Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website. The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

কাশ্মীর স্বাধীনতা আন্দোলন: ইতিহাস ও প্রথম গণআন্দোলনের সূত্রপাত

বর্তমানে দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে উত্তপ্ত, সংঘর্ষপ্রবণ ও বিক্ষত এক জনপদ হলো কাশ্মীর। গত প্রায় ৭১ বছর ধরে কাশ্মীর লড়াই করছে নিজের পরিচয়ের জন্য। কাশ্মীরের সাধারণ মানুষের মতামত বা অংশগ্রহণ ছাড়াই এই কাশ্মীরের মালিকানা কিংবা নিয়ন্ত্রণ পরিবর্তন হয়েছে বহুবার। এত বছর ধরে কাশ্মীর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নানা সমস্যা চললেও কাশ্মীর সমস্যার কোনো সুরাহা হয়নি আজও। কাশ্মীরের সাধারণ মানুষেরা এখনো স্বপ্ন দেখেন এক স্বাধীন জন্মভূমির।

জম্মু ও কাশ্মীরের ১৯৪৭ পূর্ব শাসক বংশ ছিল ‘ডোগরা’। ডোগরা বংশের শাসন শুরু হয় গুলাব সিংয়ের হাত ধরে। ১৮০৮ সালে জম্মু পাঞ্জাবকেন্দ্রিক শিখ সাম্রাজ্যের অধীনে এলে শিখ মহারাজা রণজিৎ সেন এ এলাকার শাসনভার অর্পণ করেন রাজপুত গুলাব সিংকে। শিখ সাম্রাজ্য ছিল লাহোরকেন্দ্রিক। শিখ মহারাজা রণজিৎ সিংয়ের মৃত্যুর পর শিখ সাম্রাজ্য দুর্বল হয়ে পড়ে। এ সুযোগে ব্রিটিশরা শিখদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। গুলাব সিং জম্মুর রাজা হিসেবে ব্রিটিশদের সহযোগিতা করেন।

মহারাজা রণজিৎ সিংয়ের মৃত্যুর পর লাহোর সাম্রাজ্যের দায়িত্ব পান তার কনিষ্ঠ পুত্র দুলিপ সিং। ঠিক এ মুহূর্তে ১৮৪৬ সালে ব্রিটিশরা আক্রমণ করে শিখ সাম্রাজ্যে। ব্রিটিশদের সাথে শিখ সাম্রাজ্যের এই প্রথম যুদ্ধে জম্মু ও কাশ্মীর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। যুদ্ধে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নিকট পরাজয়ের পর ১৮৪৬ সালের ৯ মার্চ তৎকালীন পাঞ্জাব শিখ রাজা দুলিপ সিংয়ের সাথে ব্রিটিশদের একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, যেটি লাহোর চুক্তি নামে পরিচিত। এই চুক্তির মধ্য দিয়েই প্রথমবারের মতো কাশ্মীর বিক্রি হয়ে যায়।

এই চুক্তির মাধ্যমে পরাজিত শিখ সাম্রাজ্য কাশ্মীর, জম্মু, হাজারাসহ বিভিন্ন এলাকা দিয়ে দেয় ব্রিটিশদের হাতে। সেই সাথে যুদ্ধের ক্ষতিপূরণ হিসেবে দেড় কোটি নানকার শাহী (শিখ সাম্রাজ্যের প্রচলিত মুদ্রা) দাবি করে ব্রিটিশরা। রাজা দুলিপ সিং ৫০ লাখ নানকার শাহী দেন এবং বাকি এক কোটি নানকার শাহীর বিনিময়ে কাশ্মীর ও এর আশেপাশের এলাকা ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে দিয়ে দেন।

শিখ মহারাজা রণজিৎ সিং; Image Source: scroll.in

প্রথম চুক্তির ধারাবাহিকতায় দ্বিতীয় চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, যা অমৃতসর চুক্তি নামে পরিচিত। এই চুক্তির ফলে দ্বিতীয়বারের মতো কাশ্মীর বিক্রি হয়। প্রথম চুক্তি বাস্তবায়নের ক’দিন পরই ১৮৪৬ সালের ১৬ মার্চ এই চুক্তি হয় ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সাথে জম্মুর স্থানীয় শাসক গুলাব সিংয়ের। এই ‘অমৃতসর’ চুক্তির মাধ্যমে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কাশ্মীর ও আশেপাশের এলাকা গুলাব সিংয়ের নিকট বিক্রি করে দেয়।

