Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

মানবেন্দ্রনাথ রায়: একজন বাঙালি বিপ্লবী

আর্নেস্তো চে গুয়েভারাকে আন্তর্জাতিক বিপ্লবী বলেই সবাই চেনে। আর্জেন্টাইন এই গেরিলা কিউবার পাশাপাশি যুদ্ধ করেছেন কঙ্গো আর বলিভিয়াতে। অথচ এই চে গুয়েভারার মতোই একজন বিপ্লবী কিন্তু খোদ এই বঙ্গভূমিতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। দেশ ছেড়ে তিনি গিয়েছিলেন সুদূর মেক্সিকোতে। মেক্সিকো আর ভারতীয় কম্যুনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠাতা সদস্যদের একজন তিনি। বিপ্লবী মানবেন্দ্রনাথ রায় ওরফে এম এন রায় আজকের যুগে একজন বিস্মৃতপ্রায় মানুষ হতে পারেন, কিন্তু গত শতকের দুটি মহাযুদ্ধ আর তার আগের কিংবা পরের উত্তাল জাতীয়তাবাদ আর বিপ্লবের ভিড়ে এই নামটি কিন্তু কম কৃতিত্বের অধিকারী নয়।

এম এন রায়; Image Source: 2.bp.blogspot.com

ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন

জন্মের পর তার নাম রাখা হয় নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য। পরে নাম পাল্টে হন মানবেন্দ্রনাথ রায় ওরফে এম এন রায়। ১৮৮৭ সালে অবিভক্ত বাংলার ২৪ পরগণা জেলার এক ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। পড়াশোনার পাশাপাশি দ্রুতই জড়িয়ে পড়েন স্বাধীনতাকামীদের সাথে। সেকালে বাংলা মুলুকে, বিশেষ করে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে বঙ্কিমচন্দ্র বা স্বামী বিবেকানন্দের খুবই নামডাক। তাদের লেখনী পড়ে অনেক যুবা তখন স্বাধীনতা আন্দোলনে জড়িয়ে পড়বার জন্য হন্যে হয়ে উঠছে।

১৯০৫ এর বঙ্গভঙ্গ এই আগুনকে আরো উসকে দিল। এম এন রায় এই ছাত্রদের সাথে জড়িয়ে পড়েন। ক্রমে তার সাথে পরিচয় হয় বারীন ঘোষ আর তার সাঙ্গপাঙ্গদের সাথে। উল্লেখ্য, এম এন রায় সে সময়কার অনুশীলন সমিতি, যুগান্তর বা বাঘা যতীনের দলবল, সবার সাথেই কমবেশি যোগাযোগ রাখতেন। সে হিসেবে তাকে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের সশস্ত্র ধারাটির অন্যতম অংশ বললে বাড়িয়ে বলা হবে না।

বারীন ঘোষ; Image Source: marxist indiana

১৯১৪ সালে প্রথম মহাযুদ্ধ বেঁধে গেলে ভারতীয়রা জার্মানদের সাহায্য নিয়ে নিজেদেরকে স্বাধীন করবার স্বপ্ন দেখা শুরু করে। বাঙালী বিপ্লবীদের অনেকেই সে সময় বার্লিনে থাকতেন। তারা কাইজার ভিলহেলমের সাথে যোগাযোগ করে ইতিবাচক সম্মতি পান। পরিকল্পনা করা হয় যে, ইন্দোনেশিয়াতে অস্ত্রশস্ত্র আর কামান সজ্জিত অনেকগুলো জার্মান জাহাজ এসে ভিড়বে। পরে এদের সাহায্যে বিপ্লবীরা প্রথমে আন্দামান দ্বীপপুঞ্জ আর পরে উড়িষ্যাতে হামলা চালাবেন। কিন্তু সব পরিকল্পনা মাঠে মারা গেল, যখন এম এন রায় ১৯১৫ সালে ইন্দোনেশিয়াতে গেলেন। যেদিন পরিকল্পনা শুরু হওয়ার কথা সেদিনই রহস্যজনকভাবে জার্মান কনসাল জেনারেল গায়েব হয়ে গেলেন। জাহাজ তো দূরের কথা, একটা পিস্তল পর্যন্ত জুটলো না। সামান্য কিছু অর্থসাহায্য পেলেন এম এন রায়। ওদিকে ভারতে এই গুপ্ত পরিকল্পনার কথা ফাঁস হয়ে গেলে ব্রিটিশরা পাহারা বাড়িয়ে দেয়। বারীন ঘোষ পুলিশের সাথে সংঘর্ষে মারা পড়েন। সশস্ত্র আন্দোলনের পরিকল্পনা ফিকে হয়ে যেতে থাকে।

