Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website. The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

মুল্লুক চলো আন্দোলন: ব্রিটিশ নির্মমতার এক অজানা উপাখ্যান

দু’শো বছরের শাসনামলে ব্রিটিশরা উপমহাদেশে কত নির্মমতার জন্ম দিয়েছে, তার কোনো হিসেব নেই। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এসব নির্মমতার ভুক্তভোগী ছিল দেশের অসহায় মানুষ। যাদের কাঁধে ভর করেই ব্রিটিশরা এদেশ থেকে বিপুল পরিমাণ সম্পদ ব্রিটেনে পাচার করতে সক্ষম হয়েছিল। তেমনই এক নির্মম উপাখ্যান রচিত হয় ১৯২১ সালে। নির্মম সেই ঘটনাটি ঘটে চাঁদপুরের মেঘনা ঘাটে। 

সিলেট এবং আসামের বন-জঙ্গল সাফ করে সেখানে চায়ের বাগান গড়ে তোলে ব্রিটিশরা। চা বাগানগুলোতে কাজের জন্য প্রয়োজন হতো প্রচুর শ্রমিক। স্থানীয় মানুষজন এসব পরিশ্রমের কাজ করতে চাইত না। তাই দূরদূরান্ত থেকে উন্নত জীবনের লোভ দেখিয়ে ধরে আনা হতো শ্রমিকদের, যাদেরকে আর কখনোই ফেরত যেতে দেওয়া হতো না।

হাড়ভাঙা পরিশ্রম করানো হতো শ্রমিকদের দিয়ে; Image source: Wikimedia Commons 

দারিদ্র্যপীড়িত ভারতের বিহার, উড়িষ্যা, মধ্যপ্রদেশ, মাদ্রাজসহ বিভিন্ন অঞ্চলের নিম্নবর্ণের হিন্দুদের ধরে নিয়ে আসা হতো কাজের জন্য। এছাড়া দলিত এবং ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর জনগণও উন্নত জীবনের লোভে পড়ে ব্রিটিশদের পাতানো ফাঁদে পা দিয়ে পাড়ি জমাত আসামে। নিম্নবর্ণের এই লোকদের দেখানো হয় সুবর্ণ এক ভূমির ঠিকানা। সেখানে সবুজে ঘেরা পাহাড়ের বেদীতে গাছে গাছে সোনার পাতা ধরে, আর সেই স্বর্ণপত্র সংগ্রহ করাই তাদের কাজ। এমন সব কাল্পনিক এবং রূপকথার গল্প শুনিয়ে অনাহারে ভুগতে থাকা লোকেদের আকৃষ্ট করা হতো। 

এসব মানুষ প্রলোভনে পড়ে যখন বন-জঙ্গলে ঘেরা পাহাড়ে এলেন, তখনই বাস্তবতা বুঝতে পারলেন। বন-জঙ্গলের হিংস্র প্রাণী এবং বিষাক্ত পোকামাকড়ের সাথে প্রতিনিয়ত লড়াই করে বেঁচে থাকতে হতো তাদের। মালিকের দেওয়া ছোট্ট এক মাটির কুটিরে পরিবারসমেত বসবাস করতে হতো। দিনের পর দিন বৃষ্টিতে ভিজে অনাহারে দিনাতিপাত করতে হতো। পারিশ্রমিক হিসেবে দেওয়া হতো না কোনো অর্থ। টি-টোকেন নামক এক ধাতব পত্র দেওয়া হতো, যার মাধ্যমে শুধুমাত্র বাগানের মধ্যে নির্ধারিত দোকান থেকেই পণ্য কেনা যেত। বাগানের বাইরে এ টোকেনের কোনো মূল্য ছিল না। ফলে চাইলেই শ্রমিকরা বাইরে যেতে বা কিছু কিনতেও পারতেন না। তাদের জীবন বাঁধা পড়েছিল একটি চা বাগানের মধ্যে।

শ্রমিকদের টি-টোকেন প্রদান করছেন ব্রিটিশ ম্যানেজার, এই চিত্রই প্রকাশ করে শ্রমিকদের করুণ জীবন; Image source: wikimedia commons

