Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

হিটলারকে হত্যার রোমহর্ষক যত প্রচেষ্টা

শুধু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ কিংবা বিংশ শতাব্দী নয়; বরং বলা যায় মানব ইতিহাসেরই সবচেয়ে বেশি আলোচিত ব্যক্তিদের মধ্যে অন্যতম হলেন নাৎসি প্রধান অ্যাডলফ হিটলার। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞের কারণে ঘৃণিত এই ব্যক্তিকে কম করে হলেও ২৭ বার হত্যা করার চেষ্টা চালানো হয়েছে! আগের পর্বে আমরা তেমন কিছু প্রচেষ্টা নিয়ে আলাপ করেছিলাম। এরই ধারাবাহিকতায় আজ থাকছে আরো কিছু ব্যর্থ হত্যাচেষ্টার কথা।

ব্ল্যাক ম্যাজিক

একদিকে জার্মান ও সুইসরা বন্দুক আর বিস্ফোরক দিয়ে হিটলারকে বধ করার চেষ্টা চালাচ্ছিল, অন্যদিকে আটলান্টিকের ওপারের মার্কিন লেখক উইলিয়াম সিব্রুক বেছে নিলেন ব্ল্যাক ম্যাজিকের মতো অদ্ভুত পদ্ধতিতে খুন করার চেষ্টা!

দিনটি ছিল ১৯৪১ সালের ২২ জানুয়ারি, মেরিল্যান্ডের বনের ভিতর এক কাঠের কেবিনে একত্রিত হলেন সিব্রুক এবং তার কিছু বন্ধু। সূর্যের গনগনে লাল আভা আকাশে থেকে যাওয়া পর্যন্ত গলা পর্যন্ত রাম গিললেন, ড্রাম এলোপাথাড়িভাবে বাজালেন এবং প্রাচীন দেবতাকে ডাকা শুরু করলেন।

কাঠের তৈরি পুতুলে নাৎসিদের পোশাক পরিয়ে দিয়ে তাকে হিটলারের আদলে তৈরি করা হলো। তারপর তার দিকে চেঁচিয়ে বলতে শুরু করলেন, “তুমিই হিটলার, হিটলার তোমার মধ্যে ঢুকে গিয়েছে!” এরপর কাঠের পুতুলের উপর চললো হাতের চড়-থাপ্পড় আর মুখের থুথুর দলার অত্যাচার, সাথে হিটলারের উপর অগণিত অভিশাপ। মাতাল ব্ল্যাক ম্যাজিশিয়ানরা এরপর ড্রামের বাজনার তালে তালে মূর্তির বুকে পেরেক ঢুকিয়ে দিলেন, সিব্রুক কুঠারের এক কোপে ধড় থেকে আলাদা করে ফেললেন হিটলারের রুপক মাথা! এরপর নাৎসি পোশাক পরিহিত পুতুলটির স্থান হলো মাটির নিচে। পোকার আক্রমণে পুতুলটির অস্তিত্ব হাওয়া হয়ে গেলেও হিটলার তখনো সদর্পেই নিজের সাম্রাজ্য বিস্তৃতি চালিয়ে যাচ্ছেন ইউরোপের বুকে।

উইলিয়াম সিব্রুক এবং তার বন্ধুদের ব্ল্যাক ম্যাজিক প্রয়োগের ব্যর্থ প্রচেষ্টা; ছবিসূত্র: Taringa

অপারেশন ফ্ল্যাশ

হিটলার ক্ষমতায় আসার পর সব জার্মানই খুশি হয়েছিলেন এমনটা বলা যাবে না। অন্যান্য রাজনৈতিক দলকে উৎপীড়ন এবং জার্মান প্যারা মিলিটারি বাহিনী “সুৎসটাফেই”-এর অনেক নেতৃত্বস্থানীয় অফিসারকে অন্যায়ভাবে হত্যা করার কারণে জেনারেল ফন ট্রেসকোর মতো অনেকেই নাৎসি দল থেকে বের হয়ে আসেন এবং নাৎসিদেরকে দমন করার জন্য উঠেপড়ে লাগেন।

