Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

জুলিয়ান কেপকে: গভীর অরণ্যে ১১ দিন কাটানো এক কিশোরী

দিনকাল বেশ ভালোই যাচ্ছিল জুলিয়ান কেপকের। স্কুলের পাট চুকিয়ে মাত্র কয়েক ঘন্টা আগেই হওয়া প্রম নাইটের পরে হাতে এসেছে গ্র্যাজুয়েশনের সার্টিফিকেট। সামনেই বড়দিন। বাবার কাছে যাবার জন্য তাই মায়ের সাথে পেরুর পুকালপাগামী প্লেনে চড়ে বসেছিল। লানসা ফ্লাইট-৫০৮ বিমানের ১৯এফ সিটে বসার সময়ে কল্পনাও করতে পারেননি, সামনে তার জন্য কী অপেক্ষা করছে।

প্রথমে একটু পিছনে যাওয়া যাক। ১৯৫৪ সালের ১০ই অক্টোবর এক প্রাণীবিজ্ঞানী দম্পতির ঘরে জন্ম নেন জুলিয়ান। জার্মান হলেও পেশাগত কাজে তারা থাকতেন পেরুর রাজধানী লিমায়। সেখানে তারা গবেষণা করতেন গ্রীষ্মমন্ডলীয় এলাকার প্রাণীজগৎ নিয়ে। জুলিয়ানের বাল্যকাল কাটে মিরাফ্লোরেস নামে লিমার এক সম্ভ্রান্ত এলাকায়। বাবা-মায়ের দেখাদেখি তার নিজেরও বড় হয়ে প্রাণীবিজ্ঞানী হবার শখ ছিল।

মা-বাবার সাথে জুলিয়ান কেপকে; Source: Ranker

১৯৭১ সাসের ২৩ ডিসেম্বর স্কুলের পড়াশোনার পাট চুকিয়ে ফেলেন জুলিয়ান। বাবা হ্যান্স উইলহেম কেপকে অ্যামাজনিয়ান রেইনফরেস্ট নিয়ে গবেষণার কাজে ছিলেন পুকালপায়। একসাথে ছুটি কাটাবার জন্য তাই ২৪ ডিসেম্বর জুলিয়ান তার মা, পক্ষীবিশারদ মারিয়া কেপকের সাথে পুকালপার উদ্দেশ্যে রওনা দেন। 

মাত্র এক ঘন্টার পথ। আকাশ কিছুটা মেঘাচ্ছন্ন থাকলেও আবহাওয়া একেবারে প্রতিকূল ছিল না। কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই তাদের প্লেনটা পড়ে যায় টারবুলেন্সের মধ্যে। ঘন ঘন বজ্রসহ বৃষ্টি আরম্ভ হয়। প্রবল বাতাসের তোড়ে প্লেনটি নিকষ কালো মেঘের মধ্যে ঘুরপাক খেতে থাকে। আতঙ্কিত যাত্রীদের চোখ ধাঁধিয়ে দিয়ে বিদ্যুত চমকানোর একপর্যায়ে একটি বাজ পড়ে প্লেনের মোটরের ওপর। তারপর আর পাইলটের কিছুই করার থাকে না। তখনই বলতে গেলে বিমানটি খণ্ডবিখণ্ড হয়ে যায়।

কিশোরী জুলিয়ান কেপকে; Source: BBC

জুলিয়ানের কাছে ব্যাপারটা ছিল জীবন্ত দুঃস্বপ্নের মতো। প্লেনটা যখন নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে বনবন করে ঘুরছিল, তখন এমনিতেই গা গুলিয়ে উঠছিল। তার সাথে যোগ হয়েছে মৃত্যুভয়ে আশেপাশের যাত্রীদের গলা ফাটিয়ে চিৎকার। অবশ্য একপর্যায়ে সবকিছু ছাপিয়ে কান দিয়ে কেবল বাতাসের শনশন শব্দটাই ঢুকছিল। একপর্যায়ে টের পান, তিনি সাঁইসাঁই করে নিচে পড়ে যাচ্ছেন। তারপর আর কিছু মনে নেই।

অজ্ঞান অবস্থাতেই জুলিয়ান আছড়ে পড়েন ১০ হাজার ফুট নিচে পেরুর গহীন অরণ্যে। জানতেও পারলেন না, তার সঙ্গী বাদবাকি ৯০ জনের কেউই আর বেঁচে নেই।

