হলিউডের মুভির খোঁজখবর রাখেন কিন্তু জেমস বন্ডের নাম শোনেননি, এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া কঠিন। ইয়ান ফ্লেমিংয়ের উপন্যাস থেকে সিনেমার পর্দায় উঠে আসা জেমস বন্ড আদতে একজন দুধর্ষ গোয়েন্দা চরিত্রের নাম। ব্রিটিশ এই গোয়েন্দা চরিত্র প্রতিনিয়তই তার প্রতিদ্বন্দ্বী সোভিয়েত গোয়েন্দাদের ঘোল খাওয়ায়, আন্তর্জাতিক অপরাধচক্রের কলকাঠি নাড়ানো ব্যক্তিদের বিচারের মুখোমুখি হতে বাধ্য করে।
এ তো গেল সিনেমার কথা। বাস্তবতা সিনেমার চেয়ে অনেক কঠিন। এখানে গোয়েন্দাদের প্রতিদিন নিত্যনতুন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হয়। একটু হেরফের হলেই প্রাণ চলে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। গোয়েন্দাদের ক্ষেত্রে খুবই প্রচলিত একটি কথা হলো- তাদের পকেটে সবসময় সায়ানাইড ট্যাবলেট থাকে, যাতে শত্রুদের হাতে ধরা পড়ার কাছাকাছি চলে গেলেই খেয়ে নিতে পারেন। সায়ানাইড ট্যাবলেট খেলে নিশ্চিত মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে হয়। এ থেকে বোঝা যায় কতটা ঝুঁকির মধ্যে তাদের সবসময় কাজ করে যেতে হয়।
আধুনিক রাষ্ট্রগুলো নিজেদের স্বার্থে অত্যন্ত কার্যকরী সব গোয়েন্দা সংস্থা তৈরি করে রেখেছে। গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর প্রধান কাজ শত্রুরাষ্ট্রের গোপন তথ্য সংগ্রহ করে এনে দেশের নীতিনির্ধারকদের হাতে পৌঁছে দেওয়া। নীতিনির্ধারকরা সেসব তথ্যের উপর ভিত্তি করে নিজ দেশের কূটনৈতিক নীতি, সামরিক পরিকল্পনা প্রণয়ন করেন। তবে আধুনিক গোয়েন্দা সংস্থাগুলো আরও বিস্তৃত পর্যায়ে বিভিন্ন কাজ সম্পন্ন করে থাকে।
ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংগঠন 'মোসাদ' পৃথিবীর সবচেয়ে দুধর্ষ গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর একটি– এটি নতুন কোনো তথ্য নয়। এই গোয়েন্দা সংগঠনের একটি অনন্য বৈশিষ্ট্য আছে। এই সংগঠন ইহুদি জাতির জন্য বিপদজনক যেকোনো ব্যক্তিকে হত্যা করাকে নিজেদের দায়িত্ব বলে মনে করে। মোসাদ এতটাই প্রভাবশালী একটি গোয়েন্দা সংস্থা যে, অনেক ইসরায়েলি নাগরিক একে নিজেদের রাষ্ট্রের অন্যতম স্তম্ভ হিসেবে বিবেচনা করেন।
মাইক হারারি মোসাদে দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে কাজ করা একজন তুখোড় গোয়েন্দা। অনেকে তাকে 'ইসরায়েলি জেমস বন্ড' হিসেবে আখ্যায়িত করে থাকেন। তার আসল নাম মাইকেল হারারি। তিনি মোসাদের সবচেয়ে প্রভাবশালী গোয়েন্দাদের একজন, যার সম্পর্কে খুব বেশি কিছু জানা যায় না। আড়ালে থেকেই তিনি মোসাদের ইতিহাসের দুর্দান্ত কিছু অপারেশনের নেতৃত্ব দিয়েছেন।