অবশেষে ১৯৪৩ সালের ১৩ই মার্চ ট্রেসকো তার সুযোগ পেয়ে যান। হিটলার তখন তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের ভিনিৎসা শহর (বর্তমান ইউক্রেন) থেকে জার্মানির পথে পাড়ি জমিয়েছেন। প্লেন মাঝখানে স্মোলেনস্ক শহরে কিছুক্ষণের জন্য বিরতি নিলে ট্রেসকো তার কাজ শুরু করেন।

হিটলারের সাথে একই প্লেনে উড়াল দেওয়া এক অফিসারের হাতে বেশ বড় সাইজের দামী বিয়ারের বোতল ধরিয়ে দেন ট্রেসকো, বোঝানো শুরু করেন এটি বার্লিনের নাৎসি অফিসারদের জন্য পাঠানো হয়েছে। নাৎসি অফিসার সেই ফাঁদে পা-ও দেয়, প্লেনের লাগেজ কম্পার্টমেন্টে রেখে দেওয়া হয় বিস্ফোরক ভর্তি বোতল। বোতল হাতে দেওয়ার আগেই ট্রেসকো ৩০ মিনিটের ফিউজ বোমার সাথে লাগিয়ে দিয়েছেন! এবার দেখার পালা। কিন্তু বিধি বাম, লাগেজ কম্পার্টমেন্টের অতিরিক্ত ঠান্ডার কারণে বিস্ফোরণ ঘটে নি সেদিন এবং হিটলার নিজের অজান্তেই বেঁচে যান মৃত্যুর কবল থেকে। অবশেষে ট্রেসকো বিস্ফোরক বোতলটি প্লেন থেকে সরিয়ে ফেলতে আবারও মাঠে নামেন এবং শুরু করেন নতুন আরও পরিকল্পনা।

জেনারেল ট্রেসকো; ছবিসূত্র: Alchetron

রুডলফ ফন গার্সডর্ফ এবং আত্মঘাতী বোমা হামলা

জেনারেল ট্রেসকোর অপারেশন ফ্ল্যাশ ব্যর্থ হওয়ার পর নাৎসি সেনাবাহিনীর ভিতরে থাকা ষড়যন্ত্রকারী দল নতুন পরিকল্পনা গ্রহণ করে। আরেক নাৎসি জেনারেল রুডলফ ফন গার্সডর্ফ অ্যাডলফ হিটলারকে হত্যা করার জন্য নিজের জীবন পর্যন্ত বিলিয়ে দিতে প্রস্তুত হয়ে যান।

অপারেশন ফ্ল্যাশের ৮ দিন পরেই অর্থাৎ মার্চের ২১ তারিখ বার্লিনের একটি প্রদর্শনীতে উপস্থিত হওয়ার কথা ছিল নাৎসি বাহিনীর প্রধানের যেখানে রাশিয়া থেকে লুটপাট করে আনা অস্ত্রসামগ্রী দেখানো হবে। প্রদর্শনীতে আরো উপস্থিত ছিল হারম্যান গোয়ারিং, হাইনরিখ হিমলার, ফিল্ড মার্শাল উইলহেম কিটেল এবং গ্রান্ড অ্যাডমিরাল কার্ল ডোয়েনিৎস; অর্থাৎ বোমা হামলা যদি সফল হয় তাহলে নাৎসি বাহিনীর প্রধান ৫ জনই একসাথে পরপারে চলে যাবে!

