Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

কেট ওয়ার্ন: আমেরিকার প্রথম পেশাদার নারী গোয়েন্দা

গোয়েন্দা বলতেই আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে ঠোঁটে পাইপ, মাথায় টুপি, গায়ে ওভারকোট এবং খাড়া নাকওয়ালা একজনের অবয়ব। আরে, এ তো শার্লক হোমস! গল্পের পাতা থেকে উঠে আসা যেন এক জলজ্যান্ত গোয়েন্দা। গোয়েন্দা বলতে পুরুষ গোয়েন্দাদেরই আমরা কম-বেশি সকলে চিনি, সে গল্পেরই হোক কিংবা বাস্তবে। এক্ষেত্রে আগাথা ক্রিস্টির মিস মার্পল বা সুচিত্রা ভট্টাচার্যের মিতিন মাসি সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। কিন্তু বাস্তবে নারী গোয়েন্দাদের অস্তিত্ব কোথায়? তা জানতে হলে আমাদেরকে ইতিহাসের পাতায় চোখ বোলাতে হবে। ইতিহাসের পাতায় জায়গা করে নিয়েছেন সেসব সত্যিকারের নারী গোয়েন্দারা, যারা ইতিহাস পাল্টে দিয়েছেন কখনো অসীম সাহস, আবার কখনো অতুলনীয় আত্মত্যাগে।

ইতিহাস খুঁজতে আমরা পাড়ি দিবো আমেরিকায়, উনিশ শতকের পঞ্চাশের দশকে। যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক, সালটা ১৮৫৬। অ্যালান পিংকারটন নামে এক ভদ্রলোক শহরে ডিটেকটিভ এজেন্সি খুলে বসেছেন। এজেন্সির নামও বেশ চমকপ্রদ ‘পিংকারটন ন্যাশনাল ডিটেকটিভ এজেন্সি’। এজেন্সির জন্য কয়েকজন পেশাদার গোয়েন্দা এবং একজন মহিলা সেক্রেটারি চেয়ে খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়েছিলেন অ্যালান। অনেকেই এসে ইন্টারভিউ দিয়ে গিয়েছেন।

অ্যালান পিংকারটন; Source: Wikimedia commons

একদিন হঠাৎ পিংকারটনের অফিসে এসে হাজির ২২-২৩ বছরের এক তরুণী। অ্যালান তাকে দেখে ভেবেছিলেন মেয়েটি সেক্রেটারির পদের চাকরির জন্য ইন্টারভিউ দিতে এসেছে। কিন্তু সে জানায়, সে গোয়েন্দা হিসেবে কাজ করতে চায়। অ্যালান তাকে বোঝাতে চাইলেন গোয়েন্দাগিরি নারীদের পেশা নয়। এতে রয়েছে পদে-পদে বিপত্তি, প্রাণের ঝুঁকি, সম্ভ্রম হারানোর ভয়। মেয়েটি তাতে মোটেই দমবার পাত্রী নয়। সে নাছোড়বান্দা। তার যুক্তি, মেয়ে হলে গোয়েন্দাগিরি নাকি ঢের সোজা হয়ে যায়। অপরাধীদের গিন্নি অথবা বান্ধবীদের সঙ্গে একবার ভাব জমিয়ে নিতে পারলেই ভেতরের গোপন কথা এক নিমিষে বের করে আনা যায়। মেয়েটির নানা যুক্তি-তর্কে অ্যালান শেষমেষ মেয়েটিকে গোয়েন্দা পদে নিয়োগ দিতে সম্মতি দেন।

পিংকারটন ন্যাশনাল ডিটেকটিভ এজেন্সির সেই সময়ের অফিসিয়াল লোগো; Source: history.com