১৯৭২ সালের মিউনিখ অলিম্পিক ইসরায়েলের জন্য এক দুঃসহ অভিজ্ঞতা ছিল। অলিম্পিক চলাকালে ইসরায়েলের এগারোজন অ্যাথলেটকে 'ব্ল্যাক সেপ্টেম্বর' নামে এক উগ্রপন্থী ফিলিস্তিনি সংগঠন প্রথমে অপহরণ ও পরবর্তীতে খুন করে। ইতিহাসে একে 'মিউনিখ ম্যাসাকার' হিসেবে অভিহিত করা হয়।
ব্ল্যাক সেপ্টেম্বর ছিল ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন ফাতাহ এর সহযোগী সংগঠন। ফিলিস্তিনিদের দুর্ভোগের প্রতি আন্তর্জাতিক মিডিয়া ও নেতৃত্বের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য ফাতাহ 'ব্ল্যাক সেপ্টেম্বর' প্রতিষ্ঠা করে। ব্ল্যাক সেপ্টেম্বরের মূল টার্গেট ছিল জর্ডান ও ইসরায়েলের স্থাপনা ও ব্যক্তিদের উপর গুপ্ত হামলা চালানো।
মিউনিখ ম্যাসাকারের পর ইসরায়েলি জনসমাজ তীব্র জনরোষে ফুঁসে ওঠে। ছয়দিনের মাথায় ইসরায়েলের সেই সময়ের প্রধানমন্ত্রী গোল্ডা মেয়ার হত্যার শিকার হওয়া ব্যক্তিদের আত্মীয়দের সাথে দেখা করেন এবং বলেন, "আমরা তাদের প্রত্যেককে (মিউনিখ ম্যাসাকারের সাথে সম্পৃক্ত) হত্যার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। ম্যাসাকারের সাথে জড়িত কোনো ব্যক্তিকে পৃথিবীতে পদচিহ্ন ফেলতে দেয়া হবে না। আমরা শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত তাদের পেছনে ছুটবো।"
ম্যাসাকারের পরপরই প্রধানমন্ত্রী গোল্ডা মেয়ার, প্রতিরক্ষামন্ত্রী মোশে দায়ান ও আরও কিছু ব্যক্তি নিয়ে একটি গোপন কমিটি গঠিত হয়। এই কমিটি ম্যাসাকারের সাথে সম্পৃক্ত সকলকে হত্যার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। প্রয়োজনীয় অপারেশনের দায়িত্ব দেওয়া হয় মোসাদ ও ইসরায়েল ডিফেন্স ফোর্সকে (আইডিএফ)। অপারেশনের নামকরণ করা হয় 'অপারেশন র্যাথ অব গড'।
মাইক হারারির নেতৃত্বে মোসাদ অপারেশন র্যাথ অব গড পরিচালনা করে। একের পর এক অপারেশনের মাধ্যমে ফিলিস্তিনের রাজনৈতিক নেতাদের হত্যা করতে থাকে।
কিন্তু নরওয়েতে একটি অপারেশনে মাইক হারারির দল বড় ধরনের ভুল করে ফেলে। নরওয়ের লিলিহ্যামারে মোসাদের সদস্যরা আলি হাসান সালিমি ভেবে একজন ভুল ব্যক্তিকে খুন করে। উল্লেখ্য, আলি হাসান সালেমি ছিলেন মিউনিখ হামলার অন্যতম মূল হোতা। এই ঘটনার পর মোসাদের তীব্র সমালোচনা শুরু হয়। নরওয়ে পুলিশের তৎপরতায় ছয়জন মোসাদ সদস্য গ্রেফতার হয়। তাদেরকে বিভিন্ন মাত্রায় কারাদন্ডাদেশ দেওয়া হয়। কিন্তু অপারেশনের নেতৃত্ব দেয়া হারারি পুলিশকে ফাঁকি দিয়ে ঠিকই ইসরাইলে ফিরে আসতে সমর্থ হন।
তীব্র আন্তর্জাতিক চাপে প্রধানমন্ত্রী গোল্ডা মেয়ার অপারেশন র্যাথ অব গডের সমাপ্তি ঘোষণা করতে বাধ্য হন। ইসরায়েলে ফিরে এসেই মাইক হারারি প্রধানমন্ত্রী গোল্ডা মেয়ারের কাছে পদত্যাগপত্র জমা দেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী গোল্ডা মেয়ার তার পদত্যাগ পত্র ফিরিয়ে দিয়ে বলেন, "এখনও অনেক কাজ বাকি আছে।" ধারণা করা হয়, এই একটি ভুলের কারণেই হারারি পরবর্তীতে মোসাদের প্রধান হতে পারেননি।
