Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website. The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

ঐতিহ্য আর আভিজাত্যের ঢাকাই মসলিন

প্রাচীন বাংলার সমৃদ্ধ ইতিহাস আর ঐতিহ্যে যে নামটি আভিজাত্য আর নিজস্ব মহিমা নিয়ে জ্বলজ্বল করছে, তা হলো মসলিন। ঢাকাই মসলিন। একসময়ে শুধু বাংলা বা মুঘল রাজদরবারই নয়, বরং সমগ্র পৃথিবীজুড়েই অতি সূক্ষ্ম, মিহি, মোলায়েম আর উজ্জ্বল এই বস্ত্র ছিলো চাহিদার শীর্ষে। অনেকে মনে করেন, মসলিন নামটি এসেছে ইরাকের বাণিজ্যনগরী মসুল থেকে। তবে এই তথ্যের তেমন কোন যথাযোগ্য প্রমাণ মেলে না।

কেমন ছিলো এই ঢাকাই মসলিন?

প্রাচীন বাংলার চীনা পর্যটক ইউয়ান চং বলেন “মসলিন, ঠিক যেন ভোরের এক ধোয়াচ্ছন্ন আলো”। আমাদের হাজার বছরের ঐতিহ্যের অন্যতম প্রতীক এই মসলিন এতটাই সূক্ষ্ম ছিলো যে কথিত আছে একটি আংটির ভেতর দিয়েই গলানো যেত গজের পর গজ কাপড়। সূক্ষ্মতা সম্পর্কে অনেকে বলে থাকেন, ৫০ মিটার মসলিন কাপড় নাকি একটা দেশলাইয়ের বাক্সে অনায়াসেই এঁটে যেতো!

মসলিনের সাথে মিশে আছে হাজার বছরের আভিজাত্যের ইতিহাস; সোর্স: কালের কন্ঠ

প্রাচীনকালে এই মহামূল্যবান কাপড় ভারতীয় উপমহাদেশে মলমল নামে পরিচিত ছিলো। আর বিদেশীরা এর নাম দিয়েছিলো মসলিন। চীনের পরিব্রাজক মা হুয়ান তাঁর ভ্রমণকাহিনীতে ১৭ ধরনের ঢাকাই মসলিনের কথা লিখে গেছেন। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো খাসসা (ঘন বুননের মসলিন), আল্লাবালী (অতি সূক্ষ্ম মসলিন), শরবতী (শরবতের মতো স্বচ্ছ), নয়ন সুখ (মোটা মসলিন), দোরিয়া (ডোরাকাটা মসলিন), তেরিন ডাম (সাধারণ মসলিন), সিরবন্দ (পাগড়ি বাঁধার কাজে ব্যবহৃত হতো), বদন খাস (মিহি মসলিন) ইত্যাদি। মূলত সূক্ষ্মতা আর বুননের ভিত্তিতেই এসব নামকরণ।

এছাড়াও ছিলো ঝুনা, শবনম আর জামদানি মসলিন। ঝুনা মসলিন এতটাই সূক্ষ্ম ছিলো যে এটি পরলে মনেই হতো না যে কাপড় পরা হয়েছে। দেশীয় ধনীদের অন্তঃপুরের নারীরা ঝুনা মসলিন ব্যবহার করতেন। তাছাড়াও আমির, ওমরাহ ও স্থানীয় গণ্যমান্য লোকেরা গরমের দিনে ঝুনা মসলিন দিয়ে তৈরি জামা পরতেন। শবনম মসলিনও নিপুণতায় ঝুনা মসলিন থেকে কোনো অংশে কম ছিলো না। শবনম তৈরি করে সকালবেলায় ঘাসে শুকাতে দিলে শিশিরের থেকে আলাদা করে চেনা খুব কষ্টকর ছিলো। দৈর্ঘ্যে বিশ গজ আর প্রস্থে এক গজ এক টুকরো শবনমের ওজন ছিলো বড়জোড় বিশ কি বাইশ তোলা! অন্যদিকে তাঁতেই যেসব মসলিনের নকশা করা হতো, তার নাম ছিলো জামদানি। দক্ষ কারিগরের হাতের নিপুণ শৈল্পিকতায় তৈরি এসব জামদানি মসলিনের চাহিদার আর দাম দুই-ই ছিলো চড়া। ধারণা করা হয়, এই জামদানি মসলিন থেকেই উত্তরাধুনিককালে জন্ম নিয়েছে ঢাকাই জামদানি।

কথিত আছে, জামদানি মসলিন থেকেই উদ্ভব হয়েছে আধুনিক জামদানি; Source: dw.com

তবে সবচেয়ে সেরা মসলিন ছিলো ‘মলবুল খাস’। মলবুল খাসের আভিজাত্য আর নিপুণতা ছাড়িয়ে গিয়েছিলো অন্যসব মসলিনকে। মুঘল সম্রাট ও তাঁর পরিবার থেকে শুরু করে সরকার-ই-আলা, বাংলার নবাব সুবেদারদের মতো উচ্চপর্যায়ের মানুষদেরই কেবল এই ‘মলবুল খাস’ ব্যবহারের অধিকার ছিলো।

