History repeats itself.
ইংরেজিতে এমন একটি প্রবাদ বাক্য আছে। এর বাংলা অর্থ- ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হয়। হ্যাঁ, কথাটা অনেকাংশেই একশত ভাগ সত্যি মানা হয়; আবার অনেকাংশেই কেবল কাকতালীয় বলেই তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেয়া হয়। তবে ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে, যেহেতু ইতিহাস নিজস্ব গতিতেই চলে, তাই নিজের গতি সচল রাখতে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটে থাকে। আজকের লেখায় এমনই এক ঐতিহাসিক গল্প তুলে ধরব, যা আসলে প্রতি এক শতক বা এক শতাব্দী কিংবা একশো বছরের ব্যবধানে আবারও দেখা দিয়েছে।
বিশ্ব এখন করোনাভাইরাস নিয়ে শঙ্কিত। আর শঙ্কিত হবেইবা না কেন? যে রোগের কোনো প্রতিষেধক কিংবা চিকিৎসাই নেই, সেই রোগ থেকে মুক্তিরও কোনো পথ নেই। আদতে কথা এরকম হলেও, তা পুরোপুরি সত্য নয়। কেননা, ইতোমধ্যেই চীন নিজেদের মহামারির ধাক্কা সামলে পুরো বিশ্বের কাছে নজির স্থাপন করেছে। নিজেদের তৈরি করা প্রযুক্তিকেই কাজে লাগিয়ে চীন রক্ষা করেছে দেশের মানুষদের। সেসব কথা এরই মাঝে আপনাদের জানা হয়ে গেছে। আজ ভিন্ন এক গল্প শোনানো হবে আপনাদের।
আপনি জানেন কি, আজ থেকে ঠিক একশো বছর আগে অর্থাৎ ১৯২০ এর দশকে সারা বিশ্বব্যাপী এমনই এক মহামারির প্রাদুর্ভাব ঘটেছিল? স্প্যানিশ ফ্লু নামে পরিচিত সেই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে লক্ষ-কোটি মানুষ মারা গিয়েছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ধাক্কা সামলে না ওঠা যুদ্ধবিদ্ধস্ত সেই সময়টা ছিল অত্যন্ত ভয়াবহ আর মারাত্মক।
আরেকটু পেছনের কথা বলি, দু'শো বছর আগের কথা। ১৮২০ এর দশকে এশিয়া জুড়ে কলেরা রোগ সর্বগ্রাসীর রূপে হানা দিয়েছিল। পুরো এশিয়া জুড়ে মহামারি হয়ে যাওয়া এই রোগের কোনো চিকিৎসাই তখন ছিল না। চিকিৎসরা মানুষের চাপের মুখে পড়ে নিজেরাই মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিল। একবার ভাবুন তো, কতটা ভয়াবহ ছিল সেই সময়টা?
আরও একশো বছর পেছনের কথা। অর্থাৎ, সর্বসাকুল্যে তিনশো বছর আগের কথা। ১৭২০ সাল। বিশ্ব যখন প্রতিনিয়ত সামনের দিকে এগিয়ে যাবার প্রত্যয়ে মত্ত, তখনই মহামারি আকারে এলো প্লেগ। এখন অবধি বিশ্বের ইতিহাসে প্লেগের চেয়ে ভয়ানক আর মরণব্যাধি কোনো মহামারির কথা উচ্চস্বরে প্রকাশ হয় না। চিকিৎসা আর শুশ্রূষার অভাবে মারা গেছে হাজার হাজার মানুষ। ভাবা যায়? গা শিউরে ওঠে না আতঙ্কে?
তাহলে এবার কি যোগসূত্রটা ধরতে পেরেছেন? ১৭২০ সালের পর থেকে প্রতি একশো বছর অন্তর একটা করে মহামারী বিশ্বব্যাপী নিজের বিস্তার লাভ করেছে আর কেড়ে নিয়েছে লক্ষ-কোটি মানুষের প্রাণ। ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি? নাকি কোনো অভিশাপ? মহামারির প্রাদুর্ভাব, নাকি কোনো স্বেচ্ছা ষড়যন্ত্রের বলিদান? চলুন, খানিকটা বিস্তারিত জেনে নিজেরাই বুঝে নিই- আসল ঘটনাটা কী?
