Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

রাজা জারক্সিস: গ্রিক অভিসারে উন্মাদ এক রাজার ইতিকথা

দূরের উত্তাল সাগরের গর্জন এসে ভেঙে পড়ছে পারস্যের সর্বক্ষমতার অধিকারী রাজা জারক্সিসের প্রাসাদে। সময় তখন গভীর রাত। গোলাকার চাঁদ, কয়েক লক্ষ তারকা, রাজপ্রাসাদের শত শত প্রহরী এবং নিদ্রাহীন রাজা জারক্সিস ব্যতীত তখন পারস্যের একটি মানুষও জেগে নেই। পিতামহ এবং পিতার কল্যাণে বিশাল সাম্রাজ্যের অধিকারী হয়ে উঠেছেন তিনি। যতদূর চোখ যায় শুধু পারস্য সাম্রাজ্যের ঝাণ্ডা উড়তে দেখা যায়। তার প্রজারা তাকে ‘রাজাদের রাজা’ বলে সম্বোধন করে। কিন্তু এত প্রাচুর্য্যের মাঝেও তার চোখে কোনো ঘুম নেই। পৈতৃক সূত্রে পাওয়া রাজত্ব নিয়ে তিনি খুশি হতে রাজি নন। তাই শত ঐশ্বর্যের মাঝেও যুদ্ধক্ষেত্রের উগ্র দামামা তার অস্তিত্বকে আকৃষ্ট করতো।

রাজার অস্থিরতার কারণ বুঝতে পারলেন তার চাচাতো ভাই মারদোনিয়াস। মারদোনিয়াস পারস্যের সেনাপতি ছিলেন। তিনিও যুদ্ধে যাওয়ার জন্য সুযোগ খুঁজছিলেন। এই সুযোগ তিনি হাতছাড়া করতে চাইলেন না। জারক্সিসকে তিনি মন্ত্রণা দেন, আমাদের পরলোকগত রাজা এবং তোমার পিতা সবকিছু জয় করতে পেরেছেন। তবে এতকিছুর মাঝেও তিনি এক জায়গায় ব্যর্থ হয়ে ফিরেছেন বারবার। আর সেটা হচ্ছে গ্রিক সাম্রাজ্য।” গ্রিক সাম্রাজ্যের কথা শুনতেই জারক্সিসের গায়ের রক্ত টগবগ করে ফুটতে থাকলো। মনে পড়ে গেলো ম্যারাথন যুদ্ধে পিতা দারিওসের শোচনীয় পরাজয়ের করুণ ইতিহাস। এবার দারিওসের অধরা গ্রিক সাম্রাজ্যকে নিজের দখলে নিয়ে আসতে হবে। আর তা করতে পারলেই নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করতে পারবেন তিনি। নিজের সিদ্ধান্তে সন্তুষ্ট জারক্সিস দৃষ্টি ফেলেন দূর সমুদ্রের দিকে। ঠিক এসময়ে ভূমধ্যসাগরের তীরে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে আছে তার শত্রু গ্রিকরা।

রাজা প্রথম জারক্সিস পরিচিতি

বিশালদেহী স্পার্টানদের হুংকারে কম্পিত হচ্ছে গ্রিসের আকাশ বাতাস। আর ওদিকে লাখ লাখ সেনাবাহিনীর পদক্ষেপে আন্দোলিত হচ্ছে গ্রিসের শক্ত মাটি। যেন রিখটার স্কেলের ৮ মাত্রার ভূমিকম্পে ধ্বসে যাচ্ছে পুরো গ্রিস। স্পার্টানদের দমন করতে এই বিশাল বাহিনীর নেতৃত্ব দিয়ে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে নিষ্ঠুর রাজা জারক্সিস। সিনেমাপ্রেমী মানুষদের নিকট জারক্সিসের চিত্রটা ঠিক এরূপ।

