Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

ক্যানসাস নেব্রাস্কা অ্যাক্ট: যে আইন আমেরিকাকে ঠেলে দিয়েছিল গৃহযুদ্ধের দিকে

সময়টা ছিল উনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি। দাসপ্রথা অবসানের প্রশ্নে গোটা আমেরিকা তখন দ্বিধাবিভক্ত। উত্তরের রাজ্যগুলো আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছিলো পুরো আমেরিকা থেকে দাসপ্রথা চিরতরে বিলুপ্ত করে দিতে। এদিকে দক্ষিণের দাসপ্রথার সমর্থক রাজ্যগুলো দাসপ্রথা অবসানের প্রশ্নে একচুলও ছাড় দিতে রাজি ছিল না। অবশ্য বিবাদমান দুই পক্ষের মধ্যে রাজনৈতিক সমঝোতা ছিল। ফলে পরিস্থিতি ছিল স্থিতিশীল। কিন্তু ১৮৫৪ সালের জানুয়ারিতে কংগ্রেসে উত্থাপিত একটি বিল হঠাৎ করে বদলে করে দিল পরিস্থিতি। কয়েক দশক ধরে বিরাজমান সাম্যবস্থা বিনষ্ট হয়ে সৃষ্টি হল চরম অস্থিতিশীল পরিস্থিতি।

বিলটি পরবর্তীতে পাস হয়েছিল আইন হিসেবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস বদলে দেওয়া এই আইনটি পরিচিত ‘ক্যানসাস নেব্রাস্কা অ্যাক্ট’ (Kansas Nebraska Act) হিসেবে। ঐতিহাসিকদের মতে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধের পেছনে যদি একক কোনো নিয়ামক প্রধান ভূমিকা পালন করে থাকে, তবে সেটি হলো ক্যানসাস নেব্রাস্কা অ্যাক্ট। শুধু কি তা-ই? আমেরিকার কিংবদন্তী রাষ্ট্রপতি আব্রাহাম লিংকনের উত্থান এবং রিপাবলিকান পার্টির জন্মের পেছনেও রয়েছে এই আইনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। আর তাই মার্কিন ইতিহাসে সম্ভবত সবচেয়ে সুদূরপ্রসারী ভূমিকা রেখেছে এই একটি আইন। ক্যানসাস নেব্রাস্কা অ্যাক্ট নিয়ে সাজানো হয়েছে রোর বাংলার এই প্রিমিয়াম ফিচারটি।

লুইজিয়ানা পারচেজ  

ক্যানসার নেব্রাস্কা অ্যাক্টের প্রেক্ষাপট নিয়ে আলোচনার সময় অবধারিতভাবে দুটি বিষয় চলে আসে। এদের মধ্যে একটি হলো লুইজিয়ানা পারচেজ এবং অপরটি মিসৌরি কম্প্রোমাইজ।

মিসিসিপি ও মিসৌরি নদীর মধ্যবর্তী বিস্তীর্ণ অঞ্চল লুইজিয়ানা টেরিটরি হিসেবে পরিচিত ছিল। অষ্টাদশ শতাব্দীতে ইউরোপের ঔপনিবেশিক শক্তিগুলোর রাজনীতির পাশায় এই লুইজিয়ানা টেরেটরি ছিল গুরুত্বপূর্ণ গুটি। লুইজিয়ানা টেরেটরি বিভিন্ন সময় স্পেন ও ফ্রান্সের মধ্যে হাতবদল হয়েছে। দীর্ঘদিন স্প্যানিশদের দখলে থাকার পর অবশেষে ১৮০৩ সালে লুইজিয়ানা টেরেটরি ফ্রান্সের হস্তগত হয়। এর মাত্র দুই সপ্তাহ পরে ফ্রান্স মাত্র ৬৮ মিলিয়ন ফ্রাঁর বিনিময়ে লুইজিয়ানা টেরেটরি আমেরিকার কাছে বিক্রি করে দেয়, যা ইতিহাসে লুইজিয়ানা পারচেজ হিসেবে খ্যাত। 

