আমাদের একমাত্র লক্ষ্য পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ভোক্তা-কেন্দ্রিক কোম্পানি হিসেবে নিজেদের উপস্থাপন করা, যেখান থেকে গ্রাহকরা চাইলেই যেকোনো জিনিস অনলাইনের মাধ্যমে ক্রয় করতে পারবে।
নিজের বিলিয়ন ডলারের কোম্পানির যাত্রার প্রথমদিকে জেফ বেজোস বলেছিলেন এই কথাটি। তিনি কতটুকু তার লক্ষ্যে পৌঁছাতে পেরেছেন, তা বিশ্বসেরা চার প্রযুক্তি কোম্পানির একটির দিকে তাকালেই উপলব্ধি করা যায়। বলছি, অনলাইনভিত্তিক পণ্য কেনাবেচার প্রতিষ্ঠান আমাজনের কথা। চাইলেই যেখানে কোনো জিনিস খুব সহজে কেনা যায়, এমনকি কেনা পণ্যটি বাসায় পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্বও পালন করে কর্তৃপক্ষ।
পণ্য বেচাকেনার মধ্যেই কোম্পানিটি সীমাবদ্ধ নয়; ইলেকট্রিক্যাল পণ্য তৈরি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে পদক্ষেপ, মহাশূন্যে সফল সাব-অরবিটাল রকেট প্রেরণ ইত্যাদি অনেক কাজ করে ফেলেছে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার মাত্র দুই যুগের মধ্যে। কিন্তু সামান্য অনলাইন বুক স্টোর থেকে কীভাবে এত বড় পর্যায়ে পৌঁছালো আজকের অ্যামাজন?
সম্ভবনাময় জেফ
টেক্সাসের রেন্সে জন্ম নেওয়া জেফ বেজোস সেই ছোটবেলা থেকেই পরিশ্রমের মূল্য বুঝতেন। প্রযুক্তি প্রবণতাও সেই সময় থেকেই গেঁথে গিয়েছিল মাথায়। স্কুলে থাকাকালীন সময়েই পান প্রথম কম্পিউটারের স্বাদ। টমাস আলভা এডিসন কিংবা ওয়াল্ট ডিজনির মতো উদ্ভাবনী উদ্যোক্তার মতো মনোভাব ছিল মাধ্যমিক স্কুলে থাকাকালীন সময়েই, যা ‘ড্রিম ইন্সটিটিউট’ নামের একটি কোম্পানি তৈরিতে প্ররোচিত করে। গ্রীষ্মকালীন ছুটিতে দুই সপ্তাহের জন্য পঞ্চম এবং ষষ্ঠ গ্রেডের ছেলেমেয়েদের বিভিন্ন ধরনের শিক্ষা বিষয়ক কর্মকাণ্ডের আয়োজন করতো এই কোম্পানিটি। তিনি প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটিতে ভর্তির আগপর্যন্ত কোম্পানিটি বেশ ভালোভাবেই চলছিল।
১৯৮৬ সালে জেফ বেজোস প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্নাতক সম্পন্ন করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন সময় প্রোগ্রামার, অ্যানালিস্ট হিসেবে বিভিন্ন গ্রীষ্মকালীন চাকরির অভিজ্ঞতা তাকে বড় বড় কিছু কোম্পানিতে চাকরির সুযোগ করে দেয়। তবে জেফ ‘ফিটেল’ নামের একটি সদ্য প্রতিষ্ঠিত প্রযুক্তি কোম্পানিতে যোগ দেন। কোম্পানিটি বিভিন্ন কম্পিউটার একসাথে সংযুক্ত করার জন্য একটি সুস্থিত সিস্টেম তৈরির কাজে নিয়োজিত ছিল, যেখানে জেফের কাজ ছিল একটি কমিউনিকেশন প্রটোকল তৈরি করা। তবে বেশ দ্রুতই তিনি ফিটেল ত্যাগ করেন এবং ওয়াল স্ট্রিটের ব্যাংকার্স ট্রাস্ট সহ আরো কয়েকটি কোম্পানিতে কাজ করার সুযোগ পান। ১৯৯০ সালে তিনি D.E Show নামের একটি ইনভেস্টমেন্ট ফার্মে যোগ দেন এবং অল্প সময়ের মধ্যে তরুণ ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিযুক্ত হন।
