জগৎবিখ্যাত মাইম শিল্পী মার্শাল মারচুকে বলা হয় মাস্টার অফ সাইলেন্স, অর্থাৎ নীরবতার অধিপতি। কোনো শব্দ উচ্চারণ না করেই জীবনের গল্প বলে গিয়েছেন তার সুনিপুণ মূকাভিনয়ের মাধ্যমে। নীরবতার ভাষায় গল্প বলে মানুষকে হাসিয়েছেন-কাঁদিয়েছেন এই ফরাসি মূকাভিনেতা। জীবনের প্রতিচ্ছবি হিসেবে তিনি তৈরি করেছেন অনন্য মাইম চরিত্র ‘দি বিপ’। বিপ হচ্ছে জীবনে আশার আলোময় একটি চরিত্র। এই চরিত্রে অভিনয় করেই তিনি নিজেকে নিয়ে গেছেন খ্যাতির অনন্য চূড়ায়। পৃথিবীর যেকোনো মূকাভিনেতার স্বপ্ন ছিল মার্শাল মারচুর সান্নিধ্য লাভ। পৃথিবীর যেকোনো মূকাভিনেতাই তাকে বিনা বাক্যব্যয়ে গুরু মানতে রাজি হয়ে যেতেন। বিশ্ববিখ্যাত বাংলাদেশি মূকাভিনেতা পার্থ প্রতিম মজুমদার ছিলেন মার্শাল মারচুর খুবই স্নেহভাজন ছাত্র।
একজন মূকাভিনেতা মার্শাল মারচুকে হয়তো লক্ষ-কোটি মানুষ চিনে থাকতে পারে। কিন্তু এই মূকাভিনয়কে পুঁজি করেই তিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ফরাসি প্রতিরোধ বা ফ্রেঞ্চ রেজিস্টেন্সের অন্যতম নায়ক হয়ে উঠেছিলেন। সেই কথা আজও অনেকের অজানা। নাৎসি বাহিনীর পৈশাচিক থাবার হাত থেকে বাঁচিয়েছিলেন তিন শতাধিক শিশুকে। তিনি আর তার চাচাতো ভাই জর্জ লঞ্জার মিলে একটি এতিমখানা পুরোপুরি খালি করে সেখানকার শিশুদের নিরাপদ স্থানে নিয়ে গিয়েছিলেন, যেন নাৎসিরা এই কোমলমতি শিশুদেরকে হত্যা করার জন্য কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে নিয়ে যেতে না পারে। আর এক্ষেত্রে মুখ্য অস্ত্র ছিল মারচুর মূকাভিনয়।
চাচাতো ভাই জর্জ লঞ্জারই মার্শাল মারচুকে জার্মানদের বিরুদ্ধে ফরাসি প্রতিরোধ কার্যক্রমে নিয়োজিত করেছিলেন। লঞ্জার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ফরাসি ইহুদি শিশুদেরকে জার্মানদের হাত থেকে বাঁচানোর একটি গোপন ইউনিটের কমান্ডার ছিলেন। সেই সুবাদেই জার্মানরা যখন ফ্রান্সের দখল নিয়ে নিচ্ছিল, লঞ্জার তার ভাই মার্শাল মারচুকে নিয়ে ইহুদি শিশুদেরকে জার্মানদের আক্রমণ থেকে মুক্ত কোনো দেশে পাঠিয়ে দেয়ার অভিযানে নেমেছিলেন। প্রায় ৩৫০ জন ইহুদি শিশুকে মৃত্যুর হাত থেকে মুক্ত করে আনার কৃতিত্ব নিয়ে লঞ্জার গত ২৮ ডিসেম্বর, ২০১৮ সালে ১০৮ বছর বয়সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
