Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

‘মেশিন গান’ কেলি: কুখ্যাত এক গ্যাংস্টারের আদ্যোপান্ত

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত একটি অঙ্গরাজ্য টেনেসী। এই টেনেসীরই দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্তে অবস্থিত এক শহর মেম্ফিস, যা আয়তনের দিক দিয়ে এ রাজ্যের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর। আজ থেকে প্রায় ১২২ বছর আগেকার কথা। ১৮৯৫ সালের ১৮ জুলাই মেম্ফিসেরই এক স্বচ্ছল পরিবারে জন্ম নেয় এক ছেলে, বাবা-মা আদর করে তার নাম রাখেন জর্জ বার্নস কেলি। ছোট্ট কেলির বয়স যখন দু’বছর, তখনই তার পরিবার চলে আসে শিকাগোতে।

কোনো এক অজানা কারণে বাবার সাথে কেলির সম্পর্ক কখনোই খুব একটা হৃদ্যতাপূর্ণ ছিলো না। একটি উদাহরণ দিলেই বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে যাবে। একবার কেলি দেখলো তার বাবা লুকিয়ে লুকিয়ে আরেক মহিলার ঘরে প্রবেশ করছেন, চুরির উদ্দেশ্যে না, পরকীয়ার উদ্দেশ্যে। কেলি তার মাকে এ ব্যাপারে কিছুই জানালো না। চুপচাপ পরদিন গিয়ে বাবার অফিসে গিয়ে হাজির হলো সে। এরপর শুরু হলো বাবাকে ব্ল্যাকমেইলের পালা। সে দাবী করলো তার মাসিক ভাতা বাড়িয়ে দিতে হবে এবং বাসার গাড়ির চাবিও এখন থেকে তাকে দিতে হবে। এটা না করলে গতকালের ঘটনা নিয়ে সে অন্যকিছু করতে বাধ্য হবে! নিরুপায় হয়ে তার বাবা সেদিন নিজের অন্যায় চাপা দিতে ছেলের দাবি মেনে নিয়েছিলো।

জর্জ বার্নস কেলি; Source: fbi.gov

কেলি বড় হয়ে কী হতে যাচ্ছে, তার নমুনা সে দেখাতে শুরু করে এ গাড়িটি পেয়েই। গাড়ির চাবি সে পেয়েছিলো হাই স্কুলে পড়াকালে। তখনই সে লুকিয়ে লুকিয়ে গাড়িতে করে বিভিন্ন অ্যালকোহলিক ড্রিঙ্ক পরিবহনের কাজ শুরু করে দেয়। খুব বেশিদিন এভাবে অবশ্য চালিয়ে যেতে পারে নি। একদিন ঠিকই আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে ধরা পড়ে যায় সে। তখন এতদিন ধরে অপছন্দ করে আসা প্রভাবশালী বাবার ফোনকলেই মুক্তি মেলে কেলির।

স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে মিসিসিপিতে এক কলেজে ভর্তি হয় কেলি, পাঠ্যবিষয় হিসেবে বেছে নেয় কৃষিবিদ্যাকে। কিন্তু কলেজ জীবনটা তার কাছে যেন ছিলো এক দুঃস্বপ্নেরই নামান্তর। একদিকে যেমন পরীক্ষার ফলাফল হচ্ছিলো যাচ্ছেতাই, অন্যদিকে তার নামে নিয়মিতই আসছিলো কলেজের নানা নিয়ম-শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগ। একসময় আর কলেজ জীবনের সাথে মানিয়ে নিতে না পেরে জন্মশহর মেম্ফিসে ফিরে যায় সে। সেখানে গিয়ে পরিচয় হয় স্থানীয় এক ধনী ব্যবসায়ীর মেয়ের সাথে। মেয়েটির নাম ছিলো জেনেভা র‍্যামসে। একসময় জেনেভার সাথে কেলির মনের ভাব আদান-প্রদান শুরু হয়ে যায়।

