Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

কামিকাযে: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের শেষ প্রচেষ্টা

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয় ১৯৩৯ সালে। নাৎসি জার্মানি ও ফ্যাসিবাদী ইতালির সাথে যুক্ত হয়ে ১৯৪০ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর জাপান একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে। সে চুক্তি অনুসারে যুদ্ধের সময় যুদ্ধের সাথে জড়িত নয় এমন কোনো দেশ যদি তাদেরকে আক্রমণ করে, তাহলে তারা পাল্টা আক্রমণ করতে একে অপরকে সাহায্য করবে। এরই মাধ্যমে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপান, জার্মানি ও ইতালি একসাথে মিলে অক্ষশক্তি গড়ে তোলে। তাদের বিপরীতে ছিল মিত্রশক্তি, যেখানে অংশগ্রহণ করেছিল যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চীন সহ আরো অনেকগুলো রাষ্ট্র।

জাপান দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সামরিক শক্তি কাজে লাগিয়ে একের পর এক জায়গা দখল করে নিচ্ছিলো, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলো ফরাসি ইন্দোচীন, ডাচ ইস্ট ইন্ডিজ, ব্রিটিশ সিঙ্গাপুর, নিউ গিনি, ফিলিপাইন, হংকং এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকার কিছু জায়গা। জাপানের এই উগ্র বিস্তার রোধ করতে শুরু থেকেই যুক্তরাষ্ট্র জাপানের উপর বিভিন্ন অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে, যাতে তারা তেল ও স্টিল কেনা-বেচা করতে না পারে। সেজন্য জাপান যুক্তরাষ্ট্রকে দমন করার উপায় বের করার কথা ভাবতে থাকে।

সেই পরিকল্পনা অনুসারে ১৯৪১ সালের ৭ ডিসেম্বর জাপান অতর্কিতভাবে পার্ল হারবারে আক্রমণ চালায়, যেখানে প্রায় ২,৪০৩ জন প্রাণ হারায় এবং অসংখ্য স্থাপনা, সামরিক জাহাজ ও সামরিক বিমান ক্ষতিগ্রস্ত হয়। হামলার বিশালত্বে সারা দুনিয়া থমকে গিয়েছিল। কারণ যুক্তরাষ্ট্রের মতো একটি শক্তিশালী দেশের উপর এত বড় আক্রমণের কথা কেউ কল্পনাই করতে পারেনি। ঘটনাটির পরদিনই যুক্তরাষ্ট্র জাপানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে এবং জাপানকে শক্তহাতে দমনের প্রতিজ্ঞা গ্রহণ করে। যুদ্ধের শুরু থেকেই ইউরোপের সঙ্কটকে তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয় বলে উল্লেখ করলেও নিজেদের ভূখণ্ডে আঘাত আসার পর যুক্তরাষ্ট্র দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণে বাধ্য হয়।

পার্ল হারবারে আক্রমণ পরবর্তী অবস্থা; Image Source: visitperalharbor.org

প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায় জাপান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে যুদ্ধাবস্থা বিরাজমান। যুদ্ধের সময় যত অতিবাহিত হচ্ছিলো, দুই পক্ষই তাদের যুদ্ধকৌশল ও প্রযুক্তির ব্যবহারে পরিবর্তন আনার চেষ্টা করছিল। তার মধ্যে জাপানের একটি যুদ্ধকৌশল ছিল কামিকাযে হামলা, যা আত্মঘাতী হামলা হিসেবেও জানা যায়। জাপানের প্রধান ভূমিতে যাতে যুক্তরাষ্ট্র আক্রমণ বা প্রবেশ করতে না পারে, সেজন্য দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষের দিকে এই কৌশল অবলম্বন করার চেষ্টা করে জাপান। স্বাভাবিকভাবেই যুদ্ধের ঐ সময়ে যুক্তরাষ্ট্রকে দমনে জাপানের এই যুদ্ধকৌশল যথেষ্ট ছিল না। তবুও শেষ চেষ্টা হিসেবে তারা কামিকাযে হামলাগুলো পরিচালনা করে।

