Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

মনোনগাহ মাইন ডিজাস্টার: মার্কিন কয়লাখনির ইতিহাসে করুণতম দিন

আমেরিকার যে শিল্পবিপ্লব হয়েছিল, সেটাকে ইতিহাসে ‘দ্বিতীয় শিল্পবিপ্লব’ (Second Industrial Revolution) হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। ধারণা করা হয়, ১৮২০-৭০ এর মধ্যবর্তী কোনো একসময়ে এই শিল্পবিপ্লবের গোড়াপত্তন ঘটে। আমেরিকান শিল্পবিপ্লব শুরু হওয়ার পর বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের জন্য বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠতে শুরু করে। অর্থনীতিতে গতানুগতিক কৃষিখাতের যে আধিপত্য, তা ম্রিয়মাণ হয়ে যাওয়ার সময় শুরু হয় শিল্পবিপ্লবের মধ্য দিয়ে। শিল্পবিপ্লব ত্বরান্বিত করতে বাষ্পীয় ইঞ্জিন ব্যবহারের মাধ্যমে রেলগাড়ির আবিষ্কার পণ্য ও মানুষ পরিবহনের ক্ষেত্রে রীতিমতো বিপ্লব ঘটিয়ে দেয়। শিল্পপণ্য উৎপাদনের পর সেটি ভোক্তার কাছে সময়মতো পৌঁছে দেয়ার যে দুরূহ কাজ, সেটি রেলগাড়ি আবিষ্কারের কারণে অনেক সহজ হয়ে যায়। এছাড়া মানুষের যেখানে দূরবর্তী স্থানগুলোতে গমন করতে লেগে যেত কয়েক মাস, রেলগাড়ির কারণে সেই সময়ের ব্যাপ্তি কয়েকদিনে নেমে আসে।

চজশজডডহ
আমেরিকান শিল্পবিপ্লব; image source: interestingengineering.com

শিল্পকারখানাগুলোতে পণ্য উৎপাদনে বিভিন্ন যন্ত্রে বাষ্পীয় ইঞ্জিনের ব্যবহার ছিল খুবই সাধারণ ঘটনা। বাষ্পীয় ইঞ্জিনে কয়লা থেকে বাষ্প উৎপন্ন করে সেই বাষ্প কাজে লাগিয়ে ইঞ্জিন চালনা করা হতো। এই কয়লা পাওয়া যেত বিভিন্ন কয়লাখনি থেকে। কিন্তু কয়লাখনি থেকে শিল্পকারখানা পর্যন্ত কয়লা পরিবহন করা ছিল বিরাট চ্যালেঞ্জ। মার্কিন সরকার কয়লাখনিসমৃদ্ধ অঞ্চলগুলোতে বিশাল রেললাইন প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিল। আমেরিকার পশ্চিম ভার্জিনিয়া অঞ্চলে বিশাল এলাকা জুড়ে ছিল কয়লাখনি। তাই সরকারের পরিকল্পনা অনুযায়ী পশ্চিম ভার্জিনিয়ার কয়লাখনিগুলো থেকে সহজে কয়লা পরিবহনের জন্য নরফোক ও ওয়েস্টার্ন রেলওয়ে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। ফলে এসব অঞ্চলে কয়লাখনির সংখ্যা বাড়তে শুরু করে। খনিতে কাজের জন্য দরকার ছিল দক্ষ খনিশ্রমিক। শুধু ওয়েস্ট ভার্জিনিয়া নয়, এর আশপাশের রাজ্যগুলো তো বটেই, আমেরিকার গন্ডি ছাড়িয়ে রাশিয়া, ইতালি থেকেও অসংখ্য মানুষ এই অঞ্চলে এসে বসতি স্থাপন করেছিল।