১৭২০ সাল - বিউবনিক প্লেগ (দ্য ব্ল্যাক ডেথ)
আঠারো শতকের গোড়ার দিকে ফ্রান্স ছিল আন্তর্জাতিক শক্তিসম্পন্ন গুরুত্বপূর্ণ এক দেশ। আর ফ্রান্সের মার্সেই শহর তখন ছিল বাণিজ্যের জন্য রমরমা। প্রাচ্যের কাছাকাছি হওয়াতে ইউরোপের একচেটিয়া বাণিজ্যকেন্দ্র হিসেবে মার্সেই তখন অত্যন্ত জনপ্রিয়। আর এই জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগিয়ে তখনকার সময়ের অন্যতম সেরা ধনী শহরে পরিণত হয়েছিল মার্সেই।
১৭২০ সালের ২৫ মে, লেবাননের সিডোন থেকে দ্য গ্র্যান্ড-সান্তে-এন্তোইন নামে একটি জাহাজ রেশম আর তুলা নিয়ে নোঙ্গর করে মার্সেইয়ের পোতাশ্রয়ে। গায়ে ফোসকা পড়ে ফুলে যাওয়া দেহ নিয়ে কয়েকজন যাত্রীও ছিল সেখানে। তাদের জন্য বন্দর কর্তৃপক্ষ কোয়ারেন্টিনের ব্যবস্থা করে। ব্যাপারটা মোটেও অস্বাভাবিক বলে কারো মনে হয়নি তখন। নতুন নতুন ধন-সম্পদ কামিয়ে মার্সেইয়ের বণিকরা তখন ইতোমধ্যেই বেশ লোভী হয়ে উঠেছে।
সুতাকলের মেলা উপলক্ষে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কার্গোগুলো সেখানে পাঠানোর জন্য তারা মরিয়া হয়েছিল একদম। ব্যাপারটা তখন অস্বাভাবিক মনে হয়েছিল, যখন সেটা সাইপ্রাসে ফিরে যাচ্ছিল এবং মহামারির কথাটা একদম ফলাও করে বিশ্বব্যাপী প্রচার হয়ে যায়। ইতালির লিভর্ন বন্দর থেকে প্রত্যাখ্যাত হয়ে শহরের বাইরের পরিত্যক্ত একটি জেটিতে জাহাজটি নোঙ্গর করে। এক তুর্কি যাত্রী অসুস্থতায় মারা যায় এবং কিছু বুঝে ওঠার আগেই জাহাজের অন্যান্য যাত্রী, নাবিক এবং সার্জনও অসুস্থ হয়ে পড়ে।
৯০ হাজার জনসংখ্যা সমৃদ্ধ মার্সেই শহরে অতিসত্ত্বর বিউবনিক প্লেগ রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিল। খুব দ্রুত এটি ছড়াতে থাকে এবং শহরের মেয়র থেকে শুরু করে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা এটি সামাল দিতে হিমশিম খায়। ১৩৪০ সালের প্লেগের সময়কালে আবিষ্কৃত ওষুধ ব্যবহার করা হয় অসুস্থদের উপর। কিন্তু চিকিৎসকরা তা দিয়ে খুব বেশি একটা সুবিধে করতে পারেনি।
ধীরে ধীরে মৃতের সংখ্যা পাহাড় বেয়ে চূড়ায় উঠতে শুরু করে। শহর জুড়ে মৃত্যুর আচ্ছন্ন একটা পরিবেশ ছায়া ফেলে অন্ধকার করে ফেলে জাঁকজমকপূর্ণ শহরটাকে। চোখের পলকে অবকাঠামোগুলো ভেঙে পড়ে, আর সামাজিকতা যায় উচ্ছন্নে। শহরের মোড়ে মোড়ে বাড়তে থাকে লাশের স্তূপ আর লাশের পঁচা-গলা গন্ধে শহরের বাতাস হতে থাকে ভারি। এক সাক্ষীর জবান থেকে জানা যায়,