জাপানি ভাষায় কামিকাযে মানে হচ্ছে ‘ঐশ্বরিক হাওয়া’। এই ধারণাটির সূত্রপাত মূলত ১৩ শতকে, যখন মঙ্গোলীয়রা জাপানে হানা দেয়ার চেষ্টা করে। কুবলাই খানের নেতৃত্বে যখন মঙ্গলীয় বাহিনী জাপানে আক্রমণ করার চেষ্টা করে, তখন একটি বিশাল টাইফুনের আঘাতে তাদের প্রচেষ্টা বিফল হয়ে যায় ও জাপান বহিরাক্রমণ থেকে রক্ষা পায়। তারা ধারণা করেছিল, ঈশ্বর তাদের মিনতি শুনে স্বর্গ থেকে এই সাহায্য পাঠিয়েছে। পরবর্তীতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় আত্মঘাতী বিমান হামলাকে কামিকাযে নাম দিয়ে তারা এই নতুন যুদ্ধকৌশল হাতে নেয়।

একজন কামিকাযে পাইলট; Image Source: gettyimages.com

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের যুদ্ধবিমান চালকেরা ছিলেন বেশ অভিজ্ঞ। জীবনের অনেক বছর তারা সামরিক বিমান চালিয়ে পার করেছিলেন। প্রায় ৫০০ ঘণ্টার প্রশিক্ষণ নিয়ে তারা একেকজন অত্যন্ত দক্ষ পাইলটে পরিণত হয়েছিলেন। কিন্তু কামিকাযে বিমান চালকেরা ছিল তরুণ ও অনভিজ্ঞ। তাদের বেশিরভাগেরই বয়স ২৪ এর কম। তাছাড়া প্রশিক্ষণ পেয়েছিল মাত্র ৪০-৫০ ঘণ্টার, যা অন্যান্য দক্ষ ও অভিজ্ঞ পাইলটদের তুলনায় কিছুই না। এরকম বৃহৎ মাত্রার যুদ্ধ প্রচেষ্টার জন্য প্রস্তুতি হিসেবে এটা মোটেও যথেষ্ট ছিল না। এমনকি এই বিমান চালকদের বেশিরভাগই ছিল ছাত্র, কৃষক, সামান্য মজুর ও সামরিক বাহিনীতে মাত্র যোগ দেয়া কয়েকজন অল্প বয়স্ক তরুণ। শুধুমাত্র নিজেদের মাতৃভূমিকে বহিরাক্রমণ থেকে রক্ষার জন্য ডাক পাওয়ার সাথে সাথে তারা যুদ্ধে অংশ নেয় এবং নিজেদের জীবন উৎসর্গ করার ব্যাপারে দ্বিধাবোধ করেনি। জাতি হিসেবে জাপানীদের মধ্যে আত্মসম্মানবোধ ও দেশপ্রেম অনেক বেশি। তাই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তারা তাদের যেকোনো শত্রুকে দমন করার জন্য যেকোনো প্রচেষ্টা চালানোর কথা ভাবতো।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কামিকাযে পাইলটগণ; Image Source: bbc.com

পার্ল হারবারে হামলার আগে জাপানী পাইলটরা তাদের মৃত্যুর শেষ প্রস্তুতি নেয়। তাদের লেখা শেষ চিঠির পাশাপাশি অল্প একটু চুল কিংবা নখ খামের ভিতর পুরে তারা তাদের প্রিয়জনদের জন্য রেখে যায়, যাতে তারা এগুলো শেষকৃত্যে ব্যবহার করতে পারে। শিন্তো মন্দিরে মিনতি সেরে সাকে (Sake) পান করে তারা তাদের মিশনের উদ্দেশ্যে রওনা করে। এত প্রস্তুতি দেখে মনে হতে পারে, তারা হয়তো কোনো আত্মঘাতী মিশনে যাচ্ছে। কিন্তু পার্ল হারবারের হামলাটি আত্মঘাতী কিংবা কামিকাযে হামলা ছিল না। তাদের বাঁচা-মরা ছিল ভাগ্যের হাতে।

