সিন্ধু সভ্যতার সময়কার এক গুরুত্বপূর্ণ বন্দর হিসেবে ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই নিয়েছে 'লোথাল'। গুজরাটি ভাষায় 'লোথ' শব্দের অর্থ 'মৃতের স্তূপ'। কথিত আছে, মৃত মানুষের ইতিহাস নাকি ছুঁয়ে দেখা যায় এই প্রত্ন ক্ষেত্রে। 'মহেনজোদাড়ো' শব্দের অর্থও 'মৃতের স্তূপ'। লোথালের অবস্থান ছিল গুজরাটের সৌরাষ্ট্র অঞ্চলের সবরমতীর উপনদী ভোগাবোর উপত্যকায়। এলাকাটিকে গুজরাটি ভাষায় 'ভাল্' বলে ডাকা হয়। বর্ষার পানিতে এই বন্দরের প্রায় সবটাই ডুবে যায়, ভেসে থাকে শুধু গ্রামগুলো। ধারণা করা হয়, লোথাল একটি আন্তঃবন্দর ছিল। ইতিহাসবেত্তা ইরফান হাবিবের ভাষায়,
"কেবলমাত্র ছোট নৌকা, তাও উজানি পালের হাওয়ায় এখানে নোঙর করতে পারে। আর প্রকৃত সমুদ্রবন্দর অবশ্যই দূরে ছিল। ঘগগরের নিকটে মধ্যযুগে খাম্বাটের বন্দর হিসেবে যে সমুদ্রবন্দরটি ব্যবহৃত হতো, সেখানেই কোথাও হয়তো এই বন্দরটির অবস্থান ছিল।"
প্রাচীন বন্দর হিসেবে অতীতে লোথাল বন্দরের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। লোথাল গুজরাটের প্রাচীন কাম্বে এবং বর্তমানে খাম্বাটের সন্নিকটে অবস্থিত। এখানকার জমি ছিল লবণাক্ত। সেই যুগে এখানে বাবলা আর তেঁতুল গাছের প্রাধান্য ছিল বেশি। এর কাছাকাছি নাল সরোবর নামে একটি জলাভূমি অবস্থিত। ধারণা করা হয়, কাম্বে উপসাগর থেকে একটি খাঁড়ি মূল ভূখণ্ডে প্রবেশ করত। সেখান থেকে লোথালে প্রবেশের একটি জলপথ ছিল। মূল কেন্দ্রটি ৪০০×৩০০ মিটার এবং ১৩ মিটার চওড়া ইটের দেয়াল দিয়ে ঘেরা ছিল। ঠিক কোন উদ্দেশ্য নিয়ে এই দেয়ার নির্মাণ করা হয়েছিল, তা এখনো অজানা।
কেন্দ্রটি পুরনো একটি নদীখাতে অবস্থিত। এই নদীখাতকে ঘিরে একটি শহরের গোড়াপত্তন হয়েছিল। কেন্দ্রের দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলকে অ্যাক্রোপলিস বলা হচ্ছে, আর বাকি অংশটুকু হলো নিম্ন-শহর। শহরের শাসকরা অ্যাক্রোপলিসে বাস করতেন। এখানে পাকা স্নানাগার, নোংরা জল ও ময়লা নিষ্কাশনের জন্য নর্দমা, পানীয় জলের কূপ, গুদামঘর অবস্থিত ছিল। নিম্ন শহর দুই ভাগে বিভক্ত ছিল। এর মধ্যে একটি ছিল প্রধান বাণিজ্যিক এলাকা। এখানে ধনী, সাধারণ ব্যবসায়ী এবং কারিগরেরা বাস করত। আবাসিক এলাকাটি বাজারের উভয় পাশে অবস্থিত ছিল। লোথালের সমৃদ্ধির বছরগুলোতে নিম্ন শহরটি পর্যায়ক্রমে প্রসারিত হয়েছিল। এখানে সন্ধানে মিলেছে একাধিক পাকা সড়কের। এর মধ্যে একটি সড়ক ১৩ মিটার প্রশস্ত। একসময় সিন্ধু সভ্যতার বণিকদের কোলাহলে মুখরিত থাকত এই স্থান।