ফ্রাঙ্ক মিলার রচিত বিখ্যাত সচিত্র-উপন্যাস ‘থ্রি হান্ড্রেড‘-এর মাধ্যমে আমরা অনেকেই জারক্সিসের সাথে পরিচিত হই। যেহেতু ঔপন্যাসিক মিলার স্বাধীনভাবে গল্পের খাতিরে জারক্সিসকে নিজের মনের মতো চিত্রায়িত করেছেন, তাই ইতিহাসে বর্ণিত জারক্সিসের গল্পের সাথে এর বেশ কিছু তফাৎ পরিলক্ষিত হয়। জারক্সিসকে গ্রিক এবং ইউরোপীয় ইতিহাসবিদগণ একজন লোভী-অত্যাচারী শাসক হিসেবে বর্ণনা করলেও পারস্যের অনেক ঐতিহাসিক পাণ্ডুলিপি এর সাথে দ্বিমত প্রকাশ করেছে। দু’দেশের ইতিহাসবিদগণ নিজস্ব দৃষ্টিকোণ থেকে জারক্সিসকে বর্ণনা করার ফলে এই সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে।

শিল্পীর তুলিতে জারক্সিসের শাসন চিত্র; Source: Ancient Origin

রাজা প্রথম জারক্সিস প্রাচীন আকামেনিদ সাম্রাজ্যের চতুর্থ শাসক ছিলেন। ইউরোপীয়দের নিকট জারক্সিস নামে পরিচিত হলেও প্রাচীন ফারসি ভাষায় তার নাম ‘খাসাইয়ার শাহ‘। আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ৫১৯ সালে জন্ম নেয়া এই পরাক্রমাশীল শাসককে পারস্যের মানুষ ‘শাহেন শাহ’ বলে সম্বোধন করতো। জারক্সিস পারস্যের বিখ্যাত শাসক দারিওসের পুত্র এবং উত্তরাধিকারী ছিলেন। ইতিহাস জারক্সিসকে মনে রেখেছে  গ্রিকদের বিরুদ্ধে তার পরিচালিত ঐতিহাসিক অভিযানের জন্য। গ্রিকদের বিরুদ্ধে জারক্সিস বাহিনী থার্মোপিলা, সালামি এবং প্লাটা নামক তিনটি যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। পারস্য রাজ ফরমান অনুযায়ী কোনো রাজার পরে তার জ্যেষ্ঠ পুত্র সিংহাসনের উত্তরাধিকারী হবে। কিন্তু জারক্সিস রাজা দারিওসের জ্যেষ্ঠ পুত্র না হওয়া সত্ত্বেও পুরো পারস্যের রাজত্ব অর্জন করেন। কারণ, জারক্সিসের সৎভাই আর্তাবাজানের মাতা পারস্য রাজপরিবারের সদস্য ছিল না। অপরদিকে জারক্সিসের মাতা আতোসা ছিলেন আকামেনিদ সাম্রাজ্যের স্থপতি মহামতি সাইরাসের কন্যা। তাই দারিওসের মৃত্যুর পর সভাসদগণের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী রাজদণ্ড জারক্সিসের হাতে তুলে দেওয়া হয়।

অভিষেকের পর চাটুকার দ্বারা পরিবেষ্টিত জারক্সিসের রাজকীয় জীবনধারা চলতে থাকে আপন খেয়ালে। কিন্তু তিনি বেশিদিন এই সুখ সহ্য করতে পারলেন না। একসময় তিনি বুঝতে পারলেন, দারিওসের পুত্র হিসেবে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করতে হলে তাকে আরো কঠোর হতে হবে। জয় করতে হবে পুরো বিশ্ব। সেই নেশা থেকে জারক্সিস পারস্য ত্যাগ করে গ্রিক অভিযানের স্বপ্ন দেখতে থাকেন।

