যুদ্ধ বলতেই আমাদের সামনে ভেসে ওঠে দুটি বিবদমান পক্ষের কথা, যারা প্রতিপক্ষকে বিন্দুমাত্র ছাড় না দিয়ে শেষ পর্যন্ত লড়ে যায়। ইতিহাস ঘাঁটতে বসলে রাজনৈতিক কারণেই বেশি যুদ্ধ হতে দেখি আমরা, যদিও ধর্মীয়, অর্থনৈতিক কিংবা কোনো কারণ ছাড়াই শুধু নিজের কর্তৃত্ব জাহির করার জন্যও পৃথিবীতে যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে। যুদ্ধ মানেই অবকাঠামো ধ্বংসের ঘটনা, যুদ্ধ মানেই অসংখ্য নিরপরাধ মানুষের হতাতত হওয়ার করুণ গল্প। অনেক সময় দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে শোষিতরা নিষ্পেষকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে, যে ঘটনাগুলোকে ইতিহাস যুদ্ধের চেয়ে 'মুক্তি সংগ্রাম' হিসেবেই বেশি স্মরণ করে থাকে।
গত শতাব্দীর প্রথমদিকে বুলগেরিয়া ও গ্রিসের কূটনৈতিক সম্পর্ক মোটেও ভালো যাচ্ছিল না। দুটি দেশই একসময় অটোমান সাম্রাজ্যের অধীনে ছিল, কিন্তু সময়ের পরিবর্তনে একসময় তারা একে অপরের শত্রুতে পরিণত হয়। বুলগেরিয়া যখন অটোমানদের হাত থেকে স্বাধীনতা লাভ করে, তখন সীমানা নিয়ে বেশ বড় ধরনের বিতর্ক শুরু হয়। মেসিডোনিয়া ও পশ্চিম থ্রেসের উপর দুই দেশই নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিল, কেউ ন্যূনতম ছাড় দিতে রাজি ছিল না। সীমানা নিয়ে ঝামেলার কারণে দুই দেশের মধ্যে গেরিলা কায়দায় ছোট ছোট সংঘর্ষ হতে থাকে, যেটি পরবর্তীতে দ্বিতীয় বলকান যুদ্ধে রূপ নিয়েছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে বুলগেরিয়া জার্মানি, অস্ট্রিয়া ও হাঙ্গেরির সমন্বয়ে গঠিত অক্ষশক্তিতে যোগ দিয়ে সার্বিয়ায় হামলা চালায়। অপরদিকে ইংল্যান্ড, ফ্রান্স ও আমেরিকার নেতৃত্বে গঠিত হওয়া মিত্রশক্তির পক্ষে থাকায় যুদ্ধ শেষে গ্রিসকে পুরষ্কার হিসেবে পশ্চিম থ্রেসের বিশাল অংশের উপর রাষ্ট্রীয় অধিকার প্রতিষ্ঠার সুযোগ দেয়া হয়।
দ্বিতীয় বলকান যুদ্ধ ও প্রথম বিশ্বযুদ্ধ– দুটো যুদ্ধেই বুলগেরিয়ার পরাজয়ে সেদেশের জনগণ ও সেনাবাহিনী রীতিমতো ফুঁসছিল। যেকোনো মূল্যে যেন বুলগেরিয়ান সরকার এই পরাজয়ের প্রতিশোধ নেয়, চারদিক থেকে সেই চাপ আসতে থাকে। বুলগেরিয়ার জনগণ এতটাই ক্ষুব্ধ ছিল যে, দেশটির প্রধানমন্ত্রী আলেক্সান্দার স্ট্যামবোলিস্কি যখন গ্রীস ও প্রতিবেশী অন্যান্য দেশগুলোর সাথে সম্পর্ক উন্নয়ন করার চেষ্টা চালান, তখন তাকে ক্ষমতা থেকে সরাসরি উৎখাত করা হয়। মেসিডোনিয়া ও পশ্চিম থ্রেসের উপর যেন গ্রীস পূর্ণ অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে না পারে তাই সেখানকার বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনকে উসকে দিয়েছিল বুলগেরিয়ানরা। এসব কারণে গ্রীসের সাথে বুলগেরিয়ার সম্পর্ক একেবারে তলানিতে এসে ঠেকে, যেকোনো সময়ে যুদ্ধ লেগে যাওয়ার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়ে যায়। তখন শুধু এমন একটি ঘটনার দরকার ছিল, যেটার দোহাই দিয়ে যেকোনো পক্ষ তার বিপরীত পক্ষের উপর আক্রমণ চালাবে এবং পূর্ণমাত্রায় যুদ্ধ শুরু হয়ে যাবে।
