Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website. The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

বাংলাদেশের প্রথম রেলস্টেশন কুষ্টিয়ার জগতির সেকাল-একাল

ঝক ঝক ঝক ট্রেন চলেছে/রাত দুপুরে অই/ট্রেন চলেছে, ট্রেন চলেছে/ট্রেনের বাড়ি কই ?

ছোটবেলায় স্কুলের বইতে প্রথম যেদিন কবি শামসুর রাহমানের এই কবিতাটি পড়েছিলাম, ততদিনে আমি কয়েকবার ট্রেনে চড়েছি। কবিতাটি পড়ে প্রথমেই আমার যেটা মনে হয়েছিলো, আসলেই কি ট্রেনের বাড়িঘর আছে! এই নিয়ে আমার কোনো শিক্ষককে প্রশ্ন করেছিলাম কি না মনে নেই! তবে একটু বড় হবার পর জেনেছি, আমি যে জেলায় জন্মেছি এই জেলাতেই রয়েছে বাংলাদেশের প্রথম রেলস্টেশন। সেই ১৮৬২ সালের কথা; ১৫ নভেম্বরে প্রথম রেলগাড়ি চলেছিলো বর্তমানের বাংলাদেশ ভূখণ্ডে, থেমেছিলো কুষ্টিয়ায় জগতি রেলস্টেশনে।

১৮২৫ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর জর্জ স্টিফেনসনের আবিষ্কৃত বিশ্বের প্রথম স্টিম ইঞ্জিন রেলের যাত্রা শুরু হয়। ‘লোকোমোশান’ নামের সেই ট্রেনটি ব্রিটেনের স্টকটন থেকে ২৬ কিলোমিটার দূরের ডালিংটন পর্যন্ত গিয়েছিলো, প্রথম চালক ছিলেন জর্জ স্টিফেনসন নিজেই। ওই সময়টাতে বিশ্বজুড়েই যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে রেলপথের গুরুত্ব বাড়তে শুরু করে। ব্রিটিশ শাসনের অধীনে থাকা ভারতও এদিক দিয়ে পিছিয়ে ছিলো না। রাজনৈতিক ও ভৌগলিক সুবিধা এবং বাণিজ্যিক স্বার্থকে বিবেচনায় রেখে ব্রিটিশ সরকার সেই সময়েই ভারতে রেলপথ স্থাপনের পরিকল্পনা করেছিলো।

উপমহাদেশের প্রথম রেলপথ দিয়ে ট্রেন যাচ্ছে; Image source: herritage-history.com

কয়েক বছর পর ১৮৫৩ সালের ১৬ এপ্রিল পেনিনসুলার রেলওয়ে নামক কোম্পানির নির্মিত প্রথম যাত্রীবাহী বাষ্পচালিত ট্রেন ইঞ্জিন ভারতীয় উপমহাদেশে যাত্রা শুরু করে। মুম্বাইয়ের বোরিবন্দর থেকে থানে পর্যম্ত ৩৪ কিলোমিটার পথ পাড়ি দেয় ৪০০ জন যাত্রী নিয়ে। এর পরের বছর, অর্থাৎ ১৮৫৪ সালে পশ্চিমবঙ্গের হাওড়া থেকে হুগলি পর্যন্ত ৩৮ কিলোমিটার রেলপথ চালু করার মধ্য দিয়ে বাংলায় প্রথম রেলপথের সূচনা হয়। এরপর ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ে ১৮৬২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর পশ্চিম বাংলার রাজধানী কলকাতার শিয়ালদহ থেকে রানাঘাট পর্যন্ত ব্রডগেজ (৫ ফুট ৬ ইঞ্চি) রেলপথ চালু করে।

শিয়ালদহ থেকে রানাঘাট পর্যন্ত যে রেলপথ চালু করা হয়েছিলো, সেটাকে সেই বছরেই বর্ধিত করে বর্তমান কুষ্টিয়া জেলার (সাবেক নদীয়া) জগতি পর্যন্ত ৫৩.১১ কিলোমিটার দীর্ঘ করা হয়। তারপর ১৮৬২ সালের ১৫ নভেম্বর কলকাতার শিয়ালদহ থেকে কুষ্টিয়ার জগতি পর্যন্ত ট্রেন চলাচল শুরু হয়। পশ্চিম বাংলার গেদে–বাংলাদেশের দর্শনা সীমান্ত পার হয়ে সরাসরি ট্রেন এসেছিলো বর্তমান কুষ্টিয়া জেলা শহর থেকে ৩ কিলোমিটার দূরে জগতি পর্যন্ত।