ইন্টারনেট প্রযুক্তি এবং উদ্ভাবনী জেফ
নব্বইয়ের দশকের প্রথম দিকে ইন্টারনেট শুধুমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়, রিসার্চ ল্যাব এবং সরকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে তথ্য আদান-প্রদানের কাজে বেশি ব্যবহৃত হলেও, বেশ দ্রুত জনপ্রিয়তা লাভ করতে থাকে। সে সময় ইন্টারনেটের বাৎসরিক ক্রমবিকাশ ছিল প্রায় ২,৩০০ শতাংশ। প্রযুক্তির প্রতি আলাদা আকর্ষণ থাকার কারণে ইন্টারনেটের সম্ভাব্য কার্যক্ষমতা উদঘাটনের কাজে জেফ বেজোস বেশ উঠেপড়ে লাগেন। খুব অল্প সময়ের মধ্যে দূরদর্শী মানুষটি বুঝে যান, ভবিষ্যৎ ব্যবসা-বাণিজ্য পুরোটাই ইন্টারনেটের উপর নির্ভর করছে।
১৯৯৬ এর দিকে D.E. Show বেশ কয়েকটি ইন্টারনেটভিত্তিক সার্ভিস প্রদান শুরু করে, যার মধ্যে ‘জুনো’ নামের একটি ফ্রি ইমেইল সার্ভিস এবং ‘ফারসাইট’ নামের ব্যক্তিগত ফাইন্যান্স সার্ভিস বেশ দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। সার্ভিসগুলো তৈরির প্রথমদিকে জেফ তার ইন্টারনেটভিত্তিক পণ্য বেচা-কেনার আইডিয়াটি খুঁজে পান।
প্রাথমিক অবস্থায়, জেফ অনলাইনের মাধ্যমে বিক্রি করতে পারবেন এমন সব পণ্যের তালিকা তৈরি করতে থাকেন। সিডি, সফটওয়্যার, হার্ডওয়ারের মতো পণ্যগুলো প্রথমাবস্থায় অগ্রাধিকার পেলেও, বই বিক্রির মাধ্যমে যাত্রা শুরু করবে বলে সিদ্ধান্ত নেন তিনি। কেননা, বুক-স্টোরগুলোতে সব রকমের বই খুঁজে পাওয়া বেশ দুঃসাধ্য এবং সব রকমের বই তালিকাভুক্ত না থাকায় কাস্টমাররা প্রায় লম্বা সময় বই খোঁজার কাজে ব্যয় করেন। প্রাথমিকভাবে জেফের আইডিয়াটি ছিল, সব রকমের বইয়ের তালিকা সম্বলিত একটি ওয়েবসাইট তৈরি করা, যেখানে যেকোনো ইন্টারনেট ব্যবহারকারী খুব দ্রুত পছন্দের বইটি খুঁজে ই-মেইলের মাধ্যমে অর্ডার করতে পারবেন। তাছাড়া, সে সময় অনলাইনভিত্তিক ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের শারীরিক উপস্থিতি না থাকায়, মেইল-অর্ডারের মাধ্যমে পণ্য বিক্রির জন্য কোনো রকমের ট্যাক্স দিতে হতো না, যা জেফের কাছে বেশ বড় রকমের সুবিধা হিসেবে দৃষ্টিগোচর হয়।
জেফ তার আইডিয়াটি D.E. Show এর পরিচালনা কমিটির কাছে উপস্থাপন করে, কিন্তু কর্তৃপক্ষ সেটি সরাসরি প্রত্যাখ্যান করে, যা জেফকে বড় মাইনের সুস্থিত চাকরি ছেড়ে নিজের কোম্পানি শুরু করার মতো ঝুঁকিপূর্ণ কাজের দিকে ধাবিত করে। ১৯৯৪ সালে বেজোস D.E Show ছেড়ে সিয়াটলের উদ্দেশ্যে পাড়ি জমান এবং আমাজনের কার্যক্রম শুরু করেন।
নামকরণসহ বাস্তবায়নের প্রাথমিক ধাপ