স্ট্রাসবার্গের ইহুদি পরিবার থেকে উঠে আসা মাত্র ১৬ বছর বয়সের একজন কিশোর মার্শাল মারচু ফ্রান্স এবং জার্মানির সীমান্তবর্তী অঞ্চলে জার্মান আক্রমণের ভয়াবহতা অনেকের আগেই খুব কাছ থেকে দেখার অভিজ্ঞতা লাভ করেছিলেন। জার্মানরা স্ট্রাসবার্গের দখল নেয়ার ঠিক আগেই পরিবারের সাথে পালিয়ে গিয়েছিলেন। তারা মধ্য ফ্রান্সের এক নগর লিমোগেসে স্থানান্তরিত হয়েছিলেন।
তখন থেকেই মারচু বুঝতে পেয়েছিলেন, বেঁচে থাকার জন্য তাকে লড়াই করে যেতে হবে। বলে রাখা ভাল, মার্শাল মারচুর আসল নাম ছিল মার্শাল ম্যাঞ্জেল। কিন্তু জার্মান বাহিনীর কাছে ফরাসি সেনাদের আত্মসমর্পণের পর তিনি তাঁর নাম পরিবর্তন করে মার্শাল মারচু রেখেছিলেন। মারচু হচ্ছে ফরাসি বিপ্লব ফ্র্যাঙ্কো সেভেরিন মারসাউ-ডেসগ্রাভিয়ার এর সাধারণ রূপ।
মার্শালের সাথে সাথে তাঁর চাচাতো ভাইও নাম পরিবর্তন করে নম দু গেরে রেখে পরিচয় গোপন করে কোনোমতে জার্মানদের চোখ ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছিলেন। তাঁর ইংরেজি এবং জার্মানসহ স্থানীয় ফরাসি ভাষায় পারদর্শিতা এবং ভাই মারচুর মূকাভিনয়; সব মিলিয়ে ফরাসি প্রতিরোধে বিভিন্ন অভিযান পার হয়ে যেতে তাদেরকে সাহায্য করেছিল।
জাল কাগজপত্র এবং নকল নাম নিয়ে তারা যুদ্ধকালীন সময়ে গেস্তাপো ডিটেকশন এড়িয়ে চলাফেরা করতে সক্ষম হয়েছিলেন। ১৯৪৪ সালে যুদ্ধ যখন এর সবচাইতে তিক্ত সমাপ্তির দিকে এগোচ্ছিল, জার্মানরা খুব তাড়াহুড়া করেই ফ্রান্সের অবশিষ্ট ইহুদি জনগণকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার মিশনে নেমেছিল।
আবারো মার্শাল মারচুর কথায় আসা যাক, জানা যাক কীভাবে তিনি মাইমের মাধ্যমে শতাধিক শিশুর জীবন বাঁচিয়েছিলেন। জর্জ লঞ্জার এবং তাঁর মূকাভিনেতা ভাই মারচুর মিশন ছিল ফ্রান্সের বিভিন্ন স্থানে আটকা পড়া ও লুকিয়ে থাকা ইহুদি বাচ্চাদের খুঁজে বের করা এবং তাদেরকে সুইস বর্ডারে নিয়ে যাওয়া, যেখানে তারা জার্মান নাৎসিদের থেকে নিরাপদে থাকতে পারবে। কিন্তু একইসাথে অনেকগুলো বাচ্চাকে নিয়ে সটকে পড়াটা তখন খুবই বিপজ্জনক ছিল।
তখন প্যারিসের একটি শিশু আশ্রমে কয়েকশ ইহুদি শিশু বাস করতো। তাদেরকে সেই আশ্রম বা এতিমখানা থেকে সরিয়ে আনাই ছিল ফরাসি প্রতিরোধ কার্যক্রমের প্রথম কাজ। আর এই কাজটি দেয়া হয়েছিল মূকাভিনেতা মার্শাল মারচুকে। তাকে বলা হয়েছিল যেকোনো মূল্যে যেকোনোভাবেই হোক না কেন,এই শিশুদেরকে এতিমখানা থেকে বের করে আনতেই হবে। তবে কোনোভাবেই নাৎসি কর্তৃপক্ষকে তা বুঝতে দেয়া যাবে না।