অ্যাকশন ক্যামেরায় জগতি স্টেশন; Image credit: লেখক

ঢাকার সাথে কলকাতার যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজতর করার জন্য প্রায় ১০ বছর পর ১৮৭১ সালের ১ জানুয়ারি জগতি রেলস্টেশন থেকে বর্তমান রাজবাড়ী জেলার গোয়ালন্দ ঘাট পর্যন্ত ট্রেন চালু করা হয়। তখনকার সময় এই পথেই সহজে কলকাতা থেকে ঢাকা বা ঢাকা থেকে কলকাতা আসা-যাওয়া করা যেত। কলকাতা থেকে মানুষ ট্রেনে করে জগতি স্টেশন পার হয়ে গোয়ালন্দ ঘাটে নামত এবং স্টিমারে পদ্মা নদী পার হয়ে ঢাকায় চলে আসত।

মূলত তৎকালীন সময়ে ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য এই অঞ্চল বেশ গুরুত্বপূর্ণ হওয়ার আর কলকাতা-রানাঘাট রেলপথের বেশ কাছাকাছি হওয়ায় প্রথম রেল যোগাযোগ এদিক দিয়েই স্থাপন করা হয়। এরপর ১৯০৮ সালে কুষ্টিয়াতে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘মোহিনী মিল’, যেটা ছিলো সেই সময়ের সমগ্র এশিয়া মহাদেশের সবচেয়ে বড় কাপড়ের মিল। কলকাতার সাথে ভালো যোগাযোগ ব্যবস্থা থাকার কারণে এত বড় কাপড়ের কল এখানে চালু হতে পেরেছিলো।

স্বাধীনতার পূর্বে পাকিস্তানের সময়ে জগতিতে ‘কুষ্টিয়া চিনিকল’ প্রতিষ্ঠিত হলে সেখানে আখ সরবরাহের কাজে বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতো এই জগতি স্টেশন। কলকাতা থেকে কুষ্টিয়ার আশপাশের জেলাগুলোতে আসা ধান, পাট, গম, আখ কিংবা অন্যান্য পণ্যসামগ্রীও খালাস হতো এই জগতি স্টেশনেই। এসব কারণেই প্রতিষ্ঠার পরেই এই অঞ্চলের মানুষের কাছে ‘জগতি স্টেশন’ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। তখন ‘কয়লা’ পুড়িয়ে কালো ধোঁয়ার কুণ্ডলী পাকিয়ে ঝক ঝক শব্দে স্টিম ইঞ্জিনের (বাষ্পচালিত) রেলগাড়ি এসে এই স্টেশনে থামতো, রেলগাড়ি কেমন সেটা দেখতেও আশপাশের মানুষজনের ভিড় এখানে লেগেই থাকতো।

শুধুমাত্র লোকাল ট্রেন থামে। সবসময়ই প্রায় যাত্রীশূন্য থাকে; Image credit: লেখক

ব্রিটিশরা কুষ্টিয়ার জগতিতে রেলস্টেশন প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি আরো কিছু অবকাঠামো এখানে গড়ে তুলেছিলো। লাল ইট দিয়ে নির্মাণ করেছিলো দোতলা স্টেশন ভবন। এখন অবশ্য ঐতিহ্যমণ্ডিত এই স্টেশন ভবনটি এক রকম পরিত্যক্তই বলা যায়। ভবনে ফাটল ধরায় উপরতলাতে কেউ যায়নি বহুবছর। অনেকদিন আগেই যাত্রীদের সুবিধার জন্য তৈরি করা ওয়েটিং রুমও ভেঙে গেছে। আবার প্লাটফর্মের ইটও ভেঙে গেছে আর গাঁথুনিও ক্ষয়ে গেছে। স্টিম ইঞ্জিনে পানি দেওয়ার জন্য প্লাটফর্মের দুই পাশে নির্মাণ করা হয়েছিলো বড় দুটি ওভারহেড পানির ট্যাংক, সেগুলোও অনেকদিন আগেই পরিত্যক্ত হয়ে গেছে। এই ট্যাংক দুটিতে সেই সময় কয়লার ইঞ্জিনে চলা পাম্প দিয়ে মাটির নিচে থেকে পানি তোলা হতো।