২০১৬ সালের হিসেবে ৬৮ মিলিয়ন ফ্রাঁ প্রায় ৫৭৬ বিলিয়ন ডলারের সমতুল্য। লুইজিয়ানা পারচেজের ফলে মিসিসিপি ও মিসৌরি নদীর মধ্যবর্তী বিস্তীর্ণ অঞ্চল আমেরিকার অন্তর্ভূক্ত হয়। লুইজিয়ানা টেরিটরির আয়তন ছিলো প্রায় ২১ লক্ষ ৪০ বর্গ কিলোমিটার। সেই হিসেবে  ফ্রান্স প্রতি একর জমি মাত্র এক পেনিতে আমেরিকার কাছে বিক্রি করেছিল। লুইজিয়ানা পারচেজের ফলে আমেরিকার আয়তন বেড়ে রাতারাতি দ্বিগুণ হয়ে যায়। থমাস জেফারসন তখন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট, অন্যদিকে ফ্রান্সের ক্ষমতায় তখন নেপোলিয়ান। লুইজিয়ানা পারচেজকে ঐতিহাসিকগণ ‘ডিল অফ দ্য সেঞ্চুরি’ হিসেবে অভিহিত করেন।  

লুইজিয়ানা পারচেজের মাধ্যমে আমেরিকার অধিভূক্ত হওয়া অঞ্চলের ম্যাপ  ;Image Source: www.history.com

এত সস্তায় আমেরিকার কাছে ভূখন্ড বিক্রির পেছনে আসলে ফরাসিদের বেশ বড়সড় একটা ফাঁকি ছিল। লুইজিয়ানা টেরিটরির বিশাল অংশ আসলে ছিল নেটিভ আমেরিকানদের দখলে। অথচ নেটিভ আমেরিকানরা এই চুক্তির ব্যাপারে কিছুই জানতো না! তাই ডিল অফ দ্য সেঞ্চুরি না বলে লুইজিয়ানা পারচেজকে অনেক সময় ‘স্টিল অফ দ্য সেঞ্চুরি’ও বলা হয়।

মিসৌরি কম্প্রোমাইজ

লুইজিয়ানা পারচেজ থেকে এবার যাওয়া যাক মিসৌরি কম্প্রোমাইজে। দাসপ্রথার অবসান নিয়ে উত্তর ও দক্ষিণের রাজ্যগুলোর মধ্যে দ্বন্দ্বের সূচনা একদিনে হয়নি। প্রাথমিকভাবে ১৩টি রাজ্য নিয়ে আমেরিকা গঠিত হলেও ১৮১৯ সাল নাগাদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রাজ্যের সংখ্যা দাঁড়ায় ২২-এ। এদের মধ্যে উত্তরের ১১টি রাজ্য ছিলো দাসপ্রথার বিরুদ্ধে, অন্যদিকে দক্ষিণের সমান সংখ্যক রাজ্য ছিলো দাসপ্রথার পক্ষে। অর্থাৎ দাসপ্রথা ইস্যুতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তখন থেকেই দ্বিধাবিভক্ত হলেও দাসপ্রথার পক্ষ ও বিপক্ষের শক্তির মধ্যে ছিল রাজনৈতিক ক্ষমতার দারুণ ভারসাম্য। এদিকে  ১৮০৩ সালে আমেরিকা লুইজিয়ানা টেরেটরি কিনে নিলেও সাথে সাথেই ঐ অঞ্চলগুলো রাজ্য হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রে যোগ দেয়নি। এই বিস্তীর্ণ অঞ্চলকে ধীরে ধীরে রাজ্য হিসেবে বিন্যস্ত করা হয়েছে এবং স্বাধীন রাজ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। এছাড়া অঞ্চলগুলোতে নেটিভ আমেরিকানদের বসবাস থাকায় আমেরিকান সেটেলারদের পক্ষে সহজে বসতি স্থাপন করা সম্ভব ছিল না। 

