Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

পদ্ম-পা: এক অমানবিক রুপচর্চার ইতিকথা

চীনের আগেকার দিনের ছবিগুলো যদি আমরা দেখি, তাহলে কিছু নারীর ছবি দেখতে পাবো, যাদের পাগুলো ঠিক আমাদের পায়ের মতো নয়। মাঝখান থেকে বাঁকানো, একেবারে দুমড়েমুচড়ে থাকা আঙুল দেখলে যে কেউই শুরুতে ভাববে যে, কেউ হয়তো তার পা-টা মাঝ বরাবর মুচড়ে দিয়েছে, ভেঙে দিয়েছে তার পায়ের আঙুলগুলো। কিন্তু অদ্ভুত শোনালেও সত্য যে, প্রায় এক হাজার বছর ধরে আনুমানিক ৩০০ কোটি চীনা নারী স্বেচ্ছায় তাদের পায়ের স্বাভাবিক আকৃতি পরিবর্তনের এ  পথ অবলম্বন করেছিলো!

পদ্ম-পায়ের এক নারী; Source: Roland Belgrave Vintage Photography

চীনের নারীদের পায়ের স্বাভাবিক আকৃতি পরিবর্তনের এ চর্চাটির খটমটে নাম ‘Foot Binding’ বা ‘পা বাঁধা’। তবে এর মোহে আকৃষ্টরা চর্চাটিকে চমৎকার এক শৈল্পিক নামও দিয়েছিলেন- ‘Lotus Feet’ বা ‘পদ্ম-পা’। আজকের লেখায় এই পদ্ম-পায়ের পেছনের ইতিহাস, কিভাবে এ কষ্টদায়ক কাজটি একজন নারীর উপর সারা হতো, কিভাবে এর অবসান ঘটলো, সমাজ জীবনে এর প্রভাব কেমন ছিলো- এমনই নানা প্রশ্নের উত্তর খোঁজা হয়েছে।

কিভাবে হলো পদ্ম-পায়ের প্রচলন?

চীনের নারীদের বিচিত্র এ পদ্ম-পায়ের প্রচলন যে ঠিক কবে, কিভাবে শুরু হয়েছিলো তা নিয়ে সঠিক নির্ভরযোগ্য তথ্য তেমন একটা পাওয়া যায় না। নানা জায়গায় মেলে নানা মতের সন্ধান।

আনুমানিক ১৬০০ থেকে ১০৪৬ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত চীনে শ্যাং রাজবংশের শাসন চালু ছিলো। এ বংশেরই এক রাজা ছিলেন ঝৌ। তার প্রিয় এক উপপত্নী ছিলো দাজি, যার কিনা ক্লাবফুটের সমস্যা ছিলো। দাজি নাকি রাজার কাছে আবদার করেছিলেন যে, তিনি যেন রাজসভায় থাকা সকল নারীকে পা বেঁধে রাখতে বলেন, যেন তার পা তখন সৌন্দর্য ও আভিজাত্যের প্রতীক হয়ে ওঠে। এভাবেই এককালে চালু হয় পদ্ম-পায়ের চর্চা।

দাজির ভাষ্কর্য; Source: Photo Dharma from Penang, Malaysia

আরেক বর্ণনার জন্য ফিরে যেতে হবে ৯৬১ থেকে ৯৭৬ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত দক্ষিণ ট্যাং অঞ্চলের সম্রাট লি ইউয়ের কাছে। মূল্যবান পাথর ও মুক্তা দিয়ে সাজিয়ে তিনি প্রায় ৬ ফুট উঁচু পদ্মের ন্যায় এক মঞ্চ তৈরি করেছিলেন। এরপর তার উপপত্নী ইয়াও নিয়াংকে সাদা সিল্কের কাপড় দিয়ে তার পাগুলো অর্ধচন্দ্রাকৃতিতে বেঁধে সেই মঞ্চের উপর নাচতে বলেন তিনি। সেদিন নিয়াং এতটাই চমৎকারভাবে নেচেছিলেন যে উপস্থিত সকলের মুখ বিস্ময়ে হাঁ হয়ে গিয়েছিলো। এরপর তার দেখাদেখি রাজসভার অন্যান্য নারীরাও পা বাঁধার নতুন সেই চর্চা শুরু করে দেয়।