ফ্রাঙ্ক মিলারের ‘থ্রি হান্ড্রেড’ সিনেমায় শাহেন শাহ জারক্সিস; Source: Collider

আগে ঘর, তবে পর

দারিওস এবং জারক্সিসের পাণ্ডুলিপি; Source: Megas Alexandros

জারক্সিস যখন গ্রিস জয়ের নেশায় বুঁদ হয়ে ছিলেন, ঠিক তখন তার রাজ্যের ব্যাবিলন অঞ্চলে দানা বেঁধে উঠছিলো বিদ্রোহের আগুন। যে আগুনের উত্তাপ তার সিংহাসনকে ভস্মীভূত করে দেয়ার জোর হুমকি দিচ্ছিলো। এই বিদ্রোহের সূচনা হয় স্বয়ং জারক্সিসের একটি বিতর্কিত সিদ্ধান্তের দরূণ। জারক্সিসের পিতামহ সাইরাসের শাসনামলে ব্যাবিলনের সাথে পারস্যের মিত্রতাপূর্ণ সম্পর্ক বিদ্যমান ছিল। কিন্তু জারক্সিস এই সম্পর্ক অস্বীকার করে বসেন এবং ব্যাবিলনকে পারস্য সাম্রাজ্যের অধীনস্ত অঞ্চল হিসেবে ঘোষণা দেন। তখন ব্যাবিলনের সভাসদগণ বিদ্রোহ করে বসে। এরপর তিনি ব্যাবিলনের প্রধান দেবতা মারদুকের স্বর্ণমূর্তি ধ্বংস করে এই বিদ্রোহের আগুনে ঘি ঢেলে দেন। ব্যাবিলনবাসী তাদের ধর্মানুভূতিতে চরম আঘাতকারী জারক্সিসের অধীনস্ত থাকতে আর এক মুহূর্ত রাজি ছিল না। ওদিকে জারক্সিস একের পর এক মিত্র রাষ্ট্রদের নিজের অধীনস্ত ঘোষণা করতে থাকেন।

ততদিনে তিনি পারস্যের রাজা জারক্সিস থেকে পারস্য এবং মেদেসের রাজা মহামতি শাহেন শাহ জারক্সিসে পরিণত হয়েছেন। আপনাদের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, জারক্সিস হঠাৎ কোনো কারণ ব্যতিরেকে কেন মিত্র রাষ্ট্রদের নিজের অধীনস্ত করা শুরু করেছিলেন? গ্রিসের মতো শক্তিশালী রাজ্য দখলের জন্য প্রথমেই জারক্সিসের দরকার লোকবল। যুদ্ধে পটু গ্রিকদের তুলনায় শক্তি এবং সংখ্যায় দুদিক থেকে এগিয়ে না থাকলে এই যুদ্ধ জয় করা অসম্ভব। পারস্যের মিত্র রাষ্ট্রগুলো এই যুদ্ধের পক্ষে ছিল না। তাই জোরপূর্বক রাষ্ট্র দখলের মাধ্যমে পারস্য বাহিনীর সেনা সংখ্যা বাড়াতে থাকেন জারক্সিস। বিদ্রোহীদের সাথে মোকাবেলা করতেও প্রস্তুত ছিলেন তিনি। তাই পরিকল্পনা মোতাবেক শক্তিশালী ফৌজ প্রেরণ করেন বিদ্রোহের আগুনে পানি ঢেলে দেয়ার জন্য। সেবার নিষ্ঠুরভাবে ব্যাবিলনের বিদ্রোহী জনতার উপর হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়। এভাবে নিভে যায় ব্যাবিলনের বিদ্রোহের আগুন।

ইরান জাদুঘর থেকে প্রাপ্ত জারক্সিসের প্রতিকৃতি; Source: National Museum of Iran

ব্যাবিলনের সমসাময়িক পারস্যের অধীনস্ত বিশাল মিশর সাম্রাজ্যেও বিদ্রোহ হয়েছিলো। প্রায় দু’বছর ধরে মিশর শাসন করছিলো বিদ্রোহী গোষ্ঠী। জারক্সিস বাহিনী মিশরের উপর চড়াও হয়ে বসে। ৪৮৪ খ্রিস্টপূর্বে মিশরের বিদ্রোহ সম্পূর্ণভাবে দমন করা হয়। পরবর্তীতে জারক্সিস নিজেকে জরথ্রুস্টের দেবদূত হিসেবে জাহির করেন। এর সাথে তিনি ব্যাবিলনের সকল দেবতার আরাধনা নিষিদ্ধ করে দেন।