১৮৫৬ সালের ২৩ আগস্ট পিংকারটন ন্যাশনাল ডিটেকটিভ এজেন্সিতে যোগ দিলেন কেট ওয়ার্ন (১৮৩৩-১৮৬৮)। তাকে বলা হয়ে থাকে আধুনিক বিশ্বের প্রথম পেশাদার মহিলা গোয়েন্দা। প্রথমে কিছুদিন শিক্ষানবিশ, তারপরেই নেমে পড়া অপরাধের অন্ধকার জগতের রহস্যের সন্ধানে। কেট যে খুব রূপবতী ছিলেন তা কিন্তু নয়। হালকা-পাতলা গড়নের কেট তার পড়নের পোশাক-পরিচ্ছদ, ব্যক্তিত্ব আর অভিব্যক্তি দিয়ে যেকোনো পুরুষকেই আকর্ষণ করতে পারতেন। লাজুক চাহনী ও মায়াময় হাসি দিয়ে বাড়ির অন্দরের মহিলাদের কাছের মেয়ে হিসেবে পরিচিতি পেতে খুব একটা বেগ পেতে হতো না তাকে। তার সবচেয়ে শক্তিশালী অস্ত্র ছিল দুটি কান। আশেপাশে কোনো গোপন কথাই তার দুটো কানকে কখনোই ফাঁকি দিতে পারতো না। এই শ্রবণেন্দ্রিয়ই ছিল সেসময়ের গোয়েন্দাদের প্রধান অস্ত্র।

কেট ওয়ার্ন চরিত্রে অভিনয় করা মার্থা ম্যাকআইসাক; Source: twitter.com

কেট মানুষকে বিভ্রান্ত করতে ছিলেন ওস্তাদ, ক্ষণে ক্ষণে নিজের চেহারার পরিবর্তন আনার এক অসাধারণ গুণ ছিল তার মাঝে। তার ব্যক্তিত্ব আর আচার-আচরণের জন্য সমাজের অভিজাত শ্রেণীর লোকদের সাথে মেশার সুযোগ সহজেই পেয়ে যেতেন। ফলে অনেকের পক্ষে যেসব গোপন তথ্য সংগ্রহ করতে গলদঘর্ম হতে হতো, কেটের পক্ষে তা যেন ছিল জলভাত।

১৮৫৮ সালে কেট প্রথম অ্যাসাইনমেন্ট পান গোয়েন্দাগিরিতে তার দক্ষতা প্রমাণের। তহবিল দুর্নীতি নিয়ে অনুসন্ধানের একটি বড় ধরনের কাজ পেলো পিংকারটন ন্যাশনাল ডিটেকটিভ এজেন্সি। অ্যাডামস এক্সপ্রেস কোম্পানির ৫০ হাজার ডলারের কোনো হিসাব পাওয়া যাচ্ছিল না। প্রধান সন্দেহভাজন যিনি, সেই মি. ম্যাহনির বিরুদ্ধেও প্রমাণের অভাবে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারছিল না কোম্পানি। ফলে কোম্পানি অভিযুক্তকে ধরার জন্য পিংকারটনের দ্বারস্থ হয়।

পিংকারটন ন্যাশনাল ডিটেকটিভ এজেন্সি নিয়ে পরিচালিত এক টিভি সিরিয়ালের দৃশ্য; Source: twitter.com

কেটের ওপর দায়িত্ব পড়লো ম্যাহনির বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় তথ্য-প্রমাণ জোগাড় করার। কেটের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় তাকে বললো, ম্যাহনির বিরুদ্ধে তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহ করতে হলে তাকে ধরতে হবে মিসেস ম্যাহনিকে। পরিকল্পনামাফিক ম্যাহনি গিন্নির সাথে বন্ধুত্ব পাতালেন কেট। কিছুদিনের মধ্যেই কেটের হাতে চলে এলো একের পর এক গুরুত্বপূর্ণ সব তথ্য। গ্রেপ্তার হলেন মি. ম্যাহনি, উদ্ধার হলো খোয়া যাওয়া অর্থের অনেকটাই। এই সফল গোয়েন্দাগিরির পর এজেন্সিতে কেটের কদর ও গুরুত্ব বেশ বেড়ে গেলো।

এক টিভি সিরিয়ালে কেট ওয়ার্ন চরিত্রটিতে অভিনয় করা মার্থা; Source: twitter.com

তিন বছর পর ১৮৬১ সালে ক্রীতদাসদের মুক্তি নিয়ে উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকার মধ্যে লেগে যায় গৃহযুদ্ধ। এর আগের বছর, ১৮৬০ সালের ৬ নভেম্বর, ষোড়শ মার্কিন রাষ্ট্রপতি হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন আব্রাহাম লিঙ্কন। তিনি ছিলেন ক্রীতদাস প্রথা বিলোপের পক্ষে। রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হয়েই তিনি ঘোষণা দিলেন ক্রীতদাস প্রথা বিলোপের এবং জাতীয় কংগ্রেসে এই প্রথা বিলোপের পক্ষে আইন আনার জন্য তিনি ছিলেন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। লিঙ্কনের এই অনমনীয় অবস্থানে রীতিমতো খেপে যায় দক্ষিণের ক্রীতদাস নির্ভর অঙ্গরাজ্যগুলো। দক্ষিণের কর্তাব্যক্তিরা ছক কষছিলেন কীভাবে লিঙ্কনকে গুপ্তহত্যা করা যায়। এই কাজের জন্য তারা  উপযুক্ত লোক ভাড়া করলো। এরপর সুযোগের অপেক্ষা।