কেউ পালিয়ে যেতে চাইলে বাগানমালিকদের লেলিয়ে দেওয়া বাহিনী খুঁজে বের করে আনত। এরপর চলত নির্মম নির্যাতন। বুটের লাথি, চাবুকের আঘাত এবং অজানা সব ভয়ঙ্কর শাস্তি দেওয়া হতো। এত কিছু সহ্য করেও দশকের পর দশক শ্রমিকরা সেখানে কাজ করেছেন। নারী-শিশু কেউই বাদ যেতেন না, হাড়ভাঙা পরিশ্রম করতে হতো সবাইকেই। এমনই করুণ জীবনযাপন করছিলেন সিলেট এবং আসামের লক্ষাধিক চা শ্রমিক।

১৯১৯ সালে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে ‘রাওলাট আইন’ পাশ হলো। ‌এ আইনের ফলে ভারতীয়দের অধিকার লঙ্ঘিত হলো। দেশীয়দের উপর ধরপাকড় ও জুলুম-নির্যাতনের পরিমাণ বেড়ে গেল। কোনো রকম ন্যায়-নীতির তোয়াক্কা না করে পুলিশ এবং সেনাবাহিনী ভারতীয়দের গণ-গ্রেফতার শুরু করে দিল এবং সম্পদ বাজেয়াপ্ত করতে থাকল। এরই পরিপ্রেক্ষিতে মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে শুরু হলো অসহযোগ আন্দোলন। সমগ্র ভারতবর্ষে এ আন্দোলনের ব্যাপক প্রভাব পড়ল। প্রভাব পড়ল আসাম এবং সিলেটের পাহাড়ে বন্দী চা শ্রমিকদের মাঝেও। শ্রমিকদের মধ্যে অসহযোগ আন্দোলনের প্রতিক্রিয়া বেশ লক্ষ্যণীয় ছিল, যা ব্রিটিশদের নজর এড়ায়নি।

অসহায় শ্রমিকদের কর্মচিত্র; Image source: Wikimedia Commons 

এরই মধ্যে সমগ্র ভারতের শ্রমিকরাও আন্দোলনের সাথে একাত্মতা পোষণ করে প্রতিক্রিয়া দেখাতে শুরু করে দিলেন। সমগ্র ভারতীয়দের মধ্যে স্বকীয়তা অনুভূত হলো, যেন এবার ব্রিটিশদের পরাধীনতার জিঞ্জির ছিঁড়ে বেড়িয়ে আসবেই।

১৯২১ সালের ঘটনা। ভারতবর্ষে ৭০ বছরের চা শিল্পের ইতিহাসে শ্রমিকরা তখন নির্যাতিত-নিপীড়িত অবস্থার চরম সীমায় পৌঁছে গেছে। এ অবস্থার সর্বশেষে সংযোজন ছিল মজুরি কমানো। টি-টোকেন বিলুপ্ত করে পরে শ্রমিকদের অত্যন্ত নিম্ন মজুরি নির্ধারণ করা হয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মন্দায় পড়ে শ্রমিকদের মজুরি আবারও কমিয়ে দিনপ্রতি তিন পয়সা করা হলো। চা শ্রমিকরা এটা মেনে নিতে পারেননি।

ভারতবর্ষের শ্রমিক আন্দোলনের প্রভাব পড়ল চা শ্রমিকদের মাঝেও। আসাম এবং সিলেট অঞ্চলের চা শ্রমিকদের মধ্যে চলছে তীব্র অসন্তোষ। বাগান মালিকদের সবধরনের নির্যাতন অগ্রাহ্য করতে তারা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। গোলামির শৃঙ্খল ছেড়ে দেশে এবার তারা ফিরবেনই। ব্রিটিশরা তাদের প্রলোভন দেখিয়ে বাগান বন্দিশালায় আটকে ফেলেছে, আর এ নির্যাতন সহ্য করবার নয়। জন্মভূমি বা ‘মুল্লুক’-এ এবার তারা ফিরবেনই। আন্দোলনের প্রতি পূর্ণ সমর্থন জ্ঞাপন করেছিলেন মহাত্মা গান্ধী।

করিমগঞ্জ থেকে ৩০ হাজার শ্রমিক পায়ে হেঁটে চাঁদপুরের উদ্দেশে যাত্রা করেন; Image source: nezine.com