প্রস্তুতি পর্ব এবং পুরোহিতদের নিষেধাজ্ঞা

মিশর সমস্যা সমাধানের পর জারক্সিস এবার গ্রিসের দিকে পূর্ণ মনোযোগ দিলেন। প্রায় চার বছর ধরে রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সামর্থ্যবান যুবকদের ধরে এনে ভর্তি করা হলো পারস্য বাহিনীতে। বিভিন্ন দিক থেকে অস্ত্র এসে জমা হতে থাকলো পারস্য ভাণ্ডারে। এমনকি অধীনস্ত রাজ্যগুলোর রাজপরিবারের সদস্যদেরও নিস্তার দেননি জারক্সিস। রাজা ক্রোসাসের বংশধর পিথিয়াসের পাঁচ পুত্রকে বলপূর্বক সেনাবাহিনীতে ভর্তি করান জারক্সিস। পিথিয়াস এই ঘটনায় দিশেহারা হয়ে পড়লেন। তিনি জারক্সিসকে প্রচুর উপঢৌকন এবং অর্থের বিনিময়ে তার সন্তানদের মুক্তির আবেদন করেন। কিন্তু সামান্য উপঢৌকনের লোভে পা দিতে নারাজ জারক্সিস। তিনি কঠোর চিত্তে এই নিবেদন প্রত্যাখ্যান করেন। তবে একদম খালি হাতে ফিরতে হয়নি পিথিয়াসকে। পিথিয়াসের ত্যাগ স্বীকারকে সম্মানিত করে জারক্সিস তাকে খাজাঞ্চি হিসেবে নিয়োগ দান করেন।

প্রায় চার বছর ধরে গড়ে তোলা হয় বিশাল পারস্য বাহিনী; Source: Comic Vine

প্রাচীনকালে যুদ্ধে রওয়ানা দেয়া মানে শুধু বিশাল সেনাবাহিনী নিয়ে দামামা বাজিয়ে যুদ্ধের ময়দানে পদার্পণ করা ছিল না। যুদ্ধের পূর্বে রাজাকে পুরোহিতদের সংকেতের জন্য অপেক্ষা করতে হতো। পুরোহিতগণ বিভিন্ন লক্ষণ বিচার করে রাজাকে সবুজ সংকেত প্রদান করা মাত্র বেজে উঠতো মাদল। জারক্সিসও তার পুরোহিতদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। কিন্তু পুরোহিতরা তার সামনে আসতে ভয় পাচ্ছিলো। কারণ চাঁদের অবস্থান এবং প্রকৃতির বিভিন্ন লক্ষণ বিচার করে এই যাত্রা শুভ হবে বলে মনে হচ্ছে না তাদের। জারক্সিস এই কথা শুনে রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে গেলেন। তিনি পুরোহিতদের নির্দেশকে তোয়াক্কা না করে দ্রুত গ্রিসের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হবার সিদ্ধান্ত নিলেন।