মাথায় অসহ্য রকমের ব্যথা। সবসময় বমি বমি ভাব কাজ করে। আর প্রতি ৬ থেকে ৮ ঘণ্টায় একটা করে নতুন বাগী উৎপন্ন হয় শরীরে এবং প্লেগের ঘা বৃদ্ধি পেতে শুরু করে। আস্তে আস্তে তা মৃত্যুর কাছে নিয়ে যায়, তীব্র যন্ত্রণা শরীরে ছড়িয়ে দিয়ে।
এই পরিস্থিতিতে স্থানীয় সংসদ খুব ভড়কে গিয়েছিল; তবে তারা এই ব্যাপারটাতে কঠোরতা অবলম্বন করে দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করেছিল। তারা ঘোষণা করেছিল, মার্সেইয়ের কেউ যদি শহর ছেড়ে যাওয়ার কথা চিন্তা করে, কিংবা কাছের কোনো শহরের কারও সাথে কথা বলা অথবা মেলামেশার চেষ্টা করে, তবে তার জন্য সর্বোচ্চ দণ্ডবিধান ফাঁসির আদেশও দেয়া হবে। এই ব্যবস্থা গ্রহণ করতে তারা বাধ্য হয়েছিল। আর একে আরও কার্যকর করার জন্য, 'লা মুর দে লা পেস্ট' নামে একটি দুই মিটারের প্রাচীর সারা শহর জুড়ে স্থাপন করা হয়েছিল এবং পদে পদে রক্ষীবাহিনী বসিয়ে এর সুরক্ষা নিশ্চিত করা হয়েছিল।
এতকিছু সত্ত্বেও স্থানীয় ছোট শহরগুলোতে প্লেগ ছড়িয়ে পড়েছিল। ১৭২০ সালের মে মাস থেকে টানা দুই বছর স্থায়ী এই প্লেগে প্রায় ১ লাখ মানুষ মারা যায়, যার মধ্যে মার্সেইয়েরই ছিল ৫০ হাজারেরও অধিক। ১৭৬৫ সালের আগ অবধি মার্সেই শহর এর জনসংখ্যা কোনোক্রমেই বৃদ্ধি করতে পারেনি, প্লেগ যেন তা থামিয়ে দিয়ে গিয়েছিল। তবে ওয়েস্ট ইন্ডিজ এবং লাতিন আমেরিকার সাথে পুনরায় বাণিজ্য স্থাপন হলে মার্সেই প্লেগকে দূরে সরিয়ে দিয়ে পুরনো ঐতিহ্যে ফেরতে আসে।
রাজকীয় ফরাসি সরকারের টনক নড়ে এই ঘটনায় এবং বন্দরের সুরক্ষার জন্য প্রচুর অর্থ আর সৈন্য নিযুক্ত হয়। বিশ্ব ইতিহাসে ১৭২০ থেকে ১৭২২ সালকে ইউরোপের 'কালো বছর' বলে অভিহিত করা হয়। এই বিউবনিক প্লেগকে 'দ্য গ্রেট প্লেগ অফ মার্সেই' বলা হয়। ক্ষেত্রবিশেষে একে 'দ্য ব্ল্যাক ডেথ অফ প্লেগ'ও বলা হয়ে থাকে।
১৮২০ সাল - কলেরা (লক্ষ লক্ষ মানুষের মৃত্যু)
ভারতবর্ষের গঙ্গার ব-দ্বীপ এলাকা থেকে ধূষিত ধানের থেকে কলেরার জীবাণু ছড়ায়; যা প্রথমবারের মতোই আসে এবং এসেই মহামারী আকারে রূপ নেয়। ভারতবর্ষ পেরিয়ে তা আধুনিক মায়ানমার, শ্রীলংকা এবং ইউরোপে বিস্তৃতি লাভ করে। মারা যায় লক্ষাধিক মানুষ।
মূলত ১৮১৭ সালেই কলেরা বিশ্বব্যাপী বিস্তৃত রোগে পরিণত হয়েছিল। সে বছর রোগটি ভারতের বৃহত্তর যশোহর, ক্যালকাটা (কলকাতা) এবং ডাক্কা (বর্তমান বাংলাদেশের ঢাকা)-ত মারাত্মক আকার ধারণ করে। পরে তা ভারতের অন্যান্য অঞ্চল, বার্মা (মায়ানমার), এবং সিলন (শ্রীলংকা) জুড়ে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। টানা তিন বছর দক্ষিণ এশিয়ার এই অঞ্চল ভুগিয়ে কলেরা আশ্রয় নেয় সিয়াম (থাইল্যান্ড) এ (যেখানে জাভা দ্বীপে প্রায় এক লক্ষেরও বেশি মানুষ মারা যায়), এবং ক্রমশ তা ফিলিপাইন এবং অন্য রাষ্ট্রগুলোতেও আঘাত হানতে শুরু করে।
