মানবজাতির ইতিহাসে এমন অনেক ঘটনাই ঘটেছে, যেসব না জানলে হয়তো আমাদের ক্ষতি নেই। তবে জানলেও যে সেসব ঘটনা মস্তিষ্কের খুব বেশি জায়গা দখল করে নেবে তা কখনোই নয়। বরং নিখাদ আনন্দ লাভের উদ্দেশ্যে সেসব ঘটনা পড়ে গেলে তা যেমন হালকা হাসির খোরাক হতে পারে, তেমনই বন্ধুমহলে সুযোগ বুঝে জানিয়ে দিলে সেসব ঘটনা অন্য সকলের নির্মল আনন্দ লাভের উৎসও হতে পারে। আবার বলা যায় না, এ ধরনের টুকটাক ঘটনা জেনে এর সাথে সম্পৃক্ত ব্যক্তিদের সম্পর্কে বিশদ অনুসন্ধান আপনার সামনে খুলে দিতে পারে জ্ঞানের আরও অনেক দুয়ারই!
তুতেনখামুনের নামসমগ্র
আজ থেকে প্রায় ৩,৩০০ বছর আগে মিশর শাসন করে গেছেন এক ফারাও, তুতেনখামুন নামেই যাকে আমরা সবাই চিনি। তবে মজার বিষয় হলো, তার নাম কিন্তু আসলে 'তুতেনখামুন' ছিল না, অন্তত জীবনের শুরুর দিকে তো কোনোভাবেই না!
তাহলে কীভাবে তিনি তুতেনখামুন হলেন?
তুতেনখামুনের বাবা-মা দুজনই ছিলেন সূর্যপূজারী। তাই সন্তান জন্মের পর দেবতা 'আতেন' এর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য তিনি সদ্য ভূমিষ্ঠ পুত্রসন্তানের নাম রাখেন 'তুতেনখাতেন', যার অর্থ 'আতেন এর জীবন্ত প্রতিচ্ছবি'।
কয়েক বছর পর তুতেনখাতেনের বাবা আখেনাতেন মারা যান। মাত্র ৮ বছর বয়সে সিংহাসনে বসেন তুতেনখাতেন, হয়ে ওঠেন মিশরের ১৮ তম রাজবংশের ১৩ তম ফেরাউন।
সিংহাসনে বসে কিছুদিন আতেনের অনুসারী ছিলেন তুতেনখাতেন। কিন্তু এরপর এই দেবতার আরাধনায় আর আত্মিক সুখ খুঁজে পাচ্ছিলেন না তিনি। ফলে এরপর থেকে তিনি দেবতা 'আমুন' এর পূজা শুরু করেন, যাকে সেসময় 'দেবতাদের রাজা' হিসেবে সম্মান করত সবাই।
আমুনের পূজা শুরুর পর তুতেনখাতেন নিজের নামটাও পালটে ফেললেন, হয়ে গেলেন 'তুতেনখামুন', যার অর্থ 'আমুন এর জীবন্ত প্রতিচ্ছবি'।
-খাতেন থেকে -খামুন যাত্রা শেষের আগে আরেকটা মজার তথ্য দেয়া যাক। তুতেনখামুনকে কিন্তু সেই আমলে মানুষজন কেবল 'তুতেনখামুন' নামেই চিনত না, বরং আরও সুবিশাল এক নামে চিনত। আসলে সেই সময় নিয়ম ছিল মিশরের ফেরাউন যিনি হবেন, তার নামে সম্মানসূচকভাবে পাঁচটি অংশ থাকা লাগবে, যার মধ্য দিয়ে তার জাগতিক ক্ষমতা, ঐশ্বরিক প্রতিপত্তি এবং একইসাথে রাজ্য পরিচালনার মিশন ফুটে উঠবে!