বিমানটি বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবার পরেও জুলিয়ানের সিটবেল্ট অক্ষত ছিল। সেটাই তাকে বাঁচিয়ে দেয়। তবে তারপরেও তার কণ্ঠার হাড় ভেঙে গিয়েছিল। বাম চোখটা ফুলে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। এছাড়াও গাছের ডালের আঘাতে হাঁটুর পেছনে সৃষ্টি হয়েছিল গভীর ক্ষত। মাথার পেছনে দপদপে ব্যথা নিয়ে পরদিন সকালে জেগে ওঠার পর সবকিছু বুঝে উঠতেই তার অনেক সময় লেগে যায়। বিমান দুর্ঘটনার পুরো ঘটনা মনে পড়ার পরে আরেক দফা জ্ঞান হারান জুলিয়ান। নিজের পায়ে দাঁড়াবার শক্তি অর্জন করতেই আধাদিন পার হয়ে যায়।

প্রথমেই তার মাথায় আসে, মাকে খুঁজে বের করার কথা। মারিয়া ছিলেন জুলিয়ানের পাশের সিটেই। কিন্তু আশেপাশে বহু খোঁজাখুঁজির পরও তার অভিযান ব্যর্থ হয়। মা-মেয়ে দুজনেরই দুর্ভাগ্য, কারণ মারিয়া কেপকে দুর্ঘটনার পরেও বেঁচে ছিলেন। আহত অবস্থায় জঙ্গলে কিছুসময় পড়ে থাকার পর রক্তক্ষরণের কারণে তার মৃত্যু ঘটে। অবশ্য জুলিয়ান তাকে খুঁজে পেলেও বাঁচাতে পারতেন কি না, সেই প্রশ্ন থেকে যায়।

যা-ই হোক, মাকে খুঁজে না পেয়ে নিরাশ হয়ে হাঁটাহাঁটির একপর্যায়ে জুলিয়ান একটি ছোট খালের দেখা পান। প্রাণীবিজ্ঞানী বাবা প্রায়শই মেয়েকে বনে-বাদাড়ে টিকে থাকার বিষয়ে নানা উপদেশ দিতেন। সেরকমই একটি উপদেশ হলো, বনে পথ হারালে কোথাও পানির প্রবাহ খুঁজে পাওয়া মাত্রই স্রোত বরাবর হাঁটা শুরু করতে হবে। তাহলেই লোকালয়ের দেখা পাওয়া যাবে। কেননা ছোট্ট পানির প্রবাহ ক্রমান্বয়ে আস্তে আস্তে বাড়তে থেকে, আর তার তীর ঘেঁষেই সবসময় সভ্যতার সৃষ্টি হয়। খালের পানি যেমন তার তৃষ্ণা মিটিয়েছিল, তেমনি বনের মধ্যে পথ সৃষ্টি করে দিয়েছিল।

মিরাকলস স্টিল হ্যাপেন ছবিতে জুলিয়ান কেপকের ভূমিকায় সুজান পেনহ্যালিগন; Source: Ninki Maslansky

বাবার কথামতো পানির স্রোত বরাবর জুলিয়ানের যাত্রা শুরু হয়, কোনো খাবার ছাড়াই। কখনো হেঁটে, কখনো সাঁতার কেটে।  চারদিন কাটানোর পর হঠাৎ সিটবেল্ট দিয়ে আঁটকানো অবস্থায় বিমানের তিন মৃত যাত্রীর লাশ খুঁজে পান। তাদের মধ্যে একজন ছিল মহিলা। জুলিয়ান প্রথমে তাকে মারিয়া মনে করে খোঁচা দিয়ে দেখেছিলেন। মাকে খুঁজে না পেলেও তার একটা লাভ হয়। যাত্রীদের একজনের কাছে ব্যাগভর্তি ক্যান্ডি ছিল। বনে কাটানো বাকি সাতদিন তিনি ঐ ক্যান্ডি খেয়েই জীবনধারণ করেছিলেন।

ঠিক সেইসময় উপর দিয়ে ভেসে আসে উদ্ধারকারী হেলিকপ্টার এবং বিমান ওড়ার শব্দ। নানাভাবে SOS সংকেত পাঠানোর চেষ্টা করলেও দুর্ভাগ্য তার, ঘন গাছের ফাঁকে তার কোনোকিছুই তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারেনি। ফ্লাইট-৫০৮ পতনের পরে যে উদ্ধারকার্যের ব্যবস্থা করা হয়েছিল, সেরকম অভিযান পেরুর ইতিহাসে আর নেই। কিন্তু গহীন অরণ্যের কারণে উদ্ধারকারী হেলিকপ্টারগুলো বিমানের ধ্বংসাবশেষ খুঁজে পেতে ব্যর্থ হয়, মাত্র একজন মানুষকে দেখতে পাওয়া তো বহুদূর। কিছুক্ষণ পরে বিমানগুলো চলে যাবার শব্দ পান জুলিয়ান। বুঝতে পারেন, তাকে নিজে নিজেই বাঁচতে হবে।

