সময়টা ছিলো উনিশ শতকের শেষ দিক। যে শতকে গৃহযুদ্ধ আটলান্টিকের ওপারের মহাদেশকে রক্তে লাল করে দিয়েছিলো।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উত্তর-পূর্ব দিকের পেনসিলভানিয়া অঞ্চল। বিদ্বেষ, রক্তপাত, দখলদারিত্ব আর শোধ-প্রতিশোধের আগুনে ভরা স্থান ও সময়।
১৮৭৭ সালের ২১ জুন।
পটসভিল এলাকার জেলখানায় ৬ জন এবং কার্বন কাউন্টি এলাকায় ৪ জনের ফাঁসির প্রস্তুতি প্রায় শেষের দিকে। বিশিষ্ট খনি মালিক জন পি জোনস ও মর্গান পাওয়েলসকে নির্মমভাবে খুন করার অপরাধে এই প্রাণদণ্ডের আদেশ হয়েছে। কার্বন কাউন্টি এলাকার ৪ জন হচ্ছে আলেক্স্যান্ডার ক্যাম্পবেল, জন ইয়েলো জ্যাক ডোনাহু, মাইকেল যে ডয়েল ও এডওয়ার্ড জে কেলি। হতভাগ্যদের সবাই আইরিশ ক্যাথলিক। পেশায় খনি শ্রমিক। পেশাগত জীবনের বিভিন্ন ঘটনাবহুল অধ্যায়ের পর অপরাধ জগতে জড়িয়ে পড়ার পরিণতিতে সেদিন তাদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিলো। তাদের নাম ছড়ানোর পাশাপাশি এক সংগঠনের নামও নাম ছড়িয়ে পড়েছিলো। আমেরিকার অপরাধ জগতে সেটি ‘মলি ম্যাগুইয়ার্স’ নামে কুখ্যাত হয়ে আছে।
উনিশ শতকের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আইরিশ অরিজিনের লোকেরা মূলত শ্রমজীবীর পেশায় নিয়োজিত ছিলো। মাতৃভূমি আয়ারল্যান্ডে অভাব, টানাপোড়েন ও রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে পেটের দায়ে তারা নতুন পৃথিবীতে পা রেখেছিলো। এই নতুন মহাদেশ অভাবের খানিকটা সমাধান করেছিলো ঠিকই, কিন্তু জীবনযাত্রার অনিশ্চয়তা সেখানেও যে কিছু কম ছিলো, তা নয়। সমাজের নিচুতলায় বিভিন্ন ছোট-বড় অপরাধ লেগেই থাকতো। আবার শ্রমজীবি ঘটিত রাজনীতি ও পক্ষ-বিপক্ষ বিদ্বেষের ফলে অনেকসময় সংঘর্ষ দেখা দিতো। অপরাধীদের পাশাপাশি প্রাণ দিতো নিরীহ মানুষও।
আমেরিকার পেনসিলভানিয়া অঞ্চল উনিশ শতকে কয়লার খনিসমৃদ্ধ এলাকা হিসেবে বেশ নাম করেছিলো। নতুন নতুন শিল্পায়ন ও পরিবহনে ব্যাপক চাহিদার কারণে কয়লা ব্যবসায়ী ও খনি মালিকদের ব্যবসা বেশ বড় আকারে প্রসারিত হয়েছিলো। ফলে খনিতে শ্রমিকের চাহিদা হু হু করে বেড়েই চললো। আর শ্রমিকদের বেশিরভাগই ছিলো আইরিশ বংশোদ্ভূত।
সেই যুগে এসব খনিতে কাজ করা শুধু বিপজ্জনকই ছিলো না, কম মজুরিরও ছিলো। পুরনো নথিপত্রে দেখা যায়, পেনসিলভানিয়ার স্কাউলকিল এলাকায় প্রায় ২২,৫০০ খনি শ্রমিকের মধ্যে ৫,৫০০ জনই ছিলো শিশুশ্রমিক! খনি এলাকায় শ্রমিকরা মালিকদের বেড়াজালে সবজায়গায় একরকম আটক অবস্থায় থাকতো। সামান্য মজুরির অর্থে প্রতিদিনের প্রয়োজনীয় সবকিছু কিনতে হতো ‘কোম্পানি স্টোর’ নামের দোকানে, অসুস্থ হলেও চিকিৎসা নিতে হতো কোম্পানিরই হাসপাতালে। মুদ্রাস্ফিতির পরিস্থিতি দরিদ্র শ্রমিকদের জন্য এমনিই বিপদের কারণ ছিলো, তাছাড়া খনি এলাকায় সামান্য আয়ের তুলনায় সব খরচ অসম্ভব বেশি হতো।
