর্মের কারণে লজ্জায় ফিরতেও পারছিলেন না। তিনি বাধ্য হন কান্দাহারের দিকে যাত্রা করতে।

ইয়াদগার নাসির মির্জা সিন্ধুর শাসক হওয়ার পরিবর্তে চরম অপমানিত হয়ে সিন্ধু ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। সম্রাট হুমায়ুনের ব্যক্তিগত পানিবাহক জওহর আবতাবচি ইয়াদগার নাসির মির্জার অপমানের কিছু ঘটনা লিখে গেছেন। তিনি বলেন,

‘(সম্রাট হুমায়ুন সিন্ধু ত্যাগের পর) শাহ হুসেন আদেশ দিলেন, ইয়াদগার নাসির মির্জার সাথে থাকা প্রত্যেক লোকের জন্য একটি করে রৌপ্য মুদ্রা, প্রত্যেক উটের জন্য সাতটি করে রৌপ্য মুদ্রা এবং প্রতিটি ঘোড়ার জন্য পাঁচটি করে রৌপ্য মুদ্রা কর হিসেবে আদায় করতে হবে।’

ইয়াদগার নাসির মির্জার জন্য এ ছিলো চরম অপমানজনক এক ঘটনা। জওহর আবতাবচি এ ঘটনাকে ইয়াদগার নাসির মির্জার শ্রেষ্ঠ অভিভাবকের সাথে প্রতারণা করার পুরষ্কার হিসেবে বর্ণনা করে তার সাথে এক প্রকারের ব্যঙ্গই করেছেন।

যে সময়ের কথা বলছি সেসময় সম্রাটের সৎ ছোট ভাই কামরান মির্জা হিন্দালের আয়ত্বাধীন কান্দাহার অবরোধ করে রেখেছিলেন। কামরানের অবরোধের মুখে হিন্দাল মির্জা বেশিদিন দুর্গ ধরে রাখতে পারেননি। তিনি আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হলেন। কামরান হিন্দাল মির্জাকে বন্দী করে কাবুলে নিয়ে গেলেন। কামরান মির্জার সাথে আরেকজনও কাবুলে গেলেন। তিনি ছিলেন সম্রাট হুমায়ুনের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করা ইয়াদগার নাসির মির্জা।

যা-ই হোক, ইয়াদগার নাসির মির্জা সিন্ধু ত্যাগ করার পরেই শাহ হুসেন আরগুন দ্রুত সিন্ধুর ক্ষতিগ্রস্থ দুর্গগুলো মেরামত করে নিলেন। তিনি হয়তো অনুমান করেছিলেন সম্রাট হুমায়ুন আবারও সিন্ধুর দিকে আসতে পারেন। তার ধারণাই ঠিক হলো। কিছুদিনের মাঝেই তিনি সম্রাট হুমায়ুনের সিন্ধুতে পুনরাগমনের সংবাদ পেলেন। এর কিছুদিন পরেই জানী বেগের শোচনীয় পরাজয়ের সংবাদও তাকে হজম করতে হলো। সম্রাটকে মোকাবেলা করার জন্য তিনি দ্রুত থাট্টা হয়ে জূন থেকে ১২ মাইল দূরে সেনা ছাউনি ফেললেন।

সম্রাট হুমায়ুনের নির্বাসনকালীন জীবনের বিভিন্ন ঘটনার সাথে সম্পর্কযুক্ত স্থান। এই লেখায় সম্রাট হুমায়ুনের ‘৬’ নাম্বার চিহ্নিত স্থানে অবস্থানের ঘটনাগুলো আলোচনা করা হয়েছে; Image Source: farbound.net

এদিকে হুমায়ুনের নিকট তখন মাত্র ১০ হাজার সৈন্যের মাঝারি আকারের একটি সেনাবাহিনী। এই সেনাবাহিনী নিয়ে সিন্ধুর মাটিতে সিন্ধুর সাথেই যুদ্ধ একটু বেশিই বিপজ্জনক হয়ে যায়। তাই তিনি দ্রুত জূনের নিকটবর্তী শাসক ও জমিদারদের নিকট সাহায্য চাইলেন। সম্রাটকে হিন্দুস্তানের বৈধ উত্তরাধিকারী বিবেচনা করে অনেক শাসক আর জমিদারই সৈন্য নিয়ে এগিয়ে এলেন। এদের মাঝে সমিঞ্চা কচ্ছের রানা আর ভাক্কাড়ের সাবেক এক নেতা জাম সাহেব উল্লেখযোগ্য ছিলেন। তাদের নিয়ে আসা বাহিনীতে সেনাসংখ্যা ছিলো প্রায় ১৫-১৬ হাজার। সম্রাট হুমায়ুন সিন্ধু বিজয়ের স্বপ্নে বিভোর হয়ে রইলেন।