চারপাশে প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করা প্রতিভাধরদের আনাগোনা থাকায় আমাজনের প্রাথমিক কার্যক্রম শুরু করার জন্য সিয়াটল ছিল জেফ এবং তার কোম্পানির জন্য আদর্শ জায়গা। প্রথমদিকে, নিজের বাড়ির গ্যারেজে সাময়িক অফিস খুলে বসেন তিনি। দিনের পর দিন নানা বিনিয়োগকারী কোম্পানির সাথে আলোচনা করাসহ অনলাইন বুক স্টোরের আইডিয়াকে বাস্তবে পরিণত করার জন্য সম্ভাব্য পরিকল্পনাগুলো গুছিয়ে নেন। সে সময় নিজের আয়ের সাথে পরিবার এবং বন্ধুদের কাছ থেকে প্রায় এক মিলিয়ন ডলার যুক্ত করতে সক্ষম হন, যা কোম্পানি শুরু করার জন্য পর্যাপ্ত ছিল।
১৯৯৪ সালের ৪ জুন পরিকল্পনা মোতাবেক ‘কাডাব্রা’ নামের কোম্পানির যাত্রা শুরু হয়। যদিও জেফের আইনজীবী একবার ‘কাডাভার’ সাথে ‘কাডাব্রা’কে গুলিয়ে ফেলার কারণে মাত্র এক বছরের মধ্যে পুনরায় কোম্পানিটির নামকরণ করা হয়। স্টার-ট্রেক সিরিজের ভক্ত জেফ, ক্যাপ্টেন পিচার্ডের ব্যবহৃত উদ্ধৃতি ‘মেইক ইট সো’ ব্যবহার করেও ডট কম ডোমেইন কেনেন। এমনকি aard.com, browse.com, bookmall.com, awake.com, relentless.com এর মতো ডোমেইনও কোম্পানিটির জন্য বাছাই করা হয়, যেগুলোর কারণে সার্চ ইঞ্জিনে আমাজনের অবস্থান প্রথম পৃষ্ঠায় থাকতো। বর্তমানে রিলেন্টলেস ডট কম আমাজনের মূল সাইটের সাথে রিডিরেক্ট করা। সর্বশেষে কোম্পানিটির জন্য প্রসিদ্ধ একটি নামের খোঁজে ডিকশনারিতে ‘A’ দিয়ে শুরু এমন শব্দগুলো দেখতে দেখতেই ‘আমাজন’ নামকরণের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হয়। পৃথিবীর সবচাইতে বড় নদীর নামের সাথে মিল রেখে নিজের স্বপ্নে বৃদ্ধি পেতে থাকা পৃথিবীর সবচাইতে বড় বুক স্টোরের নাম রাখা জেফের জন্য বেশ যুক্তিসঙ্গতই ছিল।
এরপর পুরো এক বছর বাড়ির গ্যারেজে জেফ বেজোস এবং আরো পাঁচ কর্মী নিয়ে চলতে থাকে আমাজনের বাস্তবায়নের কাজ। যেহেতু পুরো ব্যাপারটিই অনলাইন ভিত্তিক অ্যাপ্লিকেশনের মাধ্যমে পরিচালিত হবে, সেহেতু বুক স্টোরের জন্য প্রসিদ্ধ একটি কম্পিউটার প্রোগ্রাম তৈরি করাই ছিল ইঞ্জিনিয়ারদের জন্য সবচাইতে চ্যালেঞ্জিং ব্যাপার। একজন প্রসিদ্ধ কম্পিউটার প্রোগ্রামার, সত্যিকারের মার্কেটিং ভিশনারি হিসেবে জেফ ভোক্তাদের জন্য ইউজার-ফ্রেন্ডলি ইন্টারফেস তৈরির ব্যাপারে তার সর্বোচ্চটুকু দেওয়ার চেষ্টা করছিল। যেহেতু বুক স্টোর মানেই পাঠকদের সমাবেশ, সেহেতু জেফ চাইছিলেন প্রোগ্রামটি শুধু বই বিক্রির না হয়ে পাঠক সমাবেশ হিসেবেও উপস্থাপিত হবে, যেখানে পাঠকরা নির্দিষ্ট বই নিয়ে আলোচনা করবে, কোনো বই পড়ার পর নিজের মতামত প্রকাশ করবে, এমনকি পাঠকদের পূর্বে ক্রয় করা বইগুলোর উপর ভিত্তি করে সিস্টেমটি নতুন বই সুপারিশ করার কাজটিও করবে। বর্তমানে এ ধরনের ফিচারগুলো বেশ পরিচিত হলেও ১৯৯৪ সালের বিবেচনায় বেশ উদ্ভাবনী ফিচার হিসেবেই সুপ্রতিষ্ঠিত ছিল।
যাত্রা হলো শুরু