পা বাধছেন ইয়াও নিয়াং; Source: Sexual Life in Ancient China, Van Gulik 1961

শুরুর দিকে চর্চাটি কেবল সমাজের উচ্চবিত্ত নারীদের মাঝে সীমাবদ্ধ থাকলেও কালক্রমে তা সকল শ্রেণীর নারীর মাঝেই ছড়িয়ে পড়ে। তবে কিছু কিছু প্রদেশের মানুষ (যেমন- মাঞ্চু ও দক্ষিণ চীনের গুয়াংডং থেকে আসা লোকেরা) এ প্রথাটির বিরোধীতা ঠিকই করেছিলো।

যেভাবে হলো এ অমানবিক প্রথার অবসান

যদিও পা বাঁকিয়ে ফেলার পুরো প্রক্রিয়াটাই ছিলো বেশ অমানবিক, তারপরও চীনের নারী সমাজে এটা ছিলো বেশ সমাদৃত এবং পরম আকাঙ্ক্ষিত এক চর্চা। দিন দিন তারা আরো ছোট, আরো বাঁকানো পায়ের পাতার সন্ধান করতে থাকায় একসময় পদ্ম-পাগুলোর পাতার দৈর্ঘ্য দাঁড়ায় মাত্র তিন ইঞ্চির মতো!

আঠারো শতক থেকে অমানবিক এ প্রথার বিরুদ্ধে আস্তে আস্তে জনমত তৈরি হতে থাকে। শেষ পর্যন্ত নানা সফলতা-বিফলতার গল্প লিখে ১৯১২ সালে সান ইয়াত-সেনের বিদ্রোহের পর চীনে এটি নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। এরপরও মোটামুটি ১৯৫০ সাল পর্যন্ত চীনা সংস্কৃতিতে টিকে ছিলো পদ্ম-পা

Source: Jo Farrell

১৯৪৯ সালে কম্যুনিস্ট পার্টি ক্ষমতায় আসার পর দৃশ্যপট চূড়ান্তভাবে বদলাতে শুরু করে। তখন নারীদেরকে নানা ধরনের কঠিন পরিশ্রমের কাজ করতে হতো, যা পদ্ম-পায়ের নারীদের পক্ষে করা সম্ভব হতো না। এছাড়া সেই নারীদের পক্ষে অন্যদের মতো পাহাড় বেয়ে ওঠা সম্ভব হতো না। চাহিদামতো কাজ করতে না পারায় মাঝে মাঝেই তাদেরকে না খেয়ে দিন কাটাতে হতো। ফলে জীবিকার তাগিদেই নারীরা পদ্ম-পায়ের চর্চা থেকে সরে আসতে বাধ্য হয়।

পদ্ম-পা বানানোর পদ্ধতি

এখন তাহলে চলুন এই পদ্ম-পা বানানোর পদ্ধতি সম্পর্কে জেনে নেয়া যাক।

সাধারণত একটি মেয়েশিশুর বয়স যখন চার থেকে সাত বছরের ভেতর থাকতো, তখন তার পা-কে পদ্মের ন্যায় আকৃতি দেয়ার কাজটি শুরু হয়ে যেত। কারণ তখন তাদের পায়ের হাড় তুলনামূলক নরম থাকায় তা সহজে বাঁকিয়ে পছন্দসই আকৃতি দেয়া সম্ভব ছিলো

প্রথমে মেয়েটির পা বেশ কিছু সময় ধরে কুসুম গরম পানিতে ডুবিয়ে রাখা হতো। এরপর পা থেকে মৃত চামড়া অপসারণ করা হতো। তারপর পায়ের আঙুলের নখগুলো যথাসম্ভব ছোট করে কাটা হতো এবং ঘাম হওয়া রোধ করতে আঙুলগুলোর মাঝে ফিটকিরি লাগানো হতো। এরপরই শুরু হতো বাঁধাবাঁধির আসল কাজ।