বিমানের ধ্বংসাবশেষের সামনে ওয়ার্নার হারজগের সাথে জুলিয়ান কেপকে; Source:  Express

দুঃসাহসী শিকারিরাও অ্যামাজন বনে আঁটঘাট বেঁধে অভিযানে যান। অথচ সম্পূর্ণ একাকী জুলিয়ানের কাছে কিছুই ছিল না। দিনে যেমন অসহ্য গরম আর রাতে তেমনই কনকনে ঠাণ্ডা। প্রায়ই বৃষ্টি হতো। সাঁতার কাটার সময়ে এড়িয়ে চলতে হয়েছে দানবীয় কুমির, পিরানহা, ডেভিল রে’র মতো প্রাণীগুলোকে। চলার সময় পদে পদে ছিল বিষাক্ত সাপ। চশমার অভাবে চোখেও দেখতে পাচ্ছিলেন না ঠিকমতো। তবে সবসময়েই মা-বাবার সাথে রিসার্চ স্টেশনে কাটানো সময়ের কথা মনে করে নানা তথ্য কাজে লাগিয়েছেন।

বনের মধ্যে কাটানো এগারো দিনের মধ্যে একদিনও রাতে ঘুমাতে পারেননি পোকামাকড়ের যন্ত্রণায়। তার শরীরের অন্যান্য ক্ষতের পাশাপাশি পোকার কামড়গুলোতেও সংক্রমণ শুরু হয়ে গিয়েছিল। আরো নয়দিন পরে নদী বরাবর হাঁটতে হাঁটতে দেখেন, একটি কুঁড়েঘরের পাশে একটি ইঞ্জিনের নৌকা বাঁধা আছে। নৌকার মধ্যে একটি ফুয়েল ট্যাঙ্কভর্তি গ্যাসোলিনও আছে। ততদিনে বনের ভ্যাপসা পরিবেশে তার ক্ষতস্থানে পোকা ধরে গিয়েছিল। কয়েক বছর আগে বনের মধ্যে এক কুকুরের পোকায় ধরে যাওয়া ক্ষতকে তাৎক্ষণিকভাবে গ্যাসোলিন দিয়ে পরিষ্কার করেছিলেন হ্যান্স। সেই কথা মনে করে জুলিয়ান নিজেও তার গায়ে গ্যাসোলিন ঢেলে দেন। তীব্র যন্ত্রণা সহ্য করে কেবল হাতের ক্ষত থেকেই গুনে গুনে বের করেন ৩০টি পোকা!

উইংস অফ হোপ ডকুমেন্টারিতে; Source: 365movieguy

চাইলে সেই নৌকাটি নিয়ে যাত্রা শুরু করতে পারতেন। কিন্তু আরেকজনের নৌকা নিতে মন সায় দিচ্ছিল না। তাই কুঁড়ের ভেতরে আশ্রয় নেন। কয়েক ঘন্টা পরে তিনজন মিশনারি (মতান্তরে কাঠুরে) এসে জুলিয়ানকে আবিষ্কার করে। এগারোদিন কারো দেখা না পাওয়া জুলিয়ান তাদেরকে দেখে নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারেননি।

এতদিন পরে প্রথম যে মানুষের দেখা পেলাম, দেখে মনে হচ্ছিল তিনি একজন দেবদূত।

তারা অবশ্য জুলিয়ানকে দেখে কিছুটা ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন। নির্জন বনের মধ্যে দেখা দেয়া পানির প্রেতাত্মা ইয়ামাঞ্জাবুত বলেও মনে করেছিল একজন। তারপরেও তারা নানাভাবে তার সেবা-শুশ্রূষা করে। পরেরদিন ক্যানু নৌকায় সাত ঘন্টা নদী পাড়ি দিয়ে নিয়ে যায় তুর্নাভিস্তায়। স্থানীয় এক পাইলট তার বিমানে উড়িয়ে জুলিয়ানকে নিয়ে যায় পুকালপায়, তার বাবার কাছে।

