সৃষ্টিলগ্ন থেকে পৃথিবীর বুকে গড়ে ওঠা প্রাচীন সভ্যতাগুলোর মধ্যে সুমেরীয় সভ্যতা অন্যতম। প্রায় ৪৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে দক্ষিণ ইরাকের তাইগ্রিস ও ইউফ্রেতিস নদীর অববাহিকায় গড়ে উঠেছিলো প্রাচীন এই সভ্যতা। মূলত গ্রিক ভাষায় ঐ জনপদটি মেসোপটেমিয়া নামে সুখ্যাতি পেয়েছিলো। আর সেখানকার মানুষের ভাষার পরিপ্রেক্ষিতে তারা সুমেরীয় হিসেবে পরিচিতি পায়। এই সুমেরীয় সভ্যতার আড়ালে লুকিয়ে আছে মানবসভ্যতার ক্রমবিকাশের অনেক যুগান্তকারী উদ্ভব। সেই সময় ঐ জনপদের মানুষ এমন কিছু সৃষ্টি করেছিল যা বর্তমানে আধুনিক সভ্যতার ভিত্তি হিসেবে কাজ করছে। পাশাপাশি আমাদের অগ্রযাত্রাকে দ্বিগুণ গতিতে চালিত করছে।
সুমেরীয়রা জাতিগতভাবে খুবই মেধাবী এবং সৃষ্টিশীল ছিল। তাদের উর্বর মেধা এবং উদ্ভাবনী শক্তি হাজার বছর আগেকার প্রতিকূল পরিবেশে তাদেরকে বেঁচে থাকতে সাহায্য করেছিলো। যার ফলে জাতি হিসেবে নিজেদের একটি পরিচয়ও তৈরি করেছিল সুমেরীয়রা। এছাড়াও ঐ জনপদের মানুষের মাঝে যোগাযোগের একটি মেলবন্ধন তৈরি হয় ভাষার মাধ্যমে। যদিও সুমেরীয়দের সেই ভাষা বহুকাল আগেই হারিয়ে গেছে। কিন্তু হারিয়ে যায়নি তাদের সৃষ্ট প্রাচীন জিনিসপত্রগুলো। আর সেগুলোর উন্নত সংস্করণ ব্যবহার করেই আজ আমরা নিজেদের মানবসভ্যতার সর্বোচ্চ স্থানে তুলেছি।
মূলত, সুমেরীয়দের বাসস্থান এবং পরিস্থিতি তাদের সৃষ্টিশীল হতে সাহায্য করেছিলো। ঐতিহাসিকদের মতে, সেই সময় দক্ষিণ ইরাকের ঐ অঞ্চলে খুব সামান্য পরিমাণে গাছপালা ছিলো। শুধু তা-ই নয়, যথেষ্ট পরিমাণে পাথর ও ধাতব পদার্থও ছিলো না সেখানে। ফলশ্রুতিতে মাটি এবং নদীর পানিকে কাজে লাগিয়েই সুমেরীরা শুরু করেছিলেন নিজেদের প্রযুক্তিগত অগ্রযাত্রা। তবে সে সময় তারা শুধুমাত্র মৃৎশিল্পই শুরু করেনি, পাশাপাশি বস্ত্রশিল্পও গড়ে তুলেছিল। আর সেগুলো দিয়েই তারা অন্য অঞ্চলের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য করতেন।
প্রয়াত ঐতিহাসিক স্যামুয়েল নোয়াহ ক্র্যামার সুমেরীয়দের নিয়ে বিস্তর গবেষণার পর তাদের সম্পর্কে চমকপ্রদ কিছু তথ্য দেন। তার মতে, সুমেরীয়রা আধ্যাত্মিক এবং মনস্তাত্ত্বিকভাবে খুবই দৃঢ় ছিল। তাদের মধ্যে সফলতার উচ্চাকাঙ্ক্ষা, নতুন নতুন জিনিসপত্র তৈরির প্রতিযোগিতা ছিলো। আর এই পদ্ধতিকেই তারা নিজেদের মধ্যে সম্মান ও প্রতিপত্তি বাড়ানোর হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতো। তাদের সমাজব্যবস্থায় যারা বেশি জিনিসপত্র উৎপাদন করত তারাই বেশি সম্মান পেত। আর এই নীরব প্রতিযোগিতাই সুমেরীয়দের নতুন নতুন উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে বেশি মনোযোগী করেছিলো।