‘এশিয়াটিক কলেরা’ নামে পরিচিত ১৮১৭-২১ মেয়াদী এই মহামারিতে মৃতের সংখ্যা সঠিকভাবে জানা যায়নি। তবে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর রেকর্ড মোতাবেক ১০ হাজার মানুষ মৃত্যুর ভিত্তিতে গবেষকরা অনুমান করেন যে, পুরো ভারতবর্ষ জুড়ে প্রায় কয়েক হাজার (মতান্তরে লাখখানেকও হতে পারে) মানুষের মৃত্যু হয়েছে। ১৮২৩ সালের মধ্যেই বঙ্গোপসাগরের এই বদ্বীপ অঞ্চল থেকে কলেরা বেমালুম গায়েব হয়ে যায়।
এই শতকের কলেরার প্রাদুর্ভাব এতটাই মারাত্মক আর ভয়াবহ আকার ধারণ করেছিল যে, পুরো শতাব্দী ব্যাপী এবং ধীরে ধীরে পুরো পৃথিবী তা ছড়িয়ে যায়। কলেরা মহামারি খানিকটা বিরতি দিয়ে মাত্র ছয় বছরের ব্যবধানে আবারো আঘাত হানে ভারতবর্ষ জুড়ে। বাণিজ্য আর সেনাবাহিনীদের যাতায়াতের মধ্য দিয়ে ধীরে ধীরে তা রাশিয়া হয়ে তুরস্কে ঢোকে এবং পোল্যান্ড, ফিনল্যান্ড হয়ে পুরো ইউরোপ দখল করে ফেলে। পরের বছরগুলোতে কলেরাতে মৃতের সংখ্যা বাড়ার সাথে সাথে কলেরায় আক্রান্ত দেশের নামও বাড়তে থাকে। আমেরিকা এবং লাতিন আমেরিকার সকল দেশও এই ভয়াবহতা থেকে রক্ষা পায়নি।
সাধারণত কলেরার মারাত্মক লক্ষণগুলোর মধ্যে ছিল- বমি বমি ভাব, মারাত্মক রকমের ডায়রিয়া এবং হাত-পায়ে খিঁচুনি ধরা। লক্ষণগুলো এতটা মারাত্মক মনে না হলেও এগুলোর প্রভাবে মাত্র কয়েকদিন, এমনকি কয়েকঘণ্টার মধ্যেও, রোগীর পানিশূন্যতা, সেপটিক শক থেকে মৃত্যু পর্যন্ত ঘটে যেত।
১৮৫০ এর দশকে আবার তৃতীয়বারের কলেরা আঘাত হানে এবং এবার বিগতবারের ভয়াবহতাকেও ছাপিয়ে যায়। পরের দশকেই আবার ভারতবর্ষের বেঙ্গল রেজিমেন্ট আক্রান্ত হয় এবং হজ্বযাত্রীদের মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যেও তা ছড়িয়ে পড়ে। পঞ্চমবারে সবচেয়ে ভয়াবহ আক্রান্তের শিকার হয় জার্মানি। আর ষষ্ঠবারের আঘাতে ১৮৯৯ সাল থেকে শুরু করে ১৯২৩ সাল অবধি প্রায় ৮ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়। কলেরা কিন্তু এখনো অনেক দেশেই দৃশ্যমান।
১৯২০ সাল - স্প্যানিশ ফ্লু (কোটি কোটি মানুষের প্রাণহানি)