মসলিনের স্বচ্ছতা সম্পর্কে বহু ঘটনা লোকমুখে প্রচলিত আছে। একবার মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের মেয়ে সম্রাজ্ঞী জেবুন্নেসা মসলিন পড়েছিলেন বলে তার বাবা তাকে ভীষণ বকুনি দিলেন। অত স্বচ্ছ কাপড় সম্রাটের কাছে অশালীন লাগছিলো। জেবুন্নেছা তখন পিতাকে বললেন, “জাঁহাপনা আমি সাত স্তরের মসলিন জামা পরেছি।”

এককালে এই সূক্ষ্ম এই মসলিনের খ্যাতি ছিলো দুনিয়াজোড়া; Source: bangladorpon.com

আরেকবার ফ্রান্সের রাষ্ট্রদূত এসেছিলেন তৎকালীন বঙ্গদেশ ভ্রমণে। ফেরার সময় রানীর জন্য নিয়ে গেলেন এক আজব উপহার। একটি মাত্র দেশলাইয়ের বক্স নিয়ে রানীর সামনে উপস্হিত হলেন রাষ্ট্রদূত! সভাসদ সবাই অবাক। রানীর হাতে এই উপহার তুলে দিতেই রানী ভীষণ অপমান বোধ করলেন। কিন্তু দেশলাইয়ের বক্স খুলতেই রানীর সমস্ত রাগ, অপমান কর্পূরের মতো নিমেষেই উড়ে গেলো। এ যে মসলিন! এত স্বচ্ছ, মিহি আর নজরকাড়া কাপড় তিনি কখনোই দেখেননি। মসলিন পেয়ে রানীর ভরলো মন, আর রাষ্ট্রদূতের পকেট ভরলো বকশিশে। মসলিনের ঐতিহ্য, সমৃদ্ধি আর জনপ্রিয়তা নিয়ে এমন আরো বহু ঘটনা রয়েছে। আসুন এবারে একটু জেনে নেয়া যাক মসলিন তৈরির কাহিনী।

কীভাবে তৈরি হতো মসলিন?

‘অ্যা স্কেচ অফ দ্য টপোগ্রাফি এন্ড স্ট্যাটিস্টিকস অফ ঢাকা’ বইয়ে মসলিনের বর্ণনা দিতে গিয়ে জেমস টেলর লেখেন, “ঢাকাই মসলিন মানুষের কাজ নয়। এটা পরীদের কাজ।” মসলিন তৈরির পেছনে জড়িয়ে আছে অনেক না বলা গল্প। এই এত দামের মসলিন যারা তৈরি করতো, তাদের জীবন যে খুব একটা সুখের ছিলো তা কিন্তু নয়। খুবই মানবেতর অবস্থায় তাদের দিন কাটতো। লাভের বেশির ভাগই লুফে নিতেন ফড়িয়া ও মুনাফালোভী বণিকরা।

মসলিন তৈরি হতো মূলত ঢাকা ও এর পার্শ্ববর্তী অঞ্চলগুলোতে। মসলিন তৈরির জন্য শীতলক্ষ্যার পাড়ের আবহাওয়া ছিলো সবচেয়ে উপযুক্ত। মসলিনে সুতা এতই সূক্ষ্ম ছিলো যে সকাল কিংবা সন্ধ্যাবেলার শীতল আর স্নিগ্ধ পরিবেশ ছাড়া এই সুতা কাটাই যেতো না। অনেকে মনে করেন, ১৮ থেকে ৩০ বছরের মেয়েরাই এই সুতা কাটতে পারতো।

এই শীতলক্ষ্যার পাড়ের আবহাওয়াতেই একসময় তৈরী হতো বিশ্বজয়ী মসলিন; Source: snipview.com

ঢাকার পার্শ্ববর্তী গাজীপুর জেলার কাপাসিয়াতে ফুটি কার্পাস নামে একধরনের বিশেষ তুলা গাছ উৎপন্ন হতো। সেই গাছের তুলা থেকে পাওয়া যেত একধরনের বিশেষ সুতা। সেই সুতাকে আবার মিহি আর মসলিন তৈরির উপযুক্ত করে তোলার জন্য বোয়াল মাছের দাঁত আর বাঁশের ধনু দিয়ে পরিষ্কার করার পর চরকায় কাটা হতো। কারিগরেরা ধাপে ধাপে মসলিন বোনার প্রক্রিয়া মনে রাখার জন্য বিভিন্ন শ্লোক বা ছন্দ মনে রাখতেন। এইসব তাঁতীদের অক্লান্ত পরিশ্রম আর ভালোবাসায় তৈরি হতো একেকটি মসলিন। একেকটি স্বপ্ন, একেকটি আনন্দঘন মুহূর্ত।

