Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website. The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

মুসলিমদের কনস্টান্টিনোপল বিজয়ের গৌরবময় ইতিহাস

৩৩০ খ্রিস্টাব্দে রোমান সম্রাট কনস্টান্টিন বসফরাস প্রণালীর উপকূলে প্রতিষ্ঠা করেন কনস্টান্টিনোপল শহর। ৩৯৫ সালে রোমান সাম্রাজ্য দু’ভাগ হলে পূর্ব রোমান সাম্রাজ্যের নাম হয় বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য, যার রাজধানী হয় কনস্টান্টিনোপল। পশ্চিমে রোমের পতন হলেও পূর্বে রোমান সাম্রাজ্যের ধারক হিসেবে বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের পতাকাতলে টিকে ছিল কনস্টান্টিনোপল। কনস্টান্টিনোপল অনেকবার শত্রুদের আক্রমণের শিকার হলেও এগারো শতাব্দীর ইতিহাসে মাত্র একবারই এ শহর জয় করা সম্ভব হয়েছিল, ১২০৪ সালের চতুর্থ ক্রুসেডে।

প্রায় ত্রিকোণাকার এ শহরের উত্তরে বসফরাস প্রণালীর অংশ গোল্ডেন হর্ন, পূর্বে বসফরাস প্রণালীর মূল অংশ এবং দক্ষিণে মারমারা সাগর। এছাড়াও রয়েছে শহরকে ঘিরে রাখা অসংখ্য নগর প্রতিরক্ষা দেয়াল। এগুলোর মধ্যে রয়েছে থিওডেসিয়ান দেয়াল, যা প্রায় অজেয় এক নগর প্রতিরক্ষা দেয়াল। ফলে প্রাকৃতিকভাবেই নিরাপত্তা পেয়ে যেত কনস্টান্টিনোপল। মুসলিমরাও বেশ কয়েকবার চেষ্টা করেছে এ শহর বিজয়ের। শুরুটা হয়েছিল বেশ আগেই, ইয়াজিদের হাত ধরে। কিন্তু তার আক্রমণ থেমে গিয়েছিল শহরের প্রাচীরের কাছেই। উসমানীয় সুলতান বায়োজিদও চেষ্টা করেছিলেন এ শহর দখলের, কিন্তু ব্যর্থ হয়েছিলেন তিনিও।

কম্পিউটার গ্রাফিক্সে তৈরি করা এক সময়ের কনস্টান্টিনোপল; Source: reddit

এতো ব্যর্থতার পরেও উসমানীয় (অটোমান) সুলতান দ্বিতীয় মুহাম্মদ (তুর্কী ভাষায় মেহমেদ) সিদ্ধান্ত নেন কনস্টান্টিনোপল দখলের। ১৪৫১ সালে মাত্র ১৯ বছরে সিংহাসনে বসা সুলতানকে শুরুতে তার দেশের লোকেরাই খুব একটা পাত্তা দেয়নি, সেখানে আশেপাশের অন্য সাম্রাজ্যরা তাকে কোনো হুমকি হিসেবেই গণ্য করেনি। তাকে অবহেলা করার কারণও আছে। এর আগেও একবার সিংহাসনে বসেছিলেন তিনি। মাত্র বারো বছর বয়সে তার বাবা তাকে সিংহাসন ছেড়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু বহিঃশত্রুর আক্রমণের কারণে তিনি তার বাবাকে নির্দেশ দেন সিংহাসন ফিরিয়ে নিতে। এ কারণে অনেকেই তাকে দুর্বল ভাবত।