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের একদম শেষদিকে সৈন্যরা অদ্ভুত এক রোগে আক্রান্ত হতে শুরু করলো। পশ্চিম ফ্রন্টের সৈন্যরাই এতে সবচেয়ে বেশি অসুস্থ হতে শুরু করল। ধারণা করা হয়েছিল, নোংরা, আবর্জনায় পূর্ণ এবং স্যাঁতসেঁতে অবস্থার জন্যেই এই রোগের প্রাদুর্ভাব ছড়িয়ে ছিল। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে দুর্বল করে পুষ্টিহীনতায় মৃত্যু ছিল এই রোগের শেষ পরিণতি। তাদের এই অসুস্থতা 'লা গ্রিপি' নামে পরিচিত হয়েছিল, আর এটা মারাত্মক রকমের সংক্রামক ছিল; যে জন্য সৈন্যদের মধ্যে খুব দ্রুতই ছড়িয়ে পড়েছিল। মাত্র তিনদিনের মধ্যেই অনেকেই সুস্থ বোধ করতে শুরু করে, তবে বেশিরভাগ লোক সুপ্ত অবস্থায় ভাইরাসটি বহন করছিল।
১৯১৮ সালের গ্রীষ্মের সময়ে যুদ্ধ শেষে সৈন্যরা বাড়ি ফিরতে শুরু করে। তবে সাথে করে নিয়ে ভয়ানক এক ভাইরাস যা তাদেরকে খুব দ্রুতই অসুস্থ করে তোলে। শুধু অসুস্থই না, পাড়া, গ্রাম এমনকি শহর পর্যন্ত ছেয়ে যায় সংক্রামক ঐ ভাইরাসে। এই প্রাদুর্ভাবের প্রথম ধাক্কায় মৃতের সংখ্যা অত্যন্ত কম। সাধারণ ঠান্ডা, জ্বর, সর্দি আর কাশি হলেও খুব দ্রুতই সুস্থ হয়ে উঠেছিল সকলে। কিন্তু একই বছরের শরতকালের দ্বিতীয় ধাক্কায় যেন নিজের ক্রোধের সবার্ত্মক রূপটা দেখাতে সক্ষম হয়েছিল এই ফ্লুয়ের ভাইরাসটা।
এতটাই ভয়ানকভাবে আক্রমণ করেছিল যে, লক্ষণ প্রকাশের মাত্র কয়েক ঘণ্টা বা কয়েকদিনের মধ্যেই রোগী মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছিল। প্রথমে জ্বর আসে, তাপমাত্রার বাড়ার সঙ্গে বাড়ে শ্বাসকষ্টের প্রকোপ। অক্সিজেনের অভাবে ফুসফুসে রক্ত গিয়ে দমবন্ধ হয়ে আসত এবং ত্বক নীলবর্ণ ধারণ করত। নাক-মুখ থেকে গলগল করে রক্ত বেরিয়ে আসত। বয়সের কোনো নির্দিষ্টতা ছিল না রোগী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে। একজন আক্রান্ত রোগীর হাঁচি-কাশি থেকে কমপক্ষে ৫০ লক্ষ জীবাণু ছড়িয়ে পড়তো আশেপাশে। মাত্র এক বছরের ব্যবধানে আমেরিকার গড় আয়ু কমে গিয়েছিল গড়পড়তা ১০ বছর।
প্রাথমিকভাবে স্পেনই ছিল, যেখানে এই রোগটিকে মহামারি ঘোষণা করা হয়েছিল। বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন স্পেন ছিল নিরপেক্ষ এক দেশের ভূমিকায় এবং অসুস্থতার খবর অবাধে প্রকাশ করার দৃষ্টান্ত দেখিয়েছিল স্পেনের সকল পত্রিকা। বিষয়টিকে তারা এতটাই গুরুত্ব দিয়েছিল যে, যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশ আর ফ্লুতে আক্রান্ত স্পেনের মধ্যে কোনো তফাতই ছিল না।