যখন সবকিছু গুছিয়ে এসেছে, জেফ ৩০০ জন বেটা-ইউজারকে সার্ভিসটি ব্যবহারের জন্য নিয়োজিত করেন। তিনি চাইছিলেন, ওয়েবসাইটটি প্রকাশের পূর্বে বিভিন্ন কম্পিউটার সিস্টেমে ওয়েব-অ্যাপগুলো ঠিকঠাক মতো চলছে কি না তা নিশ্চিত হতে।
সবকিছু ঠিকঠাক থাকায়, ১৯৯৫ সালের ১৬ জুলাই ‘পৃথিবীর সবচাইতে বড় বুক-স্টোর’ হিসেবে নিজেদের ঢাক পিটিয়ে আমাজন তাদের ভার্চুয়াল দরজা সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেয়। সে সময় অফিসে একটি বেল স্থাপন করে কর্মচারীদের বলে দেওয়া হয়, প্রত্যেকটি বই বিক্রির পরপরেই যেন একবার করে ঐ বেল বাজানো হয়। কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যে আমাজনে বই বিক্রির বিস্ফোরণ সেই বেলকে অপ্রয়োজনীয় করে তোলে। প্রায় এক মিলিয়ন শিরোনামের বিশাল সংগ্রহ, সবচাইতে উৎকৃষ্ট কাস্টমার সার্ভিস, ইউজার-ফ্রেন্ডলি ওয়েবসাইট নিয়ে মাত্র আড়াই মাসের মধ্যে আমাজন আমেরিকার পুরো পঞ্চাশটি অঙ্গরাজ্যসহ পৃথিবীর প্রায় ৪৫টি দেশে বই বিক্রি করে। সেপ্টেম্বর নাগাদ সপ্তাহে গড়ে ২০ হাজার ডলারের বিশাল অংকের রেকর্ড সংখ্যক বই বিক্রির রেকর্ড তৈরি হয়, অনলাইনের মাধ্যমে যা কল্পনাও করা যেত না।
ভবিষ্যতের দিকে আরো এক ধাপ
১৯৯৬ এর দিকে বই বিক্রির পরিমাণ বাড়ার সাথে সাথে জেফ কোম্পানিটির আইপিও সর্বজনীন করার ব্যাপারেও মনস্থির করতে থাকেন। কেননা, গ্রাহকদের বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠার সাথে সাথে ব্যবসার সবচাইতে বড় প্রতিযোগী বার্নস এন্ড নোবেলকে টেক্কা দিতেও এর প্রয়োজন ছিল। সে সময় আমাজনের মূল সম্পত্তির পরিমাণ যেখানে মাত্র ১৬ মিলিয়ন ডলার, বার্নস এন্ড নোবেল সেখানে ২ বিলিয়ন ডলারের পৃথিবীর সবচাইতে বড় বই প্রকাশনা এবং বিক্রয় সংস্থা হিসেবে বিপ্লব ঘটিয়েছে।
আমাজনের আইপিও সর্বজনীন করা সহ কোম্পানিটিকে আরো বেশি এগিয়ে নিতে আরো কর্মী এবং চৌকস কিছু মানুষকে নিয়োগের প্রয়োজন হয়ে পরে। সে সময় আমাজন বড় বড় কোম্পানি, যেমন- DESCO’র কর্মী, বার্নস এন্ড নোবেলের সাথে প্রতিযোগিতায় রয়েছে এমন প্রকাশনী সংস্থার এক্সিকিউটিভ, সিমেন্টিক সফটওয়ার কোম্পানি থেকে প্রোগ্রামার নিয়োগ দিতে থাকে। এমনকি, মাইক্রোসফট থেকেও দুজন কর্মী, জুয়েল স্পিয়েজেল এবং ডেভিড রিশারের মতো অসাধারণ মানুষগুলোও আমাজনে যোগ দেন, যারা পরবর্তীতে আমাজনের ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং হেড অফ রিটেইল হিসেবে উন্নীত হন।
বার্নস এন্ড নোবেল সমস্যা এবং ব্যবসায়িক মডেলে পরিবর্তন
আমাজনের এই ভিন্নধর্মী ব্যবসায়িক ক্রয়-বিক্রয়ের মাধ্যমে উত্থান সবার মতো বার্নস এন্ড নোবেলের চোখেও পড়ে। প্রকাশনা সংস্থাটির অধিকর্তা লিওনার্দো রিজ্ঞিইও এবং স্টিভ রিজ্ঞিইও সিয়াটলে আসেন জেফের সাথে ব্যবসায়িক কারবার নিয়ে আলোচনা করতে। প্রথমদিকে, দুই ভাই আমাজনের সাথে যৌথভাবে কাজ করার ইচ্ছা পোষণ করেন। বিভিন্ন ধরনের প্রস্তাবও দেওয়া হয় জেফ এবং আমাজনের পরিচালনা কমিটির ডিরেক্টর টম আলবার্গকে। তারা চাইছিল, আমাজনের ওয়েব অ্যাপ্লিকেশন প্রযুক্তির লাইসেন্স নিজেদের নামে করা সহ ওয়েবসাইটটি যৌথ প্রযোজনায় পরিচালনা করতে। কিন্তু জেফ এবং টম জানান, তারা বিষয়টি ভেবে দেখবেন।