এ অবহেলার সুযোগটাই নেন সুলতান মুহাম্মদ। এছাড়াও সে সময় থেকে ইউরোপের রাজনৈতিক পরিস্থিতিও তাকে এ সিদ্ধান্ত নিতে উৎসাহ দিয়েছিল। ইউরোপের দুই পরাশক্তি ফ্রান্স আর ইংল্যান্ড নিজেদের মধ্যে যুদ্ধে লিপ্ত ছিল প্রায় একশ বছরেরও বেশি। এ যুদ্ধ ইতিহাসে ‘একশ বছরের যুদ্ধ’ নামে পরিচিত। এছাড়াও সে সময়ের অন্যান্য পরাশক্তি স্পেন, জার্মানি, পোল্যান্ড, হাঙ্গেরি নিজেদের বিভিন্ন যুদ্ধে জড়িত ছিল। এসব যুদ্ধের কারণে ইউরোপের সেনাবাহিনী বেশ দুর্বল হয়ে পড়েছিল। এর সুযোগ নিতে চেয়েছিলেন দ্বিতীয় মুহাম্মদ।

তৈলচিত্রে সুলতান দ্বিতীয় মুহাম্মদ; Source: Gentile Bellini

এক সময়ের প্রতাপশালী বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যও তার জৌলুশ হারিয়ে ফেলেছিল সে সময়ে। ল্যাটিন, সার্বিয়া, বুলগেরিয়ার কাছে রাজ্যের অনেক জায়গাই হাতছাড়া হয় বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের। তবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করেছিল উসমানীয় সাম্রাজ্যই। প্রায় সবদিক থেকে ঘিরে ফেলেছিল কনস্টান্টিনোপলকে। চতুর্দশ শতকের প্লেগে শহরের প্রায় অর্ধেক মানুষ মারা যায়। ফলে অর্থনৈতিক এবং সামরিক উভয় দিক থেকেই দুর্বল হতে থাকে বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য। সুলতান দ্বিতীয় মুহাম্মদ যখন সিংহাসনে বসেন তখন বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য বলতে টিকে ছিল শুধুমাত্র কনস্টান্টিনোপল শহর, মারমারা সাগরে প্রিন্স আইল্যান্ড এবং পেলোপন্সে।

১৪৫০ সালে কনস্টান্টিপোল ও এর চারপাশের ম্যাপ; Source: Wikimedia Commons

সুলতান মুহাম্মদ তাড়াহুড়ো করে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েননি। তিনি প্রতিটি পদক্ষেপ নিয়েছিলেন অল্প অল্প করে। এর মধ্যে ছিল ১৪৫২ সালে সুলতান মুহাম্মদ বসফরাসের পশ্চিম দিকে একটি দুর্গ নির্মাণের নির্দেশ দেয়া। এর আগে তার প্রপিতামহ প্রথম বায়োজিদ বসফরাসে একটি দুর্গ নির্মাণ করেছিলেন। তবে বায়োজিদের দুর্গ ছিল এশিয়ায় আর মুহাম্মদের দুর্গ ছিল ইউরোপে। দুর্গ দু’টি উসমানীয় সাম্রাজ্যকে বসফরাস প্রণালীর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ এনে দেয়। কারণ এই দুই দুর্গ এড়িয়ে বসফরাস প্রণালী পার করা সম্ভব ছিল না। ফলে সরাসরি যুদ্ধে জড়ানোর আগেই বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের অর্থনীতিতে আঘাত হানেন সুলতান। সে বছরের অক্টোবরেই সুলতান তুরাখান বেগকে পেলোপন্সে বিশাল সেনাবাহিনী নিয়ে যাবার নির্দেশ দেন, যাতে পেলোপন্সে কনস্টান্টিনোপল শহরে কোনো সাহায্য পাঠাতে না পারে।