ওদিকে বেচারা পিথিয়াস বুঝতে পেরেছিলেন, রাজার এই অভিযান সফল হবে না। তাই তিনি জারক্সিসের নিকট কাতর আবেদন করলেন যেন তার জ্যেষ্ঠ পুত্রকে এই যুদ্ধ থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়। জারক্সিস ক্রুদ্ধ হয়ে গেলেন পিথিয়াসের প্রতি। এর অর্থ দাঁড়ায়, পিথিয়াস সরাসরি রাজা জারক্সিসের সফলতাকে অস্বীকার করছে। জারক্সিস গ্রিক অভিযানের পূর্বে পিথিয়াসকে কঠোর শাস্তি দিতে চাইলেন। তিনি তার জ্যেষ্ঠ পুত্রকে সেনাবাহিনী থেকে বহিষ্কার করে আটক করলেন। তারপর জনসম্মুখে তাকে কেটে দু’টুকরা করে ফেলেন। তারপর সেই লাশকে জারক্সিসের যাত্রাপথের দু’ধারে দাফন করার নির্দেশ দেন। দু’দিকে পিথিয়াসের সন্তানের ছিন্ন হওয়া দেহের কবরের মাঝখান দিয়ে শৃঙ্খলভাবে এগিয়ে যেতে থাকে প্রায় দুই মিলিয়ন সেনা সম্বলিত বিশাল পারস্য বাহিনী। প্রায় চার হাজার রণতরী বোঝাই হয়ে তারা গ্রিসের পানে রওয়ানা দেয়। জাহাজ চালনার সুবিধার্থে জারক্সিসের প্রকৌশলীরা শত শত প্রশস্ত খাল খনন করেছিলেন, যার ধ্বংসাবশেষ আজও জারক্সিসের সেই অভিযানের স্মৃতি নিয়ে টিকে আছে।

জাহাজ চালনার সুবিধার্থে এরকম বহু খাল খনন করা হয়; Source: Ouranoupoli

গ্রিস আগ্রাসনে জারক্সিস

“আজ আমরা ইতিহাস পাল্টে দিতে এসেছি। আমি পারস্যের সীমানা এতদূর বিস্তৃত করবো যে এর একমাত্র সীমানা হবে মাথার উপর বিদ্যমান আসমান। যেন সূর্য প্রতিদিন উদয় হওয়ার পর পারস্য ব্যতীত আর কোনো রাজ্যের মাটিতে তার আলো পৌঁছে দিতে না পারে।”

গ্রিসের উপকূলে হাজারো জাহাজ নোঙর ফেলতে থাকলো। সবার সম্মুখে শাহেন শাহ জারক্সিস এভাবে চিৎকার করতে করতে যুদ্ধের উন্মাদনা ভর করিয়ে দিতে থাকলেন পারস্য যোদ্ধাদের মাথায়। পারস্যের যোদ্ধারা চিৎকার করতে করতে একযোগে এগিয়ে যেতে থাকে গ্রিসের প্রধান শহর এথেন্সের পানে। ওদিকে গ্রিকরা এথেন্সের সেনাপতির নির্দেশে দলে দলে যুদ্ধক্ষেত্রে যোগ দিতে থাকে। মাতৃভূমি গ্রিসকে রক্ষার জন্য মরিয়া হয়ে উঠে সংগ্রামী গ্রিকরা। গ্রিকদের সম্মিলিত বাহিনীর সাথে পারস্য বাহিনী দুটো খণ্ডযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। কিন্তু পারস্য বাহিনীর সামনে মাটির পুতুলের ন্যায় ভেঙে যেতে থাকলো গ্রিকদের প্রতিরোধ। আরতেমিসিয়াম এবং থার্মোপিলার যুদ্ধে পারস্য বাহিনী বিজয় লাভ করে। এই জয়ের ফলে পারস্য বাহিনী সরাসরি এথেন্সে প্রবেশের সুযোগ লাভ করে এবং দ্রুত এর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। জারক্সিস তখন উন্মাদ দানবে পরিণত হয়ে গেলেন। তার নির্দেশে এথেন্সের প্রতিটি স্থাপনা এবং বাসস্থানে আগুন লাগিয়ে দেয়া হয়। ভূমধ্যসাগরের তীরে যেন এক অভিশপ্ত আগুন খেলায় মেতে উঠেন তিনি।