কয়েক হাজার বছর আগে নিজেদের সৃজনশীলতা দিয়ে আমাদের আধুনিক সভ্যতাকে কয়েক ধাপ এগিয়ে দেয়া সুমেরীয়দের সকল সৃষ্টি হারিয়ে যায়নি। সেগুলো রয়ে গেছে আমাদের মাঝে, পেয়েছে নতুন রূপ। আর সেগুলোর জন্য অবশ্যই তাদের ধন্যবাদ প্রাপ্য। চলুন, জেনে নেয়া যাক সুমেরীয় সভ্যতার লোকেদের তৈরি এমনই কিছু জিনিসপত্র সম্পর্কে, যেগুলো বদলে দিয়েছে আমাদের আধুনিক সভ্যতাকে।
যন্ত্রপাতি দিয়ে মৃৎশিল্পের উন্নতি সাধন
প্রাচীনকাল থেকেই মানুষ হাত দিয়ে মাটির তৈরি জিনিসপত্র তৈরি করতো। সুমেরীয়দের আগেকার একাধিক সভ্যতায়ও হাতের তৈরি মৃৎশিল্পের প্রমাণ পাওয়া যায়। ইউফ্রেতিস এবং তাইগ্রিসের পানিকে কাজে লাগিয়ে মরুভূমির বেলে মাটি দিয়ে মাটির তৈরি জিনিসপত্র তৈরি করতেন সুমেরীয়রা। কিন্তু তারা মৃৎশিল্পকে অভাবনীয় একটি রূপ দান করেন। সুমেরীয়রা তাদের উদ্ভাবনী শক্তি দিয়ে বিশেষ যন্ত্রপাতি তৈরি করেন যার মাধ্যমে মাটির তৈরি জিনিসপত্র বিভিন্ন ডিজাইনে তৈরি করা হতো। ঐতিহাসিকদের মতে, তারাই সর্বপ্রথম মাটির পাত্রে গোলাকৃতি দান করেছিলেন।
পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমধ্যসাগরীয় শিল্প এবং প্রত্নতত্ত্বের একজন ডক্টরেট পদপ্রার্থী রেড গুডম্যান তার গবেষণায় কিছু চমকপ্রদ তথ্য দেন। তার মতে, সুমেরীয়রা সর্বপ্রথম গোলাকৃতির মাটির পেয়ালা, পাত্র তৈরি করেছিলেন। সেগুলোকে তারা বিক্রি করার পাশাপাশি নিত্যদিনের কাজেও ব্যবহার করতেন। ৬০০০ হাজার বছর পূর্বে সুমেরীয়দের সৃষ্ট সে সব মাটির পাত্রের আধুনিক রূপ বর্তমানে আমরা আমাদের ব্যবহার্য বাসনকোসনে দেখতে পাই।
লিখন প্রথা
তর্কাতীতভাবে সুমেরীয়রাই ইতিহাসের প্রথম জাতি হিসেবে লেখালেখির প্রচলন শুরু করে। ধারণা করা হয়, খ্রিস্টপূর্ব ২৮০০ সালে যখন তারা পণ্য উৎপাদন, বিপণনে খুব ভালো উন্নতি সাধন করেছিলেন তখন সেগুলোর হিসেবে নিকেশ এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে সংরক্ষণের অভাব বোধ করেন। আর সে সময়েই তারা লেখার প্রচলন করেন। লেখার প্রচলন ঘটিয়ে সুমেরীয়রা ক্রয়-বিক্রয়ের হিসেব সংরক্ষণ করতেন। তাদের আবিষ্কৃত প্রথম অক্ষরগুলো শুধুমাত্র পণ্য এবং সংখ্যা নির্দেশ করতো। পরবর্তীতে তারা বিভিন্ন বস্তুর নির্দেশক চিত্র অঙ্কনেরও প্রচলন ঘটায়। ফলশ্রুতিতে খুব অল্প সময়ের মধ্যে তারা পণ্যের নির্দেশক চিত্র, অক্ষর ও সংখ্যাগুলোকে একত্রিত করতে সক্ষম হয়। এতে করে ফুটে ওঠে কিছু পূর্ণাঙ্গ লেখনী।