সেসময় বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের সিংহাসনে ছিলেন একাদশ কন্সটানটিন। তিনি সহজেই মুহাম্মদের চাল বুঝতে পারেন। ক্রমেই ছোট হয়ে আসা বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের কফিনে শেষ পেরেক পড়ার ভয়ে সম্রাট সাহায্য চান পশ্চিমে ইউরোপের দেশগুলোর কাছে। কিন্তু কয়েক শতাব্দী ধরে চলে আসা শত্রুতা এবং পূর্বের অর্থোডক্স চার্চ ও পশ্চিমের ক্যাথোলিক চার্চের দ্বন্দ্ব বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় ঐক্যবদ্ধ সাহায্য পাবার পথে। শেষ পর্যন্ত কোনো উপায় না পেয়ে পূর্ব অর্থোডক্স চার্চ রাজি হয় পশ্চিমের ক্যাথোলিক চার্চের সাথে একতাবদ্ধ হবার ব্যাপারে। পোপের কাছে প্রস্তাবও পাঠায় এ ব্যাপারে।

বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য ভেবেছিল ইউরোপের অন্যান্য দেশের উপরে পোপের ভালো নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। কিন্তু তাদের ধারণা ছিল ভুল। নিজেদের মধ্যে যুদ্ধ করে দুর্বল হয়ে যাওয়া দেশগুলো বাইরের কোনো দেশের জন্য যুদ্ধ করতে সহজে রাজি হয়নি। শেষে পোপ পুরো ব্যাপারটিকে ধর্মযুদ্ধের মতো করে দেখানোয় মুসলিমদের থামাতে একতাবদ্ধ হয় খ্রিস্টান সেনাবাহিনী। ইউরোপের বিভিন্ন জায়গা থেকে কিছু সাহায্য পেতে থাকে বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য, তবে একেবারেই নগন্য। অনেকে নিজ উদ্যোগে ২০০-৪০০ জনের বাহিনী নিয়ে যোগ দেয় কন্সটান্টিপোল রক্ষার জন্য। এদের মধ্যে ছিলেন জেনোয়া থেকে আসা জিওভানি জিউসটিনিয়ানি। নগর রক্ষা দেয়াল প্রতিরক্ষার ব্যাপারে তিনি বেশ অভিজ্ঞ ছিলেন। ১৪৫৩ সালের জানুয়ারিতে তিনি শহরে পৌঁছানোর পরেই দেয়াল প্রতিরক্ষার মূল সেনাপতি হিসেবে নিয়োগ পান।

ভেনিস আনুষ্ঠানিকভাবে কন্সটান্টিনকে সাহায্য করার ব্যাপারে কোন সিদ্ধান্ত না নিলেও গোল্ডেন হর্নে অবস্থান করা ভেনিসিয়ান নাবিকরা শহর রক্ষার জন্য সম্রাটের পক্ষে অবস্থান নেয়। মার্চের শেষের দিকে পোপের নির্দেশে তিনটি জাহাজ যাত্রা করে কন্সটান্টিনোপল রক্ষার জন্য। ভেনিস শেষ পর্যন্ত কন্সটান্টিনোপলকে সাহায্যের সিদ্ধান্ত নেয়। ভেনিস ফেব্রুয়ারিতে নৌবাহিনী পাঠাতে চাইলেও বিভিন্ন কারণে দেরি হওয়াতে নৌবাহিনীর যাত্রা শুরু হয় এপ্রিলে। নৌ আক্রমণ প্রতিরোধের জন্য সম্রাট কন্সটান্টিন পোতাশ্রয়ের মুখে কাঠের গুড়ি দিয়ে প্রতিরক্ষা চেইন নির্মাণ করেন। স্থলপথে ওসমানীয় বাহিনীকে আটকানোর জন্য দেয়াল মেরামতের কাজও শুরু করা হয়।