জেনেভার বাবা জর্জ এফ. র‍্যামসে অবশ্য মেয়ের এমন আবেগকে প্রশ্রয় দিতে চান নি। তাই সরাসরি তিনি কেলিকে মানা করেন দেন সে যেন জেনেভার সাথে আর দেখা না করে। ওদিকে কেলিও ছিলো নাছোড়বান্দা। তার এক কথা, জেনেভাকে ছাড়া সে কিছুতেই থাকতে পারবে না। অবশেষে পরামর্শ করে একরাতে দু’জনে মিলে পালিয়ে যায় মিসিসিপিতে। ক’দিন বাদে তারা যখন ফেরত আসে, তখন তারা আর প্রেমিক-প্রেমিকা নেই, হয়ে গেছে স্বামী-স্ত্রী!

মেয়ের স্বামীকে মেনে নেয়া ছাড়া এখন আর কোনো উপায় ছিলো না জর্জ র‍্যামসের হাতে। তাই তিনি জামাইকে মিসিসিপিতে তার ব্যবসায় অংশীদার করে নেন। ভালোই চলছিলো জামাই-শ্বশুরের রসায়ন। শ্বশুরের মাঝেই যেন কেলি তার স্বপ্নের বাবার ছায়া খুঁজে বেড়াতে থাকে। তবে এ সুখ তার কপালে খুব বেশিদিন সইলো না। ১৯২০ সালের মাঝামাঝি সময়ে এক বিষ্ফোরণে মারা যান জর্জ র‍্যামসে।

এরপর থেকেই পরিস্থিতি পাল্টাতে শুরু করে। কেলির শাশুড়ি তার জামাইয়ের যাবতীয় ব্যবসা বিক্রি করে দিলেন। অবশ্য মেয়ে আর মেয়ে জামাইকেও নতুন কিছু শুরু করার জন্য অর্থ দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু কেলির কপাল খারাপ। যেখানেই হাত দিচ্ছিলো, সেখানেই ব্যর্থ হচ্ছিলো সে। আর কোনো উপায় না দেখে আবারো কৈশোরের অন্ধকার জগতের পথে পা বাড়ায় কেলি, জড়িয়ে পড়ে মাদকদ্রব্য পরিবহনের কাজে। কিন্তু আগেরবারের মতো এবারও ধরা পড়ে যায়। তাকে জামিনে ছাড়িয়ে আনতে লেগে যায় প্রায় ২,০০,০০০ ডলার। বিশাল এ অর্থ জেনেভাকে তার মায়ের কাছ থেকে ধার করতে হয়েছিলো। এরপর আর এমন করলে সে কেলিকে ছেড়ে চলে যাবে বলে হুমকিও দেয়।

মাত্রাতিরিক্ত পানাসক্তির দরুণ কোনো কাজই কেলি খুব বেশিদিন চালিয়ে নিতে পারছিলো না। একে একে তার পরিবারে আসে দুই পুত্র সনি ও ব্রুস। পুত্রদের আগমনও তাকে বদলাতে পারে নি। বরঞ্চ কাজ খুঁজে না পাওয়ার হতাশা সে ঝাড়তো স্ত্রী-সন্তানদের উপর। একসময় আর জেনেভার পক্ষে তাই কেলির সাথে থাকা সম্ভব হলো না। তারা আলাদা থাকা শুরু করেছিলো ঠিকই, কিন্তু বিবাহ বিচ্ছেদ তখনও হয় নি।

