Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পাওয়া মুসলিম ব্যক্তিবর্গ

নোবেল শান্তি পুরস্কার একটি বিতর্কিত পুরস্কার। অনেক সময়ই তা দেওয়া হয় রাজনৈতিক বিবেচনায়। তাছাড়া শান্তি যেহেতু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই যুদ্ধের বিপরীতে হয়, তাই স্বভাবতই যুদ্ধের মতোই শান্তিও একটি বিতর্কিত বিষয়। একই যুদ্ধে সমঝোতা স্থাপনকারী একপক্ষের কাছে পরিচিতি পায় শান্তির দূত হিসেবে, অন্যপক্ষের কাছে পরিচিতি পায় বিশ্বাসঘাতক হিসেবে। তবে এর মধ্যেও কেউ কেউ সত্যি সত্যিই যোগ্যতার কারণ নোবেল পুরস্কার পেয়ে থাকেন।

মুসলমানদের মধ্যে নোবেল পুরস্কার বিজয়ীর সংখ্যা খুবই কম। এখন পর্যন্ত মাত্র ১২ জন মুসলমান এ পুরস্কার পেয়েছেন, যাদের মধ্যে ৭ জনই পেয়েছেন শান্তিতে। চলুন জেনে নেওয়া যাক, কারা সেই শান্তিতে নোবেল বিজয়ী মুসলমানরা, এবং কী অবদানের জন্য তারা এ পুরস্কার পেয়েছেন।

আনোয়ার সাদাত (১৯৭৮)

আনোয়ার সাদাত © Kevin Fleming

আনোয়ার সাদাত অত্যন্ত বিতর্কতি এক মিসরীয় প্রেসিডেন্ট, যিনি ইসরাইলের সাথে শান্তিচুক্তি করার কারণে ১৯৭৮ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কার পেয়েছিলেন। সাদাতের পুরো নাম মোহাম্মদ আনোয়ার আল-সাদাত। জন্ম ১৯১৮ সালে, মিসরের আল-মিনুফিয়া প্রদেশে। তিনি ছিলেন মিসরের তৃতীয় প্রেসিডেন্ট। ১৯৭০ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে ১৯৮১ সাল সেনা অভ্যুত্থানে মৃত্যু বরণ করার পূর্ব পর্যন্ত তিনি মিসরের রাষ্ট্র ক্ষমতায় ছিলেন।

আনোয়ার সাদাত ছিলেন মিসরীয় সেনা কর্মকর্তা। তিনি ১৯৫০ সালে জামাল আব্দুল নাসেরের ফ্রি অফিসার্স মুভমেন্টে যোগদান করেন। ১৯৫২ সালে মিসরের রাজা ফারুকের বিরুদ্ধে নাসেরের নেতৃত্বে সংঘটিত সামরিক অভ্যুত্থানে তিনি সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন নাসেরের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। নাসের প্রেসিডন্ট থাকা অবস্থায় তিনি ভাইস প্রেসিডেন্ট সহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেন।

ইসরাইলের বিরুদ্ধে ইওম কিপুর যুদ্ধে নেতৃত্বে দেওয়ার সময় সাদাত; Source: npr.org

১৯৭০ সালে নাসেরের মৃত্যুর পর ভাইস প্রেসিডন্টের দায়িত্বে থাকা সাদাত অস্থায়ী প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং পরবর্তীতে হ্যাঁ-না ভোটে জয়ী হয়ে প্রেসিডেন্ট হন। ১৯৭৩ সালে সাদাত সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট হাফেজ আল-আসাদের সাথে মিলে ইসরায়েরেলের কাছ ১৯৬৭ সালে হারানো সিনাই উপদ্বীপ এবং গোলান মালভূমি পুনরুদ্ধারের জন্য অভিযান শুরু করেন, যা ইতিহাসে ইওম কিপুর যুদ্ধ নামে পরিচিত। এই যুদ্ধে প্রথম দিকে তিনি বেশ সাফল্যও অর্জন করেন।

তবে যুদ্ধের পর সাদাত সিনাই উপদ্বীপের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ পাওয়ার জন্য ইসরায়েলের সাথে শান্তি আলোচনা শুরু করেন। মুসলিম বিশ্বের প্রচণ্ড প্রতিবাদের মুখেও ১৯৭৭ সালে তিনি ইসরাইল ভ্রমণ করেন, ইসরাইলি সংসদ নেসেটে ভাষণ দেন এবং পারস্পরিক কূটনৈতিক সম্পর্কের ব্যাপারে উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তার উদ্যোগে এবং মার্কিন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টারের মধ্যস্থতায় ১৯৭৮ সালে সাদাত এবং ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেগিনের মধ্যে ঐতিহাসিক ক্যাম্প ডেভিড চুক্তি সাক্ষরিত হয়। এই চুক্তির ধারাবাহিকতায় ১৯৭৯ সালে মিসর এবং ইসরাইলের মধ্যে শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, যা ছিল কোনো মুসলিম এবং আরব রাষ্ট্রের সাথে ইসরাইলের প্রথম শান্তিচুক্তি।