অকেজো টেলিফোন; Image source: prothom-alo.com

তাছাড়া ঘরের ভেতরে সেই আমলের বেশ কিছু আসবাবপত্র নষ্ট হয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে। অকেজো টেলিফোন থেকে শুরু করে সেই সময়ে ব্যবহার হওয়া সব যন্ত্রাংশই এখন বাতিলের খাতায়। টিকিট কাটা ঘরের পরিত্যক্ত জানালা,  টাকা রাখার লকার, ট্রেনকে সিগন্যাল দিতে লকারের উপরে বসানো ল্যাম্প- সবই এখন স্মৃতি। আগে যেখানে স্টেশনজুড়ে জ্বলতো চকচকে আলো, চারদিকে গিজিগিজ করতো মানুষ, আবার গাড়ি থেকে মালপত্র ওঠানো আর নামানোর কাজে ব্যস্ত থাকতো কুলিরা, আজ সেখানে স্টেশনজুড়ে নির্জনতা, সন্ধ্যা হলেই ভূতুড়ে পরিবেশ।

জগতি স্টেশনের এই অচলাবস্থার মূল কারণ এখানে কোনো স্টপেজ না থাকা। কুষ্টিয়া শহরের দুটি রেল স্টেশন এখান থেকে মাত্র ২-৩ কিলোমিটার দূরে, আবার পোড়াদহ জংশনও জগতি থেকে খুব কাছে। এই স্টেশনে না থেমে এর ওপর দিয়ে চলে যায় রাজশাহী থেকে গোয়ালন্দ ঘাটগামী আন্তঃনগর ট্রেন মধুমতি এক্সপ্রেস আর রাজশাহী থেকে গোপালগঞ্জগামী টুঙ্গিপাড়া এক্সপ্রেস।

টিকিট কিনতে এখানে কেউ আর লাইন দেয় না; Image credit: লেখক

এখানে শুধুমাত্র স্টপেজ রয়েছে সরকারের লিজ দেয়া খুলনা থেকে গোয়ালন্দ ঘাটগামী মেইল ট্রেন নক্সিকাঁথা এক্সপ্রেস আর পোড়াদহ থেকে গোয়ালন্দ ঘাট চলাচলকারী শাঁটল ট্রেনের। এই দুটি ট্রেনের খুব অল্প সংখ্যক যাত্রী এই স্টেশন থেকে ওঠা-নামা করে। শুধুমাত্র ট্রেন আসার কিছু সময় আগে স্টেশন মাস্টারের ঘরটি খোলা পাওয়া যায়, আবার ট্রেন ছাড়ার পরেই সেটা বন্ধ হয়ে যায়। যাত্রী ছাউনিতে বসার কোনো ব্যবস্থা না থাকায় যাত্রীদের প্লাটফর্মের আশেপাশে দাঁড়িয়ে থাকা ছাড়া কোনো উপায় থাকে না।

প্রায় মাসখানেক আগে যখন খোঁজ নিয়েছিলাম, তখন এই স্টেশনে কর্মকর্তা-কর্মচারী ছিলো মাত্র পাঁচজন। এদের মধ্যে ছিলো একজন স্টেশন মাস্টার, তিনজন পয়েন্সম্যান আর একজন গেটম্যান। তাদের কথামতে, এখানে আরো ১২-১৩টি পদ দীর্ঘদিন ধরেই ফাঁকা রয়েছে। এই এলাকার বয়স্ক কয়েকজনের সাথে কথা বলে জানা যায়, তারা নাকি ছোটবেলায় ২০-২২ জন কর্মচারীকে ব্যস্ত দিন-রাত পার করতে দেখেছেন। রেলস্টেশনের সাথেই গড়ে উঠেছে জগতি বাজার, অল্প কিছু দোকানপাট রয়েছে সেখানে।

স্টেশনের সাথেই ছোট বাজার, রাস্তার দু’পাশেই দোকানপাট গড়ে উঠেছে; Image credit: লেখক

এখনও মাঝেমধ্যে এখানে ভারত থেকে কয়লা, পাথর নিয়ে আসা মালবাহী ট্রেনের দেখা পাওয়া যায়। একসময় স্টেশনের অনেক জমি থাকলেও এখন খুব বেশি জমি অবশিষ্ট নেই। বাংলাদেশ ভূখণ্ডের প্রথম স্টেশনটি একে একে পার করে ফেলেছে ১৫৬ বছর। অযত্ন, অবহেলায় ধীরে ধীরে বাতিল হতে থাকা এই স্টেশনটি রেলসেবা প্রদানের জন্য রেল মন্ত্রণালয়ের কাছে লাভজনক না হলেও ঐতিহাসিকভাবে জগতি স্টেশন অনেক গুরুত্ব বহন করে। তাই এর রক্ষণাবেক্ষণও জরুরি।

This Bangla article is about the first rail station of Bangladesh. All the required references are hyperlinked within the article.

Featured Image: Gowtam K Shuvo

Related Articles