Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

লং মার্চ: চীনা লাল ফৌজের অবিস্মরণীয় কৃতিত্ব

১৯৩৪ সাল, চীনে চলছে রক্তক্ষয়ী এক গৃহযুদ্ধ। এক পক্ষে লড়ছে পশ্চিমা বিশ্বের আশীর্বাদ পুষ্ট কুয়োমিনতাং সেনাবাহিনী। নেতৃত্বে জাতীয়তাবাদী নেতা চিয়াং কাই শেক। আর অন্যপক্ষে আছে সোভিয়েত ইউনিয়নের সমর্থনপুষ্ট চীনা লাল ফৌজ, নেতৃত্বে মাও সে তুং। কীভাবে চীন এল এই অবস্থাতে? নজর ফেরানো যাক একটু পেছনে।

সেই ১৬৩৬ সাল থেকে চীন শাসন করে আসছিলেন কিং রাজারা। জার্মানি, ফ্রান্স আর বিশেষ করে ব্রিটেনের ক্রমাগত খবরদারিতে কিং রাজারা হয়ে পড়েছিলেন ভীষণ দুর্বল। পরপর দুইটি আফিম যুদ্ধ (১৮৩৯-১৮৪২, ১৮৫৬-১৮৬০) কিং রাজাদের নিয়ন্ত্রণ অনেকটাই খর্ব করে দেয়। এর মধ্যে নতুন উৎপাত হিসেবে জোটে জাপানীরা। ১৮৯৪ সালে জাপানীরা কোরিয়া দখল করে নিলে এই সাম্রাজ্য ভীষণ দুর্বল হয়ে পড়ে। বিশাল চীন দেশ হয়ে পড়ে খণ্ড-বিখণ্ড, গজিয়ে ওঠে অসংখ্য যুদ্ধবাজ নেতা। তারা প্রাচীন দিনের মতো গোটা একেকটা শহর আর প্রদেশ দখলে নিয়ে নিজেদের রাজত্ব চালাতেন।

১৯২৫ সালে সান ইয়াত সেন নামের এক জাতীয়তাবাদী নেতা চীনা কম্যুনিস্ট পার্টির সাথে এক শক্তিশালী জোট গড়ে তোলেন। উদ্দেশ্য, চীনকে নতুন করে গড়ে তোলা। ১৯২৫ সালে সান ইয়াতের মৃত্যুর পরে কুয়োমিনতাং দলের নেতৃত্বে আসেন চিয়াং কাই শেক। তিনি কম্যুনিস্টদের মোটেও সুনজরে দেখতেন না। চীনা কম্যুনিস্ট পার্টির সাথে কুয়োমিনতাং বাহিনীর দ্বন্দ্বের সূত্রপাত হয়। ফলে উভয় পক্ষ জড়িয়ে পড়ে এক গৃহযুদ্ধে।

লং মার্চের যাত্রাপথ; Source: pinterest.com

লং মার্চ

ফিরে আসা যাক ১৯৩০ এ। চীনের দক্ষিণের জিয়াংঝি প্রদেশ। রুইজিন শহরকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে সমাজতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা। কম্যুনিস্ট পার্টির ফার্স্ট আর্মি নিজেদের প্রথম শক্ত ঘাঁটিটি বিপদমুক্ত করবার দুশ্চিন্তায় জেরবার। চারিদিকে কুয়োমিনতাং বাহিনীর চরেরা ঘুরছে। নিজেদের মধ্যে দলাদলিও কম না। সব মিলিয়ে বিপজ্জনক পরিস্থিতি।

ওদিকে কুয়োমিনতাং সেনাবাহিনী কিন্তু বসে নেই। জার্মান উপদেষ্টা হান্স ভন শেক্ট এর পরামর্শ নিয়ে চিয়াং কাই শেক ধীরে ধীরে ঘিরে ফেলেছেন গোটা জিয়াংঝি প্রদেশকে। তার হাতে রয়েছে পাঁচ লক্ষ সৈন্য। ওদিকে লাল গুপ্তচরেরা খবর নিয়ে আসলো, যেকোনো দিন চিয়াং কাই শেক হামলা চালাতে পারেন রুইজিন শহরে। ১৯৩৪ এর আগস্ট মাস; অবরুদ্ধ সমাজতান্ত্রিক নেতারা বসলেন বৈঠকে। ঠিক হলো অবরোধ ভেঙে বেরুতে হবে। দলবল শুদ্ধ তারা পালিয়ে যাবেন হুনান প্রদেশে অবস্থিত সেকেন্ড রেড আর্মির হেডকোয়ার্টারে। ঐতিহাসিক লং মার্চের প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেল।