ব্যান্ডেজ বাঁধা পা; Source: Ernst v. Hesse-Wartegg

২ ইঞ্চি প্রস্থ ও ১০ ইঞ্চি দৈর্ঘ্যের তুলার ব্যান্ডেজ গরম পানিয়ে ভিজিয়ে নেয়া হতো যেন শুকিয়ে গেলে তা সঙ্কুচিত হয়ে আসে। এ কাজগুলো সাধারণত মেয়েটির মা কিংবা গ্রামের কোনো অভিজ্ঞ মহিলা করতেন। এরপর বুড়ো আঙুল বাদে বাকি আঙুলগুলো পায়ের নিচে নিয়ে সেগুলো ব্যান্ডেজ দিয়ে বাংলা ‘৪’ এর মতো করে বাঁধা হতো। গোড়ালি আর বুড়ো আঙুল বাঁধা হতো না। এভাবে বেঁধে রাখার ফলে পায়ের নীচের অংশের হাড় একসময় ভেঙে যেত। বাঁধন যাতে শক্ত হয় এবং বাচ্চা মেয়েটি যাতে সেটি খুলতে না পারে সেজন্য ব্যান্ডেজের বিভিন্ন জায়গায় সেলাই করে দেয়া হতো। এবার বেশ ছোট একজোড়া জুতো পায়ে পরিয়ে মেয়েটিকে হাঁটতে বাধ্য করা হতো যা ছিলো অত্যন্ত যন্ত্রণাদায়ক এক ঘটনা

পদ্ম-জুতো; Source: commons.wikimedia.org

একদিন বা দুদিন পরপর মেয়েটির পায়ের সেই ব্যান্ডেজ খুলে, পা ধুয়ে আবারো ব্যান্ডেজ লাগিয়ে দেয়া হতো। ধীরে ধীরে ব্যান্ডেজ শক্ত হতে শুরু করতো, ছোট হতে থাকতো জুতার আকৃতি। এভাবে প্রায় দু’বছর ধরে চলতো প্রক্রিয়াটি যতদিন না মেয়েটির পায়ের পাতা কাঙ্ক্ষিত অর্ধচন্দ্রাকৃতি ধারণ না করছে।

পুরো প্রক্রিয়ার সাথে জড়িয়ে ছিলো নানা বিপদের হাতছানি। যদি নখগুলো ঠিকমতো কাটা না হতো, তাহলে সেগুলো পায়ের নিচের অংশে কেটে ক্ষত তৈরি করতো। মাঝেমাঝেই গ্যাংগ্রিন হতো দুর্ভাগা সেই মেয়েটির। এমনকি সবকিছু ঠিকঠাক মতো হলেও মাঝেমাঝেই মেয়েটির পা ফুলে পুঁজ হয়ে বেশ খারাপ অবস্থা হয়ে যেত।

এক্স-রে’র নিচে একটি পদ্ম-পা; Source: Frank and Frances Carpenter Collection

ব্যাপারটা যদি পা-কে পছন্দসই আকৃতি দেয়ার মধ্য দিয়েই শেষ হতো, তাহলেও কথা ছিলো। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আজীবনই এর দেখাশোনা করতে হতো একজন নারীকে। নিয়মিতই গোসলের সময় জায়গাটি পরিষ্কার করে নতুন করে জায়গাটি ব্যান্ডেজ করতে হতো তাকে। নাহলে ধীরে ধীরে পা তার পূর্বেকার আকৃতি ধারণ করতো যা ছিলো একেবারে শুরুর দিকে পা বাঁকানোর মতোই যন্ত্রণাদায়ক

একটি স্বাভাবিক পা ও একটি পদ্ম-পা; Source: C. H. Graves

সমাজ জীবনে পদ্ম-পায়ের প্রভাব

পদ্ম-পা দেখাচ্ছেন একজন চীনা নারী; Source: Women Of All Nations, page 532, MCMXI (1911)

চীনা সমাজ জীবনে এই পদ্ম-পায়ের প্রভাব ছিলো সত্যিই চমকে দেবার মতো। একবার এর প্রচলন শুরু হবার পর মানুষজন স্বাভাবিক পা যুগলকেই বরং কুৎসিত হিসেবে দেখা শুরু করে দিলো! একজন মা কখনোই চাইবেন না তার সন্তান ব্যথায় কষ্ট পাক। তবে পদ্ম-পায়ের মতো দু’বছরব্যাপী এ কষ্টকর যাত্রার পথে নিজেদের মেয়েকে ঠেলে দিতে তারা বিন্দুমাত্র কুন্ঠাবোধ করতেন না। যদি কোনো মেয়ের পা এভাবে বাঁধা না হতো, তাহলে প্রতিবেশি অন্যান্য নারীদের হাসি-ঠাট্টার শিকার হতে হতো সেই মেয়েটিকে। সামাজিক অবস্থানের চেয়ে একজন নারীর পদ্ম-পায়ের সৌন্দর্য তার ভালো জায়গায় বিয়ের ব্যাপারে অধিক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতো!