গর্ডন প্রাংগের লেখা প্রামাণিক কাহিনী ‘অ্যাট ডন উই স্লেপ্ট: দ্য আনটোল্ড স্টোরি অব পার্ল হারবার’- এ জাপানী প্রথম লেফটেন্যান্ট ফুসাতা ইদার কথা উল্লেখ করা আছে। ইদা তার সাথে থাকা বাকি পাইলটদের উদ্দেশ্যে বলেছেন, “ঝামেলা হলে আমি কোনো জরুরি অবতরণ না করে সরাসরি আমার লক্ষ্যবস্তুর দিকে উড়ে যাবো এবং সংঘর্ষ ঘটাবো।” পার্ল হারবারে আক্রমণের একপর্যায়ে ইদা লক্ষ্য করেন, শত্রুপক্ষ তার বিমানের তেলের ট্যাঙ্কে গুলি করেছে। শত্রুর কাছে ধরা দেয়ার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা ছিল না তার এবং বিমান নিয়ে ফিরে আসারও কোনো আশাও তিনি দেখছিলেন না। তাই তিনি তার পরিকল্পনা অনুসারে আত্মঘাতী হয়ে শত্রুর একটি লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করার চেষ্টা করেন। কিন্তু সামান্য ভুলের কারণে ব্যর্থ হয়ে পাশের একটি পাহাড়ের উতরাইয়ে মারাত্মকভাবে বিমানসহ ভূপাতিত হন। এভাবে বেশ কয়েকজন পাইলট আত্মঘাতী হয়ে আক্রমণ করার চেষ্টা করেন। এতে বেশ ক্ষতিসাধনও হয়েছিল। কিন্তু এটি তাদের মিশনের উদ্দেশ্য ছিল না। প্যাসিফিক বিমান পরিবহন জাদুঘর পার্ল হারবারের একজন ইতিহাসবিদ বার্ল বার্লিনগেইমের মতে, সেদিনকার পাইলটরা যে ধরা দেয়ার পরিবর্তে জীবন উৎসর্গ করতে প্রস্তুত ছিল, তা স্বেচ্ছায় আত্মহত্যা থেকে একেবারে ভিন্ন। অর্থাৎ কামিকাযে থেকে ভিন্ন। তার মতে, ফুসাতা ইদা একজন কামিকাযে পাইলট ছিলেন না।

১৯৪৪ সালের মাঝামাঝি নাগাদ জাপানের বিমান বাহিনীতে অভিজ্ঞ পাইলট, আধুনিক বিমান ও তেলের খুব অভাব দেখা দিয়েছিল। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকার একেকটি দ্বীপ দখল করে যাচ্ছিলো ও জাপানের কাছে এগিয়ে যাচ্ছিলো। অবস্থা আরো বেগতিক হলো যখন যুক্তরাষ্ট্র জাপানের সাইপান দ্বীপটি দখলে নিল। এতে করে জাপান মারাত্মক ঝুঁকিতে পড়ে গিয়েছিল। তারা দেখলো, যুদ্ধটি তাদের হাতের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে এবং তাদের কোনো আক্রমণই যুক্তরাষ্ট্রকে দমাতে পারছে না। তখন তারা সিদ্ধান্ত নিলো, তাদের পাইলটদেরকে কামিকাযে পাইলটে রূপান্তরিত করা দরকার। এভাবে শত্রুপক্ষের প্রচন্ড ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা আছে বলে তারা মনে করলো। জাপানের নৌবাহিনীর ক্যাপ্টেন মোতোহারু ওকামুরার মতে, জাপানী কামিকাযে পাইলটরা মৌমাছির মতো শত্রুপক্ষের উপর আক্রমণ চালাবে। জাপানের শেষ আশা ছিল এই কামিকাযে পাইলটরাই।