শাহ হুসেন কিন্তু এদিকে শুধু সামরিক প্রস্তুতি নিয়েই ক্ষান্ত হলেন না। তিনি বুঝতে পারলেন সম্রাটের এ বারের অভিযানের অন্যতম শক্তিস্তম্ভ হলো অমরকোটের রাণা পারসাদ। ধূর্ত শাহ হুসেন তাই সম্রাটের সাথে রাণা পারসাদের জোট ভাঙার চেষ্টা চালাতে লাগলেন। প্রাথমিক চেষ্টা হিসেবে তিনি রাণা পারসাদকে সিন্ধুর রাজকীয় খেলাতসহ বিপুল পরিমাণ উপঢৌকন পাঠিয়ে দিলেন। তবে তাতে রাণার মন গললো না। তিনি সম্রাট হুমায়ুনের প্রতি আন্তরিক রইলেন এবং কোনোভাবেই সম্রাটের সাথে প্রতারণা করবেন না বলে শাহ হুসেনকে জানিয়ে দিলেন।

শাহ হুসেন অনেক চেষ্টা করেও যা অর্জন করতে পারলেন না, ভাগ্যের জোরে এমনিতেই তা হয়ে গেলো। কিছুদিন পরেই কোনো একটি ঘটনা নিয়ে রাণা পারসাদের সাথে তরদী বেগ ও খাজা গাজীর তর্ক বিতর্ক হলে রাণা বেজায় চটে গেলেন। একপর্যায়ে তিনি মুঘল শিবির ত্যাগ করে অমরকোটের রাস্তা ধরলেন। যাওয়ার সময় তিনি বলে গেলেন,

‘মুঘলদের সাহায্য করা সময় আর শক্তির অপচয় ছাড়া আর কিছুই না।’

রাণা পারসাদ চলে গেলেন। সাথে গেলো তার আহবানে সাড়া দিয়ে সম্রাট হুমায়ুনের সাথে যোগ দেয়া উপজাতীয় যোদ্ধারা। সম্রাট হুমায়ুন অল্প কিছু সৈন্য নিয়ে একা সিন্ধুতে পড়ে রইলেন।

রাণা পারসাদ সম্রাটকে ত্যাগ করায় সম্রাট মুষড়ে পড়লেন সত্য, তবে সাহস হারালেন না। সিন্ধুতে নিজের অবস্থান শক্ত করতে দ্রুত আরও কিছু অঞ্চল দখলের পরিকল্পনা করলেন তিনি। এতে সম্রাটের শক্তি বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিলো।

রাণা পারসাদ চলে যাওয়ার পর তাই সম্রাট শেখ আলী বেগ আর মুজাফফর বেগ তুর্কমানকে পাঠালেন হাজকান দখলের জন্য। সম্রাটের বাহিনী অগ্রসর হলে শাহ হুসেন আরগুন তাদের বাঁধা দিতে আরেকটি বাহিনী পাঠালে দুই বাহিনী মুখোমুখি সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। সম্রাট হুমায়ুনের মুঘল সেনাবাহিনী এ যুদ্ধে শোচনীয় পরাজয় বরণ করতে বাধ্য হয়। শেখ আলী বেগ যুদ্ধক্ষেত্রেই মারা যান, আর মুজাফফর বেগ তুর্কমান পালিয়ে কোনোমতে নিজেকে রক্ষা করেন। পেছনে ফেলে আসেন অগণিত মুঘল যোদ্ধার মৃতদেহ। ঘটনাটি তখনই ঘটলো, যখন সম্রাটের সৈন্যের প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি ছিলো।