ক্যাম্প ডেভিড চুক্তি স্বাক্ষরের সময় বাম থেকে বেগিন, জিমি কার্টার এবং সাদাত © Keystone/Getty Images

ক্যাম্প ডেভিড চুক্তির কারণেই আনোয়ার সাদাত এবং ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেগিনকে ‌১৯৭৮ সালে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়। যদিও এই চুক্তি এবং পুরস্কারকে পশ্চিমা বিশ্ব স্বাগত জানায়, মুসলিম এবং আরব বিশ্বে এটি প্রচণ্ড নিন্দিত হয়। এই চুক্তির কারণে মিসরকে আরবলীগ থেকে বহিষ্কার করা হয়। এই চুক্তির প্রতিক্রিয়ায় গঠিত ইজিপশিয়ান ইসলামিক জিহাদ সংগঠনের সদস্যদের দ্বারা সংগঠিত এক অভ্যুত্থানেই ১৯৮১ সালে সাদাতকে প্রাণ দিতে হয়।

ইয়াসির আরাফাত (১৯৯৪)

ইয়াসির আরাফাত; Source: AFP

ইয়াসির আরাফাত ফিলিস্তিনের মুক্তি সংগ্রামের অবিসংবাদিত নেতা। তিনি ছিলেন এক সময়ের গেরিলা সংগঠ ফাতাহ’র প্রধান, পরবর্তীতে পিএলওর প্রধান এবং ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট। তার জন্ম ১৯২৯ সালে, মিসরের কায়রোতে। তার বাবা ছিলেন ফিলিস্তিনের গাজার অধিবাসী এবং মা ছিলেন আল-কুদস তথা জেরুজালেমের অধিবাসী। জন্ম মিসরে হলেও তার শৈশবের চার বছর কেটেছিল জেরুজালেমে মামার বাড়িতে। কৈশোর বয়স থেকেই আরাফাত মিসর থেকে গাজায় অস্ত্র সরবরাহ করতেন ব্রিটিশ এবং ইহুদীদের শাসন থেকে জেরুজালেম মুক্ত করার সংগ্রামের জন্য।

১৯৫৮ সালে তিনি এবং তার কিছু বন্ধু মিলে ইসরাইলের বিরুদ্ধ সংগ্রামের জন্য ফাতাহ প্রতিষ্ঠা করেন, যার লক্ষ্য ছিল সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ফিলিস্তিনের বিজয় ছিনিয়ে আনা। ১৯৬০ সালের দিকে তারা নিয়মিত ইসরাইলের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৬৪ সালে তিনি ফাতাহ সহ একাধিক গ্রুপের সমন্বয়ে প্যালেস্টাইন লিবারেশন অরগানাইজেশন, পিএলও প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৬৯ সালে তিনি পিএলওর চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। আরাফাত দীর্ঘদিন দখলদার ইসরাইলি বাহিনীর হাত থেকে ফিলিস্তিনিদের মুক্তির জন্য সশস্ত্র সংগ্রাম করেন। তিনি তার জীবনের বেশিরভাগ সময় কাটান আরব দেশগুলোর দ্বারে দ্বারে অর্থ এবং অস্ত্রের জন্য ঘুরে বেড়িয়ে।

শান্তিচুক্তির সময় বাম থেকে ইয়াসির আরাফাত, বিল ক্লিনটন এবং আইজাক রাবিন © Gary Hershorn

প্রথম জীবনে আরাফাত ইসরাইলের অস্তিত্বের সম্পূর্ণ বিরোধী ছিলেন। কিন্তু দীর্ঘদিন সংগ্রামের পরও কোনো সফলতা না আসায় এবং আরব দেশগুলো থেকে আশানুরূপ সহযোগিতা না পাওয়ায় তিনি ধীরে ধীরে আলোচনা এবং কূটনৈতিক তৎপরতার দিকে ঝুঁকে পড়েন। ১৯৮৮ সালে তিনি জাতিসংঘের অধিবেশনে এক ভাষণের মাধ্যমে ইসরাইলের অস্তিত্বের বাস্তবতা স্বীকার করে নেন এবং বলেন যে, ইসরাইলেরও অধিকার আছে শান্তিতে বসবাস করার। তিনি জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের রেজোলিউশন ২৪২ মেনে নেন, যার মাধ্যমে তিনি কার্যত দুই রাষ্ট্র সমাধানের দিকে এগিয়ে যান এবং ১৯৬৭ সালের পূর্বের সীমানা পর্যন্ত ফিরে যেতে সম্মত হন।