যার ফলে, লোকেরা ধরেই নিয়েছিল রোগটি কেবল স্পেনের জন্যই নির্দিষ্ট এবং নামটিও তাই 'স্প্যানিশ ফ্লু'তে আটকে গিয়েছিল। আর এই রোগ স্থানীয় পর্যায়ের শীর্ষস্থানীয় রাজনীতিবিদই নয়, বরং রাজা দ্বাদশ আলফানশোকেও আক্রান্ত করেছিল। স্কুল-কলেজ, ব্যারাক এবং সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর মতো বদ্ধ জায়গাগুলোতে যারা কাজ করত, তাদের মধ্যে ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ মানুষ আক্রান্ত হয়েছিল এই রোগে।
মাত্র অল্প কিছুদিনের মধ্যেই ভাইরাসটি ইউরোপের মূল ভূখণ্ডের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছিল। অস্ট্রিয়ার ভিয়েনা, হাঙ্গেরির বুদাপেস্ট, ফ্রান্স এবং জার্মানির কিছু অঞ্চল পুরোপুরি আক্রান্ত হয়ে গিয়েছিল ইতোমধ্যেই। স্কুলে ছাত্র-ছাত্রী এবং কারখানায় শ্রমিকের সংখ্যা কমে এসেছিল। একই বছরের জুলাই মাসের মধ্যে মহামারিটি লন্ডনের টেক্সটাইল বাণিজ্যকে একদম ধ্বসিয়ে দেয়।
এক সন্ধ্যায় কারখানার ৪০০ জন কর্মীর মধ্যে ৮০ জন শ্রমিক অসুস্থ হয়ে পড়লে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। মহামারিটি দ্রুত বিশ্বব্যাপী মহামারী আকারে ছড়াতে শুরু করে। পরের মাসেই সেন্ট লরেন্স নদীর তীরে কানাডার ছয়জন নাবিককে অসুস্থতার ফলে মৃত্যু অবস্থায় পাওয়া যায়। একই মাসে, সুইডেন এবং আফ্রিকায় মহামারির প্রার্দুভাব লক্ষ করা যায়। আর সেপ্টেম্বরে বোস্টন হয়ে স্প্যানিশ ফ্লু আমেরিকাতে প্রবেশ করে।
বিশ্বের ইতিহাসে মারাত্মক আর ভয়ানক এই ফ্লুটি পুরো বিশ্ব জুড়ে প্রায় ৫০০ মিলিয়ন মানুষকে আক্রান্ত করেছিল; যা ছিল পুরো বিশ্বের জনসংখ্যার এক তৃতীয়াংশ। এবং প্রায় ৭ মিলিয়ন আমেরিকানসহ বিশ্বব্যাপী ২০ থেকে ৫০ মিলিয়ন মানুষ মারা গিয়েছিল। তখনকার সময়ে এই রোগের কোনো প্রতিরোধ ব্যবস্থা চিকিৎসকদের কাছে ছিল না। কোনো কার্যকরী ওষুধ ছিল না। না ছিল কোনো ভ্যাকসিন। আক্রান্ত রোগীর সেবা করারও কোনো পদ্ধতি জানা ছিল না। হাসপাতালগুলোতে রোগীর সংখ্যা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছিল। বন্ধ হয়ে যাওয়া স্কুল-কলেজ এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলোর দালানগুলোকে সাময়িকভাবে অস্থায়ী হাসপাতালে রূপান্তরিত করতে হয়েছিল।
তাকিয়ে থেকে মৃত্যুর উৎসব দেখা আর কিছুই করার ছিল না। নাগরিকদের ঘর থেকে বের না হবার এবং বের হলেও মাস্ক ব্যবহার করার পরামর্শ দেয়া হয়েছিল। স্কুল-কলেজ, আদালত, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এবং থিয়েটারসহ সকল জনপরিসর বন্ধের নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। কিন্তু তবুও মর্গগুলোতে এত লাশ জমে গিয়েছিল, যে তা স্তূপাকারে না রেখে অন্য কোনো উপায় ছিল না।