কন্সটান্টিপোল দখলের জন্য ওসমানীয় বাহিনীর অবস্থান; Source: Sémhur

ওসমানীয়দের সেনাবাহিনী ছিল অনেক বড়, প্রায় পঁচাত্তর হাজার থেকে এক লক্ষের মতো সেনাসদস্য ছিলো তাদের। অন্যদিকে বাইজেন্টাইনদের সেনাবাহিনী ছিল অনেক ছোট, মাত্র আট হাজার জনের মতো। বাইজেন্টাইনদের সবচেয়ে বড় সুবিধা ছিল তাদের প্রায় অজেয় প্রতিরক্ষা দেয়াল। তবে দুশ্চিন্তার কারণও ছিল তাদের, কেননা অরবান নামক এক প্রকৌশলীর তৈরি করা এক বিশাল কামান। মজার ব্যাপার হলো, ধর্মযুদ্ধের রূপ নেয়া এ যুদ্ধে এই কামানের বেশ বড় ভূমিকা ছিল, যা তৈরি করেছিল এক খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী। এই কামান কন্সটান্টিনোপলের দেয়ালের জন্য ছিল এক বড় হুমকি। মারমারা সাগরে ওসমানীয়দের বিশাল নৌবাহিনীও প্রস্তুত ছিল জলপথে আক্রমণের জন্য। বসফরাস প্রণালীর উপকূলে দু’টি দুর্গ বাইজেন্টাইনদের নৌপথে চলাচল সীমিত করে দিয়েছিল।

১৪৫৩ সালের ১ এপ্রিল থেকে ওসমানীয় সেনাবাহিনী কন্সটান্টিনোপলের চারিদিকে অবস্থান নেয়া শুরু করে। চারদিন পর ৫ এপ্রিল সুলতান দ্বিতীয় মুহাম্মদ যোগ দেন সেনাবাহিনীর সাথে এবং ঠিক পরের দিন অর্থাৎ ৬ এপ্রিল শুরু হয় কন্সটান্টিপোল দখলের যুদ্ধ। শুরুতেই শহরের বাইরে থাকা বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের শক্তিশালী চৌকিগুলো দখল করে নেয় ওসমানীয় বাহিনী। এরপরই ওসমানীয় বাহিনী নগর থিওডেসিয়ান দেয়ালে কামানের গোলা বর্ষণ শুরু করে। কিন্তু কামানের দু’টি গোলা নিক্ষেপের মধ্যবর্তী সময় ছিল তিন ঘন্টার মতো। ফলে একবার গোলা বর্ষণে যে ক্ষতি হতো, বাইজেন্টাইনরা সহজেই সেই ক্ষতি মেরামত করে ফেলতো। ফলে ওসমানীয় সাম্রাজ্য বলার মতো কোনো সাফল্যের মুখ দেখেনি প্রথম কয়েকদিনে।

অন্যদিকে জলপথে সুলাইমান বাল্টোঘলুর নেতৃত্বাধীন ওসমানীয় সাম্রাজ্যের নৌবাহিনী ছিল বিপর্যস্ত। গোল্ডেন হর্নে দেয়া চেইনের কারণে তারা বেশিদূর এগোতে পারেনি। সবচেয়ে লজ্জাজনক ছিল যখন ২০ এপ্রিল বাইজেন্টাইন সাম্রাজকে সাহায্য করার জন্য আসা চারটি জাহাজ প্রায় একশটি ওসমানীয় জাহাজকে বোকা বানিয়ে লক্ষ্যস্থলে পৌঁছে যায়। কিন্তু নৌবাহিনীকে গোল্ডেন হর্নে পৌঁছানোর ব্যাপারে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ সুলতান মুহাম্মদ নির্দেশ দেন জাহাজের তলদেশে কাঠের গুড়ি লাগিয়ে স্থলপথে ঘুরিয়ে গোল্ডেন হর্নে নিয়ে যাবার। অমানবিক পরিশ্রমের পর ওসমানীয় নৌবাহিনী চেইনের পেছনের জলপথে পৌঁছায়। ২৮ এপ্রিল সম্রাট কন্সটান্টিন এই নৌবাহিনীকে আক্রমণের জন্য নৌবাহিনী পাঠান। কিন্তু আগে থেকেই খবর পেয়ে যাওয়ায় ওসমানীয় নৌবাহিনী ছিল প্রস্তুত। ফলে সহজেই বাইজেন্টাইন নৌবাহিনীকে পরাজিত করে গোল্ডেন হর্নে। ফলে গোল্ডেন হর্নের দিকে দেয়াল রক্ষার জন্য সম্রাট কন্সটান্টিনকে নতুন করে লোক নিয়োগ দিতে হয়।