এই অঞ্চলগুলোকে বলা হতো আনঅর্গানাইজড টেরেটরি, যার শাসনক্ষমতা ন্যস্ত ছিল কেন্দ্রের হাতে। ১৮০৩ সালের আগে, অর্থাৎ স্পেন ও ফ্রান্সের উপনিবেশ থাকাকালীন আনঅর্গানাইজড টেরেটরিগুলোতে দাসপ্রথা স্বীকৃত ছিল। লুইজিয়ানা টেরেটরির অন্তর্ভুক্ত মিসৌরি ১৮২০ সালে স্টেট হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার জন্য আবেদন করে। রাজ্য হিসেবে মিসৌরিকে অন্তর্ভুক্ত করতে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো সমস্যা থাকার কথা ছিল না। কিন্তু  মিসৌরিতে দাসপ্রথা চালু থাকবে নাকি রহিত হবে এই ইস্যুতে বিপত্তি বাঁধলো।

মিসৌরি রাজ্য হিসেবে যোগ দেওয়ার আগপর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে দাসপ্রথার পক্ষ এবং বিপক্ষের শক্তির মধ্যে ভারসাম্য ছিলো। কিন্তু রাজ্য হিসাবে মিসৌরির আত্মপ্রকাশ ক্ষমতার ভারসাম্যকে যেকোনো একদিকে হেলিয়ে দিতে পারে- এই আশংকা মার্কিন রাজনীতিতে বেশ সংকটময় পরিস্থিতির জন্ম দিলো। নদীবিধৌত মিসৌরি রাজ্য ছিল অত্যন্ত উর্বর এবং তুলা চাষের জন্য একদম উকৃষ্ট। মিসৌরির কৃষিক্ষেত্রে সমৃদ্ধির সাথে জড়িয়ে ছিল দাসপ্রথার ভূমিকা। এছাড়া ফ্রান্স ও স্পেনের উপনিবেশকালীন দাসপ্রথা স্বীকৃত থাকায় মিসৌরি দাসপ্রথার সমর্থক রাজ্য হিসেবে যোগ দিতে চাচ্ছিল। কিন্তু এতে করে দাসপ্রথাপন্থীদের আধিপত্য বেড়ে যাবে এবং সারা আমেরিকায় দাসপ্রথার পুনরুত্থান ঘটতে পারে এই শংকা উত্তরের দাসপ্রথাবিরোধীদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ল। এই সংকট থেকে উত্তরণের জন্য জন্ম নিলো ‘মিসৌরি কম্প্রোমাইজ’।

মিসৌরি কম্প্রোমাইজের অংশ হিসেবে মিসৌরিতে দাসপ্রথা ঠিকই চালু থাকলো, কিন্তু ক্ষমতার ভারসাম্য টিকিয়ে রাখার জন্য ম্যাসাচুসেটসকে ভেঙে দাসপ্রথা বিরোধী নতুন রাজ্য মেইন (Maine) গঠন করা হলো। এতে দাসপ্রথার পক্ষ-বিপক্ষ উভয়দিকেই রাজ্যের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াল ১২-তে। ফলে রক্ষা পেল রাজনৈতিক ভারসাম্য। এদিকে মিসৌরি কম্প্রোমাইজে আরো প্রস্তাব করা হলো অবশিষ্ট লুইজিয়ানা টেরেটরির উত্তর অংশে, অর্থাৎ ৩৬ ডিগ্রি ৩০ মিনিট অক্ষাংশ রেখার উপরের ভূখন্ডে দাসপ্রথাকে স্বীকৃতি দেয়া যাবে না। এই সীমারেখা থার্টিসিক্স থার্টি লাইন হিসাবে পরিচিত।

