Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website. The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

মহাস্থানগড়: বাংলার প্রাচীনতম নগর

বাংলাদেশের পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলোর মধ্যে অন্যতম প্রাচীন ও ঐতিহ্যপূর্ণ স্থান মহাস্থানগড়। প্রাচীন এই পুরাকীর্তিটি রাজশাহী বিভাগের বগুড়া জেলা থেকে ১৩ কিলোমিটার উত্তরে শিবগঞ্জ উপজেলার করতোয়া নদীর তীরে অবস্থিত। এটি প্রাচীন বাংলার পুণ্ড্রবর্ধনের অংশ ছিল।

মহাস্থানগড়ের একটি অংশ
মহাস্থানগড়ের একটি অংশ; Image source: Wikimedia Commons

পুণ্ড্রবর্ধন ছিল প্রাচীন বাংলার সবচেয়ে সমৃদ্ধ জনপদ। এই পুণ্ড্রবর্ধনের রাজধানী ছিল পুণ্ড্রনগর, যা পরবর্তী সময়ে মহাস্থানগড় হিসেবে পরিচিত হয়। এটি মৌর্য সাম্রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ শহর ছিল।

ইতিহাস ও পরিচিতি

‘মহাস্থান’ মানে পবিত্র স্থান, এবং ‘গড়’ মানে দুর্গ। আজ থেকে প্রায় ২,৫০০ বছর আগে গড়ে ওঠা এই স্থানটি বৌদ্ধ শিক্ষার জন্য প্রসিদ্ধ ছিল। চীন ও তিব্বত থেকে অনেক বৌদ্ধ সন্ন্যাসী এখানে লেখাপড়ার জন্য আসতেন। এরপর তারা দক্ষিণ ও পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়তেন এ শিক্ষার বিস্তার ঘটাতে। স্থানটি সম্পর্কে চীনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙ তার ভ্রমণকাহিনীতে লিখে গেছেন।

গড়ের একটি অংশ
গড়ের একটি অংশ; Image source: visitworldheritage.com

এটি ছিল মৌর্য, গুপ্ত, পাল ও সেন রাজাদের সময়ে বাংলার গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল। এছাড়া মুসলিম শাসনামলেও এর গুরুত্ব ছিল। কিন্তু এখন সেসবের ধ্বংসাবশেষ অবশিষ্ট রয়েছে মাত্র। তবু সগর্বে দাঁড়িয়ে আছে মহাস্থানগড়। বর্তমানে এটি প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর কর্তৃক সংরক্ষিত। ২০১৬ সালে একে সার্কের সাংস্কৃতিক রাজধানী হিসেবে ঘোষণা করা হয়।

এখানে শহর গড়ে ওঠার অন্যতম কারণ হলো, এটি বাংলাদেশের উঁচু অঞ্চলগুলোর মধ্যে একটি। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৩৬ মিটার উঁচু এ অঞ্চল প্রাকৃতিকভাবে বন্যামুক্ত।

মহাস্থানের চারদিক বেষ্টন করে রেখেছে প্রাচীর। প্রাচীর বেষ্টিত এ নগরীর মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন আমলের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন। শহরের কেন্দ্রে অবস্থিত দুর্গটি উপর থেকে দেখতে আয়তাকার। এটি উত্তর-দক্ষিণে ১.৫২৩ কিলোমিটার এবং পূর্ব-পশ্চিমে ১.৩৭১ কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত। আশেপাশের এলাকা থেকে দুর্গ প্রাচীরটি প্রায় ১১ থেকে ১৩ মিটার উঁচু।

গড়ের একটি প্রবেশদ্বার
গড়ের একটি প্রবেশদ্বার; Image source: visitworldheritage.com

জনপ্রিয় কাহিনি

সেন বংশের শেষ রাজা লক্ষ্মণ সেন গৌড়ের রাজা থাকার সময়ে এই গড় অরক্ষিত ছিল। সেসময় মহাস্থানগড়ের রাজা ছিলেন নল। কিন্তু ভাই নীলের সাথে তার বিরোধ লেগেই থাকত। সেসময় এক অভিশপ্ত ব্রাহ্মণ এ এলাকায় আসেন। তিনি তার পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে ভারতের দাক্ষিণাত্যের শ্রীক্ষেত্র থেকে এখানে আসেন। তিনি পরশু বা কুঠার দিয়ে নিজের মাকে হত্যার দায়ে অভিশপ্ত ছিলেন। তিনি এই দুই ভাইয়ের বিরোধ মেটানোর নাম করে কৌশলে নিজেই রাজা হয়ে যান। ইতিহাসে তিনি পরশুরাম হিসেবে পরিচিত হলেও তার আসল নাম ছিল রাম।