লেখকরা লেখার জন্য কাদামাটি এবং তীক্ষ্ণ ধাতব দন্ড ব্যবহার করতেন। তারা দন্ডটি দিয়ে শব্দ লেখার পাশাপাশি চিত্রাঙ্কন করত। ভেজা কাদামাটির উপর শব্দ ও চিত্রাঙ্কন করার পর তারা সেগুলোকে প্রখর রোদে শুকিয়ে সংরক্ষণ করত। আর এই পদ্ধতিটি সুমেরীয়দের থেকে পুরো মধ্যপ্রাচ্যে ছড়িয়েছিলো। ঐতিহাসিকদের মতে, গোটা মধ্যপ্রাচ্যে প্রায় ২০০০ বছর পর্যন্ত এই পদ্ধতিতে লেখালেখির প্রচলন ছিলো। শুধু তা-ই নয়, সুমেরীয় সভ্যতার মানুষ কোনো এক সময় লেখালেখির এই পদ্ধতি ব্যবহার করে কবিতা ও সাহিত্য রচনা করেছিলেন।
জলবাহী প্রকৌশল
আধুনিক যুগে কৃৃষিকাজের ক্ষেত্রে বিপ্লব সংগঠিত হয়েছে। আর এই বিপ্লবের পেছনে রয়েছে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি এবং বিশেষজ্ঞদের বহুমুখী চিন্তাধারা। বর্তমানে অনুন্নত এবং মধ্যম আয়ের দেশগুলোতেও কৃৃষিকাজে আধুনিক যন্ত্রপাতি লক্ষ্য করা যায়। কৃষকেরা ক্ষেতখামারে পানি দেয়ার জন্য নদী, খাল-বিল থেকে পানি সংরক্ষণ করেন। কিন্তু এই সংরক্ষণ পদ্ধতিগুলো আধুনিক যুগের কোনো উদ্ভব নয়। এই পদ্ধতিগুলো হাজার বছর আগে ইউফ্রেতিস এবং তাইগ্রিসের অববাহিকায় বসবাস করা সুমেরীয়রা সর্বপ্রথম প্রচলন করেন।
গবেষকদের দেয়া তথ্যমতে, সুমেরীয়রা কৃৃষিকাজে ব্যাপক উন্নতি সাধন করেছিল। কারণ ভৌগলিকভাবে দক্ষিণ ইরাকের ঐ অঞ্চলটিতে বন-জঙ্গল ছিলো না। যার ফলে সুমেরীর সভ্যতার লোকেরা বেঁচে থাকার তাগিদে কৃষিকাজে মনোযোগী হয়। তারা তাইগ্রিস ও ইউফ্রেতিস নদীর পানি সংরক্ষণের নানারকম পদ্ধতি নকশা করেছিলেন। এমনকি জোয়ারের পানিকে সংরক্ষণের জন্য ছোট ছোট খালও খনন করে। পরবর্তীতে তারা সে সমস্ত খালের বাঁধ খোলা কিংবা বন্ধ করার সহজ পদ্ধতিও আবিষ্কার করতেন। আর এভাবেই মরুর বুকে বিরুপ পরিবেশেও কৃষিকাজ করে নিজেদের অস্তিত্ব বাঁচিয়ে রাখত সুমেরীয়রা।
দুই চাকার রথ
বস্তুত চাকার যানবাহনের ইতিহাসের সঙ্গে সুমেরীয় সভ্যতার খুব বেশি সম্পর্ক নেই। কারণ তখনও মানুষের মাঝে এমন ধারণা জন্মায়নি। কিন্তু সুমেরীয়রা যেসব যন্ত্রপাতি তৈরি করেছিলেন সেগুলোর মধ্যে দুই চাকার রথ ছিলো উল্লেখযোগ্য। আর এই তথ্যটি রিচার্ড ডব্লিউ বুলিটের লেখা 'দ্য হুইল' গ্রন্থে পাওয়া যায়। পরবর্তীতে গুডম্যানও এই ব্যাপারে বিস্তর গবেষণা করেন এবং রিচার্ডের উল্লেখিত তথ্যটির সত্যতা খুঁজে পান।
