মিলিশিয়া: রাষ্ট্র সমর্থিত সশস্ত্র বাহিনী (ইরান পর্ব)

রাষ্ট্র সমর্থিত সশস্ত্র বাহিনী তথা মিলিশিয়াদের পরিচয় নতুন করে দেওয়ার কিছু নেই। অনেক দেশেই সরকার নিজেদের স্বার্থে, কখনও জনগণের আন্দোলন দমানো/বেগবান করার উদ্দেশ্যে, কখনো সেনাবাহিনীর অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি বা ক্ষমতা দখলের স্পৃহাকে নিয়ন্ত্রণ করার লক্ষ্যে মিলিশিয়া গঠন করে। ঘন ঘন রাষ্ট্র বিপ্লব ঘটলে শাসকশ্রেণীর এমন বাহিনী গড়ে তোলার প্রবণতা বৃদ্ধি পায়। 

রাজনীতির পাঠে ইরান খুব পরিচিত নাম। প্রাচীন আর সমৃদ্ধ দেশটির গত এক শতকের ইতিহাস বেশ বিক্ষুব্ধ; যুদ্ধ আর রাষ্ট্রবিপ্লব, বিদেশী হানাদারদের হস্তক্ষেপ হয়েছে আকছার। আজকের আলাপ এই ইরানের মিলিশিয়াদের নিয়ে। মিলিশিয়াদের উৎপত্তিসহ বর্তমান ইরানী রাজনীতিতে এদের প্রভাব-প্রতিপত্তি আর ভূমিকার একটা চিত্র আঁকার চেষ্টা করা হয়েছে এই লেখার মধ্য দিয়ে। 

বিপ্লব পূর্ব ইরান

ইরানের অধিবাসীরা সবাই শিয়া ইসলামের অনুসারী ভাবলে ভুল হবে। দেশটিতে আছে আজেরি, তুর্ক, আরব, বালুচ, কুর্দসহ অসংখ্য জাতি, সংখ্যায় এরা মোট জনসংখ্যার ৪০ ভাগের বেশি। বৈচিত্র্যময় দেশটির সমৃদ্ধ ইতিহাস আছে, আছে সংস্কৃতিগত সুদীর্ঘ ঐতিহ্য। তবে আরো অনেক প্রাচীন অঞ্চলের মতো ইরানীরাও বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে রক্ষা পায়নি।

ইরানের জাতিসত্ত্বা; Image Source: innovationiseveywhere.com

 

আধুনিক যুগে, ঊনিবংশ শতাব্দীর ইরান ছিল এক হতবিহ্বল রাজতন্ত্র। উত্তরে প্রবল রাশিয়া, দক্ষিণ-পূর্বে ব্রিটিশ উপস্থিতি আর পুরোনো শত্রু অটোমান তুর্কদের সাথে ইরানিদের শত্রুতা লেগেই ছিল। ইরানী শাহদের নিয়ন্ত্রণ ছিল দুর্বল। খাজনা আদায়ের জন্য গোত্রভিত্তিক বাহিনী গড়া হয়েছিল, এরা অনেকটা আধা-স্বাধীনভাবে যার যার অঞ্চলে শাসন করতো শাহ-এর নামে। বখতিয়ারি, কাশকাই বা খামেশ বাহিনীর দৌরাত্ম্যে ইরানী শাহের ক্ষমতা ছিল সীমাবদ্ধ। লুটি নামক পেটোয়া বাহিনী রাস্তাঘাটে টহল দিত, গুণ্ডামীও করতো। 

ইরানে ১৯১১ সাল নাগাদ পার্লামেন্ট (মজলিস) গঠিত হয়। তবে মজলিসের নেতারা রাষ্ট্রকে বিশেষ শক্তিশালী করতে পারেনি। প্রথম মহাযুদ্ধে ইরান নিরপেক্ষ থাকলেও রাশিয়া আজারবাইজান দখল করে, ব্রিটেন খুজেস্তানের আরবদেরকে উসকে দেয়। অটোমান আর জার্মানরাও ঘোঁট পাকাতে কসুর করেনি। এই গোলমালের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় এলেন রেজা শাহ