একটু সুস্থ হয়ে ওঠার পরপরই জুলিয়ানকে এয়ার ফোর্স এবং পুলিশের কাছে অনেক প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়। আশ্চর্যজনকভাবে তার এই বেঁচে যাবার ঘটনা থেকে জন্ম নেয় নানা মতবাদ। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, সিটবেল্ট দিয়ে সিটের সাথে বাঁধা থাকার কারণে পড়ে যাবার ধাক্কাটা তার সেভাবে লাগেনি, বরং সেটা কিছুটা আস্তে প্যারাস্যুটের মতো করে নামিয়েছে তাকে। দু’পাশে দুটো সিট ছিল, সেগুলো অনেকটা ঢালের মতো কাজ করেছে। তাছাড়া মাটিতে পুরু হয়ে ছড়িয়ে ছিল গাছের পাতা আর নানারকম উদ্ভিদ। তাই এভাবে পড়ে গিয়েও তেমন কোনো হাড়গোড় ভাঙেনি। এই ভয়ানক অভিজ্ঞতার পর স্বাভাবিকভাবেই বিমানে চড়ার ব্যাপারে ভীতির সৃষ্টি হয়েছিল জুলিয়ানের মধ্যে।

আমি বহুদিন, বলতে গেলে বছরের পর বছর, দুঃস্বপ্ন ছাড়া ঘুমাতে পারিনি। আমার মা সহ অন্য যাত্রীদের জন্য শোক সবসময় আচ্ছন্ন করে রাখতো আমাকে। “কেবল আমিই কেন বেঁচে গেলাম?” এই প্রশ্ন আমাকে আজীবন তাড়া করে বেড়াচ্ছে এবং বেড়াবে। 

পরবর্তীতে ম্যামালজিস্ট হিসেবে কাজ করেছেন; Source:  Müller-Stauffenberg/ullstein bild via Getty Images

অবশেষে সবকিছু সামলে নিয়ে জার্মানিতে ফিরে সেখানকার কিল বিশ্ববিদ্যালয়ে জীববিদ্যা নিয়ে পড়াশোনা শুরু করেন তিনি। এরপরে ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেন মিউনিখ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। পরবর্তীতে পেরুতে ফিরে স্তন্যপায়ী প্রাণী, বিশেষ করে বাদুড়কে নিয়ে আরো বিস্তারিত গবেষণা শুরু করেন।

১৯৭৪ সালের মিরাকলস স্টিল হ্যাপেন নামক অ্যাডভেঞ্চার মুভিতে পেরুভিয়ান অ্যামাজনে জুলিয়ান কেপকের এই নিঃসঙ্গ লড়াইকে ফুটিয়ে তোলা হয়। ১৯৯৮ সালে তাকে নিয়ে তৈরি হয় ডকুমেন্টারি উইংস অফ হোপ। সেটি নির্মাণের সময় পরিচালক ওয়ার্নার হারজগের সাথে বিমানে ঠিক ১৯এফ সিটে বসেই তিনি রওনা দেন দুর্ঘটনাস্থলের দিকে। প্রথমবারের মতো ঘটনাটি নিয়ে আরো বিস্তারিতভাবে ভাবার সুযোগ পান তিনি। এই ঘটনাটি তার ট্রমা দূর করতে অনেক সাহায্য করে। অনুপ্রাণিত হয়ে লিখে ফেলেন নিজের বেঁচে থাকার কাহিনী ‘হোয়েন আই ফেল ফ্রম দ্য স্কাই‘। বইটি প্রকাশিত হয় ২০১১ সালের ১০ই মার্চ, তাকে এনে দেয় কোরিন সাহিত্য পুরস্কার।

কোরিন সাহিত্য পুরস্কার হাতে জুলিয়ান কেপকে; Source: theepochtimes

বিয়ের পর এখন তিনি হয়েছেন জুলিয়ান ডিলার, কাজ করছেন মিউনিখের ব্যাভারিয়ান স্টেট জুওলজিক্যাল কালেকশনের লাইব্রেরিয়ান হিসেবে। তবে জীবনের সবচেয়ে বড় অর্জন নিঃসন্দেহে অ্যামাজনের এই দুঃসাহসিক অভিযান। পাহাড়সমান বাধা পেরিয়ে দুর্গম প্রকৃতির সাথে একাই পুরো এগারো দিন দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই করেছিলেন। মাত্র সতের বছর বয়সে যে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা এবং সংকল্প তিনি দেখিয়েছেন, তা আজও অবিস্মরণীয়।

This article is in Bengali Language. It is about the incredible survival story of Julian Koepcke. For references please check the hyperlinked texts in the article.

Featured Image: theepochtimes

Related Articles