Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

কোসেম সুলতান: ক্ষমতার শীর্ষে থাকা এক অপ্রতিরোধ্য নারী

উসমানীয় সাম্রাজ্যের সবচেয়ে ক্ষমতাধর নারী ছিলেন কোসেম সুলতান, যার ক্ষমতার পরিধি একজন সুলতানের চেয়ে কোনো অংশে কম ছিল না। তিনি সিংহাসনে আরোহণ করেননি, তবে সিংহাসনের অন্তরালে থেকে রাজনীতির পট রচনায় ছিল তার অনবদ্য ভূমিকা। হারেমে যেমন তার প্রতিপত্তি ছিল, তেমনি সিংহাসনের উত্তরাধিকার নির্ধারণে তার প্রভাব ছিল। তার জীবনদ্দশায় ছয়জন সুলতান সিংহাসনে আরোহণ করেন। তিনি প্রায় ৪৬ বছরব্যাপী দাপটের সঙ্গে তার ক্ষমতার চর্চা করেন। উসমানীয় সাম্রাজ্যের ইতিহাসে হুররামের পর তিনিই ছিলেন সর্বোচ্চ ক্ষমতাধারী শেষ রাজনারী। তার মৃত্যুর পর আর কোনো নারী এতটা প্রভাবশালী হয়ে উঠতে পারেননি।

সপ্তদশ শতকের গোড়ার দিকে সুলতান সুলাইমানের (দ্য ম্যাগনিফিসেন্ট) হাত ধরে উসমানীয় সাম্রাজ্য উন্নতির চরম শিখরে আরোহণ করে। সুলতান সুলাইমানের সময় থেকেই মূলত হারেমের নারীদের ক্ষমতা বৃদ্ধি করা হয়। সৃষ্টি করা হয় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদ ‘ভ্যালিদে সুলতান’। সিংহাসনে আরোহণকারী সুলতানের মাতা এই পদের অধিকারী হতেন। উসমানীয় সাম্রাজ্যে আরো একটি গুরুত্বপূ্র্ণ পদ ছিল। তা হলো ‘হাসেকি সুলতান’। সুলতানের সবচেয়ে প্রিয়তমা স্ত্রী এ পদে আসীন হতেন। কোসেম সুলতান তার জীবদ্দশায় ১৬০৫-১৬১৭ সাল পর্যন্ত ‘হাসেকি সুলতান’ এবং ১৬৪৮-১৬৫১ সাল পর্যন্ত ‘ভ্যালিদে সুলতানের’ পদ অলঙ্কৃত করেন।

কোসেম সুলতান; Image Source: ancient origin

ম্যাহপিকার: চাঁদের মতো মুখ যে নারীর

কিংবদন্তী অনুসারে, কোসেম সুলতান ১৫৮৯ সালে তিনোস দ্বীপে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন গ্রিক বংশোদ্ভুত এক ধর্মযাজকের মেয়ে। তার প্রকৃত নাম ছিল ‘আনাস্তাসিয়া’। মাত্র ১৫ বছর বয়সে বসনিয়ার কর্তৃপক্ষ তাকে দাসী হিসেবে ইস্তাম্বুলে পাঠান। তোপকাপি প্রাসাদের অসংখ্য দাসীর সাথে হারেমে তার জায়গা হয়। পরবর্তীতে মুসলিম হওয়ার পর তার নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ‘ম্যাহপেকার’ যার অর্থ, যে নারীর মুখ চাঁদের মতো। সেই সময় প্রথম আহমেদ উসমানীয় সাম্রাজ্যের শাসক ছিলেন। সুলতান প্রথম আহমেদ ম্যাহপেকারের রুপে গুণে মুগ্ধ হয়ে তাকে গ্রহণ করতে সম্মত হন। তারপর সুলতান আহমেদ তার নাম রাখেন ‘কোসেম’, যার অর্থ ছিল ভেড়ার পালের নেত্রী বা রাখাল।

‘কিশোরী আনাস্তাসিয়ার অঙ্কিত ছবি। পরে তার নাম রাখা হয় কোসেম ম্যাহপেকার; Image Source: Artmajeur