তুতেনখামুনের পুরো নামটি নিম্নরুপ:
প্রথম অংশ: কানাখ্ত তুতমেসুত (জীবনের প্রতিচ্ছবি)
দ্বিতীয় অংশ: নেফারহেপুসেগেরেহ্তাঐ (পূতপবিত্র যে ধার্মিক ব্যক্তি সকল দেবতাকেই সন্তুষ্ট রাখে)
তৃতীয় অংশ: ওয়েতজেস্খাউসেহেতেপ্নেৎজেরু (স্রষ্টার বাহ্যিক অবস্থাসমূহের ভেতর উন্নত)
চতুর্থ অংশ: নেবখেপেরুরে (রে-ই হলেন সকল প্রাণের সৃষ্টিকর্তা)
পঞ্চম অংশ: তুতেনখামুন
কানাখ্ত তুতমেসুত নেফারহেপুসেগেরেহ্তাঐ ওয়েতজেস্খাউসেহেতেপ্নেৎজেরু নেবখেপেরুরে তুতেনখামুন
এই যে পাঁচ অংশ, এর মাঝে আমরা তাকে ডাকি ও চিনি পঞ্চম অংশ 'তুতেনখামুন' দিয়ে, ওদিকে সেই আমলে তার প্রজারা তাকে চিনত 'নেবখেপেরুরে' নামে।
আচ্ছা পাঠক, কিং তুতের নাম পড়তে গিয়ে আপনার দাঁত ঠিক আছে তো?
রাইট ভ্রাতৃদ্বয়ের অসাধ্য সাধন
রাইট ভাইদের এরোপ্লেনের কথা সেই ছোটবেলা থেকেই 'সাধারণ জ্ঞান' নামক অসাধারণ জ্ঞানমূলক বিষয়ের খাতিরে আমরা পড়ে এসেছি। তবে তাদের এই প্লেন নিয়ে কিছু মজার ঘটনা কিন্তু আমরা অনেকেই জানি না।
এই ধরা যাক তাদের প্লেনের কথাই। এটা বানাতে সেই আমলে (১৯০৩) তাদের প্রায় ১,০০০ ডলার খরচ হয়েছিল। বর্তমানের হিসেবে যার মূল্য প্রায় সাড়ে ২৯ হাজার ডলার। বলে রাখা ভাল, অরভিল রাইটের দেয়া এই হিসেবে তিনি কিন্তু নিজেদের বিনিয়োগকৃত শ্রম ও সময় কোনোটাকেই হিসেবে আনেননি, কেবল যন্ত্রাংশের খরচই উঠে এসেছে এখানে।
ওদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওয়ার ডিপার্টমেন্ট স্মিথসোনিয়ান ইনস্টিটিউটের সেক্রেটারি স্যামুয়েল ল্যাংলেকে ৫০,০০০ ডলারের অনুদান দিয়েছিল সেই ১৮৯৯ সালেই। উদ্দেশ্য সামরিক বাহিনীর ব্যবহারের উদ্দেশ্যে উড্ডয়নে সক্ষম একটি বিমান তৈরি করে দেয়া। বর্তমানের হিসেবে এই অনুদানের পরিমাণ প্রায় ১৫ লক্ষ ৬৭ হাজার ডলার!
বলা বাহুল্য, এত বিশাল অর্থসাহায্য পাবার পরেও ল্যাংলের প্লেনটা কিন্তু উড়তেই পারেনি! সত্যিকারের আত্মনিবেদন আর দৃঢ়চেতা মনোভাব থাকলে যে অনেক অসম্ভবকেও সম্ভব করা যায়, তারই এক চমৎকার উদাহরণ দুই ভাইয়ের এই আর্থিক বাধা জয়ের ঘটনাটি।
অবশ্য এই এরোপ্লেন দুই ভাইকে পরবর্তী জীবনে হাত ভরেই ডলার এনে দিয়েছিল। ১৯১৪ সালে বাবা আর বোনকে নিয়ে নতুন বাড়িতে ওঠেন অরভিল রাইট, যা বানাতে সেই আমলেই খরচ হয়েছিল ৩৯,৬০০ ডলার। দুর্ভাগ্যজনকভাবে সেই বাড়িতে ওঠার সৌভাগ্য উইলবারের হয়নি, কারণ ১৯১২ সালেই টাইফয়েডে ভুগে পরপারে পাড়ি জমান তিনি। ১৯৪৮ সালে অরভিল রাইট যখন মারা যান, তখন তার রেখে যাওয়া সম্পদের আর্থিক মূল্য ছিল ১০,৬৭,১০৫.৭৩ ডলার!