শিল্পীর তুলিতে কন্সটান্টিনোপলের যুদ্ধ; Source: Weapons and Warfare

অন্যদিকে থিওডেসিয়ান দেয়ালে কামানের গোলা বর্ষণে কোন কাজ না হওয়ায় সুলতান নতুন পদক্ষেপ নেন। জাগানোস পাশা এবং সার্বিয়ান সৈন্যদের নেতৃত্বে সুড়ঙ্গ তৈরি করা শুরু হয়। উদ্দেশ্য ছিল সুড়ঙ্গ দিয়ে সেনা নিয়ে দেয়াল না ভেঙেই মূল শহরে আক্রমণ করা। ওসমানীয়দের নতুন কৌশল ধরতে পেরে বাইজেন্টাইন প্রকৌশলী জোহানসন গ্রান্ট পাল্টা আক্রমণ করেন। ১৮ মে গ্রান্টের নেতৃত্বে প্রথম সুড়ঙ্গ দখল করে বাইজেন্টাইনরা। এরপর ২১ এবং ২৩ মে আরো দু’টি সুড়ঙ্গের পাশাপাশি দুইজন ওসমানীয় অফিসারকে গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয় তারা। অত্যাচার করে তাদের কাছ থেকে অন্যান্য সুড়ঙ্গের অবস্থান জেনে সবগুলো ধ্বংস করে দেয় ২৫ মে। ফলে ওসমানীয়দের এই পরিকল্পনাও নস্যাৎ হয়ে যায়।

দীর্ঘদিন ধরে কোনো সফলতা না পাওয়ায় ওসমানীয় বাহিনী একদিকে মানসিকভাবে ভেঙে পড়ছিল, অন্যদিকে গ্রান্টের সাফল্য পাবার পরেও বাইজেন্টাইনরাও মানসিকভাবে ভেঙে পড়ছিল। ভেনিস থেকে সাহায্য আসা সম্ভব না ততোদিনে বুঝে গিয়েছিল তারা। এছাড়াও ২৬ মে ঘন কুয়াশা শহরের অনেকের মনে বিভিন্ন কুসংস্কারের জন্ম দেয়। শহরের অনেকেই ধরে নেয় হাজিয়া সোফিয়া থেকে পবিত্র আত্মার চলে যাওয়া লুকাতেই এই কুয়াশা হয়েছিল।

অন্যদিকে ক্লান্ত, বিধ্বস্ত সুলতান মুহাম্মদ ২৬ মে রাতে তার সেনাপতিদের সাথে আলোচনায় বসেন। সিদ্ধান্ত হয় ২৮ মে রাতে বিশ্রাম এবং নামাজের পর বড় একটি আক্রমণ চালানো হবে। ২৮ মে মাঝরাতের পর পর ওসমানীয় বাহিনী আক্রমণ শুরু করে। প্রথমদিকে কিছু সাফল্য পাবার পর ওসমানীয়দের এলিট ফোর্স জ্যানিসারিরা যোগ দেয় আক্রমণে। কিন্তু জিওভানি জিউসটিনিয়ানির নেতৃত্বে তাদের আটকে রাখে বাইজেন্টাইন সেনারা।