থার্টিসিক্স থার্টি লাইন; Image source: pbs.org

মিসৌরি কম্প্রোমাইজের ফলে উত্তরে আবার দাসপ্রথা ফিরে আসছে না ভেবে দাসপ্রথা অবসানকামী রাজ্যগুলো আশ্বস্ত হলো। এদিকে কৃষিসমৃদ্ধ মিসৌরিতে দাসপ্রথা টিকে থাকায় সেখানকার ধনী জোতদারদের স্বার্থও রক্ষিত হলো। আবার অর্থনৈতিকভাবে সম্ভাবনাময় একটি রাজ্যকে নিজেদের দলে ভেড়াতে পারায় দক্ষিণের দাসপ্রথার সমর্থক রাজ্যগুলোরও মিসৌরি কম্প্রোমাইজ নিয়ে অসন্তুষ্টির কোনো কারণ ছিল না। পক্ষ-বিপক্ষ উভয়েরই মুখরক্ষা হলো। ফলে আমেরিকা রক্ষা পেল আসন্ন এক সংঘাতের হাত থেকে। অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন, মিসৌরি কম্প্রোমাইজের ফলে মার্কিনীরা একটি অবধারিত গৃহযুদ্ধ সাফল্যের সাথে এড়িয়ে যেতে পেরেছিল পরবর্তী চার দশক। অবশ্য মিসৌরি কম্প্রোমাইজ নিয়ে বিস্তর সমালোচনাও রয়েছে। মিসৌরি কম্প্রোমাইজ গোটা দেশকে যেভাবে দুটি কাল্পনিক সীমারেখায় বিভক্ত করেছিল, তাতে অনেকেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অখণ্ডতা নিয়ে সন্দিহান ছিলেন।         

তবে রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিত্য বদলাতে থাকে। এই পরিবর্তনের হাত ধরেই মিসৌরি কম্প্রোমাইজ ১৮৫৪ সাল নাগাদ হুমকির মুখে পড়লো একটি আইনের কারণে। সেই আইনটিই ছিলো ক্যানসাস নেব্রাস্কা অ্যাক্ট। তাহলে কী এমন ছিলো ক্যানসাস নেব্রাস্কা অ্যাক্টে, যা প্রায় চার দশক আগে মিসৌরি কম্প্রোমাইজের ফলে সৃষ্ট স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে অস্থিতিশীল করে তুললো? সেটা জানার জন্য আমাদের ফিরে যেতে হবে ১৮৫০ এর দশকে।

ক্যানসাস নেব্রাস্কা অ্যাক্ট এর প্রেক্ষাপট

১৮৫০ এর দশকের আগে দাসপ্রথা সমর্থকরা, দাসপ্রথা বিরোধীদের চেয়ে অর্থনৈতিকভাবে অনেক বেশি আগ্রসর ছিলেন। এর কারণ তৎকালীন কৃষিনির্ভর মার্কিন অর্থনীতি। দক্ষিণের দাস মালিকদের দখলে ছিল বিশাল বিশাল ভূসম্পত্তি এবং চিনিকল। মোটকথা, কৃষিপ্রধান আমেরিকার অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি ছিল দক্ষিণের দাসপ্রথা সমর্থক রাজ্যগুলো। তাই উত্তরের রাজ্যগুলোতে যেখানে আমেরিকার জন্মের খুব অল্প সময়ের মধ্যে দাসপ্রথা বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল, সেখানে দক্ষিণের রাজ্যগুলো এই প্রথা দীর্ঘদিন টিকে ছিল সাফল্যের সাথে। কিন্তু ১৮৫০ এর দশকে মার্কিন অর্থনীতিতে নতুন মাত্রা যোগ হতে থাকে। আস্তে আস্তে শিল্পায়নের দিকে ঝুঁকে পড়ে উত্তরের রাজ্যগুলো। ফলস্বরূপ অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির ছোঁয়া লাগে উত্তরেও। মজবুত হতে থাকে দাসপ্রথা বিরোধীদের ভিত্তি।

এদিকে কৃষি জমির সম্প্রসারণ, শিল্পয়ন ও নগরায়নের লক্ষ্যে ‘লুইজিয়ানা পারচেজ’ থেকে অধিগৃহীত আমেরিকার বিস্তীর্ণ পশ্চিম ভূখণ্ডের উপর অনেকেরই তখন নজর পড়ে। ফলে পশ্চিমের আনঅর্গানাইজড টেরেটরিগুলোকে দ্রুত রাজ্য হিসেবে সুবিন্যস্ত করা আস্তে আস্তে সময়ের দাবিতে পরিণত হয়। যদিও এর অনেক আগে থেকে নেব্রাস্কার উর্বর ভূখন্ডে কৃষিকাজ সম্প্রসারণের ব্যাপারে দক্ষিণের সিনেটররা বহুবার পদক্ষেপ নিয়েছিলেন, দাসপ্রথা অবসানের  প্রশ্নে ঐক্যমতে পৌঁছাতে না পারায় উত্তরের সিনেটরদের বিরোধীতার মুখে সেসব পদক্ষেপ সফল্যের মুখ দেখেনি।