শেষ করা যাক প্রথম আর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে প্লেনের ব্যবহার নিয়ে অরভিলের বক্তব্য নিয়েই। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হবার অল্প কিছুদিন আগে যুদ্ধে প্লেনের সবিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা দেখে তিনি এক কলামে লিখেছিলেন,
প্লেনগুলো যুদ্ধক্ষেত্রকে এতটাই ভয়াবহ করে তুলছে যে আমার মনে হয় না সামনে আর কোনো দেশ কোনো যুদ্ধেই জড়াতে চাইবে...।
ওদিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের হিরোশিমা আর নাগাসাকি শহরে পারমাণবিক বোমা হামলার ভয়াবহতা দেখে চমকে উঠেছিলেন তিনিও। তাই তো এক চিঠিতে লিখেছিলেন,
একসময় আমি ভেবেছিলাম এরোপ্লেনের কারণে বোধহয় যুদ্ধ থেমে যাবে। কিন্তু এখনকার এরোপ্লেন আর পারমাণবিক বোমা দেখে মনে হচ্ছে সেটা বোধহয় কখনোই হবে না। মনে হচ্ছে, নাক উঁচু শাসকেরা দেশবাসীর জীবন, সম্পদ যেকোনো কিছুর বিনিময়ে হলেও নিজেদের স্বার্থ পুরোপুরি আদায় করেই ছাড়বে।
জিহাদের মাতৃভক্তি
যদিও এই সিরিজটি ইতিহাসের জানা-অজানা ঘটনা তুলে আনবার লক্ষ্যেই শুরু হয়েছে, তারপরও এমন কিছু ঘটনা আমাদের দৈনন্দিন জীবনেও ঘটে যায়, যেগুলোর প্রভাব অস্বীকার করার উপায় নেই। সেই চিন্তা থেকেই শেষে এসে সাম্প্রতিককালের এক ঘটনাই তুলে ধরা হলো, যার নায়ক ফিলিস্তিনি তরুণ জিহাদ আল সুওয়াইতি।
ছোটবেলায় আমরা যারা বায়েজিদ বোস্তামির মায়ের জন্য সারা রাত পানি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকার কাহিনি পড়ে বড় হয়েছি, সেই তারাই আবার এই মহামারীর সময়ে এসে করোনাতঙ্কে মাকে রাস্তায় বা বনে ফেলে যাচ্ছে গুণধর সন্তানেরা এমন খবরও দেখেছি।
তবে দ্বিতীয় ক্ষেত্রে উল্লেখিতদের পথে না হেঁটে বরং মায়ের প্রতি ভালবাসার অসাধারণ এক নজির সৃষ্টি করেছিল ফিলিস্তিনী তরুণ জিহাদ আল সুওয়াইতি, যা এই বছরের মাঝামাঝির দিকে বিশ্বব্যাপী ভাইরাল খবর হয়ে ওঠে সব সোশ্যাল মিডিয়াতেই।
জিহাদের মা রাসমি সুওয়াইতির বয়স হয়ে গিয়েছিল ৭৩ বছর। আগে থেকেই তিনি লিউকেমিয়ায় আক্রান্ত ছিলেন। এর মাঝে আবার ধরা পড়ে তিনি কোভিড পজিটিভ। ফলে পশ্চিম তীরের বাইত আওয়া শহরের এই বৃদ্ধাকে নিয়ে যেতে হয় হেব্রন স্টেট হসপিটালের ইন্টেনসিভ কেয়ার ইউনিটে।
সেখানে পাঁচদিন থাকার পর মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন এই নারী। ওদিকে মায়ের অবস্থার অবনতির কথা জিহাদকে জানানো হলেও কোভিড-১৯ পেশেন্ট হবার ফলে তার কাছে যাবার উপায়ও ছিল না তার। ফলে হাসপাতালের ভবন বেয়েই উপরে উঠে আইসিইউ এর জানালার ধারে বসে মায়ের শেষ মুহূর্তগুলোর সাক্ষী হয় সে।
আবেগকে নাড়া দিয়ে যাওয়া এই ঘটনাটি এরপর ইন্টারনেটের এই জমানায় ছড়িয়ে পড়তে খুব বেশি সময় লাগেনি।
এই সিরিজের অন্যান্য পর্ব পড়তে ক্লিক করুন নিচের লিঙ্কে:
১) ইতিহাসের জানা-অজানা যত ঘটনা - পর্ব ১
This Bengali article discusses some interesting incidents from history.
Feature Image: sbb.ch
Background Image: Wallpaper Safari