শিল্পীর তুলিতে কন্সটান্টিনোপলের যুদ্ধ; Source: Weapons and Warfare

ওসমানীয় বাহিনীর আক্রমণে জিউসটিনিয়ানি আহত হলে তার শুশ্রুষার জন্য তাকে শহরের ভেতরে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপরই প্রতিরক্ষা দুর্বল হতে থাকে বাইজেন্টাইনদের। ওসমানীয়রা বাইজেন্টাইনদের প্রতিরক্ষা ভেদ করে ধীরে ধীরে ভেতরে প্রবেশ শুরু করে। দক্ষিণ দিকে সম্রাট কন্সটান্টিন নিজেই দেয়াল প্রতিরক্ষায় নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। কিন্তু উত্তর দিকের একটি প্রবেশদ্বার ওসমানীয়রা খুলে ফেলায় তিনি চাপে পড়ে পিছিয়ে যেতে থাকেন। একই সময়ে ওসমানীয়রা আরো কিছু প্রবেশদ্বার খুলে দলে দলে শহরে ঢুকে পড়তে থাকে। সম্রাট কন্সটান্টিনের ভাগ্যে শেষ পর্যন্ত কি হয়েছিল তা জানা না গেলেও, ধারণা করা হয় ওসমানীয় বাহিনীকে শেষবারের মতো আটকে দেবার প্রচেষ্টায় মারা যান তিনি।

বাইজেন্টাইনদের প্রায় চার হাজার সেনা মারা যায়, অন্যদিকে ওসমানীয়দের হতাহতের সংখ্যা জানা যায়নি। দীর্ঘদিন অজেয় থাকা কন্সটান্টিনোপল শহর ১৪৫৩ সালের ২৯ মে দখল করে নেয় ওসমানীয় সাম্রাজ্য। আসল রোমের পতন ঘটলেও রোমান সাম্রাজ্যের জৌলুশের ছায়া হয়ে থাকা বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যেরও পতন ঘটে সেদিন। হাজার বছর ধরে চলে আসা রোমান সাম্রাজ্যের পতনের সাক্ষী হয়ে থাকে ওসমানীয় বাহিনীর এ বিজয়।

মুসলিমদের কাছে যা কন্সটান্টিনোপল বিজয়, খ্রিস্টানদের কাছে তা ছিল কন্সটান্টিনোপলের পতন। সেসময় পোপ ওসমানীয়দের বিরুদ্ধে ধর্মযুদ্ধের ডাক দিয়ে কন্সটান্টিনোপল ফিরে পাবার আহ্বান জানান। কিন্তু ইউরোপের কেউই কোনো আগ্রহ দেখায়নি কন্সটান্টিপোল ফিরে পাওয়ার ব্যাপারে। সুলতান দ্বিতীয় মুহাম্মদ ওসমানীয় সাম্রাজ্যের রাজধানী প্রতিষ্ঠা করেন কন্সটান্টিনোপলে। প্রাচীন এ শহরকে কেন্দ্র করেই ওসমানীয় সাম্রাজ্য পরবর্তীতে বিস্তৃত করে তাদের সাম্রাজ্য। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে পরাজয়ের মাধ্যমে পতন ঘটে এই ওসমানীয় সাম্রাজ্যের।

ওসমানীয়দের এই বিজয় ইউরোপের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে। এশিয়ার সাথে সরাসরি বাণিজ্যের পথ হারায় ইউরোপিয়ানরা। ফলে তারা পূর্ব দিক দিয়ে ভারত কিংবা চীনে যাবার রাস্তা খুঁজতে থাকে। সেগুলো আবার জন্ম দেয় নতুন সব অভিযানের। মাত্র একুশ বছর বয়সে প্রায় অজেয় এক শহর দখল করে সুলতান দ্বিতীয় মুহাম্মদ উপাধি পান ‘মুহাম্মদ আল-ফাতিহ’ বা ‘বিজয়ী’। এই বিজয়ী সুলতানকে নিয়ে নবী মুহাম্মদ (সা) অনেক আগেই ভবিষ্যৎবাণী করে গিয়েছিলেন,

তোমরা (মুসলিমরা) অবশ্যই কন্সটান্টিনোপল বিজয় করবে। কতোই না অপূর্ব হবে সেই বিজয়ী সেনাপতি, কতোই না অপূর্ব হবে তার সেনাবাহিনী”। (আহমাদ আল-মুসনাদ ১৪:১৩১)

ফিচার ইমেজ- Wikimedia Commons

Related Articles