শ্রমিকরা যখন দেশে ফিরবেন বলে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, তখন চা বাগান মালিকদের কারসাজিতে ধর্মঘট ডেকে বসল নৌপরিবহন এবং রেলওয়ে। শ্রমিকদের কোনো টিকেট দেয়া হলো না। বন্ধ করে দেওয়া হলো সব ধরনের যোগাযোগব্যবস্থা, যাতে করে শ্রমিকরা দেশে ফিরতে না পারেন। শ্রমিকরা যখন সবরকম চোখরাঙানি উপেক্ষা করে বাগান ছেড়ে বেরিয়ে এসেছেন, তখন বাগানমালিকরা ব্রিটিশ সরকারের সাথে ষড়যন্ত্রের ছক আঁকতে থাকল।

শ্রমিকরা যখন করিমগঞ্জ রেলস্টেশনে এসে পৌঁছলেন, তখন তাদের সাফ জানিয়ে দেওয়া হলো, তাদেরকে টিকিট দেওয়া হবে না। হতাশ এবং ক্ষুব্ধ শ্রমিকেরা বিভিন্ন বাগান থেকে দলে দলে স্লোগান দিয়ে একত্র হতে থাকলেন। বিশাল এ শ্রমিক সমাবেশ নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা মালিকদের ছিল না। ক্ষুব্ধ শ্রমিকরা সিদ্ধান্ত নিলেন, তারা পায়ে হেঁটেই দেশে ফিরবেন। আসাম থেকে ৩০ হাজার শ্রমিক করিমগঞ্জ, বদরপুর, কুলাউড়া, আখাউড়া রেলপথ ধরে পায়ে হেঁটে চলতে শুরু করলেন। দীর্ঘ এক সপ্তাহ পর ক্ষুধার্ত এবং অসহায় শ্রমিকরা পৌঁছলেন চাঁদপুর, মেঘনা ঘাটে। 

সেসময় চাঁদপুর মহকুমার প্রশাসক ছিলেন সুশীল কুমার সিংহ। প্রথমদিকে তিনি অবশ্য শ্রমিকদের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন। কিন্তু কিছুদিন পরেই চা বাগান কর্তৃপক্ষের প্রতিনিধি হিসেবে ম্যাকফারস এসে হাজির হলে পরিস্থিতি বদলে যায়। ১৯ মে জাহাজে উঠতে থাকা শ্রমিকদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে সশস্ত্র সৈন্যরা, যার নেতৃত্ব দেন সুশীল কুমার সিংহ। এ সময় জাহাজের পাটাতন সরিয়ে দেওয়া হয়। ফলে শত শত শিশু, বৃদ্ধ ও নারী মেঘনার জলে ভেসে যায়, যা এক রোমহর্ষক দৃশ্যের  অবতারণা করে।

চা শ্রমিকরা বছরের বছর পেয়েছে শুধু বঞ্চনা; Image Source: nezine com

কিন্তু নিষ্ঠুরতা তখনও বাকি। ‘বেয়াড়া’ শ্রমিকদের শায়েস্তা করতে এবার ব্রিটিশরা আরো গভীর ষড়যন্ত্র করে বসল। ২০ মে, ১৯২১ রাত্রে শ্রমিকদের চাঁদপুর স্টেশন থেকে যাত্রা করার কথা ছিল। কারণ অন্য কয়েকটি কোম্পানি স্টিমার চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। কিন্তু ব্রিটিশরা সন্ধ্যা থেকেই আশেপাশের জেলা থেকে বিপুল সংখ্যক পুলিশ এনে স্টেশন ঘিরে ফেলল। এদের মধ্যে অধিকাংশই ছিল গোর্খা সৈন্য। রাত গভীর হওয়ার পূর্বেই রেলকর্মীদের সরিয়ে নেওয়া হলো স্টেশন থেকে। তারপর রাত্রে হাজার হাজার শ্রমিক যখন প্লাটফর্মে নিদ্রামগ্ন ছিলেন, তখন ডিভিশনাল কমিশনার কিরণচন্দ্র দে’র নেতৃত্বে গোর্খা সৈন্যরা উন্মুক্ত বেয়নেট নিয়ে নারী, পুরুষ, শিশু নির্বিশেষে ঘুমিয়ে থাকা শ্রমিকদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল।