সামান্য দাসী থেকে ‘হাসেকি সুলতান’ হয়ে ওঠার গল্প

কোসেমকে যখন সুলতান আহমেদের খাসদাসী হিসেবে নির্বাচন করা হয়, তারপর থেকেই তার জীবনের মোড় ঘুরে যায়। কোসেম যখন খাসদাসী ছিলেন তখন হারেমের দায়িত্ব ছিল সুলতানের দাদী সাফিয়ে সুলতানের উপর। কিন্তু ১৬০৪ সালে সাফিয়ে সুলতান তার কর্তৃত্ব হারান। কিন্তু প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের কারণেও তাকে এই পদ হতে সরে আসতে হয়। ফলে তার বাকিটা জীবন প্রথামতে অন্য প্রাসাদে কাটাতে হয়।

একই বছরে সুলতানের মা হানদান সুলতান ‘ভ্যালিদে সুলতান’ পদ লাভ করেন। তবে তার মৃত্যুর পর, কোসেম সুলতানের নিকট সুযোগ আসে হারেমের কর্তৃত্ব গ্রহণের। নিজের রুপ ও গুণ দিয়ে সুলতানের খাসদাসী থেকে প্রিয়তম স্ত্রী হিসেবে স্বীকৃতি পান। ‘হাসেকি সুলতান’ হিসেবে সমাদৃত হন। ধীরে ধীরে হয়ে ওঠেন হারেমের অন্যতম প্রভাবশালী নারী ব্যক্তিত্ব। তিনি ১৬১৭ সাল পর্যন্ত অর্থাৎ সুলতান প্রথম আহমেদ যতদিন বেঁচে ছিলেন ততদিন পর্যন্ত এ পদে আসীন ছিলেন।

সুলতানের মৃত্যু ও ‘হাসেকি সুলতান’ হতে পদচ্যুতি

১৬১৭ সালের নভেম্বর মাসে সুলতান আহমেদ রোগাক্রান্ত হয়ে মারা যান। যদিও ইতিহাসবিদদের অনেকেই মনে করেন, সুলতানকে বিষ প্রয়োগে হত্যা করা হয়েছে। তবে, সুলতান আহমেদের মৃত্যুর পর কোসেম সুলতান তোপকাপি প্রাসাদে তার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেন এবং তাকে তোপকাপি প্রাসাদ থেকে ইস্কি সারাহ প্রাসাদে থাকতে বাধ্য করা হয়। সুলতান মারা যাওয়ার পর তার পুত্রকে না বসিয়ে তার ভাই প্রথম মুস্তফাকে সিংহাসনে বসানো হয়। তিনি ছিলেন মানসিক ভারসাম্যহীন। ফলে খুব দ্রুত তাকে সরিয়ে প্রথম আহমেদের আরেক স্ত্রী মাহফিরোজের জ্যেষ্ঠ পুত্র দ্বিতীয় ওসমানকে সিংহাসনে বসানো হয়। এতে কোসেম ক্ষুব্ধ হন। ফলে শুরু হয় সিংহাসন দখলের কোন্দল।

যেহেতু কোসেম সুলতানের পুত্রদের মধ্যে কাউকেই সিংহাসনে বসতে দেওয়া হয়নি, সেহেতু তাকে জৌলুসবিহীন প্রাসাদে থাকতে দেওয়া হয়। এতে কোসেম ক্ষুব্ধ হন। কোসেম শুধুমাত্র একজন বিধবা রাজনারী হয়ে জীবন অতিবাহিত করতে চাননি। স্বামীর মৃত্যুর পর নিজের ও তার সন্তানদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে ঘুরে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নেন।

কোসেম সুলতানের স্বামী, সুলতান প্রথম আহমেদ; Image Source: pinterest.com

ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তন

রাজনীতির খেলায় কোসেম সুলতান ফিরে আসেন ১৬২৩ খ্রিস্টাব্দে। এবার তিনি আগের চেয়ে আরো বেশি সুচতুরতার প্রমাণ দেন। ধারণা করা হয়, কোসেম সুলতান হালিমে সুলতানের (প্রথম মুস্তফার মাতা) সাথে যোগসাজশ করে সুলতান দ্বিতীয় ওসমানকে জেনিসারি বাহিনী দ্বারা সিংহাসনচ্যুত করেন। এমনকি তাকে হত্যার পেছনেও তাদের ভূমিকা ছিল বলে মনে করা হয়। কৌশলে কোসেম সুলতান তার পুত্র চতুর্থ মুরাদকে ১৬২৩ সালে সিংহাসনে বসাতে সক্ষম হন। সুলতান চতুর্থ মুরাদ অপ্রাপ্তবয়স্ক হওয়ায়, তার পক্ষে কোসেম সুলতান সাম্রাজ্য পরিচালনা করা শুরু করেন। এ সময় তিনি ‘নায়েব-ই-সালতানাত’ পদবি গ্রহণ করেন। ১৬২৩-৩২ সাল পর্যন্ত এ পদে বহাল ছিলেন। এ সময় তিনি গুরুত্বপূ্র্ণ রাজপ্রতিনিধি হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন।