মালিক আর শ্রমিকদের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্য ও বিরোধ ছাড়াও জাতিগত বিরোধও ছিলো। খনি মালিকদের একটা বড় অংশ ছিলো ওয়েলশ বংশোদ্ভূত। ১৮৭৩ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে স্মরণকালের সবচেয়ে বড় মহামন্দা দেখা দিলে মালিকপক্ষ বেতন-নীতিতে পরিবর্তন আনে। শ্রমিকদের প্রাপ্য মাইনে থেকে শতকরা ১০ থেকে ২০ ভাগ কমিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো। ফলে অসন্তোষ আর ক্ষোভ জন্ম নেয়। শ্রমিকদের স্বার্থ আদায়ের দাবি তুলতে ‘ওয়ার্কারমেন’স বেনিভোলেন্ট অ্যাসোসিয়েশন’ নামের এক সংগঠন তৈরি করা হলো।
১৮৭৫ সালে পেনসিলভানিয়ায় খনি শ্রমিকরা এক দীর্ঘ আন্দোলন গড়ে তোলে। এই আন্দোলন প্রায় ৭ মাস ধরে চলেছিলো। আন্দোলন দমন করতে অঙ্গরাজ্যের গভর্নর অতিরিক্ত নিরাপত্তারক্ষী পাঠান। আন্দোলন সাময়িক তীব্রতা দেখালেও সফলতা পায়নি। শ্রমিকরা মালিকপক্ষের আরোপিত নিয়মেই পুনরায় কাজে ফিরে যেতে বাধ্য হয়। সংগঠনও ক্ষতির মুখে পড়ে।
দাবি আদায়ে ব্যর্থ হয়ে কিছু আইরিশ শ্রমিক নতুন পথ অবলম্বন করার সিদ্ধান্ত নেয়। সতেরশ ও আঠারোশ শতকে আয়ারল্যান্ডে কিছু গুপ্ত সংগঠন গড়ে উঠেছিলো। এসব সংগঠনের মধ্যে ‘দ্য হোয়াইটবয়েজ’, ‘রিবনম্যান’ ও ‘টেরি অ্যাল্টস’ বিভিন্ন কারণে আলোচিত হয়েছিলো। এসব দল গোপন হুমকি, চরমপত্র ও হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে ত্রাস সৃষ্টি করতো।
এভাবেই ‘মলি ম্যাগুইয়ার্স’ নামের গোপন সংগঠনটির জন্ম হয়।
মূলত আয়ারল্যান্ডের মাটিতেই এই সংগঠনের আনুষ্ঠানিক সূত্রপাত হয়েছিলো। ধারণা করা হয়, মলি ম্যাগুইয়ার নামের কোনো আইরিশ রমণীর নামে এই সংগঠনের নাম দেওয়া হয়েছিলো। ইউরোপে আয়ারল্যান্ড ছাড়াও ইংল্যান্ডের লিভারপুলেও এই সংগঠনের সক্রিয় থাকার প্রমাণ পাওয়া যায়।
যুক্তরাষ্ট্রের পূর্ব উপকূলে সক্রিয় হয়ে ওঠার পর এই সংগঠন খনি মালিক, কোম্পানি পুলিশ ও মিছিলে হামলাকারীদের উপর গোপন আক্রমণের পরিকল্পনা নেয়। আইরিশ ধনী পরিবার ও জমির মালিকরা তাদের আক্রমণ থেকে মুক্ত ছিলো। ভয়ের পরিবেশ তৈরি করা, আচমকা হামলা ও মাঝেমাঝে চিহ্নিত লোকেদের খুন করা তাদের কার্যসাধনের অন্যতম পদ্ধতি হয়ে উঠলো। আইরিশ অভিবাসীদের মধ্যে ধারণা জন্মেছিলো যে, নতুন মহাদেশের আইন, পুলিশ, প্রশাসন সবকিছুই তাদের প্রতিকূল। সুতরাং নিজেদের ঐক্যের মাধ্যমে তৈরি এ ধরনের সংগঠনের প্রতি অনেকেরই আস্থা জন্মেছিলো।