জীবিকার সন্ধানে কেলি তখন পাড়ি জমায় কানসাস সিটিতে, কাজ নেয় সেখানেরই এক মুদি দোকানে। সেখানে গিয়ে পরিবারের কথা খুব মনে পড়তে থাকে তার। তাই অনেক অনুনয়-বিনয়ের পর জেনেভা আবার ফিরে আসতে রাজি হয় তার জীবনে। ওদিকে পুরনো অভ্যাস ছাড়তে পারে নি কেলি। একসময় সে সেই দোকান থেকেই এটা-সেটা চুরি করতে শুরু করে দেয়। এতে মারাত্মক আপত্তি জানায় জেনেভা। একসময় এটা নিয়ে স্বামী-স্ত্রীর মাঝে মারাত্মক ঝগড়া হয়, জেনেভার গায়ে হাতও তোলে কেলি। এবার আর জেনেভার পক্ষে কেলির সংসার করা সম্ভব হলো না। সন্তানদের নিয়ে চিরতরে কেলিকে ত্যাগ করে চলে যায় সে।

Source: Wikimedia Commons

কেলির জীবনে জেনেভা অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটে সেখানেই। এরপরই অপরাধ জগতে পুরোপুরি নাম লেখায় কেলি। জর্জ আর. কেলি নাম দিয়ে সে মাদকদ্রব্য পরিবহনের ছোটখাট একটা ব্যবসা দাঁড় করায়। আস্তে আস্তে টেক্সাস, ওকলাহোমা, টেনেসী আর মিসিসিপিতে ছড়িয়ে পড়ে তার নেটওয়ার্ক। ১৯২৭ সালে আবারো পুলিশের হাতে ধরা পড়ে কেলি। এবার বন্দীত্বের মেয়াদকাল ছিলো কয়েক মাস। মুক্তি পেয়ে কেলি পাড়ি জমায় ওকলাহোমা অঙ্গরাজ্যের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর টালসাতে। সেখানে গিয়ে অ্যালকোহল বিক্রি করতে গিয়ে আবারো ধরা পড়ে যায় সে। এবারের সাজার মেয়াদকাল তিন বছর।

১৯৩০ সালে জেল থেকে মুক্তি পায় কেলি। বের হয়েই সে সোজা চলে যায় সেন্ট পলে। সেখানে ক্যাথরিন কেলি নাম্নী এক নারীর সাথে দেখা করা ও পরবর্তীতে একসাথে কাজ করাই ছিলো তার উদ্দেশ্য। ওকলাহোমাতে মাদকদ্রব্য পরিবহনের কাজ করার সময়ই ক্যাথরিনের সাথে পরিচয় হয় কেলির। সেই পরিচয় একসময় প্রণয়ের রুপ নেয়। কেলির সাথে ক্যাথরিনের জুটিকেই ‘খাপে খাপ মিলে যাওয়া’ টাইপের বলা যায়। কারণ এর আগেও আরো তিন বিয়ে করা ক্যাথরিন নিজেও ছিলো একজন চোর ও দেহ ব্যবসায়ী। ১৯৩০ সালের সেপ্টেম্বরে তাদের বিয়ে হয়। শোনা যায়, ক্যাথরিন নাকি কেলিকে একটি টমি গান কিনে দিয়েছিলো। সেই টমি গানের ব্যবহৃত কার্ট্রিজ সে স্যুভেনির হিসেবে বন্ধু-বান্ধবদের দিতো। এভাবেই জর্জ বার্নস কেলি সবার কাছে পরিচিত হয়ে ওঠে ‘মেশিন গান কেলি’ নামে।

একটি টমি গান; Source: Wikimedia Commons

বিয়ের আগে অবশ্য জীবিকার্জনের আরেকটি উপায় খুঁজে নিয়েছিলো কেলি, ব্যাঙ্ক ডাকাতি। ফ্রান্সিস কীটিং, থমাস হোল্ডেন, ভার্নে মিলার, স্যামি সিলভারম্যান এবং হার্ভে বেইলিকে নিয়ে গড়া তাদের দলটি হামলা চালায় মিনেসোটার ব্যাঙ্ক অফ উইলমারে। মোট সত্তর হাজার ডলার সেদিন তারা ডাকাতিতে সক্ষম হয়। তবে অর্থের পরিমাণের চেয়ে সেদিন তাদের সঞ্চারিত ভীতিই ছিলো মনে রাখার মতো। পিস্তল দিয়ে আঘাত করে এক ক্যাশিয়ারকে আহত করা হয়েছিলো। গ্যাংয়ের আরেক সদস্য উৎসুক জনতার দিকে নির্বিকারভাবে গুলি ছুঁড়লে দুজন নারীও জখম হন।