তখন দুই ভাই নানাভাবে তাদের হুমকি ধামকি দেন এবং জানান, অতিশীঘ্রই তারা নিজেদের ওয়েবসাইট খুলতে যাচ্ছেন, যা আমাজনকে প্রতিযোগীতার বাইরে ফেলে দিবে। আর সে সময় বাস্তবতা ছিল, বার্নস এন্ড নোবেলের মতো বিশাল বইয়ের সাম্রাজ্যের অধিকর্তারা চাইলে তা পারতো। কিন্তু সে সময় আমাজন ছিল আরো একধাপ এগিয়ে। নতুন ব্যবসায়িক মডেল নিয়ে তাদের চিন্তা ইতিমধ্যে শুরু হয়ে গিয়েছিল।
রিজ্ঞিইও ব্রাদার্স যখন তাদের ওয়েবসাইট তৈরিতে ব্যস্ত, জেফ বেজোস এবং আমাজনের চিফ ফাইনান্সিয়াল অফিসার জয় কভে, আমেরিকা এবং ইউরোপের নানা দেশে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন। এই ভ্রমণ চলেছিল এপ্রিলের শেষ সপ্তাহ থেকে সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি পর্যন্ত। লম্বা সময়ের এই ভ্রমণে তারা নানা জায়গার সম্ভাব্য বিনিয়োগকারী, খুচরা বিক্রেতাদের সাথে সাথে আলোচনায় বসেন। তিন বছরের মধ্যে মিলিয়ন ডলারের বিক্রির মতো সলিড ব্যাকগ্রাউন্ড থাকায় প্রায় অধিকাংশ বিনিয়োগকারী কোম্পানির সাথে আলোচনা করার সুযোগ পায়। সে সময় দুজন ‘নেগেটিভ অপারেটিং সাইকেল’ নামের নতুন একটি পদ্ধতি চালু করতেও কাজ করছিলেন, যেখানে গ্রাহকদের পণ্য পৌঁছানোর পরে ক্রেডিট কার্ড থেকে পণ্যের মূল্য পরিশোধ হবে। তবে, অনেক সম্ভাব্য বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে জেফ সবচাইতে বেশি যে প্রশ্ন শুনেছিলেন তা হচ্ছে, "বইয়ের পাশাপাশি অন্য কোনো পণ্য কোম্পানিটি বিক্রি করার চিন্তা করছে কি না?" উত্তরে জেফ প্রত্যেকবারই বলেছিলেন, আমাজন শুধুমাত্র বই বিক্রির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকতে চাইছে। সেই কারণে অনেক বিনিয়োগকারীই আমাজনে বিনিয়োগ করা থেকে বিরত থাকেন। তাদের ধারণা ছিল, বার্নস এন্ড নোবেল ওয়েবসাইট চালু করার সাথে সাথেই আমাজনের দিন শেষ হয়ে আসবে। আর এদিকে জেফের অন্য পণ্য বিক্রির পরিকল্পনা থাকলেও বিনিয়োগকারীদের কাছে বলতে আগ্রহী ছিলেন না। তিনি চাইছিলেন না, কেউ তাদের পদক্ষেপ অনুসরণ করে প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে তৈরি হোক।
১৯৯৭ সালের ১২ মে, আমাজনের আইপিও সর্বজনীন হওয়ার মাত্র তিন দিন আগে, ‘পৃথিবীর সবচাইতে বড় বুক স্টোর’ এর মতো মিথ্যা দাবি করায় বার্নস এন্ড নোবেল আমাজনের বিরুদ্ধে ফেডারেল কোর্টে মামলা করে। এটি এমন একসময় ঘটে, যখন জেফ বেজোসের উপর আইপিও পাবলিকের পূর্বে মিডিয়াতে এক সপ্তাহের জন্য কথা বলার উপর নিষেধাজ্ঞা ছিল। হাস্যকরভাবে, ঐ মামলার ফলে আমাজনের উপর পুরো পৃথিবীর মনোযোগ আরো বাড়ে।