সেসময় কাশ্মীর শিখ সাম্রাজ্যের গভর্নর হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন সাবেক গভর্নর গোলাম মহিউদ্দীনের পুত্র ইমাম উদ্দীন। ব্রিটিশরা এই কাশ্মীর অঞ্চল জম্মুর শাসক গুলাব সিংয়ের নিকট বিক্রির সিদ্ধান্ত নিলে কঠোর প্রতিবাদ করেন ইমাম উদ্দীন। প্রতিরোধ সত্ত্বেও বৃটিশরা কাশ্মীর এলাকা গুলাব সিংয়ের কাছেই বিক্রি করে। এর ফলে জম্মু ও কাশ্মীর চলে আসে ডোগরা বংশের নিয়ন্ত্রণে। গুলাব সিং হয়ে ওঠেন জম্মু কাশ্মীরের একক শাসক। ব্রিটিশরা তাকে স্বতন্ত্র ‘মহারাজা’ হিসেবেও স্বীকৃতি দেয়।

কাশ্মীরের শাসক হওয়ার বিনিময়ে গুলাব সিংকে ব্রিটিশদের কোষাগারে ৭৫ লাখ মুদ্রা জমা দিতে হয়েছিল। নগদ মূল্য ছাড়াও গুলাব সিংকে প্রতি বছর একটি ঘোড়া, বারোটি উন্নত জাতের ছাগল ও তিন জোড়া কাশ্মীরী শাল দিতে হতো। এর পাশাপাশি প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে ব্রিটিশদের হয়ে যুদ্ধ করবার জন্য অনেক সৈন্য সরবরাহ করতো এই শাসক গোষ্ঠী। এসব আনুগত্যের ফলে ব্রিটিশদের প্রিয়পাত্র হয়ে ওঠেন গুলাব সিং ও তার শাসকবংশ। এছাড়াও গুলাব সিং হয়ে ওঠেন পুরো কাশ্মীর ও আশেপাশের অঞ্চলের একচ্ছত্র অধিপতি। লাহোরকেন্দ্রিক কাশ্মীর তখন জম্মুকেন্দ্রিক হয়ে পড়ে। সদ্য বিক্রিত জনপদের অবস্থা পর্যবেক্ষণের জন্য ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কোনো পর্যবেক্ষক রাখবারও প্রয়োজনীয়তা বোধ করেনি।

পুরো অঞ্চলে গুলাব সিং এক অত্যাচারী শাসকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। ইচ্ছামতো অতি উচ্চ হারে কর আরোপ করতে থাকেন কাশ্মীরের জনগণ থেকে। তিনি এই করারোপের উপায় হিসেবে বিভিন্ন জনস্বার্থ বিরোধী একচেটিয়া পদ্ধতি অনুসরণ করতে শুরু করেন। এর ফলে তার শাসনামলে কাশ্মীরের সাধারণ মুসলিম নাগরিকদের অত্যাচারিত হতে হয়।

অবশেষে, ১৮৮৫ সালে ব্রিটিশ সরকার এই এলাকার স্থানীয় প্রশাসনের উপর নজরদারি বৃদ্ধির জন্য কাশ্মীরে একজন ‘রেসিডেন্ট অব দ্য স্টেট’ নিয়োগ দেন। তাতেও স্থানীয় মুসলমানদের উপর অত্যাচার কমেনি। স্থানীয় মুসলমানদের এতটাই কোণঠাসা করে রাখা হয়েছিল যে, ১৯৩০ সাল পর্যন্ত রাজ্যের সশস্ত্র বাহিনী কিংবা প্রশাসনিক কাজে হিন্দু রাজবংশীয় বাদে স্থানীয় মুসলমানদের চাকরির কোনো সুযোগ ছিল না।

কাশ্মীরের মুসলমানদের উপর অত্যাচার ও নিপীড়নের শুরু শিখ সাম্রাজ্যের সময় থেকেই। শিখ সাম্রাজ্যের সময় প্রথম ইসলাম ধর্ম বড় ধরনের বিপত্তিতে পড়ে। কেননা, পাঞ্জাব থেকে পরিচালিত এই শাসনামলে যাদের গভর্নর হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হতো, তাদের প্রায় সবাই ছিলেন হিন্দু ধর্মাবলম্বী। মাত্র দুজন মুসলমান গভর্নর দায়িত্ব পালনের সুযোগ পেয়েছিলেন এখানে। মুসলমানদের উপর কঠোর কর ব্যবস্থা তো ছিলোই, সেই সাথে এতটাই কঠোর নীতি ছিল শাসকদের যে, প্রায় দুই দশক ধরে কাশ্মীরের প্রধান মসজিদে কোনো ধরনের ইবাদত নিষিদ্ধ ছিল।