ইয়াসির আরাফাতের এই সিদ্ধান্তের ফলে ইসরাইলের সাথে আলোচনা এবং শান্তির পথ উন্মুক্ত হয়। তিনি পর পর ইসরাইলের সাথে অনেকগুলো বৈঠক করেন, যার ধারাবাহিতায় ১৯৯৪ সালে অসলো শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তির ফলে ইয়াসির আরাফাতের পিএলও ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ হিসেবে গাজা এবং পশ্চিত তীরে আংশিক স্বায়ত্ত্বশাসিত সরকার হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। এই চুক্তিটি যদিও শান্তির পথে সহায়ক হিসেবে বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত হয়, কিন্তু তা হামাস সহ অপেক্ষাকৃত রক্ষণশীল দলগুলোর তীব্র সমালোচনার মুখে পড়ে। এই অসলো চুক্তির জন্যই ১৯৯৪ সালে ইয়াসির আরাফাতকে নোবেল শান্তি পুরস্কার দেওয়া হয়। তবে পুরস্কারটি তাকে একা দেওয়া হয়নি। তার সাথে যৌথভাবে পুরস্কারটি পান ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী আইজাক রাবিন এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী শিমন পেরেজ।

শিরিন এবাদি (২০০৩)

শিরিন এবাদি তেহরানে © Atta Kenare / Getty Images

শিরিন এবাদি একজন ইরানী আইনজীবি, বিচারক এবং মানবাধিকার কর্মী, যিনি ২০০৩ সালে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। তিনি প্রথম এবং এখন পর্যন্ত একমাত্র ইরানী নোবেল বিজয়ী। তিনি একই সাথে প্রথম মুসলিম নারী, যিনি নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। এবাদির জন্ম ১৯৪৭ সালে, ইরানের হামাদানে। তিনি ছিলেন ইরানের প্রথম নারী বিচারক। কিন্তু ১৯৭৯ সালের ইসলামী বিপ্লবের পর নারীদের বিচারক হওয়ার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা জারি করার পর তাকে এবং অন্যান্য নারী বিচারককে পদাবনতি দিয়ে বিচার বিভাগের কর্মী হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। সেই থেকেই তিনি ইরানের নারী এবং শিশুদের বিভিন্ন অধিকারের জন্য আন্দোলন করে এসেছেন।

শিরিন এবাদি ডিফেন্ডার্স অফ হিউম্যান রাইটস সেন্টার ইন ইরানের প্রতিষ্ঠাতা। তিনি দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে তিনি ইরানের নারী, শিশু, রাজনৈতিক বিরোধীদের অধিকারের জন্য আইনী সংগ্রাম চালিয়ে গেছেন। ১৯৯৯ সালে তেহরান বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রহত্যায় সরকারের ভূমিকার প্রমাণ বিতরণ করার জন্য তাকে তিন সপ্তাহ কারাবরণ করতে হয়েছিল। তিনি মানবাধিকারের উপর একাধিক গ্রন্থও রচনা করেছেন। ২০০৩ সালে নোবেল কমিটি গণতন্ত্র এবং মানবাধিকার, বিশেষ করে নারী, শিশু এবং শরণার্থীদের অধিকারের জন্য তার গুরুত্বপূর্ণ এবং অগ্রণী ভূমিকার জন্য তাকে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার প্রদান করে। ২০০৪ সালের ফোর্বস ম্যাগাজিন তাকে বিশ্বের ১০০ প্রভাবশালী নারীর তালিকায় স্থান দেয়।

শিরিন এবাদি © Ben Garvin

শিরিন এবাদির নোবেল পুরস্কার অর্জনে সাধারণ ইরানীরা উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে। লন্ডন থেকে ইরানে ফেরার পর এয়ারপোর্টে হাজার হাজার ইরানী জনতা তাকে স্বাগত জানায়। তবে ইরানের সরকার তার নোবেল পুরস্কার নিয়ে কোনো অভিনন্দন জানানো থেকে বিরত থাকে এবং সংবাদটি গুরুত্বহীনভাবে বিলম্বে প্রচার করে। তারা এটিকে অগুরুত্বপূর্ণ এবং পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোর রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিক বলে আখ্যায়িত করে। পরবর্তীতে ২০০৯ সালে অভিযোগ ওঠে যে, ইরান শিরিন এবাদির নোবেল পুরস্কারের মেডেলটি বাজেয়াপ্ত করেছে, যদিও ইরানের সরকার এই অভিযোগ অস্বীকার করে।