১৮৬২ সাল, ফেব্রুয়ারি মাসের মাঝামাঝি সময়ে রাষ্ট্রপতি হিসেবে লিঙ্কনের ইলিনয় থেকে ওয়াশিংটন আসার কথা। ট্রেনে করে বড়জোর দিন পাঁচেকের সফর। কিন্তু পথে বিভিন্ন জায়গায় লিঙ্কনকে অনেক উর্ধ্বতন ব্যক্তিদের সাথে সাক্ষাত করতে হবে। তাই পাঁচ দিনের সফর হয়ে যাবে এগারো দিন।

ষোড়শ মার্কিন রাষ্ট্রপতি আব্রাহাম লিঙ্কন; Source: Wikimedia commons

সেই সময় ইলিনয় থেকে ওয়াশিংটন পৌঁছানোর কোনো সরাসরি রাস্তা ছিল না। ক্যালভার্ট স্ট্রিট স্টেশনে ট্রেন থামলে বগিগুলোকে ইঞ্জিন থেকে আলাদা করে নেওয়া হতো। ঘোড়ায় টেনে সেই বগিগুলোকে নিয়ে যাওয়া হতো বাল্টিমোরের ক্যামডেন স্টেশনে, জুড়ে দেওয়া হতো আরেকটি ইঞ্জিনের সঙ্গে। ফলে লিঙ্কনকে ২৩ ফেব্রুয়ারি শিডিউল অনুযায়ী গাড়ি করে এক শহর থেকে আরেক শহরের মধ্য দিয়ে অতিক্রম করতে হবে। আততায়ীরা এই সময়েই লিঙ্কনের ওপর আঘাত হানার পরিকল্পনা করতে থাকে। আর এদিকে এই যাত্রাপথে লিঙ্কনের আসন্ন বিপদ রুখে দেওয়ার জন্য রেল কোম্পানি পুরো যাত্রাপথে প্রেসিডেন্টের নিরাপত্তার দায়িত্বে রেখেছিল পিংকারটন এজেন্সিকে। এজেন্সি এই কাজে কেটসহ পাঁচজন গোয়েন্দাকে বাল্টিমোরে নিযুক্ত করে।

৩ ফেব্রুয়ারি বাল্টিমোরে এসে উপস্থিত হলো এক ধনী দক্ষিণা রমণী। শহরের সবচেয়ে নামী হোটেলে উঠেছেন তিনি। তার ব্যক্ত্বিত্ব আর পরিপাটি বেশভূষায় সহজেই ভাব জমিয়ে ফেললেন শহরের অভিজাতশ্রেণীর কর্তাব্যক্তিদের সাথে। নিজেকে তিনি পরিচয় দিলেন ক্রীতদাস প্রথার সমর্থক হিসেবে। কাজেই দক্ষিণপন্থী এই সুন্দরী নারীর কানে আসতে থাকে লিঙ্কনকে হত্যার  টুকরো টুকরো সব পরিকল্পনা। জিগস’ পাজলের মতো সেগুলোকে সাজাতেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে প্রেসিডেন্টকে হত্যার ষড়যন্ত্র। সেই ধনীর দুলালী আর কেউ নন, কেট ওয়ার্ন স্বয়ং! তিনি এই ষড়যন্ত্রের খবর জানান তার এজেন্সিকে। রাষ্ট্রপতির দপ্তরে এই খবর আসার পর সফর বাতিল করার জন্য লিঙ্কনকে অনুরোধ জানানো হয়। কিন্তু তিনি কিছুতেই এই সফর বাতিল করবেন না বলে জানান। ফলে পুনরায় পিংকারটন এজেন্সির কাছে দায়িত্ব পড়লো কীভাবে লিঙ্কনের আসন্ন সফর নির্বিঘ্ন করা যায়।