কম্যুনিস্টদের লং মার্চের প্রথম দিকের পরিকল্পনাকারী ছিলেন অটো ব্রাউন নামের এক জার্মান কম্যুনিস্ট। তার নির্দেশে লাল ফৌজ শহর ছেড়ে বেরুতেই কুয়োমিনতাং সেনাদলের হামলার মুখে পড়লো। জিয়াং অঞ্চলে সংঘটিত এই যুদ্ধে লাল ফৌজের অর্ধেক সৈন্য মারা যায়, সংখ্যাটি প্রায় ৪৫,০০০। কম্যুনিস্ট পার্টির নেতারা অগত্যা নেতৃত্ব তুলে দিলেন মাও এর হাতে। অটো ব্রাউনকে বরখাস্ত করা হলো।

ক্ষমতা হাতে পেয়েই মাও কিছু পরিবর্তন আনলেন পরিকল্পনায়। সেনাবাহিনীকে ছোট ছোট অনেকগুলো দলে ভাগ করা হলো যাতে শত্রুরা সহজে খোঁজ না পায়। ভারী জিনিসপত্র, যেমন- ছাপাখানার যন্ত্রপাতি ইত্যাদি ফেলে দেওয়া হলো। মাও গন্তব্যেও পরিবর্তন আনলেন। হুনান প্রদেশের বদলে সেনাবাহিনী যাত্রা শুরু করলো সুদূর উত্তর মধ্যাঞ্চলের প্রদেশ সানশির দিকে।

শিল্পীর তুলিতে মাও এবং তার সেনারা; Source: pinterest.com

যাত্রাপথ মোটেও সোজা ছিল না। পথে ছিল তুষার ঢাকা বিশাল সব পর্বতমালা, বিস্তৃত জলাভূমি আর ধু ধু প্রান্তর। তার থেকেও বড় কথা, সানশি যাওয়ার পথে যেসব অঞ্চল পড়ে সেখানে রাজত্ব করতো অত্যাচারী সব যুদ্ধবাজ স্থানীয় নেতা। এরা নিজেদের ভূখণ্ডে লাল ফৌজের আগমনকে মোটেও ভালো চোখে দেখেনি, তা বলাই বাহুল্য। ওদিকে কুয়োমিনতাং সেনাবাহিনীও সমানে পিছু নিয়ে লেগে থাকলো। এই অবিরাম আক্রমণ এড়ানোর জন্য মাও সে তুং এবং চীনা কম্যুনিস্ট পার্টির আরেক শীর্ষ নেতা, ঝৌ এন লাই তাদের সেনাবাহিনীকে নানা পথে চালাতে থাকলেন। গুইঝু, কুনমিং আর উইনান প্রদেশের পথে পথে হঠাৎ হঠাৎ হাজির হতে থাকলো কম্যুনিস্ট সেনারা। এভাবে ক্রমাগত রাস্তা বদল করতে থাকায় কুয়োমিনতাং কর্তারা বুঝেই উঠতে পারতেন না কোনদিকে যাচ্ছে মাও এর সেনারা। ফলে ইঁদুর-বিড়াল খেলা চলতেই থাকলো।

যাত্রাপথ ছিল দুর্গম আর কষ্টসাধ্য; Source: Beijing Review

লং মার্চে শুধু মাও এর সৈন্যরাই অংশ নিয়েছিলো ভাবলে ভুল হবে। হেনান প্রদেশ থেকে ঝাং গুয়াতাও এর নেতৃত্বে ফোর্থ আর্মি এসে যোগ দেয় মাও এর বাহিনীর সাথে। যদিও মতপার্থক্যের কারণে ঝাং এর সেনারা পরে অন্য পথ ধরে সানশির দিকে যাত্রা শুরু করে। হে লং এর নেতৃত্বে সেকেন্ড আর্মিও আরেক পথ ধরে, ইউনান প্রদেশ হয়ে সানশির দিকে যাত্রা করে। পথিমধ্যে দুই সেনাদলই কুয়োমিনতাং বাহিনীর হাতে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্থ হয়।

