Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

লন্ডন টু কলকাতা বাস সার্ভিস: বিস্ময়কর এক যাত্রাপথের ইতিহাস

বাসে করে কতখানি পথই বা পাড়ি দেয়া সম্ভব। নিজদেশ থেকে প্রতিবেশী দেশ কিংবা তার পাশের কোনো দেশে? তা-ও নাহয় হলো। কিন্তু সেই বাসযাত্রা যদি হয় ডজনখানেক দেশ পাড়ি দেয়ার জন্য? সেটা ভাবতে গেলে কপালে মৃদু ভাঁজ পড়াটা খুবই স্বাভাবিক। তেমনি এক বিস্ময়কর বাসের যাত্রাপথের বিষয়ে জানা যায় নানা পত্রিকা আর ইন্টারনেটের তথ্যের ভিত্তিতে। 

ইংল্যান্ডের লন্ডন থেকে ভারতের কলকাতা পর্যন্ত চলত সেই বাস। সমান্তরাল রেখায় চিন্তা করলেও দু’জায়গার মাঝের দূরত্ব দাঁড়ায় প্রায় আট হাজার কিলোমিটারে! হাল আমলের মোলায়েম গদি আঁটা দূরপাল্লার বাসে করে নয়, বরং আজ থেকে প্রায় ষাট বছর আগেকার বাসে চেপে এই পথ পাড়ি দিতেন যাত্রীরা। ১৯৫৭ সালে এই পথে বাসের যাতায়াত শুরু বলে জানা যায়। 

লন্ডনের ভিক্টোরিয়া কোচ স্টেশন থেকে যাত্রা শুরু ইন্ডিয়া ম্যানের; image source: curlytales.com

ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা এমন অনেক তথ্যের ভেতর কলকাতা বাস ও’পিডিয়ার উল্লেখ করা তথ্য থেকে জানা যায়, অসওয়াল্ড-জোসেফ গ্যারো-ফিশারের তত্ত্বাবধানে চালু হওয়া বাস সার্ভিসটি সেসময় বেশ জনপ্রিয় হয়। যে বাসটি এই দূরপাল্লার যাত্রায় ব্যবহার করা হয়, সেটার নাম ছিল ‘ইন্ডিয়া ম্যান’। ১৯৫৭ সালের ১৫ এপ্রিল  লন্ডনের ভিক্টোরিয়া কোচ স্টেশন থেকে যাত্রা শুরু ইন্ডিয়া ম্যানের। ২০ জন যাত্রী নিয়ে প্রথম যাত্রা করে বাসটি। 

একই সূত্র থেকে জানা যায়, প্রথম সেই যাত্রায় থাকা ২০ জন যাত্রীর মাঝে ৭ জন পুরো রাউন্ডট্রিপটি সম্পন্ন করেন। বাকি যাত্রীরা লন্ডন থেকে ভারত পর্যন্ত এসে তখনকার জন্য যাত্রা বিরতি নেন। এতটা দীর্ঘ পথ বাসে চেপে পাড়ি দেবার পর যাত্রা বিরতি নেবার প্রয়োজনও স্বাভাবিক।  

দূরত্বের দিক দিয়ে বাসের এই যাত্রাপথ যেমন বিস্ময়কর, তেমনি এর টিকিটের দামও নেহায়েত কম ছিল না। লন্ডন থেকে কলকাতা যেতে যাত্রীদের গুনতে হতো ৮৫ পাউন্ড, আর ফিরতি পথের ভাড়া ছিল ৬৫ পাউন্ড। ফ্রান্স, ইতালি, যুগোস্লাভিয়া (তখন এ নামে পরিচিত ছিল), বুলগেরিয়া, তুরস্ক, ইরান এবং পাকিস্তান হয়ে ভারতে প্রবেশ করতো ইন্ডিয়াম্যানের বাস।

ইন্ডিয়া ম্যানে যাত্রী ওঠার দৃশ্য; image source: curlytales.com

দিনের বেলা বাসযাত্রা চললেও রাতের বেলা বাস থামত কোনো হোটেলে। হোটেল না পাওয়া গেলে যাত্রীরা তাবু খাঁটিয়ে ঘুমানোর ব্যবস্থা করতেন। এপ্রিলের ১৫ তারিখ শুরু হওয়া সেই বাস কলকাতা এসে পৌঁছায় ৫ জুন। কলকাতায় পৌঁছে বাসের ড্রাইভার এবং মালিক গ্যারো-ফিশার জানান, যাত্রাপথে তিনি গড়ে ২০০ কিলোমিটার পথ টানা বাস চালাতেন। বাসের যাত্রীদের ভেতর যেহেতু অনেকে এখানেই যাত্রা শেষ করছে, কাজেই নতুন যাত্রী নিয়ে তিনি শীঘ্রই রওনা হবেন। 

পুনরায় কলকাতা থেকে যাত্রা করে একই বছরের ২ আগস্ট লন্ডনে পৌঁছে ইন্ডিয়া ম্যান। যদিও যাত্রা শুরুর আগে ফিরে আসার যে দিন ধার্য করা হয়েছিল, তার থেকে ১৬ দিন পর লন্ডনে পৌঁছায় বাসটি। প্রতিকূল আবহাওয়া, তীক্ষ্ণ বাঁকযুক্ত পথ, চাকা রাস্তায় কামড় বসাতে না পারার মতো পিচ্ছিল রাস্তা পাড়ি দেবার অভিজ্ঞতা জানিয়ে তিনি এটাও উল্লেখ করেন যে, খুব শীঘ্রই পরবর্তী যাত্রার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন তিনি। ১৯৫৭ সালের পুরাতন স্টেটসম্যান এবং নিউ ইয়র্ক টাইমস পত্রিকার এক লেখা থেকে এই তথ্যগুলো জানা যায়। 