বিবাদমান দুই পক্ষের অনড় অবস্থানের কারণে পশ্চিমের উন্নয়ন যখন আলোর মুখ দেখছিল না, তখন বেশ উচ্চাভিলাষী একটি প্রস্তাব নিয়ে হাজির হলেন একজন ঝানু ডেমোক্র্যাট সিনেটর। তার নাম স্টিফেন এ ডগলাস। ইলিনয়ের এই সিনেটর ১৮৫৪ সালের জানুয়ারিতে আমেরিকার পশ্চিমের ভূখণ্ডের ব্যাপার তার প্রস্তাব বিল আকারে উত্থাপন করলেন। তুমুল বিতর্কের সূচনাকারী এই বিলটি ক্যানসাস নেব্রাস্কা বিল হিসেবে পরিচিত। ডগলাস প্রস্তাব করেছিলেন, পশ্চিমে অবকাঠামোগত উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন রেলপথ। তার প্রস্তাবিত এই আন্তঃমহাদেশীয় রেলপথ পূর্বদিকে শিকাগো থেকে শুরু হয়ে বয়ে চলবে নেব্রাস্কার বিস্তীর্ণ সমতল ভূমির উপর দিয়ে। রেলপথ বসানোর আগে অবিন্যস্ত এলাকাগুলোকে বিন্যস্ত করা দরকার। এই লক্ষ্যে তিনি লুইজিয়ানা টেরিটরিতে ক্যানসাস ও নেব্রাস্কা নামে পৃথক দুটি রাজ্য সৃষ্টি করার প্রস্তাব পেশ করলেন।

     ক্যানসাস নেব্রাস্কা অ্যাক্টের বিরুদ্ধে দাসপ্রথা অবসানকামীদের ব্যাঙ্গ চিত্র; Image source: susannalee.org

স্বভাবতই প্রশ্ন চলে আসলো, দাসপ্রথার ইস্যুতে নবীন এ দুটি রাজ্যের ভূমিকা কেমন হবে? শিকাগোতে সিনেটর ডগলাসের নিজস্ব রিয়েল এস্টেট ব্যবসা ছিল। রেললাইন বসানোর পরিকল্পনাটির সাফল্যের সাথে তার ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধির একটা ব্যাপার জড়িত থাকতে পারে বলে অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন। আবার অনেকে মনে করেন, ক্যানসাস নেব্রাস্কা বিলটি ছিল প্রবল মেরুকরণ থেকে ক্রমাগত ভাঙনের দিকে এগিয়ে চলা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে আসন্ন বিবাদের হাত থেকে রক্ষা করার একটি কৌশল।

সে যা-ই হোক, দক্ষিণের সিনেটরদের সমর্থন পাওয়া অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ছিল ডগলাসের জন্য। তাই দাসপ্রথা বিলোপের প্রশ্নে তিনি অত্যন্ত কৌশলী একটি অবস্থান নিলেন। তার যুক্তি ছিল, ক্যানসাস ও নেব্রাস্কায় দাসপ্রথা থাকবে কি না সেটা নির্ধারণ করবে সেখানকার জনগণ; এ ব্যাপারে ফেডারেল সরকারের কোনো ভূমিকা থাকবে না। এই ধারণাটি পপুলার সভারেনটি হিসেবে বহুল পরিচিত। ক্যানসাস নেব্রাস্কা বিল উত্থাপনের সাথে শুরু হলো তুমুল বিতর্ক। বিলের পক্ষের ও বিপক্ষের সিনেটরা পরস্পর বিরোধী বাক্যবাণে ও যুক্তির জালে পরস্পরকে আক্রমণ করতে শুরু করলেন। অবশেষ ৩৭/১৪ ভোটে সিনেটে এবং ১১৩/১০০ ভোটে হাউজে বিলটি পাশ হলো, কিন্তু সৃষ্টি হলো চিরস্থায়ী বিভাজন। কারণ বিলটির বিরোধিতাকারী আইনপ্রণেতাদের ৯১% ছিলেন উত্তরের রাজ্যগুলোর প্রতিনিধি। বিভাজন যে কতটা তীব্র ছিল সেটা বোঝা যায় এই তথ্য থেকেই। উত্তাল বিক্ষোভে ফেটে পড়লো উত্তরের প্রদেশগুলো। উত্তরের তীব্র প্রতিরোধের মুখেই বিলটিকে আইন হিসেবে অনুমোদন দিলেন প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন পিয়ার্স। পাস হলো ঘটনাবহুল ক্যানসাস নেব্রাস্কা অ্যাক্ট। 