বুলগেরিয়া ও গ্রিসের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক যখন একদম তলানিতে পৌঁছেছে, ঠিক সেসময় ১৯২৫ সালের অক্টোবর মাসের ১৮ তারিখে গ্রেকো-বুলগেরিয়ান সীমান্তে কুুকুর নিয়ে টহল দিচ্ছিল একজন গ্রীক সীমান্তরক্ষী। হঠাৎ তার হাত থেকে কুকুরটি বুলগেরিয়ান সীমান্তের দিক ছুট লাগায় এবং সীমান্ত অতিক্রম করে আরও ভেতরে চলে যায়। কুকুরটি সম্ভবত সৈন্যটির খুব প্রিয় ছিল, তাই তিনি আগপাছ না ভেবেই বুলগেরিয়ান সীমান্তে প্রবেশ করেন। বুলগেরিয়ার সীমান্তরক্ষী সৈন্যরা গ্রীস সৈন্যের দিকে তৎক্ষণাৎ বন্দুক তাক করে গুলি ছুড়তে শুরু করে এবং কুকুর খুঁজতে যাওয়া সেই সৈন্য মারা যান। গ্রীসের সৈন্যরা এই ঘটনা বুঝতে পারে তাদের সহকর্মীর মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে পাল্টা হামলা শুরু করে এবং বুলগেরিয়ান সীমান্তরক্ষী সৈন্যরা পিছু হটতে বাধ্য হয়। সংঘর্ষের মধ্যেই গ্রীসের সেনাবাহিনীর একজন ক্যাপ্টেন ও তার সহকারী পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য সাদা পতাকা হাতে নো ম্যান্স ল্যান্ডে গিয়ে আলোচনার মাধ্যমে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করেন। বুলগেরিয়ান সৈন্যরা তাদেরও হত্যা করে।
গ্রীস তখন থিওডোরোস পাঙ্গালোস নামক এক স্বৈরশাসক দ্বারা শাসিত হচ্ছিল। সাধারণত স্বৈরশাসকরা এই ধরনের পরিস্থিতিতে আরও বেশি যুদ্ধংদেহী হয়ে ওঠেন, গ্রিসের ৪৭ বছর বয়সী স্বৈরশাসক পাঙ্গালোসও এর ব্যতিক্রম ছিলেন না। তিনি ৪৮ ঘন্টার মধ্যে বুলগেরিয়াকে ক্ষতিপূরণ হিসেবে দুই লাখ ফ্রেঞ্চ ফ্রাঙ্ক, রাষ্ট্রীয়ভাবে ক্ষমাপ্রার্থনা এবং জড়িতদের ফাঁসিতে ঝোলানোর আল্টিমেটাম দেন। আসলে এটি ছিল একধরনের আনুষ্ঠানিকতা। তিনি নিজেও জানতেন ক্ষোভে ফুঁসতে থাকা বুলগেরিয়ানরা কখনোই এই দাবি মেনে নেবে না। তাই তিনি তার সৈন্যবাহিনীকে যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ করার নির্দেশ দেন এবং ২২ অক্টোবর তার সেনাবাহিনী বুলগেরিয়ান সীমান্তে হামলা চালায়।
গ্রিক সেনাবাহিনী বুলগেরিয়ায় আক্রমণ চালানোর আগে বুলগেরিয়ান সরকার দাবি করেছিল যে সীমান্তের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাটি আসলে 'ভুল বোঝাবুঝি'র জন্য ঘটেছিল। তারা গ্রিস ও বুলগেরিয়া– দুই দেশেরই প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করার আবেদন জানায়, যারা নিরপেক্ষভাবে ঘটনার তদন্ত করবে। তাদের এই অনুরোধ অগ্রাহ্য করে যখন গ্রিক সেনাবাহিনী আক্রমণ চালায় তখন তারা পশ্চাদপসারণ করতে বাধ্য হয়। গ্রিক সেনাবাহিনী বুলগেরিয়ার সীমান্তবর্তী পেট্রিচ নামের একটি শহর ও তার আশেপাশের এলাকা দখল করে নেয় এবং আরও সামনে অগ্রসর হয়।
প্রাথমিকভাবে গ্রিক সেনাবাহিনী সফলতা লাভ করলেও বুলগেরিয়ানরা গ্রিকদের দাবি মেনে নেয়নি কিংবা আত্মসমর্পণ করেনি। তারা চেয়েছিল যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হোক। যুদ্ধ দীর্ঘায়িত করার সবচেয়ে বড় সুবিধা হচ্ছে, আক্রমণকারী সেনাবাহিনীর অর্থনীতি যদি দুর্বল থাকে, তাহলে তারা পেরে উঠবে না। বুলগেরিয়ার সাথে সশস্ত্র সংঘর্ষে জড়ানোর আগেই তুরস্কের সাথে তিন বছর (১৯১৯-২৫) যুদ্ধ করে শেষ পর্যন্ত লজ্জাজনক পরাজয় বরণ করতে হয়েছিল গ্রিসকে, তাই স্বাভাবিকভাবেই তাদের অর্থনীতির ভিত্তি খুব মজবুত ছিল না, যেটির দ্বারা দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধ পরিচালনা করা যাবে। এজন্য যখন বুলগেরিয়ায় গ্রিস যুদ্ধ পরিচালনার খরচ কুলিয়ে উঠতে পারছিল না, তখন তারা সার্বিয়ার কাছে সামরিক সহায়তা প্রার্থনা করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। অপরদিকে বুলগেরিয়াও বিশ্বশান্তি রক্ষার জন্য গঠিত লীগ অব নেশন্সের কাছে মীমাংসার জন্য আবেদন করে। লীগ অব নেশন্স দুই প্রতিবেশীর মধ্যে ঝামেলা মিটিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।