রেজা শাহ ছলে-বলে-কৌশলে একের পর এক প্রতিপক্ষকে ঢিট করলেন। ইরানে সরকারি ক্ষমতা পাকাপোক্ত করলেন, মৈত্রী করলেন সোভিয়েতদের সাথে, তাদের কাছে থেকে জিলান প্রদেশটি ফেরত নিলেন। ব্রিটিশরাও তার কর্তৃত্ব মেনে নিল। কিন্তু তার মুখ্য কৃতিত্ব হচ্ছে প্রকাণ্ড আর শক্তিশালী একটি সরকারি সেনাদল গঠন। ১৯২৬ সালে ইরানী সেনাদলে লোক ছিল মাত্র ১৬ হাজার। ১৯৪০ এর মধ্যে সেটা ১ লাখ ছাড়িয়ে যায়। এই রাতারাতি পরিবর্তনের ফলে ইরানের স্বাধীন গোত্রগুলোর বাড়াবাড়ি অনেক কমে আসে। 

প্রথম রেজা শাহ; Image Source: Britannica

তবে ইরান দুই প্রবল প্রতিবেশী, ব্রিটিশ আর সোভিয়েতদের টালবাহানায় বিরক্ত হয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ নাগাদ জার্মানীর দিকে ঝুঁকে পড়ে। ফলে ১৯৪১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন আর ব্রিটেন মিলে ইরানকে দু’ভাগে ভাগ করে দেয়। দখলদারদের আশকারায় কাশকাই, লুর, আরব, কুর্দি আর আজেরিরা অনেক স্বায়ত্তশাসনের অধিকার আদায় করে নেয়। রেজা শাহকে সরিয়ে তার ছেলেকে সিংহাসনে বসানো হয়।

ইরানের রাজনীতির চরম বিশৃংখলার মধ্যেই জাতীয়তাবাদী নেতা মোসাদ্দেক ১৯৫০ সালে পার্লামেন্টে ক্ষমতা দখল করেন। কিন্তু বিভিন্ন মিলিশিয়া আর রাজপন্থী সেনারা বছর তিনেক পরে তাকে উৎখাত করে দ্বিতীয় রেজা শাহ পাহ্বলবীকে পুনরায় শক্তিশালী করে তোলে। ১৯৬৩ সালে আয়াতোল্লাহ খোমেনি শাহের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করলে গুপ্ত পুলিশ সাভাক, আর্মি আর পেটোয়া সরকারি বাহিনী ওরফে চমকদারদের সাহায্যে আন্দোলন ভেঙে দেওয়া হয়। খোমেনিকে নির্বাসন দেওয়া হয়। পরবর্তী ষোল বছরে ইরানী সরকারের ক্ষমতা আরো সুসংহত হলেও ১৯৭৯ এর বিপ্লবে শেষমেষ শাহ এর পতন ও রাজতন্ত্র উচ্ছেদ হয়। পরবর্তী বিশৃংখলার ইরান জুড়ে বামপন্থী, ইসলামী ভাবধারার অসংখ্য মিলিশিয়া বাহিনী গড়ে ওঠে। 

ইসলামী প্রজাতন্ত্রে মিলিশিয়া

বিপ্লবের পর খোমেনি ক্ষমতা দখল করে ইরানকে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ঘোষণা করলেন। পাড়ায়-মহল্লায় আর গ্রামে তার মিলিশিয়ারা নিজেরাই বিচারসভা বসিয়ে ইসলাম ও প্রজাতন্ত্রের শত্রুদের ঝুলিয়ে দিল। সেনাবাহিনী আর পুলিশ নিজের নিয়ন্ত্রণে এলেও খোমেনি কিন্তু এই ইসলামী মিলিশিয়াদের তাদের অন্তর্ভূক্ত করলেন না। মিলিশিয়াদের নিয়ন্ত্রণ রইলো খোমেনী সমর্থিত বিপ্লবী কেন্দ্রীয় কমিটির হাতে। ইসলামি রেভোল্যুশনারী গার্ড কর্পস (আইআরজিসি) গঠিত হয় এই মিলিশিয়াদের নিয়ে। ইরানের সরকারি সেনাদল (আরতেশ নামে পরিচিত)-কে ক্রমান্বয়ে ক্ষমতাহীন করা হয়। কেন্দ্র আর প্রদেশে বামপন্থী এবং খোমেনী বিরোধীদের হটিয়ে অনুগতদের কাউন্সিল বসানো শুরু হয় এই আইআরজিসি এর সাহায্যে। প্রেসিডেন্ট আবোল হাসান বনি সদর বামপন্থী মুজাহিদিন-ই-খালাক মিলিশিয়াদের নিয়ে পাল্টা প্রতিরোধ করলেও সুবিধা করতে পারেননি। 