কোসেম সুলতান; Image Source: pinterest.com

ভ্যালিদে সুলতান

সুলতান চতুর্থ মুরাদ সিংহাসনে বসার পর থেকে কোসেম সুলতান উসমানীয় সাম্রাজ্যের শীর্ষে চলে আসেন। হেরেমের সকল গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার সাথে সাথে রাজকার্যেও তার সিদ্ধান্ত সাদরে গৃহীত হতো। মুরাদ প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর ক্ষমতা নিজে পরিচালনা করতে শুরু করলেন। কয়েক বছরের মধ্যে সাম্রাজ্যে বিশৃংখলা দেখা দেয়। উত্তর আনাতোলিয়ায় বিদ্রোহ শুরু হয়ে যায় এবং পারস্যের সাফাভিরা গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলোর দখল নিতে শুরু করে। এরই মধ্যে জেনিসারি বাহিনী বেশ প্রভাবশালী হয়ে ওঠে এবং উজির-ই-আজমকে মেরে ফেলে। এসব দেখে সুলতান চতুর্থ মুরাদ খুব ভীত হয়ে পড়েন। সেই সময় থেকেই কোসেম সুলতান শক্ত হাতে ক্ষমতা পরিচালনা করেন।

তিনি হারেমের পর্দার আড়াল হতে বেরিয়ে ক্ষমতা প্রয়োগ করতে থাকেন। কঠোর হাতে সেই বিদ্রোহ দমন করেন। জেনিসারি বাহিনীরাও তাকে মান্য করে চলতেন। ১৬৪০ সালে সুলতান চতুর্থ মুরাদের মৃত্যু হলে কোসেম সুলতান তার একমাত্র জীবিত ছেলে ইব্রাহিমকে সিংহাসনে বসান। তিনি ১৬৪৭ সাল থেকে ভ্যালিদে সুলতান (রাজমাতা) হিসেবে বেশ শক্তিশালী হয়ে উঠেন। তিনি এতটাই শক্তিশালী হয়ে উঠেন যে, জেনিসারি বাহিনী সুলতানের চেয়ে রাজমাতা কোসেমের আদেশ মানতেন বেশি। কিন্তু ইব্রাহিম রাজ্য পরিচালনার জন্য তেমন যোগ্য ছিলেন না। তার শাসনকালে বিভিন্ন জায়গায় বিদ্রোহ শুরু হয়। এর ফলে কোসেম আবার ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসেন।

তিনি যখন দেখলেন তার পুত্র ইব্রাহিম সুলতান হিসেবে যোগ্যতার প্রমাণ দিতে পারছেন না, তখন তিনি তার পুত্রকে ক্ষমতা থেকে অপসারণ করতেও দ্বিধাবোধ করেননি। আর তাই, ১৬৪৭ সালে কোসেম সুলতান এবং সালিহ পাশা দুজনে মিলে পরিকল্পনা করেন সুলতান ইব্রাহিমকে অপসারণ করার।