আমাজনের আইপিও সর্বজনীন হওয়ার পর পুরো এক বছরের মতো বার্নস এন্ড নোবেলের সাথে কঠিন প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলে। একদিকে বার্নস এন্ড নোবেলের বইয়ের বিশাল ক্যাটালগে আরো বেশি শিরোনাম যুক্ত হওয়া এবং অপরদিকে স্বাধীন ডিলার ও অ্যান্টিক বইয়ের ক্রয়-বিক্রয়ের উপর আমাজনের মনোযোগ। সব মিলিয়ে দুই পক্ষ দুই দিক থেকেই নিজেদের অবস্থান জোরালোভাবে ধরে রেখেছিল। এর মধ্যে বার্নস এন্ড নোবেল জার্মানি মিডিয়া জায়ান্ট বার্টেলসম্যান থেকে ২০০ মিলিয়ন ডলারের বিশাল বিনিয়োগ সাথে নিয়ে আইপিও সার্বজনীন করে। অপরদিকে, আমাজন “Earth’s Biggest Bookstore” থেকে পরিবর্তিত হয়ে “Books, Music and More” শ্লোগানে নিজেদের ব্যবসায়িক মডেলে পরিবর্তন আনে এবং বইয়ের সাথে সাথে অন্যান্য পণ্য বিক্রিও শুরু করে।
আমাজনের উত্থান
আইপিও সর্বজনীন হওয়ার পর স্টক ট্রেডের মূল্য আইপিওর মূল্যের চাইতে দ্রুতগতিতে কমতে থাকে, যা আমাজনকে দেউলিয়া করে দিতে পারতো। কিন্তু মাত্র তিন দিন পর, ১৫ মে, আইপিও দিবসে স্টকগুলো মূল্য ১২ ডলার থেকে ১৪ ডলারে গিয়ে স্থির হয়। এর পরপরই তা বেড়ে ১৬ ডলারে পৌঁছায় এবং ১৮ ডলারে গিয়ে স্থির হয়। সে সময় আমাজন আইপিও থেকে ৫৪ মিলিয়ন ডলার লাভ করে এবং বুক স্টোর হিসেবে ৪৩৮ মিলিয়ন ডলারের কোম্পানি হিসেবে মাথা উঁচু করে দাঁড়ায়। কোম্পানিটি ৩ মিলিয়ন শেয়ার নিজেদের কাছে রেখে বাকিগুলো ছেড়ে দেয়। বছর শেষে দেখা যায়, আমাজনের রাজস্বের বৃদ্ধি প্রায় ৯০০ শতাংশ, যা কেউ কল্পনাও করতে পারেনি।
প্রথমদিকে জেফ বেজোস ব্যাকআপ হিসেবে পরিবারের প্রত্যেক সদস্যের জন্য ১০ হাজার ডলারের স্টক কিনে রেখেছিলেন। কোম্পানির ছয় শতাংশ শেয়ার নিজেদের থাকায় নব্বইয়ের দশক শেষ হওয়ার আগেই পরিবারটি মাল্টি-মিলিয়ন ডলারের মালিক বনে যায়। ১৯৯৯ সালে টাইম ম্যাগাজিনে ‘পার্সন অফ দ্য ইয়ার’ হিসেবে জেফ বেজোসের স্থান হয়।
নতুন শতকে পদার্পণের আগেই জেফ বেজোস আমাজনের জন্য নতুন পরিকল্পনা শুরু করতে থাকেন, যা ছিল অনলাইন বুক স্টোর থেকে আরো বেশি কিছু। একবিংশ শতাব্দীর শুরুর সাথে সাথে নতুনত্বের হাতছানি, পৃথিবীব্যাপী গ্রাহক সংখ্যার বৃদ্ধির দিকে লক্ষ্য রেখে প্রযুক্তির উৎকর্ষতাকে কাজে লাগিয়ে গ্রাহক সেবাকে একধাপ এগিয়ে নিতে যেতে জেফ বেজোস বদ্ধপরিকর হন। মিলিয়নের গণ্ডি পেরিয়ে, আমেরিকা, কিংবা ইউরোপের সীমানা ছাড়িয়ে অতিশীঘ্রই কোম্পানিটির বিস্তৃতি ছড়াবে আরো বহুদূর, ঠিক আমাজন নদীর মতো!
This article is in Bangla language. It's about Jeff Bezos and rise of Amazon online bookstore. Necessary resources have been hyperlinked.
Featured Image: David Ryder/Getty Images