মিত্রশক্তির বিমান পরিবহন জাহাজে কামিকাযে আক্রমণ; Image Source: dailymail.co.uk

কামিকাযে আক্রমণের সূচনা ঘটে ব্যাটল অব লেইটে গালফে, যা সংঘটিত হয় ১৯৪৪ সালের অক্টোবরে। ১৯৪৫ সালে ব্যাটল অব ওকিনাওয়ায় কামিকাযে আক্রমণ তুঙ্গে উঠে ছিল। শুধুমাত্র এই একটি সংঘর্ষে যে পরিমাণ ক্ষতিসাধন হয়েছিল, তা আর কখনো আমেরিকার নৌবাহিনী বহন করেনি। প্রায় ৫ হাজার মানুষ ওকিনাওয়ার সংঘর্ষে প্রাণ হারায়।

প্রচন্ড ত্যাগ-বিসর্জন জড়িত থাকা সত্ত্বেও মাত্র ১৪ থেকে ১৯ শতাংশ কামিকাযে বিমান তাদের লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করতে সফল হয়। বাকিগুলো শত্রুপক্ষের পাল্টা প্রতিরোধে ভূপাতিত হয় অথবা পাইলটের ভুলের কারণে লক্ষ্যভেদে অক্ষম হয়। তাদের সফলতার হার অনেক কম ছিল। কিন্তু তবুও জাপানের ইতিহাসের পাতায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অন্যতম ভয়ানক অস্ত্র বা যুদ্ধকৌশল হিসেবে কামিকাযে হামলাকে গণ্য করা হয়। কামিকাযে পাইলটরা তাদের জীবন উৎসর্গ করে মিত্রশক্তির মোট ৪৭টি যুদ্ধজাহাজ ডুবিয়ে দিতে সক্ষম হয় এবং আরও ৩০০টির গুরুতর ক্ষতিসাধন করে। 

কামিকাযে আক্রমণে গুরুতরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত অংশ; Image Source: dailymail.co.uk

কামিকাযে পাইলট হওয়ার জন্য নিয়োগ পাওয়া একজন হিসাও হোরিয়ামা। তিনি দ্য গার্ডিয়ানকে বলেছেন,

“আমরা মৃত্যু নিয়ে খুব বেশি চিন্তা করিনি। আমরা নিজেদের আবেগ দমিয়ে রাখার জন্য প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ছিলাম। এমনকি আমরা যদি মারা যাই, তাহলে আমরা জানতাম যে একটি উপযুক্ত কারণে আমরা মারা যাচ্ছি। আমাদের কর্তব্য পরিপূর্ণ করার চূড়ান্ত অংশ হচ্ছে মৃত্যু এবং আমাদেরকে ফিরে না আসার নির্দেশ দেয়া হয়েছিলো। আমরা জানতাম, আমরা যদি জীবিত ফিরে আসি, তাহলে আমাদের পরিচালকরা রাগ করবেন আমাদের উপর।”

তখন হোরিয়ামার বয়স ছিল মাত্র ২১ বছর। তার কাছে সম্রাট ও দেশের মানে একই ছিল। তিনি তার সম্রাট ও যুদ্ধে দেশের জয়লাভের জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করতে প্রস্তুত ছিলেন।

১৯৪৫ সালের জানুয়ারি মাসের মধ্যেই প্রায় ৫০০টি কামিকাযে বিমান যুদ্ধে অংশ নেয় এবং যুদ্ধের শেষ নাগাদ প্রায় ৩,৮০০ জন পাইলট আত্মত্যাগ করেন। তাদের চেষ্টা হয়তো পুরোপুরি সফল হয়নি, কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের নৌ বাহিনীর উপর অন্য মাত্রায় ক্ষতিসাধন করতে সক্ষম হন তারা।

This Bangla article is about the Japanese Kamikaze attack during world war 2 against the allied forces. Necessary references have been hyperlinked.

Feature Image: gettyimages.com 

Related Articles