কারণ সারা ফ্রান্স তখন নাৎসিদের পদধ্বনিতে মুখোর। একটু ভুল হলেই ধরা পড়ে যাওয়ার ভয় তো আছেই, সাথে আছে জীবন হারানোর ভয়। উপায় না দেখে তিনি একজন স্কাউটের ছদ্মবেশ ধারণ করেন। এতিমখানার স্টাফদের কাছে তিনি নিজেকে স্কাউট পরিচয় দিয়ে আশ্বস্ত করেছিলেন এবং বলেছিলেন, বাচ্চাদেরকে ফরাসি স্কাউটের অধীনে একটি ফিল্ড ট্রিপে নিয়ে যাওয়া হবে। এতিমখানার স্টাফরা আসলেই তাকে বিশ্বাস করেছিল, নাকি বাচ্চাদের নিয়তিতে সামনে কী ভয়াবহ ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছিল সেটা অনুমান করতে পেরে তাঁর সাথে বাচ্চাগুলোকে যেতে দিয়েছিল, সেটা অবশ্য রহস্যই থেকে যাবে। কিন্তু যে সাহসিকতা এবং নিজের জীবন বাজি রেখে সেই এতিমখানা থেকে তিন তিনবার করে বাচ্চাদেরকে সুইস বর্ডারে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন, তা আসলেই অসাধারণ এবং বীরত্বের শামিল।
ছোটবেলা থেকেই মারচু চার্লি চ্যাপলিনের ভক্ত ছিলেন। পাঁচ বছর বয়সে তিনি চার্লি চ্যাপলিন সম্পর্কে প্রথম জানতে পেরেছিলেন। এমনকি তাঁর দীর্ঘ মূকাভিনয় ক্যারিয়ারে চার্লি চ্যাপলিনের ছায়া দেখতে পাওয়া যায়। যখনি তিনি এতিমখানার কাছ থেকে বাচ্চাদের নিয়ে যাওয়ার ছাড়পত্র পেয়েছিলেন, তাঁর প্রথম চিন্তা ছিল, এই বাচ্চাগুলোকে যেকোনোভাবেই হোক হই-হুল্লোড় করা থেকে বিরত রাখা। কারণ যত বেশি আওয়াজ, তত বেশি ধরা পড়ে যাওয়ার ভয়।
কিন্তু একজনের পক্ষে এতজন বাচ্চাকে শান্ত রাখা কীভাবে সম্ভব! কিন্তু তখনই মারচু তাঁর গোপন অস্ত্র মূকাভিনয়কে ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তাঁর জাদুকরী মূকাভিনয়ের মাধ্যমে বাচ্চাদের নিয়ে গিয়েছিলেন কল্পনার জগতে। এবং তিনবারই তাঁর এই জাদুকরী মাইম বাচ্চাদেরকে শান্ত রাখতে কাজে দিয়েছিল।
তখনকার সময়ে মারচুর একজন সহযোদ্ধার ছেলে ফিলিপ মোরা ২০০৯ সালে সানডে মর্নিংকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন, "পালিয়ে যাওয়ার সময় বাচ্চাদেরকে শান্ত রাখার জন্য মারচু মূকাভিনয় করতে শুরু করেছিল। না, সেটা কোনো অনুষ্ঠান ছিল না। তিনি তাঁর জীবনের জন্য এবং শত শত জীবনের জন্য সেদিন মূকাভিনয় করেছিলেন।"
মারচুর চাচাতো ভাই জর্জ লঞ্জারও স্মৃতিচারণ করে বলেছিলেন, "এই এতিমখানায় মারচু আগে থেকেই মূকাভিনয় প্রদর্শন করতো। সেখানে তিনি মাইম প্রশিক্ষক হিসেবেও কাজ করতেন। সেখানকার বাচ্চাদের মধ্যে সে এমন একটা আবহ তৈরি করতে পেরেছিল যেন তারা সুইস বর্ডারের কাছাকাছি একটি স্থানে ছুটি কাটাতে যাচ্ছে। মারচু তাদেরকে তাঁর মনোমুগ্ধকর মাইম দিয়ে তাদেরকে একটা স্বস্তির পরিবেশ সৃষ্টি করেছিল।"