লোথালের প্রত্ন ক্ষেত্র থেকে আবিষ্কার করা পোড়ানো ইটের তৈরি ঘরবাড়িগুলো বেশ অক্ষত অবস্থায় পাওয়া গেছে। একটি বাড়ির ঘর থেকে একটি শঙ্খ, পাথরের শিল, একটি নোড়া উদ্ধার করা গেছে। ধারণা অনুযায়ী, এখানে পুঁতি তৈরির কারখানাও ছিল। এখানের এক বাড়িতে পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থার সন্ধান পাওয়া গেছে। নোংরা জল বাইরের জালায় গিয়ে পড়ার ব্যবস্থাও ছিল। তবে আয়তনের দিক দিয়ে লোথাল ছিল হরপ্পা বা মহেনজোদাড়োর চেয়ে ছোট। যেহেতু অনুমান করা হচ্ছে এটি একটি আন্তঃবন্দর হিসেবে ব্যবহৃত হতো, তাই স্বাভাবিকভাবে এখানে ছোট ছোট নৌকাই নোঙর করতো। আবার এও বলা হচ্ছে, এটি ক্ষুদ্র একটি নৌ-বন্দর হিসেবে ব্যবহার করা হলেও, এর থেকে আরও দূরে সমুদ্রের নিকটে বড় বন্দর ছিল। সেই বন্দরে দূর থেকে আগত নাবিকেরা তাদের বড় বড় জাহাজ ভেড়াতো।
লোথাল ব্যবহৃত হতো উপ-বন্দর হিসেবে। বন্দর হিসেবে লোথালের আয়তন ছিল অনেক ছোট। এটি ছিল ২১২ থেকে ২১৫ মিটার দীর্ঘ এবং ৩৫ থেকে ৩৭ মিটার প্রশস্ত। মনে প্রশ্ন জাগতে পারে এত ছোট একটি জলাধার সমুদ্রবন্দর হয় কী করে? আবার এর চারপাশ ইট দিয়ে বাঁধানো। অনেক বড় পুকুরও তো এর থেকে বড় হয়। উত্তর হিসেবে ইতিহাসবিদরা বলেছেন, সম্ভবত সমুদ্রের কাছে নয়, বরং দূরবর্তী কোনো স্থানের সঙ্গে এই নিম্নভূমির সংযোগ সুদূর অতীতে ছিল। যে কারণে একে ছোট বন্দর বা উপ-বন্দর হিসেবে ব্যবহার করা হতো।
আবার অনেকে এই দাবিও উত্থাপন করেন যে, এটি ছিল সেচ কাজে ব্যবহারের জন্য একটি জলাধার। সেই প্রশ্নের উত্তর দিতেও বাঁধবে গণ্ডগোল। কারণ, সেচের জল সরবরাহের জন্য এমন জটিল স্থাপত্য গড়ে তোলার কোনো প্রয়োজনই নেই। ক্ষুদ্র অ্যাক্রোপলিসের ভেতরে পুষ্করিণীর সন্নিকটে অবস্থিত গুদামঘরে কাদা ইটের একটি পাটাতন রয়েছে। সম-আকারে অসংখ্য কাদা-ইটের উল্লম্ব খণ্ডের উপর পাটাতনটি স্থাপিত। এখানে কাঠের খাঁচার মধ্যে পণ্যের মোড়ক সার সার করে রাখা থাকত। এই জায়গা থেকে প্রায় ৬৫টি সীলমোহর উদ্ধার করা হয়েছে। তবে তৎকালীন সময়ে লোথাল প্রভূত উন্নতি সাধন করেছিল।