পুরাতন স্টেটসম্যান পত্রিকার আর্টিকেল; Image Source: twitter

একই সময়ে লন্ডন-কলকাতা পথের আরো একটি বাসের ব্যাপারে জানতে পারা যায়। অ্যালবার্ট ট্রাভেল নামের একটি প্রতিষ্ঠান থেকে পরিচালিত এই বাস সার্ভিসে অ্যালবার্ট (Albert) নামের দ্বিতল একটি বাস ব্যবহার করা হতো। বাসটি লন্ডন থেকে কলকাতা পর্যন্ত ১৫ বার এবং লন্ডন থেকে সিডনি পর্যন্ত চারবার যাতায়াত করেছিল বলে জানা যায়। 

ধারণা করা হয়, ইংল্যান্ড থেকে বেলজিয়াম হয়ে একে একে এই বাস পাড়ি দিত জার্মানি, অস্ট্রিয়া, যুগোস্লাভিয়া, বুলগেরিয়া, তুরস্ক, ইরান, আফগানিস্তান এবং পশ্চিম পাকিস্তান। ইন্ডিয়াতে প্রবেশের পর সর্বশেষ গন্তব্য কলকাতায় পৌঁছার আগে নয়াদিল্লি, আগ্রা, এলাহাবাদ ও বেনারস হয়ে তবেই আসত এই বাসটি। 

যাত্রীদের কাছ থেকে পাওয়া টুকরো তথ্য আর অল্প কিছু ছবিতে উল্লেখ পাওয়া যায়- এই বাস নানা ট্যুরিস্ট স্পট ঘুরে ঘুরেই গন্তব্যে এগোত। আফগান আদিবাসী, কমিউনিস্ট বুলগেরিয়া, কাস্পিয়ান সাগরের উপকূল, তুরস্কের গোল্ডেন হর্ন, নীল দানিয়ুব, রাইন উপত্যকা এবং খাইবার পাস দেখিয়ে ভারতের ভেতরে প্রবেশের পর বেনারস, গঙ্গা তীরের তাজমহল ইত্যাদি জায়গায় বিরতি দিত অ্যালবার্ট। বাজার করার জন্য থামত তেহরান, সালজবার্গ, কাবুল, ইস্তাম্বুল এবং ভিয়েনার মতো প্রসিদ্ধ স্থানগুলোতে। 

অ্যালবার্ট বাসের বিজ্ঞাপন; Image Source: curlytales.com

অ্যালবার্টে চেপে লন্ডন থেকে কলকাতা আসতে যাত্রীদের খরচ পড়ত ১৪৫ পাউন্ড। তবে এর সাথে যুক্ত ছিল বাস সার্ভিসের অফার করা আরামদায়ক সব ব্যবস্থা। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য লাউঞ্জ, যেখানে বসে যাত্রা পথের দৃশ্য অবলোকন করা যেত আয়েশ করে। ছিল স্লিপিং বাঙ্ক, যেখানে চলন্ত বাসেও চাইলে শুয়ে বা ঘুমিয়ে নেয়া যেত ইচ্ছানুযায়ী। দিন-রাতের আবহাওয়ার তারতম্য কিংবা প্রচন্ড ঠাণ্ডার ভেতর দিয়ে যাবার সময় ব্যবহারের জন্য ছিল ফ্যান হিটার, পুরু কার্পেটে মোড়ানো বাস ফ্লোর আর রঙিন পর্দা। 

অ্যালবার্টের নিচতলায় ছিল বই পড়ার স্থান এবং খাবার লাউঞ্জ। আর ওপরতলায় ছিলো অবজারভেশন লাউঞ্জ। সেই সাথে খাবার রান্নার জন্য একটি পূর্ণ রান্নাঘর, পার্টির জন্য রেকর্ড করা গান ও রেডিওর ব্যবস্থাসহ আরো অনেক কিছু। সেই সময়ের হিসেবে দূরপাল্লার একটি বাস হিসেবে অ্যালবার্ট সত্যিই ছিল ‘ঘরের বাইরের ঘর’। 

নিউ ইয়র্ক টাইমসের আর্টিকেল; Image Source: idiva.com

নানা প্রতিকূলতার ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছিল অ্যালবার্টকে। বেশ কয়েকবছর টানা চলার পরে বাসটির পেছনের দিক ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় এর চলাচল সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেয়া হয়। ১৯৬৮ সালের মে মাসে ব্রিটিশ পর্যটক অ্যান্ডি স্টুয়ার্ট বাসটি কিনে নেন এবং নিজের মতো করে সাজিয়ে পুনরায় একই যাত্রাপথে চালু করেন। 

১৯৭৬ সাল পর্যন্ত লন্ডন-কলকাতা পথের বাস চালু ছিল বলে তথ্য পাওয়া যায়। তৎকালীন ইরানী রাজনৈতিক পরিবর্তন, ভারত-পাকিস্তানের সীমান্ত সংক্রান্ত জটিলতায় এই পথে বাস চলাচল অনিরাপদ হয়ে ওঠে। ফলে এই বাস যাত্রাপথ বন্ধ করে দেয়া হয়।

Related Articles