তাদের দুজনের দেয়া তথ্যমতে, সুমেরীয়রা গৃহপালিত পশুপাখি এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় আনা নেয়ার জন্য দুই চাকার রথ ব্যবহার করতেন। এছাড়াও তখনকার সময়ের সেনাবাহিনীও অস্ত্র বহনে এই রথ ব্যবহার করেছিলো। যদিও বাস্তবিক সেই রথের আকার কতটুক ছিলো সে সম্পর্কে ধারণা নেয়ার কোনো উপায় খুঁজে পাননি রিচার্ড এবং গুডম্যান। তবে ধারণা করা হয়, খ্রিস্টপূর্ব ৩০০০ সালের দিকে এই রথ সর্বপ্রথম তৈরি করা হয়েছিলো।
লাঙ্গল
কিছুকাল আগেও কৃষি ব্যবস্থায় লাঙ্গল ছিলো সর্বাধিক জনপ্রিয়। আধুনিক প্রযুক্তি হয়তো আমাদের পাওয়ার টিলার কিংবা ট্রাক্টরের সঙ্গে পরিচয় করে দিয়েছে। কিন্তু হাজার বছর ধরে কৃষিকাজের উন্নতি ও অগ্রগতি পরিচালিত হয়েছে লাঙ্গল দিয়েই। আর এই লাঙ্গল মেসোপটেমিয়ার সুমেরীয় সভ্যতার লোকেদের সৃষ্টি। আর এটি গবেষকরা প্রমাণ করতেও সক্ষম হয়েছেন। সুমেরীয় সভ্যতার লোকেরা নিজেদের উর্বর মেধাকে কাজে লাগিয়ে যতগুলো যন্ত্রপাতি আবিষ্কার করেছেন তার মধ্যে লাঙ্গল শ্রেষ্ঠ। তাইগ্রিস ও ইউফ্রেতিসের পানিকে কাজে লাগিয়ে তারা কৃষিকাজে ব্যবহার করত। পরবর্তীতে চাষাবাদের প্রয়োজনে তারা লাঙ্গলের নকশা প্রণয়ন করে। যদিও সুমেরীয়দের সময়েই লাঙ্গল বার বার নতুনত্ব পেয়েছিলো।
সেকালে ঐ অঞ্চলে ধাতু ছিলো খুবই দুর্লভ। যার কারণে লাঙ্গল তৈরিতে তারা পাথরের তীক্ষ্ণ ফলা ব্যবহার করত। আর সেটিকে কাঠের দন্ডের সঙ্গে শক্ত করে বেঁধে জমি চাষ করা হতো। লাঙ্গল আবিষ্কার করে সুমেরীয় সভ্যতার লোকেরা কৃষিখাতে বিপ্লব ঘটিয়েছিলো। নদীর পানি আর লাঙ্গলের চাষাবাদ মিলিয়ে খুব কম সময়ে তিনগুণ বেশি উৎপাদন করতে সক্ষম হন কৃষকরা। আর এই বিপ্লবের কারণে দুর্গম অঞ্চলে সুমেরীয়রা স্থায়ীভাবে দীর্ঘ সময় ধরে বসবাস শুরু করেন।
টেক্সটাইল মিল
পোশাকের অতীত ইতিহাস ঘাঁটলে মধ্যপ্রাচ্যের নাম বিশেষভাবে উঠে আসে। বস্তুত পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলের মানুষদের সঙ্গে ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের মানুষের পোশাক উৎপাদন প্রক্রিয়ার ব্যাপক পার্থক্য ছিলো এবং এখনো রয়েছে। ঐ অঞ্চলের লোকেরা আদিকাল থেকেই পশুপালন করতেন। তারা সে সকল পশুর লোমকে নানান কাজে ব্যবহার করত। যার মধ্যে পোশাক উৎপাদন ছিলো বহুল প্রচলিত একটি পদ্ধতি। আর সর্বপ্রথম এই পদ্ধতিটি প্রচলন ঘটায় সুমেরীয় সভ্যতার লোকেরা।