এদিকে সম্রাটের শোচনীয় অবস্থায় সম্রাটেরই এক আমির মুনিম খান তরদী মুহাম্মদ বেগের সাথে অভ্যন্তরীণ এক দ্বন্দ্বের প্রেক্ষিতে সম্রাটকে ত্যাগ করে যোগ দিলেন শাহ হুসেন আরগুনের দলে। তিনি গিয়েই শাহ হুসেনকে বললেন, সম্রাটের শিবির ন্যূনতম কোনো নিরাপত্তা ছাড়াই খোলা মাঠে পড়ে আছে। শাহ হুসেন চাইলেই যেকোনো সময় সম্রাটের নামমাত্র সেনাবাহিনীটিকে মাটিতে পিষে ফেলতে পারেন। এ কথা শুনে ধূর্ত শাহ হুসেনের চোখে আনন্দের ঢেউ খেলে গেলো।

মুনিম খানের পালিয়ে যাওয়ার কথা হুমায়ুনের অজানা ছিলো না। মুনিম খান মুঘল শিবিরের দুর্বলতা শাহ হুসেনকে জানিয়ে দিতে পারেন, এমন আশঙ্কা থেকে সম্রাট দ্রুত শিবিরের চারপাশে গভীর পরিখা খননের নির্দেশ দিয়ে নিজে তত্বাবধায়ন করতে লাগলেন। ফলে মাত্র ৩ দিনের মাথায় গভীর একটি পরিখা খনন হয়ে গেলো। আপাতত এই পরিখাটিই মুঘল শিবিরের ফার্স্ট লাইন অফ ডিফেন্স হিসেবে কাজ করবে।

সম্রাটের শোচনীয় অবস্থা দেখে সম্রাটের অনেক আমির আর যোদ্ধাই পালিয়ে যেতে লাগলো। তবে শেষপর্যন্ত তরদী মুহাম্মদ বেগ, মির্জা ইয়াদগার, মির্জা পায়ান্দা মুহাম্মদ, মুহাম্মদ ওয়ালী, নাদিম কোকা, রাশান কোকাসহ আরও বেশ কিছু বিশ্বস্ত আমিরদের সম্রাট তার পাশে পেলেন। সকলেই নিজেদের জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সম্রাটের সাথে থাকার ইচ্ছা ঘোষণা করলো।

এমন বিপজ্জনক পরিস্থির মাঝেও সম্রাটের মনে কিছু সময়ের জন্য হাসির রেখা দেখা দিলো। কারণ সম্রাটের কাছে খবর পৌঁছেছে বৈরাম খান সম্রাটের সাথে যোগ দিতে এগিয়ে আসছেন। বৈরাম খানের আগমন সংবাদে তো সম্রাট আনন্দিত হয়ে বলেই বসলেন,

‘আমাদের দুঃখ কষ্টের একজন অংশীদার পাওয়া গেলো।’

বৈরাম খান মূলত কনৌজের যুদ্ধের পরই সম্রাটের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিলেন। কনৌজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পালিয়ে তিনি রাজা মিত্র সিং নামক এক জমিদারের নিকট আশ্রয় গ্রহণ করেন। তবে শীঘ্রই শের শাহ বৈরাম খানের ব্যাপারে জানতে পারলে মিত্র সিং বৈরাম খানকে শের শাহের হাতে তুলে দিতে বাধ্য হন। পরবর্তীতে শের শাহের নিকট থেকে পালিয়ে তিনি গুজরাটে চলে যান। শেষপর্যন্ত গুজরাট থেকে তিনি সম্রাটের খোঁজ পেয়ে হাজকানের দিকে চলে আসলেন। বৈরাম খানের আসার সংবাদে আনন্দিত সম্রাট তার আমিরদের অভ্যর্থনা জানাতে নির্দেশ দিলেন।

