Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

ইউফও’র সাক্ষাৎ পাওয়া পাইলটের নিরুদ্দেশের আসল রহস্য

ফ্রেডেরিক ভ্যালেন্টিচ ছিলেন একজন অস্ট্রেলিয়ান পাইলট, যিনি ১৯৭৮ সালের ২১ অক্টোবর রাত্রিবেলা প্লেন চালাতে গিয়ে প্লেন সহ নিখোঁজ হয়ে গিয়েছিলেন। তার নিরুদ্দেশের ঘটনাটি রহস্যমণ্ডিত, ষড়যন্ত্র তত্ত্বে আচ্ছাদিত এবং আজপর্যন্ত অমীমাংসীত। নিখোঁজ হওয়ার আগে সর্বশেষ তিনি দাবি করেছিলেন যে, তিনি রহস্যজনক মহাকাশযান ইউএফও (UFO– Unidentified Flying Object) দেখতে পেয়েছিলেন। কিন্তু আসলেই কি তাই?

কে এই ফ্রেডেরিক?

পাইলট ফ্রেডরিক ভ্যালান্টিচ; Source: unsolvedmysteries.wikia.com

ফ্রেডেরিক ভ্যালেন্টিচ পাইলট হিসেবে খুব বেশি অভিজ্ঞ ছিলেন না। ১৯৭৮ সালে তার বয়স ছিল মাত্র ২০ বছর। তার ১৫০ ঘণ্টা আকাশে ওড়ার অভিজ্ঞতা ছিল। যথেষ্ট দক্ষতা না থাকায় কেবলমাত্র আকাশ এবং আবহাওয়া অত্যন্ত পরিস্কার থাকলেই তার রাত্রিবেলা প্লেন চালানোর অনুমতি ছিল। তিনি দু’বার রয়্যাল অস্ট্রেলিয়ান এয়ারফোর্সে (RAAF) ভর্তি হওয়ার জন্য আবেদন করেছিলেন, কিন্তু যথেষ্ট শিক্ষাগত যোগ্যতা না থাকায় তার আবেদন নাকচ হয়ে যায়।

এয়ারফোর্সে ভর্তি হতে না পেরে এয়ার ট্রেনিং কোরের সদস্য হিসেবে ফ্রেডেরিক বাণিজ্যিক প্লেনের পাইলট হওয়ার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। কিন্তু একাধিকবার তিনি বাণিজ্যিক লাইসেন্স প্রাপ্তির পরীক্ষায় অকৃতকার্য হন। এছাড়াও প্রশিক্ষণকালে একবার সিডনির সুরক্ষিত এলাকায় বিক্ষিপ্তভাবে প্লেন নিয়ে বিচরণ করায় এবং একাধিকবার ইচ্ছাকৃতভাবে মেঘের ভেতর প্রবেশ করায় তাকে সতর্ক করা হয়েছিল এবং তার বিরুদ্ধে আইনী ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও বিবেচনা করা হচ্ছিল।

ফ্রেডেরিকের শেষ বিমান যাত্রা

প্লেনের পাশে দাঁড়ানো ফ্রেডেরিক; Source: medium.com

১৯৭৮ সালের ২১ অক্টোবর সন্ধ্যা ৬টা ১৯ মিনিটে ফ্রেডেরিক অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন থেকে কিংস আইল্যান্ড পর্যন্ত ১২৫ মাইল ট্রেনিং ফ্লাইটের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। তার প্লেনটি ছিল এক ইঞ্জিন বিশিষ্ট সেসনা ১৮২-এল প্লেন। এটি ছিল ফ্রেডেরিকের রাত্রিকালীন দ্বিতীয় ফ্লাইট।

যাত্রা শুরুর প্রায় পৌনে এক ঘণ্টা পর, সন্ধ্যা ৭টা ৬ মিনিটে ফ্রেডেরিক মেলবোর্নের এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলারের সাথে রেডিওতে যোগাযোগ করেন এবং জানান যে, একটি প্লেন ১,৪০০ মিটার উচ্চতা দিয়ে তার পিছু ধাওয়া করছে। তিনি জানতে চান, ঐ এলাকা দিয়ে ঐ উচ্চতায় অন্য কোনো প্লেনের যাতায়াত করার কথা আছে কিনা। কিন্তু দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা তাকে অবাক করে দিয়ে জানায় যে, সেই সময়ে আকাশে কোনো প্লেন যাতায়াত করার কথা নেই।

ফ্রেডেরিকের প্লেন এবং রহস্যময় মহাকাশ যানের কাল্পনিক চিত্র; Source: pinterest.com