বিয়ের পর সেপ্টেম্বরেই ফ্রেড বার্কার, হোল্ডিং, কীটিং আর ল্যারি দ্যভলকে নিয়ে তারা হামলা চালায় টেক্সাসের সেন্ট্রাল স্টেট ব্যাঙ্ক অফ শেরম্যানে। এবার তাদের হাতে আসে চল্লিশ হাজার ডলার। দীর্ঘদিন ধরে অপরাধ জগত দাপিয়ে বেড়ানো অ্যালবার্ট এল. বেটসের সাথে কেলি জুটি বাধে ১৯৩২ সালে। সে বছরই ওয়াশিংটন স্টেটের কোলফ্যাক্সে অবস্থিত একটি ব্যাঙ্কে ডাকাতি করে তারা সাতাত্তর হাজার ডলার লুটে নেয়। সে বছরেরই নভেম্বর মাসে কেলি তার সর্বশেষ ব্যাঙ্ক ডাকাতিতে অংশ নেয়। এডি ডল আর বেটসের সাথে মিলে মিসিসিপিতে অবস্থিত সিটিজেন্‌স স্টেট ব্যাঙ্ক অফ টুপেলোতে হামলা চালায় তারা। সর্বশেষ এ মিশনে আটত্রিশ হাজার ডলার লুণ্ঠনে সক্ষম হয় কেলির দল।

মাদকদ্রব্য পরিবহন আর ব্যাঙ্ক ডাকাতি ছাড়া আরেকটি দিকেও নিজের হাত পাকা করেছিলো মেশিন গান কেলি, অপহরণ। ১৯৩৩ সালের ২২ জুলাই পর্যন্ত সমাজের নানা গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিকে অপহরণ করেছিলো তারা। সেই লোকগুলোর মুক্তিপণ হিসেবে পাওয়া অর্থও ছিলো অনেক বেশি। ফলে ব্যাঙ্ক ডাকাতির পাশাপাশি এদিকে নেশা গড়ে উঠতে কেলির খুব বেশিদিন সময় লাগে নি।

একসময় তাদের নজর গিয়ে পড়লো ওকলাহোমা সিটিতে বাস করা ধনী তেল ব্যবসায়ী চার্লস এফ. আর্শেলের দিকে। পরিকল্পনামতো একদিন আর্শেলের বিশাল বাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়ালো কেলি আর বেটস। স্ত্রী আর আরেকজন আগন্তুকের সাথে তখন ব্রিজ খেলায় মত্ত ছিলেন আর্শেল। তাদের সামনে ধীর পদক্ষেপে গিয়ে দাঁড়ালো কেলি। হাতে তার শোভা পাচ্ছিলো মেশিনগান। সে ঠিক বুঝতে পারছিলো না এ দুইয়ের মাঝে কোনজন আর্শেল। তাই অস্ত্রের মুখে দুজনকেই গাড়িতে উঠতে বাধ্য করে সে। তাদের গাড়িটি শহর থেকে বাইরে আসার পর দুজনের ওয়ালেট চেক করে তারা বুঝে নেয় কে আর্শেল। তারপর অন্য লোকটিকে গাড়ি থেকে নামিয়ে আবার চলা শুরু করে তারা।

