Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website. The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

মডেল টি: যে গাড়ি কেনার সাধ্য ছিল সাধারণের

রাস্তায় কত ডিজাইনের প্রাইভেট কারই তো দেখা যায় আজকাল। কোনোটি চোখে লেগে থাকে, কোনোটি হয়তো বেশ সাধারণ মনে হয়। সাধ আর সাধ্য যা-ই থাকুক, কোনো কোনো প্রাইভেট কার দেখে আমাদের মনে ছোট্ট একটা আকাঙ্ক্ষা জাগা মোটেও অস্বাভাবিক নয়। শুধু বর্তমান যুগেই নয়, আঠারো শতকের শেষ কিংবা উনিশ শতকের শুরুর দিকে যখন প্রাইভেট কার ব্যবসার সম্প্রসারণ ঘটছিল, তখনও মানুষের মনে এমন ইচ্ছে উঁকি দিয়েছিল। সেসময় ‘মডেল টি’ নামে একটি গাড়ি বাজারে আসে। বেশিরভাগ মানুষ যাতে সাধ্যের মধ্যে কিনতে পারে- এমনই ছিল সেই গাড়ি। আজ সেই ‘মডেল টি’-র গল্পই জানবো আমরা। 

১৮৮৬ সালে জার্মান মোটর প্রকৌশলী কার্ল ফ্রেডরিখ বেঞ্জের উদ্যোগে সর্বপ্রথম আধুনিক গাড়ি নির্মাণ শুরু হয়। যুক্তরাষ্ট্রের গাড়ি নির্মাণের ইতিহাস অবশ্য আরও বছর কয়েক পরের। ১৮৯৩ সালে দুই ভাই চার্লস এগার দুরিয়া ও জেমস ফ্রাঙ্ক দুরিয়া ম্যাসাচুসেটসে প্রথম মার্কিন গাড়ি নির্মাণ করেন। স্বভাবতই, সেসময়ের গাড়িগুলো সব পেশার মানুষ কিনতে পারতো না। সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরেই ছিল সেসব গাড়ি। সাধারণের নাগালের মধ্যে গাড়ি বাজারে আসতে সময় লেগেছে আরও ১৫ বছর। আর এই সাফল্য আসে হেনরি ফোর্ডের হাত ধরে। ফোর্ড ছিলেন মার্কিন এক কৃষক দম্পতির সন্তান। 

নিজের উদ্ভাবিত মডেল পেটেন্ট কারে কার্ল বেঞ্জ, ১৯২৫ সালে মিউনিখ থেকে তোলা; Image source: mercedes-benz

আঠারো শতকের শেষের দিকে এডিসন ইলেকট্রিক ইলুমিনেটিং কোম্পানির প্রধান প্রকৌশলীর দায়িত্বে থাকাকালীন ফোর্ড দিনে কোম্পানির কাজ করে রাতে একটি গ্যাসোলিন ইঞ্জিন তৈরিতে সময় দিতেন। ১৮৯৩ সালের একদিন সফলতা ধরা দেয়— সেসময় তার তৈরি ইঞ্জিনটি ৩০ সেকেন্ড ধরে কাজ করেছিল। ফোর্ড নিশ্চিত হয়ে যান— তিনি সঠিক পথে আছেন। বছর তিনেক পর ফোর্ড ‘কোয়াডসাইকেল’ নামে একটি স্ব-চালিত যান তৈরি করেন। দুটি ব্যর্থ ব্যবসায়িক উদ্যোগের পরে ফোর্ড মোটর সংস্থার জন্ম ১৯০৩ সালে। মডেল টি তৈরির আগে আরও আটটি গাড়ির মডেল তৈরি হয়েছিল। ফলে, ফোর্ড বিভিন্ন দিক বিবেচনায় নিয়ে শেষপর্যন্ত সব মডেলের অভিজ্ঞতা একত্র করে মডেল টি-র ডিজাইন করেন।