কয়লাখনিগুলোতে কাজ করার পরিবেশ মোটেই খনিশ্রমিকদের অনুকূলে ছিল না। একইসাথে সেই সময়ে পর্যাপ্ত শ্রমনীতিমালা না থাকায় অসংখ্য শিশু খনির ঝুঁকিপূর্ণ কাজগুলোতে অংশগ্রহণ করতো, যাদের শরীর খনির গুরুতর কাজগুলোর ধকল সহ্য করার উপযোগী ছিল না। মার্কিন অর্থনীতিতে কৃষির আধিপত্য কমে আসায় গ্রামের অসংখ্য পরিবার বেকারত্বের হাত থেকে বাঁচাতে সন্তানদের বিভিন্ন কয়লাখনিতে পাঠিয়ে দেয়। এছাড়া অন্য যেসব দেশে শিল্পবিপ্লব শুরু হয়নি, সেসব দেশে বেকারত্বের হার ছিল বেশ উঁচু। সেসব দেশ থেকে অসংখ্য কর্মহীন মানুষ একটু ভালো জীবিকার আশায় ওয়েস্ট ভার্জিনিয়ার খনিগুলোতে এসেছিল। তারা জানতেন, খনির এই কাজ বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। পাশাপাশি নিয়মিত বিভিন্ন খনিতে দুর্ঘটনাও ঘটছিল। যে মাসে আমেরিকার ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়ংকর কয়লাখনি দুর্ঘটনা ঘটলো, সে মাসে আরও বেশ কিছু দুর্ঘটনা ঘটে পুরো আমেরিকাজুড়ে। পরিসংখ্যান বলে, ১৯০৭ সালের ডিসেম্বরে বিভিন্ন দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছে ৩২৪১ জন মানুষ। সংখ্যাটি কিন্তু নেহায়েত কম নয়!

আমশমসমড
মার্কিন কয়লাখনিতে কর্মরত একজন খনিশ্রমিক; image source: jaha.org

‘মনোনগাহ্ মাইন ডিজাস্টার’ এর মতো প্রলয়ঙ্কারী দুর্ঘটনার ইতিবৃত্ত জানা যাক। যেদিন এই দুর্ঘটনা ঘটে, তার আগের দিন ছিল ছুটি। তাই সেদিন কর্তৃপক্ষ খনিশ্রমিকদের উপর বাড়তি চাপ তৈরি করেছিল, যাতে ছুটির ঘাটতি পুষিয়ে আনা যায়। শ্রমিকেরা নিয়মমাফিক তাদের প্রয়োজনীয় উপকরণসহ খনিতে নেমে গিয়েছিলেন। সকাল ১০টা ২০ মিনিটে ফেয়ারমন্ট ওয়েল কোম্পানির আট নম্বর খনিতে ভয়াবহ বিস্ফোরণ দিয়ে দুর্ঘটনার সূত্রপাত ঘটে। শত শত খনিশ্রমিক কিংবা ফেয়ারমন্ট ওয়েল কোম্পানি কর্তৃপক্ষ, কারোরই ধারণা ছিল না এরকম কোনো বিস্ফোরণ হতে পারে। বিস্ফোরণ এতটাই ভয়াবহ ও তীব্র ছিল যে, এর কম্পন সাড়ে আট মাইল দূর থেকেও দিব্যি টের পাওয়া গিয়েছে। বিকট আওয়াজে আশেপাশের সমস্ত ভবনের কাঁচের জানালা ভেঙে গিয়েছিল৷ ঘটনাস্থলের আশেপাশে যেসব রাস্তাঘাট ছিল, সেসবে অবস্থানরত সব যানবাহন রাস্তা থেকে সরে গিয়েছিল। খনির যে ইঞ্জিন রুম, সেই রুমের একশো পাউন্ড ওজনের ধ্বংসাবশেষ পাওয়া গিয়েছিল ঘটনাস্থল থেকে পাঁচশো গজ দূরে, বিস্ফোরণ এতই ভয়াবহ ছিল!

চ্ডনসনসন
বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বিস্ফোরণের পর আটকে পড়া খনিশ্রমিকদের জীবিত উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি; image source: timeswv.com

দুর্ঘটনার দুই সপ্তাহ আগে খনি বিষয়ক বিজ্ঞানীরা কোম্পানির সমস্ত খনি পরিদর্শনে এসেছিলেন। তাদের প্রদান করা রিপোর্ট ছিল সন্তোষজনক; কোনো খুঁত পায়নি তাদের অনুসন্ধানী চোখ। এছাড়া ফেয়ারমন্ট ওয়েল কোম্পানি কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে যেন দ্রুততার সাথে খনিশ্রমিকদের উদ্ধার করা যায়, সেজন্য সুপ্রশিক্ষিত উদ্ধারকারী দল প্রস্তুত রেখেছিল। বিস্ফোরণের পর খুব দ্রুত চারজন লোক খনি থেকে বেরিয়ে আসতে সক্ষম হন। উদ্ধারকারী দল আপ্রাণ চেষ্টার পরও খনিতে প্রবেশ করতে পারেনি। কারণ বিস্ফোরণের পর পরই পুরো কয়লাখনি মিথেন ও অন্যান্য বিষাক্ত গ্যাসে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। উল্টো উদ্ধারকারীদের মধ্যে কয়েকজন ব্যক্তি বিষাক্ত গ্যাসের তীব্রতায় তৎক্ষণাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন। এছাড়াও বিভিন্ন ধ্বংসাবশেষ এমনভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল যে, উদ্ধারকারীদের পক্ষে খনিতে গমন করা ছিল পুরোপুরি অসম্ভব। তবে একজন লোককে উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছিল। খনির ক্রপ হোলের কাছাকাছি কান্নার আওয়াজ ভেসে আসায় উদ্ধারকারীরা সেখানে গিয়ে দেখতে পান পিটার আরবান নামের একজন ব্যক্তি তার ভাইয়ের মৃতদেহের পাশে চিৎকার করে কাঁদছে। এরপর তাকে ১০০ ফুট নিচ থেকে উদ্ধার করা হয়। পিটার আরবান হলেন শেষ জীবিত ব্যক্তি, যাকে উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছিল।