গার্সডর্ফ নিজের কোট বিস্ফোরক দিয়ে নিজেকে সজ্জিত করেন; বোমার সাথে ফিউজ সেট করেন এমনভাবে যেন তা ঠিক ১০ মিনিট পর বিস্ফোরণ ঘটায়। এরপর চলে যান প্রদর্শনীতে; নাৎসি সৈন্য দিয়ে ঘিরে থাকা জায়গায় নিজেকে স্বাভাবিক রাখতে বেশ বেগ পেতে হয়েছিল বলা যায়। হিটলার প্রদর্শনীতে আসতে বেশ কয়েক ঘণ্টা দেরি করে ফেলেন। ফলে সময় স্বল্পতার কারণে ঘোষক ঘোষণা করেন যে হিটলার মাত্র ৮ মিনিট প্রদর্শনীতে উপস্থিত থাকতে পারবেন। অর্থাৎ গার্সডর্ফ যদি ফিউজ সেট করেও দেয় তাহলে ফুয়েরার তার আগেই নিরাপদ জায়গায় পৌঁছে যাবে। এই পরিস্থিতিতে গার্সডর্ফ নিজের জীবনের ঝুঁকি আর না নিয়েই ফিরে আসেন এবং সন্দেহ এড়ানোর জন্য যুদ্ধক্ষেত্রে চলে যান।

রুডলফ ভন গার্সডরফ; ছবিসূত্র: B. Orsal Inno

ইস্ট্রোজেন এবং মহিলা হিটলার!

হিটলারকে নিকেশ করে দেওয়ার সবগুলো পরিকল্পনাই যে তাকে কবরে পাঠিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে ছিল তা কিন্তু নয়; অনেকগুলো ছিল তার নিষ্ঠুর চরিত্রের বারোটা বাজিয়ে দেওয়া। সেরকম একটিই হলো হিটলারের খাবারে ইস্ট্রোজেন মিশিয়ে দিয়ে তাকে মহিলাতে রুপান্তরিত করার উদ্ভট চেষ্টা!

হিটলারের বোন অনেকটাই মার্জিত স্বভাবের ছিলেন; বিশেষ করে অকারণে হত্যাযজ্ঞ চালানো ঘৃণা করতেন। ব্রিটিশদের হাতে এ তথ্য যাওয়ার পর তারা ধারণা করে যে হিটলারকে যদি কোনোভাবে মহিলাতে রুপান্তরিত করা যায় তাহলে সে তার বোনের মতো নিরীহ মানুষে পরিণত হবে! ব্রিটিশরা তাদের এ চিন্তাভাবনা মাথার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখেনি, তারা সত্যি সত্যি এটা কাজে লাগিয়েছিল। হিটলারের বাগানে থাকা এক মালিকে ঘুষ দিয়ে চাষ করা গাজরের মধ্যে ইস্ট্রোজেন ইনজেক্ট করে দেয়া হয়।

কিন্তু তাদের এই চেষ্টাও ব্যর্থ হয়েছিল, কেন তা জানা যায়নি। হতে পারে হিটলারের খাবার পরীক্ষকরা তা ধরে ফেলেছিল কিংবা বাগানের মালি বিশ্বাসঘাতকতা করতে রাজি না হয়ে বাইরে বিক্রি করে দিয়েছে। কে জানে?

মিত্রবাহিনীর হিটলারকে মহিলায় রুপান্তর করার ব্যর্থ চেষ্টা; ছবিসূত্র: Hexjam

অপারেশন ফক্সলি

ব্রিটিশরা যেকোনো মূল্যে হিটলারকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছিল। তারা হিটলারের ব্যক্তিগত ট্রেনে বিস্ফোরণ ঘটানোর চেষ্টা চালিয়েছে, পানির মধ্যে বিষ মিশিয়েছে। কিন্তু এর কোনোটিতেই আশানুরুপ ফলাফল পাওয়া যায়নি।

১৯৪৪ সালের শেষ দিকে ব্রিটিশরা অবশেষে একটা উপায় খুঁজে পায়। তারা ফুয়েরারের ব্যক্তিগত দেহরক্ষীদের একজনকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয় এবং বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেয়ে যায়। হিটলার বাভারিয়ান আল্পসে পিছু হটার পর সেখানেই ছিলেন বেশ কিছুদিন। এখানে থাকার সময় তিনি প্রতিদিন সকাল দশটায় বাসভবন থেকে খাবার খাওয়ার জন্য অন্যত্র হেঁটে যেতেন। এই ২০ মিনিটের পথে তিনি সম্পূর্ণ অরক্ষিত অবস্থায় থাকতেন। আশেপাশের ঘন বন-জঙ্গল থেকে অনায়াসে যেকোনো স্নাইপার হিটলারের কপাল ফুটো করে ফেলতে পারবেন।