চার্লস এফ. আর্শেল; Source: swordandscale.com

আর্শেলকে নিয়ে রাখা হয় টেক্সাসের ওয়াইজ কাউন্টির প্যারাডাইজ শহরের প্রায় পাঁচশ একরের বিশাল বড় এক খামারবাড়িতে। এর মালিক ছিলো এক গ্যাংস্টার, নাম বস শ্যানন। সে ছিলো ক্যাথরিনের সৎবাবা। আর্শেলকে শেকল দিয়ে একটি বিছানায় বেঁধে রাখা হয়। পরদিন সকালে নাস্তা খেতে খেতে কেলি, বেটসরা খুব রসিয়ে রসিয়ে আর্শেলের অপহরণ সম্পর্কে বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত খবরগুলো পড়ছিলো।

ওদিকে কেলির দ্বিতীয় স্ত্রী ক্যাথরিন নিজেকে নির্দোষ প্রমাণে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। সে তার এক গোয়েন্দা বন্ধুর সাথে এমনিই দেখা করতে গেলো। গোয়েন্দা বন্ধুটি কি আর অত সহজে হার মানে? তার মনে ঠিকই ক্যাথরিনকে নিয়ে সন্দেহ দানা বেধেছিলো। পরবর্তীতে ক্যাথরিনের গাড়ির চাকায় লেগে থাকা লাল মাটি আর পেছনের সিটে দৈনিক পত্রিকায় অপহরণের খবরের পাতাটি খোলা অবস্থায় দেখতে পেয়ে সে দুইয়ে দুইয়ে চার মিলিয়ে নেয় মনে মনে। অবশ্য উপযুক্ত তথ্য-প্রমাণ না থাকায় ক্যাথরিন সে যাত্রায় পুলিশের হাত থেকে বেঁচে যায়। গোয়েন্দা বন্ধুটি অবশ্য তার পক্ষ থেকে কাজ ঠিকই এগিয়ে রেখেছিলো। সে ফোন করে এফবিআইকে এ ব্যাপারে জানায়। পরবর্তীতে আর্শেলের স্ত্রীকে ক্যাথরিনের ছবি দেখালে তিনি সাথে সাথেই মেয়েটিকে অপহরণকারী দলের একজন সদস্য বলে চিহ্নিত করেন।

Source: alcatrazhistory.com

চার্লস আর্শেলও চুপচাপ বসে ছিলেন না। বন্দী হলে কী হবে? মনে মনে তিনি এমন প্ল্যান কষছিলেন যাতে কোনোভাবে এখান থেকে মুক্তি পেলে তিনি অপরাধীদের ধরিয়ে দিতে পারেন। প্রতিবার বাড়ির উপর দিয়ে প্লেন গেলে আনুমানিক পাঁচ মিনিট পর তাকে পাহারা দিতে থাকা লোকগুলোর কাছে তিনি জানতে চাইতেন তখনকার সময়। এভাবে সকাল পৌনে দশটা ও বিকাল পৌনে ছয়টার কথা মাথায় রাখলেন তিনি। সেখানকার পানির স্বাদ কেমন তা মনে রাখার পাশাপাশি আরো বিভিন্ন বিষয় মাথায় রাখতে লাগলেন তিনি, যাতে করে অন্তত সেখানকার অবস্থান খুঁজে বের করা যায়।

কেলির দল আর্শেলকে মুক্তিপণ চেয়ে কয়েকটি চিঠি লিখতে বাধ্য করলো। একটি তার স্ত্রীর কাছে, অপর দুটি দুই বন্ধু ক্যাটলেট ও কার্কপ্যাট্রিকের কাছে। মুক্তিপণ হিসেবে পুরাতন নোটে ২,০০,০০০ ডলার চাওয়া হয়। কার্কপ্যাট্রিককে বলা হয় ২৯ জুলাই রাতের ট্রেনে কানসাস সিটির উদ্দেশ্যে একা একা বেরোতে, ট্রেনের ডানদিকে নজর রাখতে। পরপর জ্বলতে থাকা দুটো আগুনের উৎসের খোঁজ করে দ্বিতীয় আগুন দেখা মাত্রই টাকার বস্তাটা বাইরে ছুঁড়ে ফেলতে বলা হয় তাকে। এরপরই আর্শেলকে ছেড়ে দেয়া হবে।

