Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

লবস্টার বয়: সার্কাসের মঞ্চ থেকে খুনি হয়ে ওঠা এক বিরল রোগী

প্রায় এক শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে বিরল এক শারীরিক বিকলঙ্গতার শিকার হয়ে আসছে স্টাইলস পরিবার। ‘অ্যাক্রোডাকটিলি’ নামক এই অসুখের ফলে জন্মগতভাবেই তাদের হাত দেখতে গলদা চিংড়ির দাঁড়া বা পায়ের মতো। সে হাতের মাঝখানে কোনো আঙুল নেই, বুড়ো আঙুল আর কড়ে আঙুল দুটো ফুলে গিয়ে মিশেছে একসাথে। অনেকের কাছে যখন এই বিষয়টি বিকলাঙ্গতা ছাড়া আর কিছুই নয়, স্টাইলস পরিবার তখন এই অসুখকে বানিয়ে ছেড়েছে মোক্ষম সুযোগ। ১৮০০ শতকের শুরুর দিক থেকে পরিবারটিতে লবস্টারের মতো হাত-পাওয়ালা শিশুর সংখ্যা বাড়তে থাকে। সে সময় লবস্টার পরিবারের পক্ষ থেকে একটি সার্কাস গঠনের উদ্যোগ নেয়া হয়, যার নাম ‘দ্য লবস্টার ফ্যামিলি’। যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা শহরের এটি কার্নিভ্যালটি বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে বেশ খ্যাতি লাভ করে। এই পরিবারের এক খুনে ছেলে গ্র্যাডি স্টাইলসের জীবনের অন্ধকার একটি দিক তুলে ধরা হবে আজকের লেখায়।

স্টাইলস পরিবার যখন সার্কাসের জগতে বেশ সুনাম কুড়াচ্ছে, তখন তাদেরই এক পুত্র গ্র্যাডি স্টাইলস জুনিয়র, পরিবারের গায়ে খুনের কালিমা লেপে দিয়েছে। পরবর্তী জীবনে ‘লবস্টার বয়’ হিসেবে খ্যাতি, বলা ভালো কুখ্যাতি, পাওয়া এই ছেলেটির জন্ম ১৯৩৭ সালের ২৬ জুন, পিটসবার্গে। সে সময়ে তার বাবা গ্র্যাডি স্টাইলস সিনিয়র সার্কাসে রীতিমতো ফ্রিকে পরিণত হয়েছেন। পরিবারের অ্যাক্রোডাকটিলি রোগের শিকার অন্যান্য বাচ্চাদেরও সার্কাসে নিয়ে আসেন তিনি। জেনেটিক এই রোগে আক্রান্ত গ্র্যাডি জুনিয়রের অবস্থা বেশি খারাপ ছিল। হাতের পাশাপাশি তার পা দুটোও আক্রান্ত হয়েছিল অসুখে, যার কারণে সে কখনো সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি, হাঁটা তো অনেক দূরের কথা।

গ্র্যাডির জীবনের বেশিরভাগ সময়ই কেটেছে হুইলচেয়ারে। একটু বড় হলে অবশ্য কষ্ট করে মেঝে থেকে শরীরের উপরের অংশটুকু কোনোমতে টেনে-হিঁচড়ে তুলতে শিখেছিল সে। বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, যতই দিন যেতে থাকে, গ্র্যাডির শরীরে শক্তির পরিমাণও যেন ততই বাড়তে থাকে। শারীরিক এই শক্তির অপব্যবহারই তাকে পরবর্তীতে ভিলেন বানিয়ে ছাড়ে।

শৈশবে লবস্টার বয়; Source: historicmysteries.com

পুরো শৈশব জুড়ে স্টাইলস তার পরিবারের সাথে ঘুরে বেরিয়েছে নানা দেশের নানা শহরে। কার্নিভ্যাল দলের সাথে গিবস্টোন, ফ্লোরিডা নানা জায়গায় গিয়েছে সে। প্রতি সিজনে গড়ে প্রায় ৫০ হাজার থেকে ৮০ হাজার ডলার আয় করতো তারা। অন্যান্য তথাকথিত ফ্রিক বা ক্লাউনদের মতো রঙ্গ করে, লোক হাসিয়ে টাকা আয় করতে হতো না তাদের। চুপচাপ এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থেকে, দর্শকদের নিজের অদ্ভুত হাত-পা দেখিয়েই দিব্যি কাজ চলে যেত। স্টাইলসের জগত গড়ে ওঠে কার্নিভালকে কেন্দ্র করে। কাজেই কার্নিভালে কর্মরত কোনো নারীর প্রেমে পড়বে সে, এতে আর অবাক হওয়ার কী আছে? তরুণ গ্র্যাডি প্রেমে পড়ে যায় আরেক সার্কাসকর্মী তরুণী মারিয়া তেরেসার। কৈশোরে সার্কাসে যোগ দেয়ার জন্য বাড়ি থেকে পালিয়ে আসে সে।