সিনেটর স্টিফেন ডগলাস; Image source: worldhistory.us

যদি পপুলার সভারেনটির মাধ্যমে দাসপ্রথা নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা নবীন রাজ্য দুটির জনগণের হাতেই ন্যাস্ত করার বিধান রাখা হয়, তাহলে ক্যানসাস নেব্রাস্কা বিলের পপুলার সভারেনটির ধারণা উত্তরের রাজ্যগুলোকে কেন এতটা ক্ষুব্ধ করেছিল? এ প্রশ্নের উত্তর বিস্তারিতভাবে আলোচনা না করা হলে এই উপাখ্যান যেন অসম্পূর্ণই থেকে যাবে।

পপুলার সভারেনটি কেন ক্ষুব্ধ করেছিল দাসপ্রথা বিরোধীদের?

মিসৌরি কম্প্রোমাইজের মাধ্যমে থার্টিসিক্স থার্টি রেখার নিচে দাসপ্রথাকে সীমিত রাখার যে বিধান রাখা হয়েছিল, পপুলার সভারেনটির মাধ্যমে তা রহিত হওয়ার সম্ভবনা দেখা দিল। কেননা নবগঠিত নেব্রাস্কা টেরেটরিটি ছিল এই রেখার উপরে এবং মিসৌরি কম্প্রোমাইজ অনুসারে এই অঞ্চলে দাসপ্রথাকে অনুমোদন দেওয়ার কোনো সুযোগই ছিল না। কিন্তু পপুলার সভারেনটির মাধ্যমে এই ভূখণ্ডে দাসপ্রথা পুনরায় বৈধতা পাবার সুযোগ সৃষ্টি হলো। তাই উত্তরের দাসপ্রথা বিরোধীদের কাছে এই আইনটি ছিল মিসৌরি কম্প্রোমাইজের লঙ্ঘন। কার্যতই ক্যানসাস নেব্রাস্কা অ্যাক্ট পাস হওয়ার পর মিসৌরি কম্প্রোমাইজ মূল্যহীন হয়ে পড়েছিল।

এক্ষেত্রে আমাদের মনে রাখা দরকার, লুইজিয়ানা পারচেজের অর্ধ শতাব্দী পরেও ক্যানসাস ও নেব্রাস্কার বিস্তীর্ণ অঞ্চল ফেডারেল টেরেটরি হিসেবে শাসিত হতো। সুবিন্যস্ত প্রশাসন না থাকায় আয়তনে বিশাল এই অঞ্চল ছিল জনবিরল। তাছাড়া নেটিভ আমেরিকানদের প্রতিরোধ সংগ্রাম তো ছিলই। তাই এসব ভূখণ্ডে স্থায়ী অধিবাসীর সংখ্যা ছিল অতি নগণ্য। ক্যানসাস নেব্রাস্কা অ্যাক্ট বাস্তবায়িত হলে আশেপাশের রাজ্যগুলো থেকে এই অঞ্চলে যে বিপুল পরিমাণ অভিবাসীদের আগমন ঘটবে তা সহজেই অনুমেয় ছিল। ফলে এসব অভিবাসীর ইচ্ছার উপরই যে সেখানে দাসপ্রথার ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে তা উত্তরের দাসপ্রথা বিরোধীদের বুঝতে বাকি ছিল না। নিজেদের দল ভারি করতে উত্তর ও দক্ষিণ থেকে হাজার হাজার মানুষ নবগঠিত রাজ্য দুটিতে পাড়ি জমাতে শুরু করলো। কিন্তু এর মধ্যে ঘটে গেল কিছু রক্তক্ষয়ী ঘটনা, যা পরিস্থিতির মোড় ঘুরিয়ে দিল অন্যদিকে।