বেশ কিছু সমস্যার কারণে এই প্ল্যান কাজ করে নি। এরপর কার্কপ্যাট্রিককে কানসাস সিটির মুয়েহ্লেনবাখ হোটেলে ই. ই. কিন্সাইড ছদ্মনামে উঠতে নির্দেশ দেয়া হয় অপহরণকারীদের পক্ষ থেকে। সেদিন বিকাল পৌনে ছয়টায় তার কাছে একটি ফোন আসে, বলা হয় ট্যাক্সি নিয়ে লা সাল হোটেলে চলে যেতে টাকা নিয়ে। সেখানে নেমে ডান হাতে টাকার ব্যাগ নিয়ে পশ্চিম দিকে হাঁটতে বলা হয়।

একটু এগিয়ে যেতেই লম্বা-চওড়া এক লোক এগিয়ে এলো তার দিকে, মাথার পানামা হ্যাটটা ছিলো কিছুটা নামানো যাতে চেহারা দেখা না যায়। ওটাই ছিলো মেশিন গান কেলি। সে কার্কপ্যাট্রিকের কাছে এসে শুধু বলে, “এটা আমি নিচ্ছি”। হঠাৎ করে এমন কথায় কিছুটা চমকে যান কার্কপ্যাট্রিক। তিনি শুধু জানতে চান আর্শেলকে কখন ছাড়া হবে। উত্তরে শুধু বারো ঘন্টা পরের কথা কর্কশ স্বরে জানিয়ে বিদায় নেয় কেলি।

৩১ জুলাই আর্শেলকে ছেড়ে দেয়া হয়। পরদিন সকালেই এফবিআই-এর সাথে যোগাযোগ করেন তিনি। তাকে আটকে রাখা মানুষজন এবং সেখানকার পরিবেশ সম্পর্কে যথাসাধ্য বর্ণনা দেন তিনি। তার বর্ণনার উপর ভিত্তি করে জায়গাটি খুঁজেও পাওয়া যায়। ১২ আগস্ট সেখানে অভিযান চালিয়ে হার্ভে বেইলি, বস ও ওরা শ্যাননকে গ্রেফতার করে পুলিশ। সেদিন বিকালে ডেনভার হোটেল থেকে আটক হয় আলফ্রেড বেটস। এ দলের পাঁচজন সদস্যকেও গ্রেফতার করা হয়। মায়ের গ্রেফতারের খবর শুনে বেপরোয়া হয়ে ওঠে ক্যাথরিন। ওকলাহোমার সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেলকে উদ্দেশ্য করে হুমকি দিয়ে একটি চিঠি দেয় সে।

ওদিকে কেলি-ক্যাথরিন দম্পতির নিজেদের অবস্থাও তখন খুব একটা ভালো না। চারদিকে পুলিশ তাদের খুঁজে বেড়াচ্ছে। এমন সময় তাদের সাথে দেখা হয়ে যায় এক ভ্রমণকারী দম্পতির। লুথার আর্নল্ডের সাথে ছিলো তার স্ত্রী ও মেয়ে জেরাল্ডাইন। সাথে সাথেই ক্যাথরিনের মাথায় অন্য এক বুদ্ধি খেলে যায়। সে কিছু ডলার দিয়ে জেরাল্ডাইনের মা-বাবাকে রাজি করার মেয়েকে কিছুদিনের জন্য তাদের সাথে ঘুরতে দিতে। ফলে এক মেয়ে সহ কেলি-ক্যাথরিনকে দেখলে আর কেউ সন্দেহ করবে না।