শুধু মর্গই নয়, এমনকি কবরস্থানেও লাশ স্তূপ করে রাখা হতো এবং পরিবারের বা আত্মীয়স্বজনকেই কবর খুঁড়তে হয়েছিল। অসংখ্য কৃষক মারা যাওয়াতে কৃষি শ্রমিকদের সংকট তৈরি হয়েছিল। গ্রীষ্মের শেষে ফসলের মৌসুমে যা তীব্র আকার ধারণ করেছিল এবং খাদ্য সংকট তৈরি হয়েছিল পুরো বিশ্বব্যাপী। মহামারিটি এশিয়া, ইউরোপ, দক্ষিণ আমেরিকা এবং প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায় নিজের আধিপত্য বিস্তার করেছিল। এশিয়ার ভারতে প্রতি এক হাজার জনে ৫০ জন লোক মারা গিয়েছিল।
২০২০ সাল - করোনাভাইরাস কোভিড-১৯ (বিশ্বকে থামিয়ে দেয়া এক অদৃশ্য শত্রু)
২০১৯ সালের ডিসেম্বরের শেষের দিকের কথা। মধ্যচীনের এক প্রদেশ উহান শহরে অদ্ভুত এক রোগের উৎপত্তি টের পায় চীনা বিশেষজ্ঞরা। বছরের শেষ দিনে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে সতর্কবার্তা দিয়ে চীন জানায় যে, নিউমোনিয়ার মতো এক অদ্ভুত রোগ চীনের উহান প্রদেশ জুড়ে ছড়াতে শুরু করেছে। পরীক্ষা করে জানা যায়, করোনা নামক এক নতুন ভাইরাসের সংক্রমনে আক্রান্ত হয়েছে উহান প্রদেশ। এই রোগে আক্রান্ত হয়ে প্রথম মৃত্যু ঘটে ১১ জানুয়ারি, ২০২০।
করোনা আসলে একক কোনো ভাইরাস নয়, এটি একটি ভাইরাসের পরিবারকে বোঝানো হয়। এই পরিবারে অসংখ্য ভাইরাস আছে। পূর্বে এই পরিবারের ছয়টি ভাইরাস মানুষকে আক্রান্ত করেছিল এবং এ নিয়ে সাতটি হলো। নতুন এই ভাইরাসের নাম দেয়া হয়- ২০১৯ নভেল করোনা ভাইরাস (এনওসি)।
করোনা এবারই প্রথম আক্রমণ করেছে বিশ্বকে, এমনটা কিন্তু নয়। এর আগে, ২০০২ সালে, চীনে সার্স করোনা ভাইরাস নামে পরিচিত একটি ভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছিল। আর পরে ২০১২ সালে আরেকটি করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে ছিল, যা মার্স করোনা ভাইরাস নামে পরিচিত। তবে এই ভাইরাস সংক্রমণের উৎসটা ঠিক কোথা থেকে, তা জানা যায়নি।
বিশেষজ্ঞদের ধারণা, কোনো প্রাণীর কাছ থেকেই এই রোগের বিস্তার ঘটেছে। প্রাণী থেকেই মানুষের দেহে ঢুকেছে এবং তা ছড়াতে শুরু করে। এর আগে বাদুড় থেকে সার্স ভাইরাস এবং উট থেকে মার্স রোগের উৎপত্তি। উহান প্রদেশে অবস্থিত দক্ষিন চীন সাগরের উপকূলে সামুদ্রিক খাবারের একটি পাইকারি বাজার আছে। এই বাজারে সামুদ্রিক স্তন্যপায়ী প্রাণীর মাংস ছাড়াও জ্যান্ত মুরগী, সাপ, বাদুড়, খরগোশ- ইত্যাদি বিক্রি হয়। হয় এসব জীবজন্তু, আর নয়তো বেলুগা জাতের তিমি থেকে এই রোগের উৎপত্তি।