আয়াতোল্লাহ রুহুল্লা খোমেনি ○ Francois LOCHON/Gamma-Rapho

 

ক্ষমতায় এসেই খোমেনি লেবানন আর ইরাকি শিয়াদের নিয়ে জোট পাকানো শুরু করেন। ইরানের বিশৃংখলতার সুযোগ নিয়ে সাদ্দাম হুসেন যুদ্ধ ঘোষণা করে বসেন। ইরাকি সেনাদলের সামনে আরতেশ ছিন্নভিন্ন হয়ে গেলেও আইআরজিসি কিন্তু ভালো প্রতিরোধ গড়ে তোলে, বিশেষ করে আবাদানের তৈল ক্ষেত্রে ইরাকি হামলা সফলভাবে মোকাবেলা করায় নিয়মিত সেনাদলের তুলনায় তাদের দক্ষতা স্পষ্ট হয়। কাতারে কাতারে যুবা-তরুণ নামমাত্র অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে হামলে পড়ে ইরাকিদের ওপর। তবে গেরিলাযুদ্ধে এই হালকা অস্ত্র সজ্জিত মিলিশিয়ারা কৃতিত্ব দেখালেও নিয়মিত সেনাদলের হাতে তাদের প্রচুর লোকক্ষয় হত। 

ইরাকিরা নিজেদের সীমানায় ফিরে গেলেও ১৯৮৩ আর ১৯৮৪ সালে জুড়ে মূলত আইআরজিসি মিলিশিয়ারা একের পর এক আক্রমণ চালাতে থাকে। বিপ্লবী নেতারা ভেবেছিলেন সাদ্দামের পতন সময়ের ব্যাপার। কিন্তু ভারী অস্ত্র সজ্জিত ইরাকিরা শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তুললে সেসব অভিযান ব্যর্থ হয়। নেতারা বুঝলেন, যতই আদর্শগত উচ্ছ্বাস থাকুক, মিলিশিয়াদের একটি সেনাদলের মতো সুশৃংখল করে তোলা প্রয়োজন। ১৯৮৬ নাগাদ আইআরজিসি-র নিজস্ব নৌ, বিমান আর স্থলবাহিনীর কমাণ্ড গড়ে তোলা হয়। গঠিত হয় নিজস্ব সামরিক আকাদেমী আর বিশ্ববিদ্যালয়। যুদ্ধক্ষেত্রে আইআরজিসি আর আরতেশ অনেকটা একযোগেই কাজ করতো। 

আইআরজিসি; Image Source: Britannica

স্থানীয় আইন-শৃংখলা আর বিরোধীদের দমানোও আইআরজিসি মিলিশিয়াদের অন্যতম কর্তব্য ছিল। তাদের সাহায্য করার জন্য বাসিজ মিলিশিয়া গড়া হয়। এরা মূলত দ্বিতীয় ধারার বাহিনী। দুই সপ্তাহের ট্রেনিং আর ধর্মীয় জ্ঞান বোঝাই সাধারণ লোকদের এই বাহিনীতে নেওয়া হয়। বাসিজও ঘরোয়া শৃংখলার ব্যাপারে বেশ প্রভাবশালী মিলিশিয়া। ১৯৯৯ এর ছাত্র আন্দোলনের সময় আনসার-ই-হেজবোল্লাহ এর মতো ভুঁইফোড় মিলিশিয়াদের উপস্থিতিও প্রত্যক্ষ করা গিয়েছে। 