পরিত্রাতা হিসেবে এগিয়ে এলেন সেই কেট। সফরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশে লিঙ্কনকে তিনি সাজালেন নিজের বিকলাঙ্গ ভাই। নিজেই কাটলেন দুজনের টিকিট, তারপর প্রেসিডেন্টকে তার কম্পার্টমেন্টে ঢুকিয়ে ২৩ ফেব্রুয়ারি সারাটা রাত সতর্ক প্রহরায় রইলেন। তার এই কাজের সঙ্গে যুক্ত রইলেন তার বস অ্যালান পিংকারটন। আর কয়েক বছর পরেই পৃথিবীর ইতিহাস পাল্টে দেবেন যে মানুষটি, সেই আব্রাহাম লিঙ্কনের নিরাপত্তা নিশ্ছিদ্র রাখাই তখন কেটের জীবনমরণ পণ। সফল হলেন কেট ও তার এজেন্সি। কেটের নিখুঁত পরিকল্পনায় আততায়ীরা বুঝতেই পারলো না ঠিক কোন গাড়িতে আছেন লিঙ্কন। ব্যর্থ হয়ে ফিরে গেলো তারা। নিরাপদে ওয়াশিংটন পৌঁছলেন প্রেসিডেন্ট, হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো মার্কিন প্রতিরক্ষা দপ্তর।

আব্রাহাম লিঙ্কন ও অ্যালান পিংকারটন; Source: history.com

এজেন্সিতে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা দপ্তরে কেটের খ্যাতি ও সুনাম ছড়িয়ে পড়লো। কেট তার উর্ধ্বতনের কমান্ড মানতে ও যেকোনো ঝুঁকি নিতে যেমন পিছপা হতেন না, ঠিক তেমনি সন্দেহজনক ব্যক্তির কাছ থেকে কথা আদায় করতে নির্মোহ থাকতে পারতেন। কাজের প্রয়োজনে হতে পারতেন যেমন স্নেহশীলা রমণী, ঠিক তেমনি প্রয়োজনের মুহুর্তে বন্দুক ধরা থেকে শুরু করে কঠোর ব্যক্তিত্বের মনোভাবও ফুটে উঠতো তার কাজের মধ্য দিয়ে। কার্যসিদ্ধির জন্য দিনের পর দিন নির্ঘুম রাত কাটিয়ে দিতে পারতেন তিনি। ফলে পিংকারটন এজেন্সীতে তার সুখ্যাাতি বাড়ার সাথে সাথে এজেন্সির সুখ্যাতিও দিন দিন ছড়িয়ে পড়ে।

অ্যালান পিংকারটন, এই গোয়েন্দা সংগঠনটির প্রধান, প্রথম অনুভব করেন যে নারীদের গুপ্তচর হিসেবে কাজে লাগাতে পারলে অনেক গোপন তথ্য সহজে উদঘাটন করা সম্ভব। এর আগে মূলত গোয়েন্দা দপ্তর বা এজেন্সিগুলোতে নারীদের সাচিবিক দায়িত্ব পালনে নিয়োজিত করা হতো। এজেন্সির প্রতিষ্ঠাতা অ্যালানই এজেন্ট হিসেবে নারীদের নিযুক্ত করার সাহস প্রথম দেখিয়েছিলেন। এক্ষেত্রে তাকে অগ্রদূতও বলা যায়।

কেট ওয়ার্নের এক দুর্লভ ছবি; Source: all-that-is-interesting.com

সেসময়ের আমেরিকার জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ নিরাপত্তা সেবা প্রদানে পিংকারটন গোয়েন্দা সংস্থায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন কেট ওয়ার্ন। এরপর গৃহযুদ্ধের সময়ও লিঙ্কন সরকারের অনেক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। ক্রমশ যশ ও পরিচিতি বাড়ছিলো তার। কিন্তু ১৮৬৮ সালের জানুয়ারি মাসে এক দুরারোগ্য জ্বরে আক্রান্ত হয়ে চিরকালের মতো ঘুমিয়ে পড়লেন ৩৫ ছোঁয়া এই রহস্যভেদী তরুণী, ইতিহাসে প্রথম নারী গোয়েন্দা হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়া এই আমেরিকান তরুণী।

ফিচার ইমেজ: Civil War Women Blog

Related Articles