Source: Jo Farrell

স্ত্রীর উপর স্বামীর অধিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতেও প্রত্যক্ষ ভূমিকা ছিলো বাঁকানো এ পায়ের। যেহেতু এ পা দিয়ে খুব বেশি হাঁটাচলা করা সম্ভব ছিলো না, তাই একজন মহিলা অধিকাংশ সময় ঘরেই কাটিয়ে দিতেন। ফলে ধীরে ধীরে স্বামীর উপর তিনি অত্যাধিক মাত্রায় নির্ভরশীল হয়ে পড়তেন। স্বামীর হাতে মার খেলেও দুর্ভাগা সেই নারীরা বাড়ি ছেড়ে যেতে পারতো না সাহায্যের খোঁজে

Source: Jo Farrell

পদ্ম-জুতো আমাদের হাতের চেয়েও ছোট! Source: Andrew Lichtenstein

স্থাপত্যশিল্পের উপর প্রভাব

তৎকালে চীনের স্থাপত্যের উপরও ছিলো এর বিশেষ প্রভাব। একজন নারীর পক্ষে সিঁড়ি বেয়ে উপরে ওঠা কষ্টকর হবে বিধায় চীনারা তাদের বাড়িগুলো একতলা করে বানানো শুরু করেছিলো। হাঁটাচলার সময় দেয়াল বা রেলিংয়ে ভর দিয়ে চলতে হতো বলে তাদের সড়ক ও গলিগুলোও হতো তুলনামূলক সংকীর্ণ

বাদ যায় নি যৌনতাও

প্রাচীন চীনা সমাজ ব্যাবস্থায় বিকৃত এ পা-ই ছিলো পুরুষদের কাছে সর্বাপেক্ষা যৌনাবেদনময় অঙ্গ। স্ত্রীর সাথে মিলিত হবার আগে তারা অনেকক্ষণ ধরে কেবল তার সেই পায়েই হাত বুলিয়ে আদর করতো। কিং রাজবংশের সময়কালে একটি নির্দেশিকাও প্রকাশ করা হয়েছিলো এ বিষয়টি নিয়ে। সেখানে নারীদের পদ্ম পায়ে আদর করার ৪৮টি পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করা হয়েছিলো!

প্রাচীন চীনা নারীদের পদ্ম-পা সহ এমন ভঙ্গিমা আকৃষ্ট করতো তাদের পুরুষদের; Source: Frank and Frances Carpenter Collection

নারী শরীরের সেই বিকৃত পা-কে যদি শুধু যৌনাবেদনময় অঙ্গ বলা হয়, তাহলে ভুল বলা হবে, বরং এর আগে ‘সবচেয়ে’ শব্দটিও যোগ করতে হবে। কারণ প্রাচীন চীনের যৌনতা বিষয়ক নানা বইয়ে নারীদের এমন ছবি দেখা গেছে যেখানে তারা সারা শরীর উন্মুক্ত রাখলেও ঢেকে রেখেছে তার সেই ‘পদ্ম-পা। পায়ের বাঁধনগুলো নিয়ে তাদের এমনভাবে খেলা করতে দেখা যেতো যে, এখনই যেন তারা পাগুলো সবার সামনে দেখাতে যাচ্ছে, তবুও দেখাচ্ছে না!

Source: Jo Farrell

একজন নারীকে এভাবে কষ্ট দেয়া একটি চর্চা কিভাবে হাজার বছর ধরে টিকে থাকলো আর কেনই বা নারীরা সেই ব্যাপারটিকে মেনে নিয়ে বরং এ থেকে দূরে সরে যেতে চাওয়া অন্যান্য নারীদের নিয়ে মজা করতো তা আসলেই আমার মাথায় ঢোকে না। শেষপর্যন্ত যে গত শতকের মাঝামাঝির দিকে অমানবিক এ সৌন্দর্য লাভের চর্চাটির অবসান ঘটেছে এটাই স্বস্তির বিষয়।

Related Articles