প্রত্নতত্ত্ববিদদের গবেষণায় সুমেরীয় সভ্যতার লোকেদের পোশাক তৈরির চমকপ্রদ কিছু তথ্য উঠে এসেছে। গবেষক গুডম্যানের মতে, তারাই সর্বপ্রথম আত্মীয়তার সম্পর্ক গড়ে তোলেন। যার ফলে তারা পোশাক তৈরির জন্য বড় সংগঠন প্রস্তুত করতে সক্ষম হন। মূলত পরিবার কেন্দ্রিক সেই সংগঠনের মাধ্যমে সুমেরীয়রা পোশাক তৈরিকে শিল্পে রূপান্তরিত করেছিলেন এবং পুরো মেসোপটেমিয়া অঞ্চলে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। তাদের পারিবারিক সেসব পোশাক কারখানার ধারণা থেকেই আজকের যুগের গার্মেন্টস শিল্পের উৎপত্তি হয়েছে বলে ধারণা করেন গবেষকরা।
ইট
সুমেরীয় সভ্যতার লোকেরা প্রথমদিকে বাসস্থানহীন হয়ে বসবাস করলেও কৃষি ও পোশাক তৈরির প্রক্রিয়া প্রচলন হওয়ার পর অনেকটা সভ্য হয়ে ওঠে। তারা একসময় নিজেদের বাসস্থান এবং উপাসনার জন্য মন্দিরও নির্মাণ করেছিল। মৃৎশিল্পে পারদর্শী সুমেরীয়রা মন্দির ও বাসস্থান নির্মাণ করত কাদামাটির তৈরি ইট দিয়ে। যদিও সুমেরীয় সভ্যতার লোকেরা সর্বপ্রথম অট্টালিকা তৈরি করেনি। তবে কাদামাটির তৈরি ইট তাদের সৃষ্টি বলেই ধারণা গবেষকদের।
বিভিন্ন সভ্যতার ইতিহাসে বাড়িঘর কিংবা উপাসনালয় তৈরিতে বেশিরভাগ সময়ে মার্বেল পাথর কিংবা সাধারণ পাথরের ব্যবহার ছিলো সর্বাধিক। কিন্তু সুমেরীয় সভ্যতার লোকেরা ইটের তৈরি বাড়িঘর এবং মন্দির নির্মাণ করেছিল। ফলশ্রুতিতে আস্তে আস্তে পুরো মধ্যপ্রাচ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বাস করতে পেরেছিল তারা। কিছুকাল আগে ইউফ্রেতিস নদীর তীরে অবস্থিত সিরিয়ার তেল তারিরি শহরে সুমেরীয়দের তৈরি ইটের স্থাপনা আবিষ্কার করেন প্রত্নতত্ত্ববিদরা। যার ফলে সহজে এই বিষয়ে একমত হওয়া যায় যে, সুমেরীয়দের আবিষ্কৃত ইটের মাধ্যমে সময়ের পরিক্রমায় বদলে গেছে স্থাপত্যকলার পুরো ইতিহাস।
ধাতুবিদ্যা
সুমেরীয় সভ্যতার লোকেরা প্রথম পর্যায়ে মৃৎশিল্পে উন্নতি ঘটিয়ে ও কৃষিকাজ করে নিজেদের অবস্থান পরিবর্তন করে। পরবর্তীতে পরিবার প্রথার প্রচলন ঘটিয়ে তারা পোশাক উৎপাদন এবং বিপণন করে। কিন্তু যখন তারা তাদের সভ্যতার একেবারে সর্বোচ্চ শিখরে আরোহন করেছিল ঠিক তখন ধাতুর ব্যবহারও শুরু করে। বাস্তবিক ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে ধাতু ছিলো দুর্লভ। কিন্তু যখন তারা ধাতুবিদ্যায় পারদর্শী হয়ে ওঠে ততদিনে তাদের বিস্তার শুধুমাত্র তাইগ্রিস ও ইউফ্রেতিসের অববাহিকাতেই সীমাবদ্ধ ছিলো না।