চার হাজার জাহাজ নোঙর ফেললো গ্রিক উপকূলে; Source: Pinterest

টেবিলের অন্তরালে রহস্যময় বার্তা

এথেন্সের পতনের পর গ্রিকরা হতবিহ্বল হয়ে পড়লো। জারক্সিসের এই অতিকায় বাহিনী, যাদের পদচারণায় গ্রিসের শক্ত ভূমি কম্পিত হয়ে উঠে, তাদের সাথে গ্রিকদের একা পেরে উঠা কোনোভাবেই সম্ভব ছিল না। যুদ্ধের পর যখন পারস্য শিবিরে আনন্দ উদযাপন হচ্ছিলো, ঠিক তখন শিবিরের শেষ তাবুতে এক ব্যক্তি চিন্তিত মনে একা বসে আছে। তার নাম দেমারাতাস। লোকটির নাম থেকেই বোঝা যায়, সে জন্মগতভাবে পারসি ছিল না। বরং সে ছিল এক গ্রিক নাগরিক।

এক বিশেষ কারণে তাকে গ্রিস থেকে বিতাড়িত করা হলে জারক্সিস তাকে নিজ রাজ দরবারে এনে ঠাঁই দেন। সেদিন থেকে সে গ্রিকদের মনেপ্রাণে ঘৃণা করে। কিন্তু আজ তার মনের মাঝে অস্বস্তিবোধ হচ্ছে। হাজার হোক, গ্রিস তার জন্মভূমি। এভাবে এক অত্যাচারী রাজার হাতে সভ্য গ্রিকদের পরাজয় সে মেনে নিতে পারবে না। এই বিশাল বাহিনীর বিপক্ষে বিজয় লাভ করতে হলে, গ্রিকদের অবশ্যই জারক্সিসের সম্পূর্ণ পরিকল্পনা সম্পর্কে পূর্ব থেকে অবগত হওয়া জরুরি। কিন্তু পারস্য প্রহরীদের কড়া নজরকে ফাঁকি দিয়ে চিঠি তো দূরের কথা, একটি মাছিও গ্রিক শিবিরে যেতে পারে না। তাহলে উপায়?

‘থ্রি হান্ড্রেড’ সিনেমায় স্পার্টার রাজা লিওনাইডাস এবং তার বুদ্ধমতি স্ত্রী গ্রোগো; Source: 300 Photo Gallery

বুদ্ধিমান দেমারাতাস সম্পূর্ণ ভিন্ন পথ অবলম্বন করে গ্রিক শিবিরে বার্তা প্রেরণ করলো। সে একটি কাঠের টেবিলের উপরিভাগে খোদাই করে জারক্সিসের সম্পূর্ণ পরিকল্পনা এবং পারস্য বাহিনীর দুর্বলতা সম্পর্কে জানিয়ে একটি পত্র রচনা করলো। তারপর সে ঘন মোমের প্রলেপ দিয়ে সেটি আচ্ছাদিত করে এক প্রহরীর মাধ্যমে গ্রিক শিবিরে প্রেরণ করে দেয়। গ্রিকরা টেবিলটি উপহার হিসেবে গ্রহণ করলেও তাদের সর্দার কিংবদন্তি রাজা লিওনাইডাস এর মর্মার্থ উদ্ধারে ব্যর্থ হলেন। তার কাছে পুরো ব্যাপারটি এক গ্রিক নির্বাসিত বিশ্বাসঘাতকের প্রহসন হিসেবে লাগলো।

কিন্তু তার স্ত্রী গ্রোগো বুঝতে পেরেছিলেন এটি কোনো সাধারণ টেবিল নয়। তিনি টেবিলের উপর মোমের আচ্ছাদন লক্ষ্য করে নির্দেশ দিলেন যেন এটি খুব দ্রুত সতর্কতার সাথে তুলে ফেলা হয়। মোমের আচ্ছাদন সরে যেতেই ধরা পড়লো সেই গোপন বার্তা। অভিভূত লিওনাইডাস নতুন উদ্যমে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে থাকলেন। পর্দার আড়ালে থাকা এক দেশপ্রেমিকের বুদ্ধিমত্তায় যেন গ্রিকরা যুদ্ধে নিজেদের নতুনভাবে আবিষ্কার করলো। 1