মসলিনের বিলুপ্তি

মুঘল আমলে মসলিন তৈরিতে বহু পৃষ্ঠপোষকতা করা হতো। মূলত পলাশী যুদ্ধের পরপরই এর পসার কমতে শুরু করে। ঢাকা রাজধানীর মর্যাদা হারিয়ে শহর হিসেবে এর গুরুত্ব যেমন কমে যাচ্ছিলো, তেমনি মসলিন শিল্পেও ভাঙ্গন ধরে। ইংরেজরা বহু তাঁত নষ্ট করে দেয়, তাঁতীরা যাতে মসলিন তৈরি করতে না পারে সেজন্য তাদের বুড়ো আঙুল কেটে নেওয়া হয়।

পলাশীর যুদ্ধের পরাজয়ের পরপরই মসলিনের পতন শুরু হয়; Source: defendingthe-legacy.blogspot.com

আবার অনেকে মনে করেন, তাঁতীরা স্বেচ্ছায় নিজেদের আঙ্গুল কেটে ফেলেছিলেন যাতে মসলিন তৈরি করতে না হয়। মূলত অস্থিতিশীল রাজনৈতিক অবস্থা, বাজারধ্বস, কাঁচামালের অপ্রাপ্যতা, জলবায়ু পরিবর্তন আর পৃষ্ঠপোষকতার অভাবেই উনিশ শতকের মাঝামাঝিতে সম্পূর্ণভাবেই বিলুপ্ত হয়ে যায় মসলিন। এখন শুধু জাদুঘরেই এর দেখা মেলে।

আবার ফিরবে মসলিন!

আশার কথা, বর্তমানে দেশের মানুষ সহ প্রশাসন মসলিনের গুরুত্ব ও ঐতিহাসিক মান উপলব্ধি করতে পেরেছে। তাই চলছে একে পুনরুদ্ধারের চেষ্টা
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউশন অব বায়োলজিক্যাল সায়েন্সের পরিচালক ও বায়োটেকনোলজি গবেষক অধ্যাপক ড. মনজুর হোসেনের নেতৃত্বে একটি দল এ নিয়ে কাজ করছেন। চলছে ফুটি কার্পাস গাছের অনুসন্ধান। সেই দেয়াশলাইয়ের বাক্সে আঁটবে এমন মসৃণ মসলিন তারা তৈরি করতে পারবেন, এমনটা না বললেও তাদের আশা আদি মসলিনের কাছাকাছি মসলিন নিশ্চয়ই তৈরি করা সম্ভব। এ ব্যাপারে ড. মনজুর বলেন, “ইতোমধ্যেই কিছু তুলার জাতের সন্ধান পাওয়া গেছে। ২০১৯ সালের মাঝে মসলিনের একটি রুমাল হলেও বানিয়ে দেখাবো।”

মসলিন উৎসবের প্রদর্শনী ঘুরে দেখছেন বাংলাদেশ সরকারের অর্থমন্ত্রী ও সংস্কৃতি মন্ত্রী; Source: deshebideshe.com

এছাড়াও সরকারি বেসরকারি উদ্যোগে কাজ চলছে। ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় জাদুঘরে আড়ং, দৃক গ্যালারি ও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে মাসব্যাপী মসলিন উৎসবের আয়োজন করা হয়। এতে মসলিনের হারানো ঐতিহ্য, ইতিহাস মানুষের সামনে তুলে ধরার পাশাপাশি প্রদর্শিত হয় মসলিনের কাছাকাছি তৈরি কাপড়ের ফ্যাশন শো। আভিজাত্য আর অনন্যতার প্রতীক হিসেবে বিশ্ববাজারে এখনও এর চাহিদা রয়েছে বলে মনে করেন আয়োজকেরা। কেননা ভারতের খাদি মসলিন বছরে প্রায় ৮০০ কোটি টাকার ব্যাবসা করে, সেক্ষেত্রে আমাদের আসল ঢাকাই মসলিনের চাহিদা যে আরো ও বেশি হবে সেটা বলা যায় নিঃসন্দেহে।

মসলিন উৎসবে সাধারণ মানুষের ছিলো স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ; Source: cpd.org_.bd

মসলিন আমাদের ঐতিহ্য, আমাদের অহংকার। আমাদের জাতিসত্তার একটি অংশ। সঠিক পৃষ্ঠপোষকতা আর প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকলে নিশ্চয়ই মসলিন একদিন তার হারানো ঐতিহ্য ফিরে পাবে । সেদিন হয়তো মসলিন দিয়েই বাংলাদেশকে আবার নতুন করে চিনবে বিশ্ব। এমন স্বপ্ন দেখা নিশ্চয়ই অমূলক নয়।

তথ্যসূত্র

১. মসলিনের দেশে, প্রকাশক: দৃক পিকচার লাইব্রেরি লিমিটেড।
২. ঢাকাই মসলিন, লেখক: আবদুল করিম

ফিচার ইমেজ: Wikimedia Commons

Related Articles