বৈরাম খান; Image Source: Wikimedia commons

এদিকে প্রবল উৎসাহ নিয়ে শাহ হুসেন সম্রাটের বাহিনীকে পিষে ফেলতে এসে পরিখা দেখে বেশ হতাশই হলেন। তবে হাল ছাড়লেন না। তিনি পরিখার চারপাশে অবস্থান নিয়ে মুঘল সেনাবাহিনীকে অবরোধ করলেন। ব্যাপারাটা আসলে এমন দাঁড়ালো যে, সম্রাট হুমায়ুন নিজের খনন করা পরিখা দিয়ে নিজেই অবরুদ্ধ হয়ে গেলেন। অবরোধের কারণে শিবিরে কোনো খাদ্যবস্তু আসতে পারছিলো না। খাদ্য আর পানীয়ের অভাবে নামমাত্র যা-ও একটা সেনাবাহিনী ছিলো সম্রাটের হাতে, দ্রুতই তার অবস্থা শোচনীয় হয়ে গেলো। সম্রাটের সিন্ধু বিজয়ের পরিকল্পনা দুঃস্বপ্নে পরিণত হলো।

শেষমেষ কোনো উপায় না পেয়ে সম্রাট শাহ হুসেন আরগুনকে সন্ধির প্রস্তাব দিলেন।

সন্ধির প্রস্তাবে শাহ হুসেন বেশ খুশি হলেন। সিন্ধুতে সম্রাট হুমায়ুনের উপস্থিতিকে তিনি আপদ মনে করতেন। আর আপদ বিদায় করতে পারলেই যেন তিনি বেঁচে যান।

সন্ধির শর্ত নিয়ে বেশ কিছুদিন আলোচনা হলো। শেষপর্যন্ত সন্ধির শর্তানুযায়ী শাহ হুসেন বিনা ক্ষতিতে মুঘল সেনাবাহিনীকে সিন্ধু ত্যাগের অনুমতি দিলেন। সিন্ধু ত্যাগের জন্য তিনি সম্রাটকে ৩০টি নৌকা, ২০০০ গাধার বহনযোগ্য পরিমাণ খাদ্যশস্য, ৩০০ উট, ৩০০ ঘোড়া আর নগদ ১ লাখ মিশকাল দিতে সম্মত হলেন।

১৫৪৩ সালের ১১ জুলাই চরম বাজে এক অভিজ্ঞতা আর স্বপ্নভঙ্গের দুঃসহ স্মৃতি সাথে নিয়ে সম্রাট সিন্ধু ত্যাগ করলেন। সিন্ধু ত্যাগ করে কোথায় যাবেন, এ ব্যাপারে সম্রাট কিছুই ঠিক করতে পারলেন না। এ সময় বৈরাম খান আর তরদী মুহাম্মদ বেগ সম্রাটকে বললেন,

‘উত্তরে আর কান্দাহার সীমান্তের শালমাস্তান (আধুনিক কোয়েটা) ছাড়া অন্য কোথাও যাওয়া আমাদের জন্য নিরাপদ হবে না। এ দুটি জায়গা আফগান অধ্যুষিত। আল্লাহর ইচ্ছায় তারা হয়তো আমাদের পক্ষে চলে আসবে। তাছাড়া সেখানে মির্জা আসকারির লোকদেরও থাকার কথা। সুযোগ পেলে তারাও আপনার পক্ষে চলে আসবে।’

অনেক চিন্তা-ভাবনার পর সম্রাটও তাদের সাথে একমত হলেন। দুর্বল মুঘল শিবির আবারও এক দীর্ঘ ক্লান্তিকর যাত্রার প্রস্তুতি নিতে লাগলো।

মুঘল সিরিজের পূর্বে প্রকাশিত সবগুলো পর্ব একসাথে পড়তে চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

তথ্যসূত্র

১। মোগল সম্রাট হুমায়ুন, মূল (হিন্দি): ড হরিশংকর শ্রীবাস্তব, অনুবাদ: মুহম্মদ জালালউদ্দিন বিশ্বাস, ঐতিহ্য প্রকাশনী, প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি, ২০০৫

২। তাজকিরাতুল ওয়াকিয়াত, মূল: জওহর আবতাবচি, অনুবাদ: চৌধুরী শামসুর রহমান, দিব্য প্রকাশ, প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ (চতুর্থ মুদ্রণ)

৩। হুমায়ুননামা, মূল: গুলবদন বেগম, অনুবাদ: এ কে এম শাহনাওয়াজ, জ্ঞানকোষ প্রকাশনী, প্রকাশকাল: জানুয়ারি, ২০১৬

ফিচার ইমেজ: Wikimedia Commons

Related Articles