ইরানী রাজনীতিতে মিলিশিয়াদের গুরুত্ব ব্যাপক। যেকোনো বিক্ষোভেই মিলিশিয়াদের অস্তিত্ব অস্বীকারের প্রশ্ন ওঠে না। মাহমুদ আহমেদিনেজাদ বিরোধী বিক্ষোভের সময় বিরোধী নেতারা বারবার আইআরজিসি আর বাসিজ বাহিনীর প্রতি সহমর্মিতা দেখিয়েছেন, ইরানী অনেক নেতাই বাসিজের সামাজিক প্রভাবকে খর্ব করার চেষ্টা চালিয়েছেন, কেউ আবার বাসিজ মিলিশিয়াদের সাথে আইআরজিসি এর মাত্রাতিরিক্ত মাখামাখিকে নিরুৎসাহিত করেছেন।

বাসিজ মিলিশিয়া; Image Source: kayhanlife.com

যুদ্ধের পর অবশ্য আইআরজিসি আর আরতেশ, দুটো সেনাদলকেই আধুনিক সশস্ত্র বাহিনী হিসেবে গড়ে তোলার দিকে মনোযোগ দেওয়া হয়। বাসিজকে গ্রাম আর শহরের পুলিশি বাহিনীর অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে। ইরানী সংবিধান অনুসারে নিয়মিত সেনাদলের কাজ সীমানা রক্ষা, আর আইআরজিসি এর কাজ হচ্ছে ইসলামী প্রজাতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে রক্ষা করা। অর্থ আর সামরিক শক্তিতে বলীয়ান এই মিলিশিয়ারা রাষ্ট্রের ক্ষমতাকাঠামোতে দারুণ প্রভাবশালী। ২০০৯ এর নির্বাচন পরবর্তী হাঙ্গামাতে আহমেনিদেজাদ বিরোধী শিবিরের ওপর এই মিলিশিয়ারা ভয়ানক মারপিট চালায়।

ইরান ও বহিঃবিশ্ব

ইরানি রেভল্যুশনারী গার্ড কর্পস গঠনের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল, ইরানের বাইরেও ইসলামী বিপ্লবকে ছড়িয়ে দেওয়া। খোমেনি স্বয়ং এটাই চাইতেন, যদিও রক্তক্ষয়ী ইরান-ইরাক যুদ্ধের পর সে প্রচেষ্টায় কিছুটা ভাটা পড়ে। যুদ্ধ পরবর্তী ইরানি রাজনীতিতে এই আইআরজিসি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছে। যখনই কট্টরপন্থী, সম্প্রসারণবাদীরা শক্তিশালী হয়েছে, ইরানি আইআরজিসি বাড়িয়েছে তাদের বৈদেশিক কর্মকাণ্ড। সেদিক থেকে অন্যান্য রাষ্ট্র সমর্থিত মিলিশিয়াদের তুলনায় ইরানি এই মিলিশিয়া বাহিনীকে নিঃসন্দেহে শক্তিশালী বলতে হয়। তেল বাণিজ্যসহ নানা ঠিকাদারীর কাজে বিপুল অর্থ আসে এই মিলিশিয়াদের হাতে, ফলে আধুনিক অস্ত্রের প্রচলন ঘটে বহুলাংশে। 

বদর ব্রিগেডের যোদ্ধা; REUTERS/Ahmed Jadallah

 

বাগদাদে মার্কিন বিমান হামলায় সম্প্রতি আল কুদস বাহিনীর কমাণ্ডার কাশেম সোলায়মানী নিহত হওয়ার পর বিশ্ব ইরানী মিলিশিয়াদের নিয়ে আরেক দফা সচকিত হয়। লেবাবনের হিজবোল্লাহ, সিরিয়ার লিয়া ফাতেমিউন আর লিয়া জাইনেবিউন, ইরাকের বদর ব্রিগেদ, আসাইব আহল আল-হক আর কাতাইব হিজবোল্লাসহ অসংখ্য মিলিশিয়া বাহিনী আছে যেগুলো আইআরজিসি এর অফিসার আর ইরাকি-সিরীয়-লেবানিজ-আফগান-পাকিস্তানি যোদ্ধাদের দ্বারা সংগঠিত। মধ্যপ্রাচ্যের শিয়া অধ্যূষিত অঞ্চলগুলোর রাজনীতি আর যুদ্ধে ইরান প্রভাবিত এসব মিলিশিয়া বাহিনী শক্ত ভূমিকা পালন করে থাকে।

Related Articles

Exit mobile version