হাল না ছেড়ে রায় যাত্রা করলেন জাপানে। সেখানে জার্মান বা জাপান কোনো পক্ষই তাকে সাহায্য করতে রাজি হলো না। নিরুপায় রায় দেখা করলেন চীনা জাতীয়তাবাদী নেতা সান ইয়াত সেনের সাথে। কিন্তু তিনিও নেতিবাচক মতামত দিলেন ভারতে বিপ্লবের ব্যাপারে। শেষমেষ রায় ভুয়া কাগজপত্র যোগাড় করে যুক্তরাষ্ট্রে চলে গেলেন। তার আশা ছিল যুক্তরাষ্ট্রের জার্মান দূতাবাস তাকে সাহায্য করবে।

মেক্সিকো

যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণের শহর পালো আলতোতে লুকিয়ে থাকবার সময় রায় ইভিলিন নাম্নী এক মহিলাকে বিয়ে করেন। দুজনে মিলে নিউ ইয়র্ক যান। এখানেই এম এন রায় কম্যুনিজম নিয়ে আগ্রহী হয়ে পড়েন। তবে যুক্তরাষ্ট্রে বেশিদিন থাকা গেল না। ব্রিটিশ গোয়েন্দাদের ভয়ে এই জুটি শেষমেষ সীমান্ত পার হয়ে মেক্সিকোতে চলে যায়। পথে জার্মান গোয়েন্দারা রায়কে বিপুল পরিমাণ টাকা দেন।

এম এন রায় এবং তার স্ত্রী; Image Source: 4.bp.blogspot.com

মেক্সিকোতে ১৯১৭ সালে রায় একটি সোশ্যালিস্ট পার্টি গঠন করেন। এটিই পরে মেক্সিকান কম্যুনিস্ট পার্টিতে রূপ পায় ১৯১৯ সালে। সোভিয়েত কম্যুনিস্ট পার্টির পর এটাই ছিল বিশ্বের দ্বিতীয় মাত্র সমাজতান্ত্রিক দল। রায় তার লেখালেখির সুবাদে বিশ্বের তাবত কম্যুনিস্টপন্থী নেতাদের সম্মেলন ২য় ওয়ার্ল্ড কংগ্রেসে যোগদান করেন। লেনিন তাকে বিশেষ সমাদর করতেন। রায় কম্যুনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল তথা কমিনটার্নের সাথেও যুক্ত ছিলেন।

সোভিয়েত ইউনিয়ন

লেনিনের নির্দেশে উজবেকিস্তানের রাজধানী তাসখন্দে রায়কে ভারতীয়দের সংগঠিত করে পুনরায় ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন শুরু করবার সুযোগ করে দেওয়া হয়। উল্লেখ্য, রায়ের সাথে ভারতের জাতীয়তাবাদী নেতা চিত্ত রঞ্জন দাসের যোগাযোগ ছিল। যা-ই হোক, রায় ১৯২০ সালে গঠন করেন ভারতীয় কম্যুনিস্ট পার্টি

এদিকে মস্কোতে শুরু হয়েছে আরেক ঝামেলা। ১৯২৪ সালে লেনিন মারা যাওয়ার পর তার উত্তরসূরি কে হবেন, তা নিয়ে দ্বন্দ্ব বেঁধে গিয়েছে। একদিকে স্ট্যালিন, জিমেনিয়েভ, কামেনেভ, আর অন্যদিকে ট্রটস্কি। ট্রটস্কি শেষমেষ দেশ ছেড়ে পালান। রায়কে স্ট্যালিন ট্রটস্কিপন্থী হিসেবেই দেখতেন হয়তো। কিন্তু আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন একজন নেতাকে কব্জা করবার সুযোগ তিনি পাচ্ছিলেন না। শেষমেষ সুযোগ এলো ১৯২৭ সালে। রায় চীনের ক্যান্টনে গিয়েছিলেন সেখানে বিপ্লবীদেরকে সাহায্য করতে। তো চীনা কম্যুনিস্ট পার্টির সাথে তার বিরোধ বেঁধে গেলে স্ট্যালিন তার দরকারি অজুহাত পেয়ে গেলেন। ১৯২৮ সালে এম এন রায় সোভিয়েত ইউনিয়ন ছেড়ে জার্মানি চলে যেতে বাধ্য হলেন।