মাতৃক্রোড়ের শিশু থেকে শুরু করে স্ত্রী, পুরুষ, বৃদ্ধ কাউকেই বেয়নেট ও নির্বিচারে গুলির আঘাত থেকে রেহাই দেওয়া হলো না। অনেককে নদীতে নিক্ষেপ করে হত্যা করা হয়। শত শত লাশ মেঘনা নদীতে ভাসতে দেখা গেল। যে মেঘনার জল চা শ্রমিকদের রক্তে রঞ্জিত হয়েছিল, সেই মেঘনাপাড়ে এর কোনো স্মৃতিচিহ্ন বর্তমানে রাখা হয়নি, একটা স্মৃতিস্তম্ভও নয়।

মেঘনা পাড়ে এর কোনো স্মৃতিচিহ্ন বর্তমানে রাখা হয়নি, অস্থায়ী স্মৃতিস্তম্ভে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছেন বর্তমান চা শ্রমিকেরা; Image source: Jugantor.com

এরপর বাদবাকি শ্রমিকদের জোরপূর্বক ধরে নিয়ে যাওয়া হলো চা বাগানে। সেখানে চলল অমানুষিক নির্যাতন। তখন মহাত্মা গান্ধী বলে বসলেন, চা শ্রমিকদের আন্দোলনের প্রতি তার কোনো সমর্থন ছিল না। শ্রমিকরা যেন বাগানমালিকদের কথামতো কাজ করে। সেদিন এই চা শ্রমিকদের পক্ষে কেউ দাঁড়ায়নি। নির্মম এ হত্যাযজ্ঞের বিরুদ্ধে একটা কথা বলারও সাহস হয়নি বুলি আওড়ানো বর্ষীয়ান নেতাদের। কংগ্রেসের আহবানে শ্রমিকরা আন্দোলন গড়ে তুললেও শেষ পরিস্থিতিতে সর্বভারতীয় কংগ্রেস শ্রমিকদের পাশে ছিল না। শুধু তা-ই নয়, খোদ মহাত্মা গান্ধী কথা ঘুরিয়ে তখন বলতে থাকেন, 

শ্রমিকরা মালিকদের ছেড়ে চলে যাওয়ার ঘটনাকে নেতৃত্ব দিতে কেউ যদি আমার নাম নিয়ে থাকে, তাহলে আমি দুঃখিত। পুঁজি বা পুঁজিপতিদের বিরুদ্ধে কোনো অসহযোগিতা চলছে না। একটি ব্যবস্থা হিসেবে সরকারের বিরুদ্ধে অসহযোগিতা চলছে।

একমাত্র আসাম বেঙ্গল রেলওয়ের শ্রমিক সংগঠন এই হত্যাযজ্ঞের প্রতিবাদে ধর্মঘট ডেকে কর্মবিরতি পালন করে। তখন রেল কর্মচারী ইউনিয়নের সভাপতি ছিলেন দেশপ্রিয় যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত। ২৪ মে থেকে একটানা আড়াই মাস আসাম বেঙ্গল রেলওয়ে শ্রমিক ইউনিয়ন ধর্মঘট পালন করে। চা শ্রমিকদের সাথে রেল শ্রমিকদের কোনো স্বার্থসংশ্লিষ্টতা না থাকলেও শুধুমাত্র মানবিক কারণে চট্টগ্রামের পাহাড়তলীতে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। ধর্মঘটের কারণে রেলওয়ে কারখানা বন্ধ হয়ে যায়। কার্যত অচল হয়ে পড়ে সামগ্রিক অর্থনীতি। এ পরিস্থিতিতে ব্রিটিশরা শ্রমিকদের কোয়ার্টার ছেড়ে দেওয়ার আদেশ জারি করে এবং চট্টগ্রামে ১৪৪ ধারা জারি করে। 

এই হত্যাযজ্ঞের প্রতিবাদ জানানোর কারণে প্রায় ৫,০০০ রেলকর্মীকে চাকরিচ্যুত করা হয়। পরবর্তী সময়ে এই শ্রমিকদের আর খোঁজ রাখেনি কেউ। সর্বভারতীয় কংগ্রেস তো তখন দেশ ভাগ-বাটোয়ারা করতেই ব্যস্ত। শ্রমিকদের খোঁজ রাখার সময় কোথায় তাদের!

This is a Bengali Article. It's About Chargola Exodus or Mulluke Cholo.

Necessary references have been hyperlinked inside the article. 

Featured Image: Wikimedia Commons 

Related Articles