ক্যানসাস হলো রক্তাক্ত

মিসৌরি থেকে দলে দলে মানুষ ক্যানসাসে আসতে শুরু করল। উত্তরের রাজ্যগুলোও হাত গুটিয়ে বসে রইল না। অভিবাসনের এই প্রতিযোগিতা সংঘাতের দিকে রূপ নিল। দাসপ্রথা বিরোধী এবং এর সমর্থকদের রক্তে রঞ্জিত হলো ক্যানসাস। আমেরিকার ইতিহাসে যা ব্লিডিং ক্যানসাস হিসেবে পরিচিত। দাসপ্রথার পক্ষ-বিপক্ষের লোক মিলে ১৮৫৪ থেকে ১৮৬১ পর্যন্ত কয়েক’শ মানুষ নিহত হয়েছিল। তবে এসব ঘটনার ভেতরে সবচেয়ে মর্মান্তিক ঘটনাটি ঘটেছিল ১৮৫৬ সালের ২৫ মে দিবাগত রাতে। ঐদিন জন ব্রাউন নামে দাসপ্রথাবিরোধী এক ব্যক্তি এবং সহযোগীরা মিলে দক্ষিণের পাঁচজন সেটেলারকে তলোয়ার দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে। এই দুঃখজনক ঘটনাটি পটওয়াটমি ম্যাসাকার হিসেবে পরিচিত।  

শিল্পীর স্কেচে ব্লিডিং ক্যানসাস; Image source: nps.gov

ক্যানসাস নেব্রাস্কা অ্যাক্ট ও রিপাব্লিকান পার্টির জন্ম

ক্যানসাস নেব্রাস্কা অ্যাক্ট পাস হওয়ার আগেও মার্কিন রাজনীতিতে উত্তর-দক্ষিণ বিভাজন ছিল। কিন্তু সেই বিভাজন কখনও পারিপার্শ্বিক ঘটনাগুলোকে ছাপিয়ে মুখ্য হয়ে উঠতে পারেনি। তৎকালীন মার্কিন রাজনীতিতে প্রধান দুটি দল ছিল হুইগ পার্টি ও ডেমোক্র্যাটিক পার্টি । দাসপ্রথার ইস্যুতে আমেরিকা উত্তর ও দক্ষিণ দুই শিবিরে বিভক্ত হলেও অন্যান্য ইস্যুতে দুই শিবিরের মধ্যে মেলবন্ধন রচনা করতো এই দুটি রাজনৈতিক দল, কারণ উভয় দলের অভ্যন্তরেই দাসপ্রথা সমর্থক এবং অবসানকামী সিনেটররা ছিলেন। অর্থাৎ দাসপ্রথা বিলোপের প্রশ্নে দুটি দলের ভেতরেই মেরুকরণ ছিল। ফলে দাসপ্রথার প্রশ্নে বিভক্ত থাকলেও যুক্তরাষ্ট্র ব্যবস্থায় ভাঙন ধরেনি।