মাইক হারারির জন্ম ১৯২৭ সালে। ইসরায়েল তখন ব্রিটিশদের দ্বারা পরিচালিত হতো। রাষ্ট্র হিসেবে তখনও ইসরায়েল প্রতিষ্ঠা লাভ করেনি। কিশোর থাকা অবস্থায়ই তিনি হাগানাহ্-তে যোগ দেন। হাগানাহ্ হলো ইহুদিবাদী আধা-সামরিক বাহিনী। একে ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর পূর্বসূরী হিসেবে বিবেচনা করা হয়। হাগানাহ্-এর অভিজাত কমান্ডো ইউনিটের নাম ছিল 'পালমাখ'। কথিত আছে, শুধু এই ইউনিটে যোগ দেয়ার জন্য হারারি তার বয়স সম্পর্কে নিয়োগদানকারীদের ভুল তথ্য দেন। নিয়োগের সময় তিনি তার বয়স ১৫ বলে উল্লেখ করেন, যদিও আদতে তার বয়স ছিল ১৩!
হাগানাহ্-তে হারারি গুপ্ত আক্রমণ, গোয়েন্দাগিরি, সামরিক প্রশিক্ষণের প্রাথমিক পাঠ লাভ করেন। ২য় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পরপরই তাকে ফ্রান্সের মার্সেইলিতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। তাকে ফ্রান্সে পাঠানোর উদ্দেশ্য ছিল, সেখানকার ইহুদিদের নিরাপদে ফিলিস্তিনে নিয়ে আসায় নেতৃত্ব দেওয়া। প্রায় তেরোশ ইহুদি, যারা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের গণহত্যার ধকল সয়ে বেঁচে ছিল, তাদের তিনি ফিলিস্তিনে নিয়ে আসেন
মার্সেইলিতে যাওয়ার পর সেখানকার ইহুদিদের সাথে অবস্থান করার ফলে তিনি নাৎসিদের নির্মমতা সম্পর্কে জানতে পারেন। ১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হলে হারারি ইসরায়েলের অভ্যন্তরীণ গোয়েন্দা সংস্থায় যোগ দেন। নিয়োগ পাওয়ার পর ইসরায়েলের বেন গুরিয়ন আন্তর্জাতিক এয়ারপোর্টে একটি গোয়েন্দা স্টেশন স্থাপন করেন। এখানে কিছুদিন দায়িত্ব পালন করার পর তাকে ইউরোপের ইসরায়েলি দূতাবাসগুলোর নিরাপত্তার জন্য দেশের বাইরে পাঠানো হয়।
১৯৫৪ সালে হারারির জীবনের 'মোসাদ অধ্যায়' শুরু হয়। মোসাদে গোয়েন্দা নিয়োগ ইউনিটের হয়ে কাজ করেন। এরপর ইউনিট কমান্ডার হিসেবে পদোন্নতি পান। এসময় পূর্ব ইউরোপের সমাজতান্ত্রিক দেশগুলো থেকে ইহুদিদের নিরাপদে ইসরায়েলে নিয়ে আসতে তিনি মূখ্য ভূমিকা পালন করেন।
সবচেয়ে বেশি যে অবদানটির জন্য মোসাদ হারারিকে স্মরণ করবে, সেটি হলো 'কিডন' ইউনিটের প্রতিষ্ঠা। মোসাদের বিভিন্ন বিশেষায়িত ইউনিট নিয়ে গঠিত। এই ইউনিটগুলোর মধ্যে অপারেশনের পরিকল্পনা নিখুঁতভাবে বাস্তবায়িত করার জন্য যে ইউনিটটি রয়েছে, তা হচ্ছে 'সিসেরা ইউনিট'। এই ইউনিটের কাজ হচ্ছে পরিকল্পনা অনুযায়ী নিখুঁতভাবে হামলা পরিচালনা করা। সিসেরা ইউনিটের আরেকটি শাখা হচ্ছে 'কিডন'। এই কিডন ইউনিট দক্ষ পেশাদার খুনীদের দ্বারা গঠিত যারা মোসাদের হয়ে হত্যাকান্ড চালিয়ে থাকে। মূলত সেনাবাহিনী থেকে এদের নিয়োগ দেয়া হয়।