মোহাম্মদ আল-বারাদেই (২০০৫)

মোহাম্মদ আল-বারাদেই © Patrick Piel

মোহাম্মদ আল-বারাদেই একজন মিসরীয় আইনজীবি এবং কূটনীতিক, যিনি দীর্ঘদিন পর্যন্ত আন্তর্জাতিক পারমাণবিক শক্তি সংস্থার (IAEA) মহাপরিচালক ছিলেন। সামরিক উদ্দেশ্যে পারমাণবিক শক্তির ব্যবহার হ্রাস করার ব্যাপারে দীর্ঘকালীন ভূমিকার জন্য তাকে এবং IAEAকে ২০০৫ সালে যৌথভাবে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার প্রদান করা হয়।

আল-বারাদেইর জন্ম ১৯৪২ সালে, মিসরের রাজধানী কায়রোতে। তিনি কায়রো বিশ্ববিদ্যালয় এবং নিউ ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইনে যথাক্রমে স্নাতক ও পিএইচডি অর্জন করেন। তিনি দীর্ঘদিন মিসরীয় কূটনীতিক হিসেবে জাতিসংঘে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৪ থেকে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত তিনি মিসরের সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৪ সালে তিনি আন্তর্জাতিক পারমাণবিক শক্তি সংস্থার উপদেষ্টা হিসেবে কাজ শুরু করেন। পরবর্তীতে ১৯৯৩ সালে এর সহকারী মহাপরিচালক এবং ১৯৯৭ সালে মহাপরিচালক হিসেবে পদোন্নতি লাভ করেন। তিনি ২০০১ সালে দ্বিতীয় বার এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরোধিতা সত্ত্বেও ২০০৫ সালে তৃতীয়বার এর মহাপরিচালক হিসেবে নির্বাচিত হন।

নোবেল পুরস্কার গ্রহণ করছেন আল-বারাদেই; Source: achievement.org

IAEA এ দায়িত্ব পালন কালে আল-বারাদেই পারমাণিক অস্ত্রের বিস্তার রোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। বিশেষ করে সুদান, ইরাক, ইরান এবং উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক প্রকল্প সীমিত রাখার ক্ষেত্রে তাকে সফল দাবি করা হয়। এসব ক্ষেত্রে তিনি জোর প্রয়োগের চেয়ে কূটনীতিকেই প্রাধান্য দিতেন। ২০০২ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যখন ইরাক আক্রমণের অজুহাত হিসেবে সাদ্দাম হোসেনের কাছে গণবিধ্বংসী অস্ত্র থাকার অভিযোগ করছিল, তখন আল-বারাদেই তার তীব্র বিরোধিতা করেন এবং নিশ্চিত করেন যে, ইরাকের কোনো পারমাণবিক কর্মসূচী ছিল না

আল-বারাদেই ২০০৯ সালে IAEA থেকে অবসর গ্রহণ করেন। ২০১১ সালে তিনি হোসনি মোবারকের বিরুদ্ধে চলমান আরব বসন্তের আন্দোলনকে সমর্থন দেন। সে সময় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের ব্যাপারে আলোচনার জন্য তিনি বিরোধী রাজনৈতিক দল মুসলিম ব্রাদারহুডেরও সমর্থন লাভ করেন। কিন্তু পরবর্তীতে ব্রাদারহুড নির্বাচনে জয়ী হয়ে সরকার গঠন করার পর তিনি প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুরসীর বিভিন্ন কঠোর পদক্ষেপের সমালোচনা শুরু করেন। তিনি গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মুরসীকে অবৈধভাবে ক্ষমতাচ্যুত করার ব্যাপারে আব্দুল ফাত্তাহ আল-সিসিকে সমর্থন দেন এবং অভ্যুত্থান পরবর্তী সরকারের ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। কিন্তু সেনাবাহিনী ব্রাদারহুড সমর্থকদের আন্দোলন কঠোরভাবে দমন করলে তিনি সরকার থেকে পদত্যাগ করেন।

মুহাম্মদ ইউনূস (২০০৬)