কিন্তু ক্যানসাস নেব্রাস্কা অ্যাক্ট পাস হওয়ার পর উত্তরের রাজনীতিবিদরা দলে দলে হুইগ পার্টি ও ডেমোক্র্যাটিক পার্টি ত্যাগ করে নতুন একটি সম্পূর্ণ দাসপ্রথা বিরোধী রাজনৈতিক দল গঠন করলেন। এই দলটিই হলো বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে ক্ষমতাসীন রিপাবলিকান পার্টি। রিপাবলিকান পার্টির জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির পেছনে আব্রাহাম লিংকনের ভূমিকা ছিলো অত্যন্ত গুরত্বপূর্ণ, যদিও আব্রাহাম লিংকন আনুষ্ঠানিকভাবে রিপাবলিকান পার্টিতে যোগ দেন ১৮৫৬ সালে। ঐ একই বছর মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রিপাবলিকানদের হয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন জন সি ফ্রিমন্ট। ফ্রিমন্ট ছিলেন কট্টর দাসপ্রথাবিরোধী। যদিও তিনি ডেমোক্র্যাট প্রার্থী জেমস বুকাননের কাছে পরাজিত হন, তথাপি তার ৩৩ শতাংশ ভোটপ্রাপ্তি রিপাবলিকানদের মনোবল বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছিল।

লিংকন বনাম ডগলাস

আব্রাহাম লিংকন  ও ক্যানসাস নেব্রাস্কা বিলের উত্থাপক সেই বহুল আলোচিত সিনেটর স্টিফেন এ ডগলাস দুজনেই ছিলেন ইলিয়ন থেকে নির্বাচিত সিনেটর। ১৮৫৮ সালের সিনেট নির্বাচনে আব্রাহাম লিংকন, সিনেট নির্বাচনে স্টিফেন ডগলাসের বিরুদ্ধে অংশগ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নেন। এ সময় ইলিয়নের ৭টি শহরে লিংকন ও ডগলাসের মধ্যে বিতর্ক অনুষ্ঠিত হয়। এই বিতর্কগুলো ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে আছে। বিতর্কগুলোতে নিজের বিচক্ষণতার স্বাক্ষর রেখেছিলেন লিংকন। যদিও নির্বাচনে তিনি স্টিফেন ডগলাসের কাছে পরাজিত হন, নির্বাচনের পর রিপাবলিকানদের কাছে তার জনপ্রিয়তা রাতারাতি বেড়ে গিয়েছিল।

লিংকন-ডগলাস বিতর্ককে স্মরণীয় করে রাখতে মার্কিন পোস্টেজে বিতর্কের ছবি; Image Source: mysticstamp.com

ফলস্বরূপ ১৮৬০ সালের নির্বাচনে রিপাবলিকান দল থেকে প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন পেলেন আব্রাহাম লিংকন। মজার ব্যাপার হলো, এবারও লিংকনের বিপক্ষে প্রার্থী হিসেবে দাঁড়ালেন ডগলাস। ডগলাস মনোনয়ন পেয়েছিলেন ডেমোক্র্যাটিক পার্টি থেকে। তবে এবার লিংকনকে রুখতে পারলেন না তিনি। অবশেষে ইতিহাস রচনা করে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নিলেন একজন দাসপ্রথাবিরোধী।যদিও আব্রাহাম লিংকন রাতারাতি দাসপ্রথা বিলুপ্ত করতে চাননি, দক্ষিণের রাজ্যগুলো বুঝতে পারছিল তাদের রাজনৈতিক অস্তিত্ব হুমকির সম্মুখীন। ফলে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল দাসপ্রথার সমর্থক দক্ষিণের রাজ্যগুলো। ফলস্বরূপ ১৮৬১ সালের ১২ এপ্রিল গৃহযুদ্ধের সূচনা হলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে।

আপাতদৃষ্টিতে সহজ এনং ভারসাম্যপূর্ণ মনে হলেও ক্যানসাস নেব্রাস্কা অ্যাক্ট মার্কিন রাজনীতিকে প্রবলভাবে নাড়িয়ে দিয়েছিল। আর তাতেই  চিরতরে নষ্ট হয়েছিল ক্ষমতার ভারসাম্য। তাই বলা যায়, ক্যানসাস নেব্রাস্কা অ্যাক্ট কেবল একটি আইনই ছিলো না, বরং ছিলো আমেরিকার ইতিহাস চিরতরে বদলে দেওয়ার মতো ঘটনা।

This article is in Bangla language. It discusses about the Kansas-Nebraska Act. Necessary resources have been hyperlinked.

Feature Image: unmistakablylawrence.com

Related Articles