ডজহডহশসম
আমেরিকার আরও বেশ কিছু দুর্ঘটনার পর ১৯১০ সালে ‘ব্যুরো অব মাইন’ গঠন করা হয়; image source: cdc.gov

পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসার পর উদ্ধারকারী দল খনির ভেতরে প্রবেশ করে। এরপর যেসব দৃশ্য তারা দেখতে পায়, তা ছিল খুবই মর্মান্তিক। শত শত মানুষ বিষাক্ত গ্যাস ও কালো ধোঁয়ার কবলে পড়ে মারা গিয়েছে। অনেকের মৃতদেহ এতটাই বিকৃত ছিল যে, তাদের আর চিহ্নিত করা সম্ভব হয়নি। বেশিরভাগ মৃতদেহ প্রাথমিক ময়নাতদন্তের পর গণকবর দেয়া হয়। আনুষ্ঠানিক হিসেব অনুযায়ী এই দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছিল ৩৬২ জন। কিন্তু বিভিন্ন সূত্রমতে, খনিশ্রমিকদের অনেকেই তাদের কাজে সহায়তার জন্য শিশু বা অল্পবয়সী বালকদের নিয়ে খনিতে নেমেছিলেন। সেই হিসেবে হতাহতের সংখ্যা আরও অনেক বেড়ে যাবে। বিস্ফোরণের কারণ হিসেবে ওহাইও রাজ্যের তদন্তকারীরা বলেন, আগে যেদিন সর্বশেষ খনিতে কয়লা উত্তোলন করা হয়েছিল, সেদিনের কয়লাখনির ছাই ঠিকমতো নিষ্কাশন করা হয়নি। সেই ছাই থেকেই আগুনের সূত্রপাত, এবং একপর্যায়ে বিস্ফোরণ ঘটে যায়। ওয়েস্ট ভার্জিনিয়ার তদন্তকারীরাও যে রিপোর্ট জমা দেন, তাতে একই ধরনের কথা বলা হয়। তদন্তকারীরা পরামর্শ দিয়েছিলেন, পরবর্তীতে আরও দুর্ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা রয়েছে। তাই তারা পুরো খনির কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়ার পরামর্শ দেন।

এই দুর্ঘটনার দুই বছরের একটু বেশি সময়ের পর আমেরিকায় ‘ইউনাইটেড স্টেটস ব্যুরো অব মাইন’ গঠন করা হয়। এই ব্যুরোর কাজ ছিল অতীতের খনি দুর্ঘটনাগুলো খতিয়ে দেখা, খনি কোম্পানিগুলোর জন্য পর্যাপ্ত নিয়ম-কানুন প্রণয়ন করা, যাতে ভবিষ্যতে বিভিন্ন দুর্ঘটনা এড়িয়ে চলা যায়।

বর্তমানে মনোনগাহ মাইন ডিজাস্টারকে যেন মানুষ ভুলে না যায়, সেজন্য দুটি চিহ্নিতকারী পিলার আছে। একটি আছে দুর্ঘটনাস্থলে, যেখানে বিস্ফোরণ ঘটেছিল। খনিতে কাজ করতে আসা নিহত ব্যক্তিদের স্ত্রী ও সন্তানের প্রতি উৎসর্গ করা হয়েছে এই পিলার। আরেকটি চিহ্নিতকারী পিলার রয়েছে ইতালির ‘স্যান জিওভান্নি দেল ফিওরে’ নামের জায়গায়, যেখান থেকে অধিকাংশ ইতালীয় খনিশ্রমিক কাজ করতে এসেছিলেন।

Related Articles