সার্কাসে কোনো খেলা দেখাত না মারিয়া, কলাকুশলীদের একজন ছিল কেবল। গ্র্যাডি স্টাইলস জুনিয়রের প্রেমে পড়ে যায় সে, পারিবারিকভাবে বিয়ে হয় দুজনের। দুই সন্তান নিয়ে বেশ সুখে দিন কাটছিল তাদের। বাবার মতো সে-ও বাচ্চা দুটোকে পারিবারিক ব্যবসায় নিয়ে আসে। তার একটি সন্তান অ্যাক্রোডাকটিলিতে আক্রান্ত হলেও অপর শিশুটি ছিল সুস্থ। বাচ্চারা যত বড় হতে থাকে, স্টাইলস পরিবারের খারাপ সময় যেন ততই ঘনিয়ে আসতে থাকে। বিশেষ করে গ্র্যাডির মেয়ে ক্যাথি অ্যাক্রোডাকটিলিতে আক্রান্ত না হওয়ায় সে ছিল বাবার চোখের মণি। বাচ্চাদের কেন্দ্র করেই শুরু হয় গ্র্যাডির জীবনের অন্ধকার অধ্যায়।

মদ্যপ হিসেবে বেশ কুখ্যাত ছিল স্টাইলস। তার সাথে শরীরের উপরের অংশের অস্বাভাবিক শক্তি মিলে তাকে এক প্রকার দানবে পরিণত করে। স্ত্রী-সন্তানদের উপরে চলতে থাকে তার অকথ্য অত্যাচার। ঝগড়ার এক পর্যায়ে চিংড়ি মাছের পায়ের মতো হাত দিয়ে স্ত্রীর গলা টিপে ধরে সে। এমনকি চিমটার মতো হাত দিয়ে স্ত্রীর যোনি ক্ষতবিক্ষত করে দেয়ার রেকর্ডও আছে তার। হাত দুটো যেন বানানোই হয়েছিল কাউকে আঁকড়ে ধরে খুন করার জন্য। সবচেয়ে খারাপ ব্যাপারটা অবশ্য তখনও ঘটেনি। গ্র্যাডির কিশোরী কন্যা ডোনা যখন এক যুবকের প্রেমে পড়ে, তখনই বেরিয়ে আসে গ্র্যাডির আসল চেহারা। এই প্রেম মেনে নেয়নি গ্র্যাডি। মেয়েকে ফেরাতে সে আশ্রয় নেয় অসুরের মতো অস্বাভাবিক শারীরিক শক্তির, অপব্যবহার করে মাতাল মস্তিষ্কের।

পরিবারের সাথে গ্র্যাডি; Source: rebelcircus.com

আসলে যে সেদিন কী ঘটেছিল, কেউ তা নিশ্চিত করে বলতে পারেনি। হয় স্টাইলস নিজে তার মেয়ের হবু বরকে দেখতে তার বাড়িতে গিয়েছিল, নাহয় তাকে দাওয়াত করে বাড়িতে ডেকে এনেছিল। দ্বিতীয়টির সম্ভাবনাই বেশি বলে শোনা যায়। সবার সামনে সে এমন একটা ভাব দেখায় যেন এর চেয়ে ভালো জামাই সে আশাও করেনি! কাজেই আশীর্বাদ দেয়ার নাম করে বেচারাকে বাড়িতে ডেকে আনে সে। মেয়েকে জানায়, বিয়ের পরিকল্পনা করবে জামাই-শ্বশুর মিলে, তাদের সেখানে না থাকাই ভালো। পরিকল্পনামাফিক চলতে থাকে সবকিছু। ঠিক হয় যায় দুজনের বিয়ে। বিয়ের দিন সন্ধ্যায় ঠাণ্ডা মাথায় শটগান হাতে নিয়ে মেয়ের হবু বরকে গুলি করে মেরে ফেলে গ্র্যাডি।

এই ঘটনার পরপরই নিজ হাতে বাবাকে পুলিশের কাছে সোপর্দ করে তার মেয়ে। আদালতে দাঁড়িয়ে অবলীলায় নিজের অপরাধ স্বীকার করে নেয় গ্র্যাডি। কিন্তু এক ফোঁটা অনুশোচনাও কাজ করে না তার মধ্যে। বরং বিজ্ঞ বিচারককে সে জানিয়ে দেয়, তার শারীরিক প্রতিবন্ধকতার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ কোনো কারাগার এখনো তৈরি হয়নি। তাছাড়া একজন প্রতিবন্ধীকে এভাবে জেল-হাজতে বন্দী করা রীতিমতো অন্যায়, নিষ্ঠুরতা এবং অবিবেচকের মতো কাজ হবে। এরই মধ্যে তার লিভার সিরোসিস ধরা পড়ে। অতিরিক্ত মদ্যপানের ফলে এই অসুখের পাশাপাশি ধূমপানের কারণে হাঁপানিতেও ভুগছিল সে।