লেনিন ও রায়; Image Source: sreenivasarao’s blogs

আবার ভারত

১৯৩০ সালে, প্রায় ১৬ বছর পর এম এন রায় ভারতে ফিরলেন। যদিও নেহেরু বা সুভাষ চন্দ্র বোস তাকে বিশেষ সমাদর করলেন, কিন্তু এটাও পরিষ্কার হয়ে গেলো যে তারা তাকে জায়গা ছেড়ে দেবেন না। ওদিকে গান্ধীর সাথে তার বনে না। ব্রিটিশ পুলিশ তো ওঁত পেতেই ছিল। দেশে ফেরার কয়েক মাসের মধ্যে তাকে জেলে পোরা হয়। প্রহসনের বিচার শেষে জেল খাটতে হয় ছয় বছর। এতেই রায়ের শরীর একদম ভেঙে পড়ে। তিনি আরো অসংখ্য কম্যুনিস্ট নেতাদের মতো বারবার কোন্দল না পাকিয়ে বরং কম্যুনিস্টদের আহ্বান করেন যেন তারা ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসে যোগ দেয়। এতে করে ডাকসাইটে কম্যুনিস্টদের সাথে তার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। তবে এরই মধ্যে তিনি ১৯৩৪ সালে ভারতীয় গণপরিষদ গঠনের দাবি জানান। পরে কংগ্রেস এই দাবি নিয়ে আন্দোলন শুরু করে।  

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ বাঁধলে এম এন রায় ভারতীয়দেরকে আহ্বান জানান যেন তারা ব্রিটিশদেরকে সাহায্য করে। রায়ের বক্তব্য ছিল, ফ্যাসিস্ট বা নাজী সরকার যুদ্ধে জিতলে ভারত আর কোনোদিনই স্বাধীনতা পাবে না। ওদিকে গান্ধী ১৯৪২ সালে ভারত ছাড় আন্দোলন শুরু করেন, সুভাষ বোস জাপানী আর জার্মানদের সাহায্য নিয়ে গড়ে তোলেন আজাদ হিন্দ ফোর্স। কম্যুনিস্ট বা কংগ্রেসীরা রায়ের এই পথ পরিবর্তন ভালো চোখে দেখেনি। অনেকটা এই সময়েই রায় ‘নিও হিউম্যানিজম’ নামের একটি নতুন তত্ত্ব হাজির করেন। মূলত কংগ্রেস আর কম্যুনিস্টদের সাথে মতের মিল না হওয়াতেও এই নতুন তত্ত্ব।

এম এন রায়; Image Source: The Logical Indian

এম এন রায় র‍্যাডিক্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টি নামে দল গঠন করে নিজের তত্ত্ব প্রচার করা শুরু করেন। তার বিখ্যাত ‘রিজন, রোমান্টিসিজম অ্যান্ড রেভল্যুশন’ গ্রন্থে তিনি নিজের নিও হিউম্যানিজম নিয়ে নতুন ধারার একটি রাজনৈতিক আন্দোলন গঠনের প্রয়াস পান। এটি মূলত মানবিক গুণাবলী দ্বারা পরিচালিত ধর্মনিরপেক্ষ একটি সমাজ গঠনের প্রয়াস পেত, যেখানে জ্ঞান, মুক্তি আর স্বাধীনতাকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়। উল্লেখ্য, আন্তর্জাতিক হিউম্যানিস্ট আন্দোলনের অপেক্ষাকৃত র‍্যাডিক্যাল ঘরানাটিই রায়ের নিউ হিউম্যানিজমের সারবত্তা। 

স্বাধীন ভারতে এম এন রায়কে খুব উঁচুদরের তাত্ত্বিক হিসেবে প্রচুর সম্মান দেখানো হলেও রাজনৈতিকভাবে তিনি একরকম শক্তিহীন হয়ে পড়েন। শারীরিকভাবেও হয়ে পড়েছিলেন অসুস্থ। কম্যুনিস্টদের মধ্যে বহু ভাঙনের ফলে কংগ্রেসই ভারতের সবথেকে শক্তিশালী রাজনৈতিক দল হিসেবে আবির্ভূত হয়। বাঙালি বিপ্লবী মানবেন্দ্রনাথ রায় ১৯৫৪ সালে দেরাদুনে মৃত্যুবরণ করেন। তাবত বিশ্ব ঘুরে যে বিপ্লবের স্বপ্ন তিনি দেখেছিলেন, তা অনেকাংশেই সাকার না হওয়ার ফলেই বোধহয় বিস্মৃত হয়ে পড়েছেন আধুনিক রাজনীতির পাঠে।

ফিচার ইমেজ- 1.bp.blogspot.com

Related Articles