সুমেরীয়রা তাপকে কাজে লাগিয়ে তামা গলিয়ে নানা রকম আকৃতি প্রদান করত। যদিও সময়ের পরিক্রমায় সুমেরীয়দের মাঝেই ধাতুর তৈরি জিনিসের উৎপাদন ও ব্যবহারে উন্নতি ঘটেছিলো। কপার ডেভেলপমেন্ট অ্যাসোসিয়েশানের তথ্যমতে, সুমেরীয়রা ধাতুর ফলা ব্যবহার করে বর্শা ও নানা রকম অস্ত্র তৈরি করত। শুধু তা-ই নয়, সংস্থাটির দাবি তারা তামা গলিয়ে নানা রকম প্রাণীর আকৃতি দান করতে পেরেছিল। ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে এমনই কিছু ঈগল ও সিংহের শিল্পকর্ম খুঁজে পেয়েছেন গবেষকরা। ধারণা করা হয়, সেগুলোও সুমেরীয়দের হাতে গড়া শিল্পকর্ম।
গণিতবিদ্যা
মেসোপটেমিয়ার সুমেরীয় সভ্যতার লোকেরা গণিতবিদ্যায়ও পারদর্শী ছিল। গণনার কাজে তারা কয়েকটি চমৎকার পদ্ধতি আবিষ্কার করেছিল। যদিও বেশিরভাগ প্রাচীন সভ্যতার লোকেরা গণনার জন্য প্রাণীর হাড়ে দাগ কেটে রাখতেন। কিন্তু সুমেরীয়রাই সর্বপ্রথম ঐ পদ্ধতিকে আরো উন্নত রূপ প্রদান করেছিলেন। রবার্ট ই এবং ক্যারোলি ক্র্যাবসের বই 'গ্রাউন্ডব্রেকিং সায়েন্টিফিক এক্সপেরিমেন্টস, ইনভেনশনস অ্যান্ড ডিসকভার অফ দ্য অ্যানসিয়েন্ট ওয়ার্ল্ডে' সুমেরীয়দের গণিতবিদ্যার সুস্পষ্ট বর্ণনা রয়েছে। মূলত ৬০ ইউনিটের একটি সংখ্যা পদ্ধতিতে গণিত চর্চা করত সুমেরীয় সভ্যতার লোকেরা।
এই পদ্ধতিতে তারা পাশাপাশি এবং উম্বভাবে সংখ্যা লিখত। আর পুরো কাজটি সম্পন্ন হতো কাদামাটির উপর। প্রতিটি ইউনিটকে ভাগ করে পূর্ণাঙ্গ গণনার হিসেব প্রকাশ করত সে সময়ের গণিতবিদরা। লেখা শেষে সেগুলোকে রোদে শুকিয়ে সংরক্ষণ ও বাণিজ্যের কাজে ব্যবহার করত ব্যবসায়ীরা। তাদের এই গণিতবিদ্যা মানব সভ্যতার ক্রমবিকাশে নানাভাবে সহায়তা করেছিলো। যেমনভাবে তাদের সভ্যতার শুরু থেকে শেষ অবধি তাদের সৃষ্ট শিল্পগুলো আধুনিক যুগের বিশেষ ভিত্তি হিসেবে কাজ করছে এখনও। কয়েক হাজার বছর আগেকার সুমেরীয়দের গণিত চর্চার এমন অত্যাধুনিক পদ্ধতি দেখে বোঝাই যায় কতটা মেধাবী এবং উর্বর মস্তিষ্ক নিয়ে মরুর বুকে নিজেদের বিকাশ ঘটিয়েছিল তারা।
This is a bengali article describing some amazing inventions of the sumerians. Necessary references have been hyperlinked.
Feature image: history.com