কিন্তু রাজা হওয়ার পর তিনি অত্যাচারী শাসক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। তার অত্যাচারে যখন এলাকার জনগণ অতিষ্ঠ হয়ে পড়ে, তখন এখানে একজন আধ্যাত্মিক শক্তিধারী দরবেশের আগমন ঘটে। তার নাম ছিল হযরত শাহ সুলতান মাহমুদ বলখী (র.)।

কিংবদন্তি অনুযায়ী, তিনি মাছ আকৃতির নৌকা করে (অন্য তথ্য অনুযায়ী, মাছের পিঠে করে) সেসময়ের বিশাল করতোয়া নদী পার হয়ে মহাস্থানগড়ে আসেন। এজন্য তার আরেক নাম মাহিসাওয়ার, যার অর্থ ‘মাছের পিঠে আরোহণকারী’। তিনি বর্তমান আফগানিস্তানের বলখী নগর থেকে এসেছিলেন। তিনি সাথে করে অনেক অনুসারীও নিয়ে আসেন এ অঞ্চলে।

মহাস্থানগড়ে এসে তিনি ইসলাম ধর্ম প্রচার শুরু করলে স্থানীয় রাজা পরশুরামের সাথে তার বিরোধ হয়। একসময় (আনুমানিক ১২০৫-১২২০ খ্রিস্টাব্দ) তাদের মাঝে যুদ্ধ হয় এবং যুদ্ধে পরশুরাম পরাজিত ও নিহত হন।

কথিত আছে, জিয়ত কুণ্ড নামে একটি কূপের পানি পান করে পরশুরামের আহত সৈন্যরা সুস্থ হয়ে যেত। তাই হযরত শাহ সুলতান মাহমুদ বলখী (র.) একটি ঈগলের মাধ্যমে এই কূপে একটি মাংসের টুকরো ফেলেন। আর তাতেই কূপের পানি তার আশ্চর্য গুণ হারিয়ে ফেলে। এর ফলেই পরশুরাম যুদ্ধে পরাজিত হন। 

জিয়ত কুণ্ড
জিয়ত কুণ্ড; Image source: Wikimedia Commons

মহাস্থানগড়ের দুর্গ প্রাচীরের দক্ষিণ-পূর্বে অথবা মহাস্থানগড় বাসস্ট্যান্ডের কিছুটা পশ্চিমে হযরত শাহ সুলতান মাহমুদ বলখী (র.)-এর মাজার শরীফ রয়েছে। মাজারের সামনে বিভিন্ন দোকানে কটকটি নামে একপ্রকার মিষ্টিজাতীয় খাবার পাওয়া যায়। এটি এখানকার প্রসিদ্ধ খাবার।

হযরত শাহ সুলতান মাহমুদ বলখী (র.) এর মাজার শরীফ
হযরত শাহ সুলতান মাহমুদ বলখী (র.)-এর মাজার শরীফ; Image source: visitworldheritage.com

এবারে জেনে নেওয়া যাক মহাস্থানগড়ে আবিষ্কৃত কিছু দর্শনীয় স্থান সম্পর্কে।

বেহুলা-লখিন্দরের বাসরঘর বা গোকুল মেধ

ঐতিহাসিকদের মতে, মূলত এটি একটি বৌদ্ধ মঠ। সম্রাট অশোক এটি নির্মাণ করেছিলেন বলে ধারণা করা হয়। তবে লোককাহিনী অনুযায়ী, এটি বেহুলা-লখিন্দরের বাসরঘর নামে পরিচিত। চাঁদ সওদাগর তার ছেলে লখিন্দরকে দেবী মনসার হাত থেকে রক্ষা করার জন্য এখানকার একটি গোপন কুঠুরিতে বন্ধ করে রাখেন। বিয়ের রাতে বেহুলা এবং লখিন্দর গোপন কুঠুরিতে অবস্থান করা সত্ত্বেও সেখানে দেবী মনসার প্রেরিত সাপ প্রবেশ করে এবং লখিন্দরকে দংশন করে।