লীগ অব নেশন্স গ্রিসকে বুলগেরিয়া থেকে সরে যেতে আহ্বান জানায়। কিন্তু গ্রিস এই দাবি মেনে নিতে প্রস্তুত ছিল না, কারণ যুদ্ধের ফলাফল ছিল অমীমাংসিত এবং যে দাবিগুলোর জন্য তারা যুদ্ধ শুরু করেছিল, সেগুলোর একটিও আদায় করা সম্ভব হয়নি। কিন্তু পরবর্তীতে লীগ অব নেশন্স যখন ফ্রান্স ও ইতালি থেকে শান্তিরক্ষী বাহিনীকে বুলগেরিয়ায় নিযুক্ত করার ঘোষণা দেয়, তখন গ্রিস পিছু হটতে বাধ্য হয় এবং বুলগেরিয়া থেকে সৈন্য সরিয়ে নেয়। গ্রিসের তেমন কোনো ক্ষতি না হলেও তাদের আক্রমণে বুলগেরিয়ার একশোজনেরও কম মানুষ মারা গিয়েছিল এবং যেসব এলাকা গ্রিক সেনাবাহিনীর অধীনে এসেছিল, সেসব এলাকার অর্থনৈতিক অবকাঠামো গুঁড়িয়ে দেয়া হয়েছিল। তুলনামূলক অন্যান্য যুদ্ধের তুলনায় এই ক্ষয়ক্ষতি খুব বেশি ছিল না।
বুলগেরিয়া লীগ অব নেশন্সের আদেশের পরিপ্রেক্ষিতে গ্রিস সরকারকে দুই মাসের মধ্যে পয়তাল্লিশ হাজার ইউরো ক্ষতিপূরণ প্রদান করে। কিন্তু বুলগেরিয়ার সরকার লীগ অব নেশন্সের হস্তক্ষেপের ঘটনায় সন্তুষ্ট ছিল। কারণ যদি লীগ অব নেশন্সের গড়িমসি করত, তাহলে সার্বিয়ার সহায়তা নিয়ে হয়তো গ্রিস যুদ্ধের চেহারাই পাল্টে দিতে পারত। অপরদিকে গ্রিস পরাজিত না হলেও যে জন্য যুদ্ধে যোগ দিয়েছিল, তা শতাংশও পূর্ণ হয়নি। নিজ দেশে স্বৈরশাসক পাঙ্গালোসের ভাবমূর্তি চরমভাবে ক্ষুণ্ণ হয় এবং পরবর্তীতে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে তাকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেয়া হয়।
সীমান্তে যুদ্ধ, লীগ অব নেশন্সের হস্তক্ষেপ, পয়তাল্লিশ হাজার ইউরো ক্ষতিপূরণ কিংবা গ্রিসের 'না হেরেও হেরে যাওয়া'– সবকিছুর পেছনে কিন্তু সেই কুকুরের দৌড়ে যাওয়ার ঘটনা দায়ী ছিল। কুকুরটি দৌড়ে পালিয়ে যাওয়ার পর যদি টহল দেয়া সৈন্যটি বুলগেরিয়ার সীমান্ত অতিক্রম না করে যেতেন তাহলে হয়তো যুদ্ধও শুরু হতো না, বুলগেরিয়ার প্রায় একশোজন মানুষ মারাও যেতেন না, লীগ অব নেশন্সকেও হয়তো হস্তক্ষেপ করতে হতো না। সামান্য কুকুরের সীমানা অতিক্রম করার ঘটনা থেকে যুদ্ধ শুরু হওয়ার এই ঘটনা আমাদের সামনে ইতিহাসের যে ধ্রুব সত্যটি তুলে ধরে তা হলো– যখন দুটি দেশের মধ্যে যুদ্ধ লাগার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়, তখন আসলে শুধু একটি অযুহাত দরকার, যার মাধ্যমে যুদ্ধ শুরু হবে। পৃথিবীর সবচেয়ে অদ্ভুত কারণে শুরু হওয়া যুদ্ধগুলোর মধ্যে 'ইনসিডেন্ট অ্যাট পেট্রিচ' অবশ্যই প্রথম কাতারে থাকবে।
Language: Bengali
Topic: Incident at Petrich
Reference:
১) Incident at Petrich - DBpedia
২) Incident at Petrich - Alchetron
৪) The Petrich Incident: How a stray dog caused the death of more than 50 people?
Feature Image: War History Online