এর পরপরই কয়েকমাস যুদ্ধের পর মিত্রবাহিনী ফ্রান্সকে স্বাধীন করে নরম্যান্ডির উপকূলে জাহাজ ভেড়ায়। এরপর মারচু এবং লঞ্জার ফ্রান্সের মুক্ত সামরিক বাহিনীতে যোগ দিয়ে বার্লিনে তাদের অভিযান চালিয়ে যেতে থাকেন। সেখানে মারচু তাঁর সাথে কয়েকজন সৈনিক নিয়ে একটি সম্পূর্ণ জার্মান ইউনিটের বিপক্ষে দাঁড়িয়ে গিয়েছিলেন। এবং এই জার্মান ইউনিটের সামনে তিনি মাইমের মাধ্যমে নিজেকে এমনভাবে উপস্থাপন করেছিলেন যে, মনে হচ্ছিল তারা বিশাল একটি ফরাসি সামরিক দলের প্রহরী। মারচুর ভাষ্যমতে, সেটি ছিল একজন যোদ্ধা হিসেবে তাঁর সবচাইতে বড় কৃতিত্ব। জার্মানরা ভেবেছিল, এত বড় বাহিনীর বিপক্ষে লড়াই করতে যাওয়া বোধহয় তাদের জন্য বোকামি হবে তাই তারা মারচুর কাছে আত্মসমর্পণ করেছিলো।
তবে জার্মানদের বিপক্ষে মার্শাল মারচুর অভিযান নিয়ে একটি কল্পকাহিনী প্রচলিত ছিল। এই কল্পকাহিনী অনুসারে, মারচু জার্মান ইউনিট থেকে একটি নির্দিষ্ট দূরত্বে থেকে এমনভাবে মাইম প্রদর্শন করেছিলেন যে, জার্মানরা ভেবেছিল একটি বিশাল ফরাসী বাহিনী তাদের দিকে ধেয়ে আসছে। যদিও পরবর্তীতে মারচু এবং লঞ্জার এই কল্পকাহিনীর সত্যতা নেই বলে জানিয়েছিলেন।
যুদ্ধের পর তরুণ মারচুকে জার্মানির বার্লিনে প্রায় ৩,০০০ মার্কিন সৈন্যের সামনে আমন্ত্রণ করা হয়েছিল, যেখানে তিনি তাঁর জাদুকরী মূকাভিনয় প্রদর্শন করেছিলেন। ২০০১ সালে মারচুকে যুদ্ধক্ষেত্রে দুঃসাহসিক অভিযান পরিচালনার জন্য মেডেল দিয়ে স্বীকৃতি প্রদান করা হয়েছিল এবং সেই অনুষ্ঠানে তিনি যুদ্ধকালীন সময়ের কথা স্মৃতিচারণ করে বলেছিলেন, "আমি জিআইএস এর হয়ে মূকাভিনয় করেছিলাম, ঠিক এর দুই দিন পর স্টার অ্যান্ড স্ট্রাইপস থেকে আমার ডাক আসে।"
শত্রুদের বিপক্ষে ফরাসি প্রতিরোধ অভিযানে মার্শাল মারচুর অবদান কখনোই ভুলে যাওয়া সম্ভব না। এবং যুদ্ধের সময় আইসভিচে তাঁর বাবার মৃত্যুতে যে অকল্পনীয় শোক তিনি বহন করেছিলেন,সেই বিষণ্ণতা পরবর্তীতে তাঁর মূকাভিনয়ে প্রবলভাবে ফুটে উঠেছিল। ২০০৭ সালে কিংবদন্তী এই মূকাভিনেতা শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
This a Bangla article about heroic contibution of Marcel Marceau during Holocaust. All the information sources are hyperlinked inside the article.
Feature Image: Tony Vaccaro/Hulton Archive/Getty Images