১৯০৭ সালের জানুয়ারিতে মডেল টি-র নির্মাণ শুরু হয়। পরের বছরের অক্টোবরে বাজারে আসে মডেল টি। ২০ হর্স পাওয়ারের ইঞ্জিনে গাড়িটি ঘণ্টায় ৬৫-৭০ কিলোমিটার বেগে চলতে পারতো। প্রাথমিকভাবে গাড়িটি কাঠের তৈরি ছিল। সামনে-পেছনে মিলিয়ে একসাথে পাঁচজন যাত্রীর বসার সুবিধা ছিল। হেনরির নকশাকৃত গাড়িতে বামপাশের চাকার সঙ্গে স্টিয়ারিং যুক্ত করা ছিল। অটোমোবাইল শিল্পে তখন এটি ছিল নতুন সংযোজন। পরবর্তীতে অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোও এর ব্যবহার শুরু করে। এর চালনাপদ্ধতি ছিল সহজ, দামে সস্তা, এবং মেরামতযোগ্য। অন্যান্য সুবিধার সাথে গাড়িতে গ্রাউন্ড ক্লিয়ারেন্স সুবিধা থাকায় এটি এবড়োখেবড়ো সড়কেও চলতে পারতো অনায়াসে। এজন্য গ্রামীণ এলাকার চালকদের কাছেও বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে ‘মডেল টি’। গাড়ির সব পার্টস ফোর্ডের কোম্পানিতেই তৈরি হতো।  

বাজারে আসার পর ‘মডেল টি’ ৮৫০ ডলারে বিক্রি শুরু হয়। যদিও এই অর্থ ব্যয় করাটাও সাধারণ মানুষের জন্য বিলাসিতাই ছিল তখন। ফোর্ডের তাই লক্ষ্য ছিল ক্রমান্বয়ে মডেল টি-র দাম কমিয়ে আনা। পত্রিকা ও ম্যাগাজিনে নিজের তৈরি গাড়ির বিজ্ঞাপন প্রচারে ইঞ্জিনিয়ারিং স্টান্ট ব্যবহার করতেন ফোর্ড। মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতেন চ্যালেঞ্জ নিতে।

১৯১১ সালে এক স্কটিশ গাড়ি ব্যবসায়ী তার ছেলে হেনরি আলেকজান্ডার জুনিয়রকে চ্যালেঞ্জ জানানোর জন্য ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জের সর্বোচ্চ পর্বত, স্কটিশ হাইল্যান্ডস বেন নেভিসের শীর্ষে ৪,৪১১ ফুট উচ্চতায় পৌঁছানোর জন্য একটি মডেল টি চালানোর প্রস্তাব করেন। বাজি ছিল— ছেলে শিখরে পৌঁছাতে ব্যর্থ হলে তিনি বাবার দেয়া ভাতা থেকে বঞ্চিত হবেন। হেনরি আলেকজান্ডার জুনিয়র মডেল টি নিয়ে তার যাত্রা শুরু করেন ফোর্ট উইলিয়াম থেকে। পাঁচ দিনের যাত্রায় পাথরের উপর দিয়ে, জলাভূমি পেরিয়ে এবং তুষারের মধ্য দিয়ে গাড়িটি চালান তিনি। জিগ-জ্যাগ ড্রাইভিং প্যাটার্ন ব্যবহার করে একসময় গাড়িটি পর্বতের শীর্ষেও উঠে যায়। কয়েকশো লোকের ভীড় জমে যায় এই দৃশ্য দেখতে। তারপর তিনি ব্রেক সামঞ্জস্য করে গাড়িটি ফের ড্রাইভ করে এডিনবার্গে তার বাবার ডিলারশিপে ফিরিয়ে দেন।  

বেন নেভিসে মডেল টি; Image Source: BFI NATIONAL archive

এই পাবলিসিটির পর মডেল টি-র বিক্রি বেড়ে যায়। যুক্তরাজ্যে প্রায় ১৪ হাজার গাড়ি বিক্রি হয় মডেল টি-র। ফোর্ড বুঝে যান এমন পাবলিসিটি স্ট্যান্টই তার ব্যবসার সম্প্রসারণে বড় ভূমিকা রাখতে পারে। 