তখন ফিলাডেলফিয়া ও রিডিং অঞ্চলের কয়লা, লৌহশিল্প ও রেল-কোম্পানির মালিক ছিলেন ফ্রাংকলিন গোয়েন। আইরিশ গুপ্ত সংগঠনের এসব নৃশংস কার্যকলাপে তার মতো অনেকেই প্রমাদ গুনলো। তিনি তার মতো ধনী খনি মালিকদের এক সংগঠনের ছত্রছায়ায় আসার প্রস্তাব তুললেন। ‘অ্যানথ্রাসাইট বোর্ড অব ট্রেড’ নামে একটি দল গড়ে তোলা হলো। গোয়েন আরো প্রস্তাব করলেন, আইরিশদের অপরাধচক্রের জবাবে যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত ‘পিনকার্টন ডিটেকটিভ এজেন্সি’র সহায়তা নেওয়া হলে বেশি সুবিধে হবে। মলি ম্যাগুইয়ার্সের ভেতর গুপ্তচরবৃত্তি ও পিনকার্টন এজেন্সিকে তথ্য সরবরাহের দায়িত্ব জেমস ম্যাকপার্ল্যান্ডকে দেওয়া হলো।
ম্যাকপার্ল্যান্ড বেশ অল্প সময়ের মধ্যেই সফলতা দেখালেন। পরিচয় গোপন করে তিনি বেশ সূক্ষ্মভাবেই ম্যাকগুইয়ার্স দলের বড় বড় পান্ডাদের কাছে যেতে সক্ষম হয়েছিলেন। দলটির বিভিন্ন আঞ্চলিক দপ্তর ‘লজ’ নামে পরিচিত ছিলো। তিনি তেমনই এক লজের সেক্রেটারি নির্বাচিত হয়েছিলেন। তিনি সংগঠন থেকে নেওয়া খুন, বিস্ফোরন ও অন্যান্য আতঙ্কের খবর পিনকার্টন এজেন্সির কাছে গোপনে পাঠিয়ে দিতেন। তবে তার কিছু সীমাবদ্ধতা ছিলো। সংগঠনে পরিচয় লুকিয়ে কাজ করার কারণে অপরাধে সরাসরি বাধা দেওয়ার ক্ষমতা তার ছিলো না।
মলি ম্যাকগুইয়ার্স ধীরে ধীরে তাত শক্তি বাড়িয়েই তুলছিলো। তাদের অপরাধের পরিধিও ধীরে ধীরে প্রসারিত হয়েছিলো। সংগঠনে অপরাধ কার্যক্রমকে প্রায় ধর্মীয় প্রথার পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিলো। ‘এনসিয়েন্ট অর্ডার অব হাইবার্নিয়ানস’ নামে গোপন একটি সংগঠন সব ঘটনার আড়ালে ঘটনা তদারকি করতো। এটি ছিলো আইরিশ ক্যাথলিকদের একটি গুপ্ত সংস্থা।
১৮৭৬ সালে মলি ম্যাগুইয়ার্সকে বিচারের আওতায় আনা সম্ভব হয়ে উঠলো। জেমস ম্যাকপার্ল্যান্ড মামলার সাক্ষী হলেন। ফ্রাংকলিন গোয়েন ভিচারের চিফ প্রসিকিউটর নিযুক্ত হলেন। মজার ঘটনা হচ্ছে, এই বিচারে তদন্ত করেছে প্রাইভেট এজেন্সি, পুলিশ ছিলো প্রাইভেট সংস্থার, বিচারকাজ চলেছে প্রাইভেট প্রসিকিউশনের অধীনে। শুধু আদালত ভবনের মালিকানা ছিলো অঙ্গরাজ্যের সরকারের। বিচারের মাধ্যমে মলি ম্যাগুইয়ার্স, এনসিয়েন্ট অর্ডার অব হাইবার্নিয়ানস ও আইরিশ অভিবাসী বিষয়গুলো প্রশ্নের সম্মুখীন করা সম্ভব হয়েছিলো।