শুধু যে অপারেশন র্যাথ অব গডই হারারির তুখোড় গোয়েন্দা প্রতিভার পরিচায়ক, তা কিন্তু নয়। অপারেশন থান্ডারবোল্ট নামে পরিচালিত এক অপারেশনেও তিনি দুর্দান্ত দক্ষতার পরিচয় দিয়েছিলেন। উগান্ডার এনতেব্বে এয়ারপোর্টে ইহুদি যাত্রীসহ একটি বিমানকে জিম্মি করা হয়। সেই অপারেশনে তিনি একজন ইসরায়েলি ব্যবসায়ীর বেশে কন্ট্রোল টাওয়ারের সাথে যোগাযোগ করেন। তারপর ইসরায়েলি প্যারাট্রুপার ও কমান্ডোদের সাহায্যে জিম্মিকারীদের হত্যা করেন এবং ইসরায়েলিদের নিরাপদে দেশে ফিরিয়ে আনেন।
১৯৮০ সালে মাইক হারারি মোসাদ থেকে অবসর নিয়ে ব্যবসায় নিজেকে নিয়োজিত করেন। ব্যবসার কাজে তাকে মধ্য আমেরিকায় বেশ কয়েক বছর অবস্থান করতে হয়। পানামার স্বৈরশাসক জেনারেল নরিয়েগার সাথে তার সখ্য গড়ে ওঠে। কেউ কেউ বলে থাকেন, তিনি পানামার সেনাবাহিনী পুনর্গঠন করেন এবং পানামা যেন ইসরায়েলের কাছ থেকে অস্ত্র কিনতে পারে, সেই বন্দোবস্ত করেন। কিন্তু পরবর্তীতে এক টকশোতে হারারি এসব বিষয় অস্বীকার করেন।
২০০৭ সালে মোসাদ তাকে সম্মাননা প্রদান করে। 'অভিযান পরিচালনায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখা'র জন্য তাকে মোসাদ সর্বোচ্চ সম্মাননা প্রদান করে। কিন্তু বিশেষভাবে কোন অপারেশনের জন্য তিনি এই সম্মাননা পান, সেটি গোপন রাখা হয়। ধারণা করা হয়, ইরানের গোপন নিউক্লিয়ার আর্কাইভ ইসরায়েলের হাতে এনে দেওয়ার ইস্যুতে অবদান রাখার জন্য তাকে এই সম্মাননা দেওয়া হয়েছিল।
বার্লিন অলিম্পিকের ট্রাজেডি নিয়ে খ্যাতনামা পরিচালক স্টিভেন স্পিলবার্গ 'মিউনিখ' নামে একটি সিনেমা নির্মাণ করেন। সেই সিনেমায় মোশে ইভগি হারারির চরিত্রে অভিনয় করেন।
২০১৪ সালের ২১ সেপ্টেম্বর তেল আবিবে মাইক হারারি মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যুর পর এক বিবৃতিতে ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী 'ইসরায়েলের নিরাপত্তার জন্য সবচেয়ে দুধর্ষ যোদ্ধাদের অন্যতম' বলে তাকে সম্বোধন করেন।
This article is about Mike Harari, who is called zionist james bond by some historians. He lead the revenge mission of Mossad which was named 'Operation Wrath of God'.
Feature Image: Sputnik News
References:
1) When the Mossad's Revenge for the Munich Olympics Went Tragically Wrong
2) Was 'Operation Wrath of God' Operational Success?
4) What You Won't Read About Michael Harari, Noriega's Israeli Adviser Who Got Away
5) The Mossad Agent Who Was Second Fiddle to Panama's Dictator