কাশ্মীরে ডোগরা শাসকবংশের নির্মিত প্রাসাদ; Image Source: malicethoughts.blogspot.com

অমৃতসর চুক্তির পর ডোগরা শাসনামলে এই অবস্থার আরো অবনতি ঘটে। রাজা গুলাব সিং থেকে শুরু করে পরবর্তী ১০০ বছর এ এলাকার শাসন ব্যবস্থা পরিচালিত হয়েছে মূলত হিন্দু পণ্ডিতদের দ্বারা। পণ্ডিতরা শাসনকার্য পরিচালনা করতে গিয়ে কাশ্মীরের মুসলমানদের নির্যাতিত ও নিঃস্ব করে দেন। এক ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছিল সেই সময়টায়। ১৮৭৭ থেকে ১৮৭৯ সালে ঘটা এই দুর্ভিক্ষে স্থানীয় জনসংখ্যার পাঁচভাগের দু’ভাগ মারা গেলেও একজন হিন্দু পণ্ডিতও খাদ্যাভাবে মারা যাননি! এটাই প্রমাণিত হয় যে, কাশ্মীরের সাধারণ নাগরিকদের প্রতি কীরূপ বৈষম্যমূলক আচরণ করতেন হিন্দু পণ্ডিত শাসকেরা।

শাসকদের এ অত্যাচারের ফলেই পরবর্তীতে ১৯৩১ সালে আজাদি (স্বাধীনতা) আন্দোলনের সূত্রপাত হয় কাশ্মীরে। দীর্ঘদিনের পুঞ্জিভূত ক্ষোভ রূপ নেয় আন্দোলনে। ১৯৩১ সালে তৎকালীন মহারাজা হরি সিংয়ের প্রশাসনিক কর্মকর্তা ঈদের নামাযে খুৎবার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। মহারাজার সৈনিকেরা কুরআন শরীফের প্রতিও অবমাননামূলক আচরণ করে। এসবের ফলে সমগ্র রাজ্যে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। এর মাঝে এক সমাবেশে উত্তেজিত এক যুবক ‘আব্দুল কাদির’ মহারাজার বাসভবন ধবংসের হুঁশিয়ারি দেয়। তাকে আটক করা হয় এবং দ্রুত বিচার কাজ শুরু করা হয়।

১৯৩১ সালের ১২ জুলাই আব্দুল কাদিরের সমর্থনে কাশ্মীর জুড়ে মিছিল চলতে থাকে। এরূপ অবস্থায় উত্তেজিত জনতার রোষানল থেকে মুক্তির জন্য আব্দুল কাদিরের বিচার স্থানান্তর করা হয় কারা অভ্যন্তরে। শ্রীনগর কারাগারে পরদিন ১৩ জুলাই আব্দুল কাদিরের বিচার অনুষ্ঠিত হয়। সেখানেও কাতারে কাতারে স্থানীয় মুসলমান সমবেত হয় সেই বিচার প্রত্যক্ষ করতে। বিচার চলাবস্থায় নামাযের ওয়াক্ত হয়ে যাওয়ায় এক যুবক আজান দেয়। সাথে সাথে মহারাজার গভর্নরের নির্দেশে তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। তাকে গুলি করার সাথে সাথে আরেকজন দাঁড়িয়ে যান আজান দিতে। তাকেও গুলি করে হত্যা করা হয়। তারপর দাঁড়িয়ে যান আরো একজন। এভাবে সেদিন আজান দেয়ার অপরাধে একে একে ২২ জন কাশ্মীরী মুসলমান মৃত্যুকে বরণ করেন। শোকে ক্ষোভে প্রথমে স্তব্ধ হয়ে পড়লেও পরে উত্তাল হয়ে ওঠে সমগ্র কাশ্মীর।

১৩ জুলাই আজান দেয়ার ঘটনায় নিহতদের নামাজে জানাজা; Image Source: Kashmir reader

১৯৩১ সালেই প্রথমবারের মতো দীর্ঘদিনের অত্যাচার, নিপীড়ন ও সাম্প্রদায়িক বৈষম্যের বিরুদ্ধে স্থানীয় মুসলমান প্রজারা গণআন্দোলন করে। ১৯৩১ সালের এই গণআন্দোলনই পরবর্তীতে কাশ্মীরের স্বাধীনতা আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটায়।

This article is in Bengali language. It is about the history of Kashmir freedom movement and first mass movement in 1931. For reference please check the hyperlinks inside the article. 

Featured Image: Herald Magazine - Dawn

Related Articles