পরবর্তী পাঁচ মিনিট ধরে ফ্রেডেরিকের সাথে ট্রাফিক কন্ট্রোলার কর্মকর্তার কথপোকথন থেকে জানা যায়, বেশ বড় আকৃতির একটি অজানা মডলের প্লেন ফ্রেডেরিকের চেয়েও আরো ৩০০ মিটার উপর দিয়ে অত্যন্ত দ্রুতগতিতে উড়ছিল। প্লেনটির চারপাশে চারটি উজ্জ্বল ল্যান্ডিং লাইট ছিল। ফ্রেডেরিক জানান, প্লেনটি তাকে কেন্দ্র করে চারপাশে ঘুরছিল। তার ধারণা হয়, সম্ভবত এটি তার সাথে কোনো ধরনের খেলা খেলছিল।

ফ্রেডেরিক প্লেনটিকে পরিচিত কোনো মডেলের সাথে মেলাতে পারেননি। তিনি শুধু বলেন, এর কাঠামোটি চকচকে ধাতুর তৈরি এবং এতে সবুজ রংয়ের আলো ছিল। কিছুক্ষণ পর ফ্রেডেরিক অভিযোগ করেন, তার প্লেনের ইঞ্জিনে সমস্যা হচ্ছে, ইঞ্জিন বারবার বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হচ্ছে। ট্রাফিত কন্ট্রোলার যখন আবারও প্লেনটির বর্ণনা জানতে চান, ফ্রেডেরিক জানান, এটি কোনো প্লেন না, ধাতব কাঠামোর অন্য কোনো যান। এর পরপরই ফ্রেডেরিকের সাথে সকল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।

অনুসন্ধান এবং তদন্ত

পত্রিকায় ফ্রেডেরিকের নিঁখোজ সংবাদ; Source: abc.net.au

ফ্রেডেরিকের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ায় রেডিও কর্মকর্তারা ধরে নেন যে, ফ্রেডেরিকের প্লেনটি বিধ্বস্ত হয়েছে। পরবর্তী চার দিন ধরে রয়্যাল অস্ট্রেলিয়ান এয়ারফোর্সের একটি প্লেন, আটটি বেসামরিক প্লেন, সমুদ্রগামী একাধিক জাহাজ মিলে প্রায় ১,৭০০ বর্গ কিলোমিটার স্থল এবং জলপথ জুড়ে অনুসন্ধান কার্যক্রম পরিচালনা করে। কিন্তু ফ্রেডেরিক বা তার প্লেনের কোনো চিহ্ন পাওয়া যায়নি। অক্টোবরের ২৫ তারিখে অনুসন্ধান কার্যক্রমের সমাপ্তি ঘোষণা করা হয়।

অস্ট্রেলিয়ার ডিপার্টমেন্ট অফ ট্রান্সপোর্ট ঘটনাটির তদন্ত করে, কিন্তু তদন্তে তারা নিখোঁজ হওয়ার কোনো ব্যাখ্যা দিতে ব্যর্থ হয়। প্রায় পাঁচ বছর পর নিকটবর্তী একটি দ্বীপে একটি প্লেনের ইঞ্জিনের ঢাকনার একটি অংশ ভেসে ওঠে। তদন্ত কর্মকর্তারা অনুসন্ধানের পর জানতে পারেন, এটির সাথে নিখোঁজ হওয়া ফ্রেডেরিকের প্লেনের ইঞ্জিনের সিরিয়াল নাম্বারের মিল আছে। কিন্তু ফ্রেডেরিকের প্লেনটি কীভাবে বিধ্বস্ত হয়েছিল, আজ পর্যন্তও তার সমাধান হয়নি।

বিভিন্ন তত্ত্ব এবং সম্ভাব্য ব্যাখ্যা

ফ্রেডেরিকের যাত্রাপথ; Source: Wikimedia Commons

ফ্রেডেরিক ভ্যালেন্টিচের নিঁখোজ হওয়ার রহস্যকে বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করা হয়েছে। একটি ব্যাখ্যা হলো, ফ্রেডেরিক নিজেই ইচ্ছে করে নিঁখোজ হওয়ার নাটক সাজিয়ে অন্যত্র অবতরণ করেছেন। কিন্তু তার প্লেনে থাকা জ্বালানীর উপর নির্ভর করে তার পক্ষে যতদূর পর্যন্ত যাওয়া সম্ভব, সেসব এলাকার রাডারে সেদিন অজানা কোনো প্লেনের অস্তিত্ব ধরা পড়েনি। কেউ কেউ ধারণা করেন, ফ্রেডেরিক হয়তো আত্মহত্যা করেছিলেন। কিন্তু তার পরিচিত জনেরা এবং ডাক্তাররা এই সম্ভাবনা নাকচ করে দিয়েছেন। এছাড়া আত্মহত্যা করলে তিনি অন্য রহস্যময় যান দেখার কথা কেন দাবি করবেন, তারও কোনো যুক্তি নেই।