ব্রিটিশরা পরিকল্পনানুযায়ী সবকিছু প্রস্তুত করেই রেখেছিল; এমনকি স্নাইপারও পাঠিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ব্রিটিশরা তাদের পরিকল্পনা পরিবর্তন করে ফেলে। লেফটেন্যান্ট কর্নেল রোনাল্ড থর্নলি বুঝতে পারেন যে যুদ্ধের শেষ অবস্থায় হিটলারকে খুন করলে হিটলার শুধু যুদ্ধের শহীদ হিসেবেই পরিগণিত হবেন না, বরং নাৎসিবাদ আরো জনপ্রিয় হয়ে যাবে। এর চেয়ে হিটলার বেঁচে থাকলে নাৎসিবাদের ভয়াবহ পরিণতি জনগণ বুঝতে পারবে এবং তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিবে। তাছাড়া ইউরোপজুড়ে নাৎসিদের পতন শুরু হয়ে গেছে ভালোভাবেই, এমন সময় নাৎসি প্রধানকে ইহলোক ত্যাগ করিয়ে দিয়ে খুব একটা লাভ হবে না।

স্নাইপার রাইফেলের ফোকাসে হিটলার; ছবিসূত্র: Locker Dome

২০ জুলাইয়ের বিস্ফোরণ এবং হিটলারের শরীরের আচড়

কাউন্ট স্টাফেনবার্গ হিটলারকে প্রায় খুনই করে ফেলেছিলেন এবং তিনিই একমাত্র ব্যক্তি যিনি হিটলারের গায়ে কিছুটা হলেও আঁচড় ফেলতে পেরেছিলেন!

দিনটা ছিল ২০ জুলাই; হিটলারের টপ সিক্রেট কনফারেন্স রুম ‘ওলফ’স লেয়ার’-এ ঢোকার সুযোগ পান কাউন্ট স্টাফেনবার্গ, যেখানে ফুয়েরার তার সবচেয়ে বিশ্বস্ত লোকদের নিয়ে সামরিক কলাকৌশল পর্যালোচনা করেন। স্টাফেনবার্গ তার সাথে ব্রিফকেসভর্তি বিস্ফোরক নিয়ে আসেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে। ‘ওলফ’স লেয়ার’-এর এক রুমে এক ফাঁকে ঢুকে ব্রিফকেস থেকে বিস্ফোরকের ফিউজ জ্বালিয়ে দেওয়া শুরু করতেই এক কর্মচারী তাকে ডাকা শুরু করেন। স্টাফেনবার্গ তাড়াহুড়ো করে মাত্র একটা বিস্ফোরকের ফিউজই জ্বালাতে পারেন এবং তা নিয়েই কনফারেন্স রুমে ঢুকে পড়েন। তিনি টেবিলের নিচ দিয়ে যতটা সম্ভব হিটলারের দিকে ব্রিফকেসটা ঠেলে দেন। বিস্ফোরণ ঘটে ঠিকই, কিন্তু একটা বিস্ফোরক হিটলারকে পরপারে পাঠিয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল না; বিস্ফোরণের আঘাতে চারজন মারা যায় এবং বাকিরা ভালোমতোই আহত হন। স্টাফেনবার্গকে ধরে ফেলা হয় এবং পরবর্তীতে তার মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়।

বোমার বিস্ফোরণে বিধ্বস্ত ‘ওলফ’স লেয়ার’; ছবিসূত্র: Wikipedia

তো এই হলো হিটলারকে হত্যাচেষ্টার কিছু রোমহর্ষক কাহিনী। পরবর্তীতে আরো কিছু হত্যাচেষ্টার কাহিনী নিয়ে উপস্থিত হব আশা করছি।

প্রথম পর্বঃ হিটলারকে হত্যাচেষ্টার রোমহর্ষক কিছু কাহিনী

Related Articles