গোকুল মেধ বা বেহুলা লখিন্দরের বাসরঘর
গোকুল মেধ বা বেহুলা লখিন্দরের বাসরঘর; Image source: Wikimedia Commons

খোদার পাথর ভিটা

এটি একটি লম্বা এবং আয়তাকার মসৃণ পাথর। ধারণা করা হয়, রাজা পরশুরাম এই পাথরকে বলি দেওয়ার কাজে ব্যবহার করতেন। বর্তমানে হিন্দু ধর্মাবলম্বী অনেক নারী এ পাথর দুধ এবং সিঁদুর দিয়ে স্নান করান। অনেকে খালি পায়ে দুধ ঢেলে ভক্তি নিবেদন করেন।

খোদার পাথর ভিটা
খোদার পাথর ভিটা; Image source: Wikimedia Commons

শীলাদেবীর ঘাট

মহাস্থানগড়ের পূর্বদিকে করতোয়া নদীর তীরে এ ঘাট অবস্থিত। রাজা পরশুরামের বোন ছিলেন শীলাদেবী। কথিত আছে, রাজা পরশুরাম হযরত শাহ সুলতান মাহমুদ বলখী (র)-এর কাছে পরাজিত হলে শীলাদেবী এ স্থানে আত্মাহুতি দেন। এখনো প্রতি বছর অনেক হিন্দু ধর্মাবলম্বী ভক্ত এখানে পূজা দেন এবং স্নান করেন।

গোবিন্দ ভিটা

এটি মহাস্থান জাদুঘরের ঠিক সামনে অবস্থিত। ‘গোবিন্দ ভিটা’ অর্থ দেবতা বিষ্ণুর আবাসস্থল। এখানে একটি মন্দির রয়েছে। তবে বৈষ্ণব ধর্মের কোনো নিদর্শন এখানে পাওয়া যায়নি

গোবিন্দ ভিটা
গোবিন্দ ভিটা; Image source: Wikimedia Commons

ভাসু বিহার

স্থানীয়ভাবে এটি নরপতির ধাপ নামে পরিচিত। এখানে বৌদ্ধ সংঘারামের ধ্বংসাবশেষ পাওয়া গিয়েছে। ধারণা করা হয়, এটি একটি বৌদ্ধ ধর্মপীঠ ছিল।

ভাসু বিহার নরপতির ধাপ
ভাসু বিহার বা নরপতির ধাপ; Image source: Wikimedia Commons

পরশুরামের প্রাসাদ

এখানে পাল আমলে নির্মিত ইমারতের নিদর্শন পাওয়া গিয়েছে। তবে স্থানীয়ভাবে এটি পরশুরামের প্রাসাদ হিসেবে পরিচিত।

পরশুরামের প্রাসাদ
পরশুরামের প্রাসাদ; Image source: Wikimedia Commons

ভীমের জাঙ্গাল

এটি একটি দীর্ঘ বাঁধ, যা বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে রক্ষার জন্য রাজা ভীম কর্তৃক নির্মিত হয়েছিল বলে মনে করা হয়। এটি ইতালির বৃত্তাকার দুর্গের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ। আরো একটি মতানুসারে, এটি এ এলাকায় বন্যা থেকে বাঁচার জন্য তৈরি করা হয়েছিল। মহাস্থানগড়ের তিনদিক পর্যন্ত পরিবেষ্টিত এবং উত্তরাঞ্চলের প্রায় ৭০ কিলোমিটার পর্যন্ত এর বিস্তৃতি। এখানে বহু মঠ রয়েছে

ভীমের জাঙ্গাল
ভীমের জাঙ্গাল; Image source: Vromon Guide

এছাড়া এখানে আরো কিছু দর্শনীয় স্থান রয়েছে, যেমন- মানকালীর ঢিবি, বৈরাগীর ভিটা, স্কন্ধের ধাপ, তোতারাম পণ্ডিতের ধাপ, বিহার ধাপ, মঙ্গলকোট স্তুপ, টেংরা বৌদ্ধ স্তুপ, কালিদহ সাগর ইত্যাদি।