আরেকটি তত্ত্ব হচ্ছে, ফ্রেডেরিক মানসিকভাবে বিচলিত হয়ে প্লেনটিকে উল্টো অবস্থায় চালাচ্ছিলেন। এর ফলে সমুদ্রের পানিতে তার নিজের প্লেনের লাইটগুলোর প্রতিফলন দেখেই তার কাছে মনে হচ্ছিল, অন্য কোনো যান তাকে ধাওয়া করছে এবং উল্টো চালাতে গিয়েই একসময় তার প্লেন পানিতে বিধ্বস্ত হয়।

ঘটনার দিন রয় ম্যানিফোল্ডের তোলা ছবি, যেটি ইউএফওর ছবি বলে দাবি করা হয়; Source: unsolvedmysteries.wikia.com

ফ্রেডেরিকের নিখোঁজ হওয়ার ব্যাপারটি ইউএফও বিশ্বাসীদের মধ্যে বেশ আগ্রহ সৃষ্টি করে। তারা দাবি করতে থাকে, এলিয়েনরা তাকে ইউএফওতে করে নিয়ে চলে গেছে। পরবর্তী সময় অনেকে সেদিনের আকাশে ইউএফও দেখা গিয়েছিল বলেও দাবি করেন। রয় ম্যানিফোল্ড নামে একজন চিত্রশিল্পী একটি ছবি হাজির করেন, তার দাবি অনুযায়ী ছবিটি ঘটনার দিন তোলা এবং এতে আকাশে অদ্ভুত একটি বস্তুর অস্তিত্ব ধরা পড়ে। যদিও অনেকে সন্দেহ করে, ওটা আসলে ছবি তোলার সময়ের যান্ত্রিক ত্রুটি থেকে সৃষ্ট দাগ।

তবে ২০১৩ সালে এই রহস্যময় ঘটনার অত্যন্ত চমৎকার একটি ব্যাখ্যা দিয়েছেন অবসরপ্রাপ্ত মার্কিন পাইলট এবং জ্যোতির্বিদ জেমস ম্যাকগাহা এবং লেখক জো নিকেল। তারা সে সময়ের আকাশে গ্রহ-নক্ষত্রের অবস্থান দেখিয়ে ব্যাখ্যা করেন যে, ফ্রেডেরিক যে চারটি লাইটের কথা বলছিল, সেগুলো হতে পারে সেদিনের আকাশে থাকা চারটি অত্যন্ত উজ্জ্বল তারকা। তাদের হিসেব অনুযায়ী, সেদিনের আকাশে শুক্র, মঙ্গল এবং বুধ গ্রহ এবং আন্তারেস নামক তারকা অবস্থা কাছাকাছি অবস্থান করছিল, যেগুলোর প্রতিটি ছিল অত্যন্ত উজ্জ্বল।

ম্যাগাজিনে ফ্রেডেরিকের সংবাদ; Source: abovetopsecret.com

তাদের মতে, ফ্রেডেরিক হয়তো সেগুলোকে কাছাকাছি দেখে কোনো মহাকাশযানের আলো বলে ভুল করেছিলেন। এই দৃষ্টিভ্রমের ফলে তিনি আতঙ্কিত হয়ে পড়েন এবং দিকভ্রান্ত হয়ে সর্পিল আকৃতিতে প্লেন নিয়ে ঘুরপাক খেতে থাকেন। ফলে তার কাছে মনে হতে থাকে মহাকাশযানটি তাকে চক্রাকারে ধাওয়া করছে। এভাবেই একসময় তিনি প্লেন নিয়ে বিধ্বস্ত হন।

তবে যে কারণেই দুর্ঘটনাটি ঘটুক না কেন, ফ্রেডেরিক কেন অদ্ভুত কোনো যান দেখেছিলেন বলে দাবি করেছিলেন, তার ব্যাখ্যা পাওয়া যায় তার বাবার বর্ণনা থেকে। তার বাবা জানান, ফ্রেডেরিক ইউএফও নিয়ে খুবই আগ্রহী ছিলেন। তিনি এ বিষয়ে পত্র-পত্রিকার প্রবন্ধ সংগ্রহ করে রাখতেন, এ সংক্রান্ত চলচ্চিত্র দেখতেন এবং নিজেও একবার একটি ইউএফও দেখেছিলেন বলে দাবি করেছিলেন। তাই সম্ভাবনা আছে, সেদিন হয়তো অলৌকিক কিছুই ঘটেনি। হয়তো তিনি খুব স্বাভাবিক কিছুই দেখেছিলেন, কিন্তু যেহেতু তিনি ইউএফও নিয়ে অতিরিক্ত আগ্রহী ছিলেন, সেগুলোর অস্তিত্বে বিশ্বাস করতেন এবং সেগুলোকে দেখতে চাইতেন, তাই সেই স্বাভাবিক কিছুকেই তিনি ইউএফও বলে ভুল করেছিলেন। ইউএফও’র প্রতি অতিরিক্ত আগ্রহই হয়তো শেষ পর্যন্ত তার মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল।

ফিচার ইমেজ- ihdimages.com

Related Articles