১৯১৩ সালে যুক্তরাজ্যের হাইল্যান্ড পার্ক এলাকায় ৬০ একর জমির উপর মডেল টি গাড়ির কারখানা নির্মিত হয়। সেসময় এটিই ছিল বিশ্বের বৃহত্তম কারখানা। নতুন কারখানায় ফোর্ড তার কর্মীসংখ্যাও দ্বিগুণ করে ফেলেন। ফোর্ড কারখানায় উৎপাদন প্রক্রিয়ার অ্যাসেম্বলি লাইন উন্নত করতে সচেষ্ট হন। এই অ্যাসেম্বলি লাইনই তাকে সাফল্যের পথ দেখায়। যেখানে অন্যান্য নির্মাতারা মেকানিকদের ছোট একটি গ্রুপের মাধ্যমেই খুব ধীরগতিতে সম্পূর্ণ গাড়ি তৈরি করত, সেখানে ফোর্ড অ্যাসেম্বলি লাইনের মাধ্যমে বিভিন্ন দল দিয়ে গাড়ির বিভিন্ন অংশ তৈরি করিয়ে নিতেন। পরবর্তীতে সব অংশ একত্রিত করে পূর্ণাঙ্গ গাড়িতে পরিণত করা হতো। এভাবে তৈরির ফলে গাড়ির উৎপাদন বহুগুণে বেড়ে যায়। কমে আসতে শুরু করে উৎপাদন সময়ও। যেখানে আগে একটি মডেল টি তৈরি করতে গড়ে ৯ ঘণ্টা ৫৪ মিনিট লাগতো, সেখানে মাস ছয়েকের মধ্যে এই সময় নেমে আসে ৫ ঘণ্টা ৫৬ মিনিটে। সময় কমার সাথে সাথে কমে যায় গাড়ির মূল্যও। সে সময় ২৫০ ডলারে বিক্রি হতো মডেল টি। 

মডেল টি কারখানা; Image source: The Detroit Bureau

মডেল টি ‘টিন লিজ্জি’ নামেও পরিচিত ছিল। যদিও এই নামের উৎপত্তি বা এটি কেন মডেল টি-র সাথে জুড়ে গেল সেই ইতিহাস অজানাই থেকে গেছে। তবে কারো কারো মতে, এটি মূলত ঘোড়ার নাম ছিল। পরে মডেল ‘টি’-তে এসেছে। নানা বাধা-বিপত্তি পেরিয়েও মডেল টি ঠিকই ব্যবসা করে গেছে বহাল তবিয়তে। সাধারণ মানুষের চাহিদার সাথে মিলে যাওয়ায় সেসময় বেশিরভাগ আমেরিকানের কাছেই পছন্দের তালিকায় শীর্ষে উঠে আসে এই গাড়ি। 

১৯১৩-২৭ সালের মধ্যে ফোর্ডের কারখানায় ১৫ মিলিয়নের বেশি মডেল টি উৎপাদন করা হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় যুক্তরাজ্যেও ফোর্ডের কারখানায় ব্যাপক উৎপাদন শুরু হয় ফোর্ডের গাড়িগুলোর। যুদ্ধ শেষে দেখা গেল, রাস্তায় থাকা প্রতি পাঁচটি গাড়ির দুটিই ছিল ফোর্ড কোম্পানির। এসব গাড়ির অধিকাংশই ছিল ‘মডেল টি’।

সাধারণত কালো রঙেই উৎপাদন হতো মডেল টি। ১৯১৪ সাল থেকে পরবর্তী ১১ বছর কালো রঙের ডিজাইনই বেশ জনপ্রিয় ছিল। কিন্তু কালো ছাড়াও ‘মডেল টি’ পাওয়া যেত নীল, লাল, ধূসর এবং সবুজ রঙেও। 

কিন্তু সবকিছুরই একটা সীমা থাকে বলে যে ধারণা প্রচলিত আছে, সেটি ‘মডেল টি’-র ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম হয়নি। ১৯২০ এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে এসে গাড়ির বাজারে বেশ প্রতিযোগিতা শুরু হয়। উন্নততর প্রযুক্তি আর নজরকাড়া ডিজাইনের গাড়ি আসতে শুরু করে বাজারে। এতে ‘মডেল টি’র বিক্রি কমে যেতে থাকে। 

মডেল টি উৎপাদনের শেষ দিনে হেনরি ফোর্ড ও অ্যাডসেল ফোর্ড; Image Source : The Henry Ford 

ক্রেতারা মডেল টি-কে পুরনো আমলের ডিজাইন আখ্যায়িত করে মুখ ফিরিয়ে নেয় নিতে থাকে। ‘মডেল টি’-র বাজারে টিকে থাকা একপ্রকার অসম্ভব হয়ে পড়তে শুরু করে। অবস্থা বেগতিক দেখে ১৯২৭ সালের মে মাসে গাড়িটির উৎপাদন বন্ধ করে দেন ফোর্ড। এর বদলে সেই বছরের ডিসেম্বরে বাজারে আসে ফোর্ডের তৈরি নতুন গাড়ি ‘মডেল এ’। শেষ হয় মডেল টি অধ্যায়।

Language: Bangla

This article is based on the Model T invented by Henry Ford. All the references are hyperlinked.

Featured Image: Three Lions—Getty Images

 

Related Articles