এরপর তারা রওয়ানা হয় শিকাগোর উদ্দেশ্যে। পথে টেক্সাসে থেমে ক্যাস কোলম্যান নামক এক সহকর্মীর খামারে ৭৩,০০০ ডলার মাটির নিচে পুঁতে রেখে আসে তারা। শিকাগো থেকে তারা চলে যায় মেম্ফিসে। সেখানে জন টিকেনর নামে কেলির এক বন্ধুর বাড়ি গিয়ে লুকিয়ে থাকে তারা। এরপর জেরাল্ডাইনকে তার পরিবারের কাছে ফিরে যাবার ব্যবস্থা করে দিয়ে তারা পালিয়ে যায় মেক্সিকোতে। সেখানে কিছুদিন থেকে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে তারা আবার মেম্ফিসে ফিরে আসে।

ওদিকে পুলিশও তো আর বসে ছিলো না। কিছুদিনের মাঝেই তারা আর্নল্ড দম্পতির সন্ধান পেয়ে যায়। জেরাল্ডাইন পুলিশকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দেয়। সেসব তথ্যের ভিত্তিতেই তারা টিকেনরের বাসা খুঁজে বের করে।

১৯৩৩ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর সকালবেলা, দুজন পুলিশ সদস্য গিয়ে কড়া নাড়লো টিকেনরের বাসার দরজায়। দরজা খুলেই পুলিশ দেখে হতভম্ব হয়ে যায় কেলি। পুলিশদের হাতে থাকা শটগান দেখে সে কী করবে তা বুঝতে না পেরে চিৎকার করে বলে ওঠে, “Don’t shoot, G-Men! Don’t shoot, G-Men!” কেলির খেলা বলতে গেলে এখানেই শেষ হয়ে যায়। মেশিন গান কেলি আর তার স্ত্রী ক্যাথরিন কেলিকে গ্রেফতার করে পুলিশ। ১০ অক্টোবর নয়টি এরোপ্লেনের এক বহরে করে কড়া নিরাপত্তায় তাদের নিয়ে যাওয়া হয় ওকলাহোমা সিটিতে।

Source: fbi.gov

বিচারে ওরা ও বস শ্যাননের যাবজ্জীবন কারাদন্ড দেয়া হয়। ১২ অক্টোবর রায় হয় কেলি-ক্যাথরিনের বিচারের। তাদের দুজনকেই যাবজ্জীবন কারাদন্ডে দন্ডিত করা হয়। ১৯৫৮ সালে অবশ্য ক্যাথরিন এবং তার মা ওরা শ্যাননকে প্যারোলে মুক্তি দেয়া হয়। ১৯৮০ সালে মারা যায় ওরা। ১৯৮৫ সালে একাশি বছর বয়সে মারা যায় ক্যাথরিন নিজেও।

কেলির স্বাক্ষর; Source: alcatrazhistory.com

কেলিকে যখন ট্রেনে করে লিভেনওয়ার্থে জেলখানায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছিলো, তখন সে মজা করে সাংবাদিকদের উদ্দেশ্যে বলেছিলো অল্প কিছুদিনের ভেতরেই জেলখানা ভেঙে পালিয়ে যাবার কথা। তার সেই আশা অবশ্য শেষপর্যন্ত পূরণ হয় নি। বরং কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা দিতে ১৯৩৪ সালে তাকে স্থানান্তর করা হয় আলকাত্রাজ জেলখানায়, যে জেলখানা থেকে কখনোই পালানো সম্ভব নয় বলে ভাবতো সবাই (অবশ্য পালানোর ইতিহাস আছে!)। ১৯৫১ সাল পর্যন্ত আলকাত্রাজেই ছিলো কেলি। এরপর তাকে আবারো ফেরত পাঠানো হয় লিভেনওয়ার্থে। ১৯৫৪ সালের ১৮ জুলাই নিজের ঊনষাটতম জন্মদিনের দিনই হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে পরপারে পাড়ি জমায় ‘মেশিন গান কেলি’ খ্যাত এই গ্যাংস্টার।

কেলির সমাধিফলক; Source: Wikimedia Commons

ফিচার ইমেজ- fbi.gov

Related Articles