অবশেষে ১৯৩৫ এর অক্টোবরে, এক বছর ধরে চীনের নানা প্রান্ত থেকে কষ্টসাধ্য যাত্রা শুরু করার পর, সানশি প্রদেশে মাও এর মূল সেনাদল আর সেকেন্ড আর ফোর্থ আর্মি একত্র হয়। সানশির উত্তরাঞ্চলে আগেই স্থানীয় কম্যুনিস্ট নেতারা বেশ কিছু অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছিলেন। এবারে সেনাদল এসে পৌঁছাতে সানশি প্রদেশেই চীনা কম্যুনিস্ট পার্টির মূল ঘাঁটি স্থাপন করা হয়। চীনের নানা প্রান্ত থেকে দলে দলে মানুষ এসে যোগ দেওয়াতে লাল ফৌজের আকার ততদিনে ৮০ হাজারে পৌঁছেছে। যদিও ততদিনে এদের মধ্যে একদম শুরু থেকে লং মার্চে অংশ নিয়েছে এমন মানুষের সংখ্যা কমে মাত্র দশ হাজারে এসে ঠেকেছে।

মাও সে তুং এর নেতৃত্বে ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে এগিয়ে যায় লাল ফৌজ; Source: NYTIMES

১৯৩৪ এর অক্টোবর থেকে ১৯৩৫ এর অক্টোবর, এক বছর ব্যাপী এই দীর্ঘ মার্চে চীনা লাল ফৌজ ঠিক কতটা পথ পাড়ি দিয়েছিলো, তা নিয়ে অবশ্য মতভেদ আছে। চীনা সরকারের ভাষ্যমতে, যাত্রাপথ ২৫ হাজার লি বা ১২,৫০০ কিলোমিটার দীর্ঘ ছিল। যদিও পশ্চিমা পণ্ডিতদের ধারণা, আসল দৈর্ঘ্য ছিল এর অর্ধেক। তবে আসল দূরত্ব যেমনই হোক, বিরাট একটি সেনাবাহিনীকে নিয়ে এত দূর রাস্তা পাড়ি দেওয়া যে সামরিক কৌশলের দিক থেকে এক বিস্ময়কর ঘটনা, সেটা সব সমরবিদই স্বীকার করেন।

লং মার্চ মাও সে তুং এর ব্যক্তিগত জীবনেও একটি স্মরণীয় ঘটনা হিসেবে ধরা হয়। এই মার্চ চলাকালীনই, ১৯৩৫ এর ফেব্রুয়ারিতে মাও এর স্ত্রী হি ঝেঝেন একটি কন্যাসন্তানের জন্ম দেন। প্রতিকূল পরিবেশের কথা চিন্তা করে মেয়েটিকে দত্তক দিয়ে দেওয়া হয়। বহু পরে, ২০০৩ সালে ইউনান প্রদেশের এক প্রত্যন্ত গ্রামের জনৈকা বৃদ্ধা নিজেকে মাও সে তুং এর মেয়ে বলে দাবি করে, যদিও সরকারিভাবে এর কোনো স্বীকৃতি পাওয়া যায়নি।

চেয়ারম্যান মাও, নয়া চীনের প্রতিষ্ঠাতা; Source: pinterest.com

পরিশেষে

লং মার্চ শেষ হওয়ার বছর দেড়েক পড়ে, ১৯৩৭ সালে জাপানী বাহিনী পুনরায় চীন আক্রমণ করে বসলে কুয়োমিনতাং আর লাল ফৌজের মধ্যে এক চুক্তি সাক্ষরিত হয়। দুই দল সম্মিলিতভাবে জাপানীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশ নেয়। ১৯৪৫ সালে জাপান আত্মসমর্পণ করলে আবার গৃহযুদ্ধ বেঁধে যায়। তবে এবারে কম্যুনিস্ট সেনাদল বছর তিনেকের মধ্যেই কুয়োমিনতাং সেনাদেরকে একেবারে বিধ্বস্ত করে ফেলে। চিয়াং কাই শেক তাইওয়ানে পালিয়ে যান। সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে চীনের যাত্রা শুরু হয়। মাও সে তুং হয়ে ওঠেন নয়া চীনের অবিসংবাদিত নেতা, লং মার্চের সাফল্য তাকে অন্যান্য কম্যুনিস্ট নেতাদের তুলনায় অনেক বেশি সম্মান আর প্রভাব-প্রতিপত্তি এনে দেয়। এমনকি বর্তমানের চীনা রাজনীতিতেও সেই লং মার্চের প্রভাব দৃশ্যমান।

ফিচার ইমেজ- Pinterest

Related Articles