রাজনৈতিক কোন্দল ও কোসেম সুলতানের অপসারণ

সুলতানের বিরুদ্ধে কোসেম এবং সালিহ পাশার এই ষড়যন্ত্রের কথা সবার সামনে চলে আসে। সুলতানের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের দায়ে সুলতান ইব্রাহিম শাস্তিস্বরূপ সালিহ পাশাকে মৃত্যুদন্ড দেয়। আর কোসেম সুলতানকে প্রাসাদ থেকে বের করে দেওয়া হয়। তোপকাপি প্রাসাদ থেকে বের হয়ে যাওয়ার পর তার প্রভাব এক বিন্দুও কমেনি, বরং প্রাসাদের বাইরে থেকেও জেনিসারি ও ওলামাগণের উপর যথেষ্ট আধিপত্য বজায় ছিল। ১৬৪৮ সালে জেনিসারি বাহিনী ও ওলামাগণ সুলতানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু করেন এবং সুলতান ইব্রাহিমকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়। তোপকাপি প্রাসাদে তাকে বন্দি করে মৃত্যুদন্ডাদেশ দেওয়া হয়। বলা হয়ে থাকে, ওলামাগণ এ আদেশ জারি করার ক্ষেত্রে কোসেম সুলতানের পরামর্শ চেয়েছিলেন এবং কোসেম ক্ষমতার মোহে এতটাই আবিষ্ট ছিলেন যে তাতে তিনি সায় দিয়েছিলেন।

ক্ষমতার শিখরে পদার্পণ

কোসেম, সুলতান ইব্রাহিমকে হটিয়ে তারই সাত বছরের পুত্র চতুর্থ মেহমেতকে নামমাত্র সিংহাসনে বসিয়ে রাজ্য পরিচালনার যে স্বপ্ন দেখছিলেন, অবশেষে তা সফল করেছিলেন। চতুর্থ মেহমেত ছিলেন পূর্ববর্তী সুলতান ইব্রাহিম এবং তুরহান সুলতানের পুত্র। তাই ইব্রাহিমের মৃত্যুর পর চতুর্থ মেহমেত সিংহাসনে বসেন। কাজেই প্রথামতো, ভ্যালিদে সুলতান (রাজমাতা) পদটিতে তুরহান সুলতানের অধিষ্ঠিত হওয়ার কথা। কিন্তু কোসেম ভ্যালিদে সুলতান পদ থেকে অব্যাহতি না নিয়ে আরো ক্ষমতাশালী হিসেবে আবির্ভূত হলেন। চতুর্থ মেহমেতকে সিংহাসনে বসিয়ে নিজে সরাসরি রাজ্য পরিচালনা করতে লাগলেন। শিশু নাতিকে সামনে রেখে সাম্রাজ্যের সকল দায়িত্ব পালন করেন।

‘সুলতান সুলেমান: কোসেম পর্ব’ টিভি সিরিজে ‘কোসেম’ চরিত্রটি; Image Source: twitter

দানশীলতা

শত্রুদের কখনো ক্ষমা না করলেও তিনি প্রজাদের স্বার্থে দানবীর ছিলেন। মিশরের বন্যা দুর্গতদের সাহায্য দান, মক্কার গরীব মানুষদের আর্থিক সহায়তা প্রদান। গরিব পরিবারের মেয়েদের বিয়েতে সাহায্য প্রদান করতেন। ১৬৪০ সালে উস্কুদারে একটি মসজিদ ও স্কুল তৈরি করেন।

কোসেম সুলতানের হত্যাকান্ড; Image Source: youtube.com

মর্মান্তিক মৃত্যু 

প্রভাবশালী এই মহিয়সী নারীর মৃত্যু ছিল মর্মান্তিক। ক্ষমতার শীর্ষে থাকা সুলতানাকে ষড়যন্ত্র করে অত্যন্ত নির্মমভাবে খুন করা হয়। তুরহান সুলতান স্বামী ইব্রাহীমের মৃত্যুর জন্য কোসেমকে দায়ী করতেন। তাই ধারণা করা হয়, প্রতিশোধের স্পৃহা ও রাজমাতা হওয়ার আকাঙ্ক্ষা থেকে তুরহান সুলতান ১৬৫১ সালে প্রাসাদের কয়েকজন খোজা ও প্রহরীর সাহায্যে তাকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করেন। মৃত্যুর পর তাকে তার স্বামী প্রথম আহমেদের কবরের পাশে দাফন করা হয়। 

কোসেম সুলতানের হত্যাকান্ড; Image Source: vestiturkey.com

ষোড়শ শতকের প্রথমভাগে হুররাম সুলতানের সময় নারী ক্ষমতায়নের যে সূচনা ঘটেছিল, কোসেম সুলতানের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে তার ইতি ঘটে। উসমানীয় সাম্রাজ্যে আর কোনো নারী কোসেম সুলতানের মতো রাজনৈতিকভাবে এত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারেননি।

ফিচার ইমেজ: wordpress.com

Related Articles