গ্রিকদের পাল্টা জবাব

এথেন্স পতনের পর পলাতক গ্রিক সেনারা লিওনাইডাসের অধীনে পেলোপনিস অঞ্চলে নতুন করে সেনাবাহিনী গড়া শুরু করে। ওদিকে জারক্সিস তখন তার সভাসদদের সাথে শলা-পরামর্শ করছিলেন। অনেকে বলছিলো, রাজা যেন গ্রিস অভিযানকে সফল ঘোষণা করে এথেন্সের মাটিতে পারস্যের ঘাঁটি নির্মাণ করে পারস্যে ফিরে যান। কিন্তু সেনাপতি এবং আরতেমিসিয়া নামক এক রাজকন্যার পরামর্শ অনুযায়ী জারক্সিস যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনায় অটল থাকেন।

সালামির যুদ্ধ নিয়ে শিল্পকর্ম; Source: Wikimedia Commons

দার্শনিকদের হিসাব অনুযায়ী, ৪৮০ খ্রিস্টপূর্বের ২৩ সেপ্টেম্বর পারস্যদের সাথে গ্রিক বাহিনী লিওনাইডাস নামক এক স্পার্টান রাজার অধীনে সালামি যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। দেমারাতাসের নির্দেশ মতো গ্রিকরা প্রায় দুইশত জাহাজ নির্মাণ করে সেদিন যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো। জারক্সিসের পরিকল্পনা গ্রিকদের কাছে ফাঁস হয়ে যাওয়ায় মনস্তাত্ত্বিকভাবে গ্রিকরা যুদ্ধে এগিয়ে ছিল। গ্রিক নৌবাহিনীর সাথে পারস্যের নৌবাহিনীর সরাসরি যুদ্ধ লেগে যায়। যুদ্ধের একপর্যায়ে গ্রিকরা ইচ্ছে করে পিছু হটতে থাকলে জারক্সিস উল্লাসে ফেটে পড়েন। তিনি ভেবেছিলেন গ্রিকরা পরাস্ত হয়েছে। কিন্তু ওদিকে সুকৌশলে গ্রিকরা পারস্য নৌবাহিনীকে গ্রিক উপসাগরে প্রবেশ করিয়ে কোণঠাসা করে ফেলছিলো।

কয়েক মুহূর্ত পরে কোনো কিছু বুঝে উঠার পূর্বে ভূমধ্যসাগরীয় বায়ু তার দিক পরিবর্তন করে বিপরীত দিকে বইতে শুরু করলে হতবিহ্বল হয়ে পড়ে হাজার হাজার পারস্য জাহাজ। বাতাসের তীব্রতার কাছে হার মানে লক্ষ লক্ষ পারসি সেনা। প্রকৃতির সাথে তাল মিলিয়ে আক্রমণ করতে থাকে গ্রিকরা। এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে প্রাণ হারাতে থাকে পারসি সেনারা। রাজকন্যা আরতেমিসিয়া যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পলায়ন করে। সেদিন গ্রিকদের বুনো চিৎকারের কাছে ম্রিয়মাণ হয়ে পড়ে প্রজ্বলিত জারক্সিস বাহিনীর দুর্ধর্ষতা। সেদিন মাত্র কয়েক হাজার পারসি সেনা প্রাণে বেঁচে ফিরে আসতে সক্ষম হয়েছিলো। যুদ্ধের ভয়াবহতা অবলোকন করে সভাসদদের পরামর্শ অনুযায়ী জারক্সিস মারদোনিয়াসকে পুরো বাহিনীর দায়িত্ব প্রদান করে নিজে পারস্যে পালিয়ে যান।