সংগঠনের হত্যা ও নৈরাজ্যের প্রমাণ হিসেবে একাধিক আলামত আদালতে পেশ করা হয়েছিলো। তার মধ্যে ‘কফিন নোটিশ’ প্রমাণ হিসেবে বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। এগুলো খানিকটা সচিত্র চরম পত্রের মতো হতো। হত্যাকাণ্ডের প্রমাণ হিসেবে কফিনের ছবি আঁকা এই চরমপত্র আদালতে কার্যত অকাট্য প্রমাণ হিসেবে সাব্যস্ত হয়েছিলো।
১৮৭৭ সালের মাঝামাঝি বিচারের কাজ আনুষ্ঠানিকভাবে সম্পূর্ণ হলো। খুন ও আতঙ্ক ছড়ানোর অভিযোগে ১০ জনের ফাঁসির রায় দেওয়া হলো। ফাঁসি কার্যকর করার দিন খনি মালিক ও তার পরিবারদের মধ্যে সাজ সাজ রব রেখা গেলো। জেলখানা অঞ্চলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য স্টেট মিলিশিয়া নিযুক্ত করা হয়েছিলো। মালিকপক্ষ স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে রায় কার্যকর করার দৃশ্য দেখতে এলেন। হতভাগ্য আসামীদের পরিবারও এলো কাছের মানুষদের শেষবারের মতো একবার দেখতে।
অন্যতম অভিযুক্ত আলেক্স্যান্ডার ক্যাম্পবেল ফাঁসির আগে নিজেকে সম্পূর্ণ নির্দোষ দাবি করেছিলেন। তিনি সাহসের সাথে ঘোষণা করেছিলেন, ভবিষ্যৎ তার এই অন্যায় ও প্রহসনের বিচার ও ফাঁসির জন্য লজ্জায় মাথা হেঁট করবে।
সেই বছরের ২১ জুন পটসভিলে ৬ জন ও কার্বন কাউন্টিতে ৪ জন আসামীকে ফাঁসি দেওয়ার মাধ্যমে মার্কিন অপরাধের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় শেষ হলো।
প্রখ্যাত গোয়েন্দা চরিত্র শার্লক হোমসকে নিয়ে লিখিত উপন্যাস ‘ভ্যালি অব ফিয়ার’ এই ঘটোনাকে কেন্দ্র করে লেখা। উপন্যাসে বর্ণিত ‘এনসিয়েন্ট অর্ডার অব ফ্রিম্যান’ আসলে ‘এন্সিয়েন্ট অর্ডার অব হাইবার্নিয়ানস’ এর সাহিত্যিক রূপ।
ইতিহাসে মলি ম্যাগুইয়ার্স সংগঠনটি ‘লেবার ওয়ার’ হিসেবেও খ্যাতি পেয়েছিলো। তবে এ কথা সত্য যে, ন্যায্য আন্দোলন হিসেবে শুরু হলেও পরে জাতিবিদ্বেষ, গুপ্তহত্যা ও শ্বাসরুদ্ধকর অপরাধের একটি পরিচ্ছেদ হিসেবে একটি পরিণতি পেয়েছিলো। আর তৎকালীন মার্কিন ধনাঢ্য সমাজ তার প্রতিক্রিয়ায় নিজেদের ক্ষমতা অনুযায়ী তার প্রতিদান দিয়েছে।
This Bangla article is about Molly Maguires which was a Irish American secret society and crime organization.
References:
01. Who Were the Molly Maguires?
02. How the Molly Maguires’ Executions Gave Birth to a Legend
03. Molly Maguires: remembering one of the biggest federal executions in US history this day in 1877