তখনকার রাস্তাগুলো ছিল কাঁকর বা পোড়ামাটির নুড়ি বিছানো অথবা কাদা-ইট আর চুলে পরিণত বালির কাঁকর দিয়ে বাঁধানো। সুপ্রশস্ত পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থায় নালির জল প্রবাহিত হয়ে একটি নর্দমার ডোবা এবং জাহাজঘাটায় গিয়ে পড়ত। এখানে পুঁতি তৈরি প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো। পুঁতির কারখানায় দশটি ঘর এবং কাজ করার জন্য বড় একটি উঠান ছিল। একসাথে একাধিক কারিগর যাতে স্বাচ্ছন্দ্যে কাজ করতে পারে, সেজন্য পাঁচটি চুল্লি এবং বেসিনের ব্যবস্থা ছিল। পুরো শহরকে আচ্ছাদিত করে রেখেছিল কাদামাটির ইট দ্বারা নির্মিত প্রাচীর। লোথাল বন্দরের কাহিনী মৌর্য যুগের রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক আলোচনায় খুঁজে পাওয়া যায়। তবে, মৌর্য যুগের আগেও সমুদ্র হিসেবে লোথালের কথা বেশ কিছু জায়গায় উঠে এসেছে।
সিন্ধু সভ্যতার সময়ে ব্রোঞ্জ যুগের একটি মানচিত্র থেকে অনুমান করা হচ্ছে, লোথাল সমুদ্রের নিকটবর্তী এক স্থানে অবস্থিত ছিল। বিশেষ কোনো ছোট নদীর সাথে লোথালের সংযোগ ছিল। সমুদ্র থেকে ছোট নদীপথে নৌকায় করে লোথালে পণ্য পরিবহন করা হতো। এই প্রসঙ্গে অতুল সুর বলেছেন,
"বাণিজ্যের একটি প্রধান কেন্দ্র ছিল গুজরাটের অন্তর্ভুক্ত লোথাল। এখানে ছিল প্রাচীন জগতের এই বিরাট পোতাশ্রয়। বাঙালী বণিকরাও যে লোথাল থেকে আরও অগ্রসর হয়ে ওই পথে নিজেরা ভূমধ্যসাগরীয় দেশসমূহের সাথে বাণিজ্য করতে যেত, এর প্রমাণও আছে।"
এই কথা থেকে আরেকটা যুক্তির উদয় হয় যে, লোথাল ছোট নৌ-বন্দর ছিল না। আয়তনের দিক দিয়ে বেশ বড় বন্দরই ছিল। তবে তা ক্ষয়প্রাপ্ত হয়েছিল হরপ্পার যুগ পর্বেই। পরবর্তীতে হয়তো প্রাকৃতিক পরিবর্তনের কারণে লোথাল পুনরায় গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। তখন সেটাকে পুনঃখননের মাধ্যমে বড় আয়তনে নতুন বন্দর হিসেবে রূপ দেওয়া হতে পারে। হয়তো তা পূর্বেকার স্থানে না হয়ে, গুজরাটের অন্য কোনো স্থানে তৈরি করা হয়েছিল।
সিন্ধু সভ্যতার সূর্য অস্ত যাওয়া পর্যন্ত এ অঞ্চলের বাণিজ্য ব্যবস্থা পাকাপোক্ত ছিল অনেক দেশের সঙ্গে। লোথালে প্রচুর গুদাম ঘরের অস্তিত্ব বিদ্যমান ছিল। তাই, লোথালকে অনেকে বাণিজ্যিক শহর হিসেবেও অভিহিত করেন। লোথালের গুদামঘর থেকে পোড়ামাটির সিলমোহর পাওয়া গেছে। পণ্য ও দ্রব্যাদির পাত্রের মুখ বন্ধ করে সিল মারা হতো। কোথাকার পণ্য কোথায় যাচ্ছে, তা চিহ্নিত করার জন্যই এই ব্যবস্থা। যেটাকে বর্তমান যুগের বিভিন্ন কোম্পানির পার্সেলের সাথে তুলনা দেওয়া যায়। সিলের ছাপ যেসব পণ্যের উপর অঙ্কিত ছিল, সেসব পণ্য সিন্ধু নদ হয়ে বিভিন্ন প্রান্ত থেকে লোথালে উপনীত হতো।