হাঁচি-কাশি, শারীরিক সংস্পর্শ বা হাত মেলানো, ভাইরাস আছে এমন জায়গা স্পর্শ করে পরে নিজের নাক-মুখ স্পর্শ করার মধ্য দিয়ে এই রোগ ছড়াতে পারে। সাধারণ জ্বর-ঠাণ্ডা-কাশির মতোই বিশ্রাম নেয়া ব্যতীত অন্য কোনো চিকিৎসা নেই এই রোগের। তবে যেহেতু ছোঁয়াচে, তাই সচেতনতা অত্যন্ত জরুরি। সচেতনতাগুলো হচ্ছে-
- সাবান আর পানি দিয়ে অন্তত ২০ সেকেন্ড সময় ধরে ভালোভাবে হাত ধুতে হবে।
- হাত না ধুয়ে নিজের নাক-মুখ বা চোখ স্পর্শ করা যাবে না।
- আক্রান্ত ব্যক্তির থেকে দূরত্ব বজায় রাখতে হবে।
- জনসমাগম এড়িয়ে চলতে হবে, অথবা মাস্ক ব্যবহার করা যেতে পারে।
চীনের উহান প্রদেশে শুরু হলেও বর্তমানে করোনাভাইরাস বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে। ইউরোপ থেকে শুরু করে এশিয়া কিংবা আমেরিকা মহাদেশেও এই রোগ বিস্তার লাভ করেছে। সচেতনতার সাথে এই রোগ প্রতিরোধ করতে হবে।
প্রতি একশো বছর অন্তর অন্তর পৃথিবী একটা মহামারির প্রাদুর্ভাবে কেঁপেছে। হয়তো ব্যাপারটা কেবলই কাকতালীয়; কিংবা হতে পারে এটাই মহামারির ধরন। অথবা হতে পারে, এ এক আদিম অভিশাপের ফল। এমন মহামারিতে, বিশ্বকে দাপিয়ে বেড়ানো মানুষেরা প্রকৃতির কাছে নিজেদের অসহায়ত্ব প্রকাশ করতে বাধ্য হয়েছে। ঐক্যবদ্ধ জাতি সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে বাধ্য হয়েছে। এত উন্নত প্রযুক্তি আর অস্ত্রও যে প্রকৃতির কাছে নিতান্তই তুচ্ছ, তা যেন মানবসন্তান হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে। প্রকৃতির উপর অত্যাচার চালানোর জন্য মানুষকে আফসোস করতে হয়েছে। আর প্রকৃতি নিজের প্রতিশোধ নিয়ে ফিরিয়ে দিয়েছে এক নতুন পৃথিবীকে।
পৃথিবীটা প্রকৃতির দান আর মানবসন্তান আদতে প্রকৃতিরই সন্তান। তাই, প্রকৃতির রাজ্যে বিচরণ করতে চাইলে হিংস্রতা আর বর্বরতাকে বর্জন করে সচেতনতা আর আদর্শতাকে ধরে টিকে থাকতে হবে। বারবার প্রকৃতি হয়তো এটাই বোঝাতে চেয়েছে, এই মহামারীকে আঁকড়ে ধরে।
This article is in Bengali Language. This is about the great pandemics that usually occur in Hundred year of timeline.
Necesary references have been hyperlinked inside the article.
Featured Image: DEA M. SEEMULLER/De Agostini/Getty Images