গ্রিকদের আক্রমণে বিধ্বস্ত পারস্য নৌবাহিনী; Source: Pinterest

মারদোনিয়াস জারক্সিসের নামে গ্রিকদের বিরুদ্ধে প্লাটা যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। কিন্তু শাহেন শাহের অনুপস্থিতিতে যেন পারসি সেনারা ঝিমিয়ে পড়েছিলো। এর খেসারত দিতে গিয়ে যুদ্ধে প্রাণ হারায় মারদোনিয়াস। এর মাধ্যমে পারস্য বাহিনীর চূড়ান্ত পরাজয় হয়। যুদ্ধক্ষেত্র থেকে বিজয়ের বেশে সম্পূর্ণ গ্রিসের অধিকার পুনরুদ্ধার করে ফিরে আসে গ্রিক সেনারা। এথেন্সের রাজপথ জুড়ে গ্রিক সেনাদের বন্দনা সংগীতে মুখর থাকে সাধারণ জনতা। এর মাধ্যমে জারক্সিসের গ্রিক আগ্রাসনের চূড়ান্ত যবনিকাপাত ঘটে।

জারক্সিস সমাপ্তি

গ্রিক যুদ্ধে পরাজিত জারক্সিস মাত্র কয়েক হাজার যোদ্ধা নিয়ে দেশে ফিরে আসেন। অর্থ এবং খাদ্যের অভাবে পারসি সেনারা অনাহারে মরতে থাকে। কিন্তু সেদিকে জারক্সিসের কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই। তিনি তখন নিজেকে হারিয়ে এক উদাসীন রাজায় পরিণত হয়েছেন। রাজকার্যেও তার মনোযোগের ঘাটতি দেখা যায়। সভাসদদের হাতের পুতুলে পরিণত হন জারক্সিস। জারক্সিসের গ্রিক পরাজয়ের মাধ্যমে পারস্য সাম্রাজ্যের বিখ্যাত আকামেদিন যুগের সূর্য চিরদিনের জন্য অস্তমিত হয়

গ্রিক অভিযান ব্যর্থতার ঝিমিয়ে পড়েন প্রতাপশালী জারক্সিস; Source: 300 Movie Gallery

অস্থিতিশীল রাজ দরবারের বিশ্বাসঘাতক সভাসদগণ জারক্সিসের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। তাকে অপসারণ করার মাধ্যমে একজন শক্তিশালী শাসককে পুনরায় পারস্যের সিংহাসনের বসানোর পরিকল্পনা করা হয়। খ্রিস্টপূর্ব ৪৬৫ সালে জারক্সিসের মন্ত্রী আরতাবানুস বেশ কিছু সভাসদের সাহায্যে জারক্সিসকে সিংহাসন থেকে উৎখাত করে। জারক্সিসের পর পারস্য সিংহাসনে আসীন হন তার পুত্র রাজা প্রথম আর্তাজারক্সিস। এর মাধ্যমে পৃথিবীর ইতিহাসের এক অন্যতম খলনায়ক জারক্সিসের অবসান ঘটে।

ইতিহাসের আবর্তে সেদিনের পারস্য সাম্রাজ্য ধীরে ধীরে ধ্বংসের দিকে ধাবিত হতে থাকে। একসময় পৃথিবীবাসী ভুলে যায় এককালের প্রতাপশালী সাম্রাজ্য পারস্যের কথা। কিন্তু ইতিহাস পারস্যকে ভুলে যায়নি। ইতিহাস ভুলেনি জারক্সিসের গ্রিক অভিসারের কথা। যতদিন পৃথিবীর মানুষ ইতিহাসকে ভালোবাসবে, ততদিন ইতিহাসের রথে চড়ে পৃথিবীর বুকে বারবার ফিরে আসবে জারক্সিস এবং তার অতিকায় বাহিনী। অপরদিকে প্রস্তুত থাকবে স্পার্টার রাজা লিওনাইডাস। যিনি এক রহস্যময় টেবিলের মাধ্যমে ইতিমধ্যে জারক্সিসের গোপন পরিকল্পনা সম্পর্কে অবহিত আছেন।

তথ্যসূত্র:

1 The Code Book by Simon Singh, 1st edition, published on 1999 from Anchor Books. Page no: 20-21

ফিচার ইমেজ: Lakwatsera Lovers

 

Related Articles