সব কথা শুনে আদালত বুঝতে পারে এর কোনো পাল্টা জবাব নেই। তাছাড়া এ কথাও সত্যি যে এ ধরনের শারীরিক বিকলাঙ্গদের জন্য জেলখানায় পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা নেই। গ্র্যাডির এই বিরল অসুখের ক্ষেত্রে তা আরও বেশি করে প্রযোজ্য। কাজেই ১৫ বছর পর্যবেক্ষণে থাকার আদেশ দিয়ে ছেড়ে দেয়া হয় তাকে। এরই মধ্যে প্রথম স্ত্রী তার বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটায়, পুনরায় বিয়ে করে সে। নতুন সংসারে আরও দু’টি সন্তান জন্ম নেয়। এখানেও চলতে থাকে মাতাল অবস্থায় তর্জন-গর্জন করার পুরনো সেই বদভ্যাস। ফলাফল, দ্বিতীয় স্ত্রীও তাকে ছেড়ে চলে যায় অল্প কিছুদিনের মধ্যেই।

পুত্র-কন্যার সাথে গ্র্যাডি; Source: procaffenation.com

স্টাইলস পরিবারের কিংবা বাইরের কেউ এখনো বুঝে উঠতে পারেনি ঠিক কী কারণে স্টাইলসের প্রথম স্ত্রী তাকে আবার বিয়ে করতে রাজি হয়েছিল। দুই মেয়েকে নিয়ে ১৯৮৯ সালে গ্র্যাডির কাছে ফিরে আসে মারিয়া তেরেসা। তবে এবার মারিয়া আর তার প্রাপ্তবয়স্ক মেয়েরা মুখ বুজে অন্যায় অত্যাচার সহ্য করেনি। আদালতকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে পার পেয়ে আসায় নিজেকে আইনের ঊর্ধ্বে ভাবতে শুরু করেছিল গ্র্যাডি স্টাইলস। কাজেই এ দফা মারধরের পরিমাণ উল্লেখযোগ্য হারে বাড়তে শুরু করে। কয়েক দিনের মধ্যে তার স্ত্রী বুঝতে পারে এভাবে চলতে পারে না। কাজেই সে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য মানসিকভাবে তৈরি হলো।

গ্র্যাডিকে নতুন করে বিয়ে করার বছরখানি পর মারিয়া পাশের বাড়ির ১৭ বছর বয়সী এক ছেলে, ক্রিস ওয়াইন্টের সাথে একটি ফন্দি আঁটে। দেড় হাজার ডলারের বিনিময়ে গ্র্যাডিকে মেরে ফেলতে রাজি হয় সে। এই পুরো কাজে তাদের সহায়তা করে মারিয়া তেরেসা ও তার আরেক স্বামীর ছেলে গ্লেন। একরাতে ০.৩২ কোল্ট অটোম্যাটিক হাতে পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জ বা একদম কাছ থেকে গুলি করে মেরে ফেলে লবস্টার বয়কে। হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত কেউই নিজ নিজ ভূমিকা অস্বীকার করেনি। আদালতে দাঁড়িয়ে সবার সামনে মারধরের কথা সবিস্তারে উল্লেখ করে গ্র্যাডির স্ত্রী মারিয়া। “আমার স্বামী আমার পরিবারের প্রতিটি মানুষকে মেরে ফেলতে যাচ্ছিল, অন্তর থেকে এটা আমি বিশ্বাস করি”, আদালতকে এ কথাই জানায় সে।

কে বলবে এই শিশুটিই বড় হয়ে খুনের দায়ে দোষী সাব্যস্ত হয়েছিল? Source: openroadmedia.com

মারিয়া ও গ্র্যাডির সন্তান ক্যাথিও তার বাবার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেয়। বিচারক ওয়াইন্টকে সেকেন্ড ডিগ্রী খুনের অপরাধে ২৭ বছরের কারাদণ্ড দেয়। অপরদিকে মারিয়া ও তার ছেলে গ্লেনকে প্রথম ডিগ্রি খুনের দায়ে দোষী সাব্যস্ত করে। ১২ বছরের কারাদণ্ড হয় মারিয়ার। এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করলে তা খারিজ করে দেয় আদালত। ১৯৯৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাস থেকে শুরু হয় কারাবাস। গ্লেনের হয়ে আত্মপক্ষ সমর্থন করতে চায় মারিয়া কিন্তু আদালত তা নাকচ করে দেয়। যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয় গ্লেন।

লবস্টার বয় তার পরিবার বা পাড়া-প্রতিবেশীর কাছে এতটাই অপছন্দনীয় ছিল যে তার শেষকৃত্যের আয়োজন করার জন্যও কাউকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। শেষ পর্যন্ত তার একমাত্র জীবিত পরিবারের অর্থাৎ তার দ্বিতীয় স্ত্রী ও তার সন্তানরা কোনোমতে একটি সাদামাটা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বিদায় জানায় গ্র্যাডিকে। টেলিভিশন সিরিজে, সাহিত্যে বেশ কয়েকবার উঠে এসেছে লবস্টার বয়ের এই গল্প।

ফিচার ইমেজ- rebelcircus.com

Related Articles