লোথালে বৃহৎ কোনো বন্দরের সন্ধান না পাওয়া গেলেও এটাকে ছোটখাটো নৌ-বন্দর হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। এই বন্দর সিন্ধুর বিভিন্ন শাখা নদী থেকে আসা পণ্যবাহী নৌকা অন্তত বর্ষায় লোথালের বন্দরে প্রবেশ করতে পারত। সবরমতি নদী দিয়ে এই বন্দর আরবসাগরের উপকূলবর্তী ধোলাভিরার সাথে যোগাযোগ রাখত। এই বন্দরের মারফতেই সিন্ধু সভ্যতার মানুষ মেসোপটেমিয়া, মিশর ইত্যাদি অঞ্চলে ব্যবসা বাণিজ্যের জন্য যাতায়াত করতে পারত। মেসোপটেমিয়ায় প্রাপ্ত ষাঁড়ের ছবিওয়ালা সিলমোহর যার অকাট্য প্রমাণ। ধাতুপাত্র, স্বর্ণ, গহনা এবং সজ্জিত অলঙ্কার, ওজন পরিমাপের বাটখারা, সিলমোহর, মাটির পাত্র লোথালের মানুষজনের রুচিশীল সংস্কৃতির প্রমাণ তুলে ধরে। লোথাল থেকে পুঁতি, রত্নপাথর, হাতির দাঁত এবং শাঁস রপ্তানি করা হতো। চাষাবাদ করে লোথালের বাসিন্দাদের জীবনে আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য আসেনি বলে, বন্দরের আয়ই ছিল তাদের জীবিকার প্রধান অবলম্বন।
লোথালের পতনের উৎস হিসেবে ধরা হয় বন্যা ও ঝড়কে। একটি শক্তিশালী বন্যা শহরটিকে নিমজ্জিত করে ফেলে এবং এতে শহরের বেশিরভাগ বাড়িঘরই ধ্বংস হয়ে যায়। নদীর গতিপথ পরিবর্তনও লোথালের জন্য বিপদ ডেকে আনে। এর ফলে লোথালের নৌ-বন্দরের যোগাযোগ দারুণভাবে বিপর্যস্ত হয়েছিল। মাটি ক্রমশ লবণাক্ত হয়ে যাওয়ার ফলে চাষাবাদ প্রক্রিয়ায় আসে বাধা। এছাড়াও সম্পদ স্বল্পতা, দুর্বল প্রশাসনিক ব্যবস্থা, ভেতর থেকে ক্ষয়ে যাওয়া অর্থনীতিকে লোথালের পতনের জন্য দায়ী করা হয়।
Feature Image: iStock
Information Sources
2. Lothal: India's First Port City - Live History India.
3. 4,500-year old Lothal in Gujarat needs greater promotion and preservation - The Times of India
4. সিন্ধু সভ্যতা, ইরফান হাবিব, ভাষান্তর - কাবেরী বসু, ন্যাশনাল বুক অ্যাজেন্সি প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা - ২০১৩।
5. প্রাগৈতিহাসিক ভারত, দিলীপকুমার চক্রবর্তী, আনন্দ পাবলিশার্স, কলকাতা ২০১৪।
6. ভারতবর্ষের ইতিহাস, প্রগতি প্রকাশনী, মস্কো, ১৯৮২।
7. ভারত-ইতিহাসের আদিপর্ব [প্রথম খণ্ড], রণবীর চক্রবর্তী, ওরিয়েন্ট ব্লাকসোয়ান, কলকাতা, ২০০৯।
8. প্রাগৈতিহাসিক ভারত, অতুল সুর, সাহিত্যালোক, কলকাতা, ১৯৯৭।
9. সিন্ধু সভ্যতার সন্ধানে, শেখ মাসুম কামাল, দ্যু প্রকাশন, ঢাকা, ২০২০।