ধ্বংস ও পুনরুদ্ধার

চৌদ্দ শতকের দিকে শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহ গৌর, বঙ্গ, পুণ্ড্র, সমতট,হরিকেল নিয়ে বাঙালা নামে রাজ্য গড়ে তোলার ফলে মহাস্থানগড়ের গুরুত্ব কমে আসতে থাকে। ফলে পনের শতকের দিকে মহাস্থানগড়ে মানুষের আনাগোনা কমে যায় এবং এটি তার পূর্বের অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলে। কালক্রমে এটি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়।

পোড়ামাটির ফলক
পোড়ামাটির ফলক; Image source: visitworldheritage.com

বহু বছর এই জায়গাটি মানুষের কাছে অজানা রয়ে যায়। অতঃপর ১৮০৮ সালে সর্বপ্রথম ফ্রান্সিস বুকানন হ্যামিল্টন এই ধ্বংসাবশেষ চিহ্নিত করেন। পরবর্তী সময়ে ব্রিটিশ প্রত্নতত্ত্ববিদ আলেকজান্ডার কানিংহাম এই ধ্বংসাবশেষকে প্রাচীন পুণ্ড্রনগর বলে নিশ্চিত করেন।

১৯২৮-২৯ খ্রিস্টাব্দে আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অভ ইন্ডিয়ার তৎকালীন মহাপরিচালক কাশীনাথ নারায়ণ দীক্ষিতের তত্ত্বাবধানে মহাস্থানগড়ের প্রথম প্রত্নতাত্ত্বিক খননকাজ আরম্ভ হয়।

চলছে খনন কাজ
চলছে খনন কাজ; Image source: tbcnews.com

১৯৩১ সালে এখানে প্রত্নতাত্ত্বিক খননের ফলে ব্রাহ্মী লিপির সন্ধান মেলে, যাতে সম্রাট অশোক কর্তৃক দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষকে সাহায্য করার তথ্য পাওয়া যায়।

ব্রাহ্মী লিপির অংশ
ব্রাহ্মী লিপির অংশ; Image source: Wikimedia Commons

মহাস্থানগড় থেকে সামান্য উত্তরে গেলে দেখা পাওয়া যাবে মহাস্থানগড় প্রত্নতাত্ত্বিক জাদুঘরের। এটি ১৯৬৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। মহাস্থানগড় খনন করে যেসব মূল্যবান জিনিসপত্র পাওয়া গেছে, তা এখানে সংরক্ষিত রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মের বিভিন্ন দেব-দেবতার মূর্তি, বিভিন্ন যুগের মুদ্রা, স্মারকলিপি, মাটির তৈজসপত্র, পোড়ামাটির ফলক, সিলমোহর,  শিলালিপি, আত্মরক্ষার অস্ত্র, মূল্যবান অলঙ্কার সামগ্রী, সোনা, রূপা, লোহা, কাঁসা, তামাসহ বিভিন্ন মূল্যবান ধাতব সামগ্রী

প্রত্নতাত্ত্বিক জাদুঘর,মহাস্থানগড়
প্রত্নতাত্ত্বিক জাদুঘর,মহাস্থানগড়; Image source: offroadbangladesh.com

যাতায়াত

ঢাকা থেকে খুব সহজে বাস অথবা ট্রেনে বগুড়া যাওয়া যায়। কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে রংপুর এক্সপ্রেস বা লালমনি এক্সপ্রেসেও বগুড়া যাওয়া যায়। বগুড়ার হাড্ডিপট্টি বা রেলস্টেশন থেকে খুব সহজেই বাসে বা অটোরিকশা নিয়ে ৩০-৪০ মিনিটের মধ্যে মহাস্থানগড়ে পৌঁছে যাওয়া যায়। প্রতি বছর বহু পর্যটক এই স্থানে বেড়াতে আসেন।

This article is in Bangla. It is about Mahasthangarh, a tourist place of ancient interest situated near Bogra.

Necessary References have been hyperlinked inside the article.

Featured Image: visitworldheritage.com

Related Articles