ড. মুহাম্মদ ইউনূস © Andreas Solaro

ড. মুহাম্মদ ইউনূস একজন বিশ্বনন্দিত অর্থনীতিবিদ এবং বাংলাদেশের গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা। তিনি ১৯৪০ সালে চট্টগ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ১৯৬৯ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভ্যান্ডারবিল্ট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতি ডক্টরেট ডিগ্রী অর্জন করেন। সেখানে কিছুদিন অধ্যাপনা করার পর তিনি দেশে ফিরে আসেন এবং পুনরায় অধ্যাপনায় নিযুক্ত হন। ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষের পর দরিদ্রদেরকে সাহায্য করার লক্ষ্য নিয়ে তিনি ক্ষুদ্র ঋণ কর্মসূচী চালু করেন। এই কর্মসূচীর আওতায় দরিদ্র জনগোষ্ঠী, যারা সাধারণ ব্যাংকের ঋণ পাওয়ার যোগ্য বলে বিবেচিত হয় না, তাদেরকে ক্ষুদ্র পরিমাণ ঋণ প্রদানের মাধ্যমে সামান্য সাবলম্বী করার প্রচেষ্টা করা হয়।

১৯৮৩ সালে ড. ইউনূস গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেন। তার প্রবর্তিত ক্ষুদ্র ঋণ কর্মসূচী বিশ্বব্যাপী ব্যাপক প্রশংসিত হয় এবং বিশ্বের অনেক রাষ্ট্র তা অনুকরণ করে। যদিও অর্থনীতিবিদ এবং উদ্যোক্তা হিসেবেই ড. ইউনূস বেশি বিখ্যাত, কিন্তু ২০০৬ সালে নোবেল কমিটি তাকে এবং তার প্রতিষ্ঠান গ্রামীণ ব্যাংককে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার প্রদান করে। তিনি প্রথম এবং এখন পর্যন্ত একমাত্র নোবেল পুরস্কার পাওয়া বাংলাদেশী নাগরিক। নোবেল কমিটি উল্লেখ করে যে, দারিদ্র্য দূরীকরণ ছাড়া দীর্ঘ মেয়াদে শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। তাই কয়েক দশক ধরে ক্ষুদ্র ঋণ কর্মসূচীর মাধ্যমে গোড়া থেকে জাতীয় এবং সামাজিক উন্নয়ন সৃষ্টিতে অবদানের স্বীকৃতি হিসেবেই তাদেরকে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছে।

নোবেল পুরস্কার ছাড়াও ড. ইউনূস আরও অনেক পুরস্কার অর্জন করেছেন। ২০০৯ সালে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেনশিয়াল মেডেল অফ ফ্রিডম এবং ২০১০ সালে কংগ্রশনাল গোল্ড মেডেল অর্জন করেন। ২০০৮ সালে ফরেন পলিসি ম্যাগাজিনের বিশ্বের সেরা ১০০ চিন্তাবিদের তালিকায় তাকে ২ নম্বরে স্থান দেওয়া হয়। ২০০৭ সালে ড. ইউনূস নাগরিক শক্তি নামে রাজনৈতিক দল সৃষ্টির আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু সুশীল সমাজের সমর্থন না পাওয়ায় তিনি সেখান থেকে সরে আসেন। বহির্বিশ্বে অত্যন্ত সম্মানিত এই অর্থনীতিবিদকে নিয়ে দেশের ভেতরে মিশ্র প্রতিক্রিয়া আছে। তার বিরোধীদের কেউ কেউ তার উচ্চ সুদ ভিত্তিক ব্যাংকিং পদ্ধতির সমালোচনা করে। কেউবা আবার তার নোবেল প্রাপ্তিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক তাকে বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠিত করার প্রচেষ্টা হিসেবে দেখে।

তাওয়াক্কুল কারমান (২০১১)

সানা’র রাজপথে তাওয়াক্কুল কারমান; Source: newyorker.com

তাওয়াক্কুল কারমান একজন ইয়েমেনি সাংবাদিক, রাজনীতিক, সংগঠক এবং মানবাধিকার কর্মী। তার জন্ম ১৯৭৯ সালে, ইয়েমেনের তা’ইজে। বাণিজ্যে স্নাতক এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর করার পর তিনি সাংবাদিক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। তিনি বিভিন্ন সচেতনামূলক প্রবন্ধ লেখা, ডকুমেন্টারি নির্মাণ এবং মোবাইল ফোনের টেক্সট ম্যাসেজ ভিত্তিক সংবাদ সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। ২০০৫ সালে ইয়েমেন সরকার যখন তার কর্মকাণ্ডে বাধা প্রদান করে, তখন তিনি তার নারী সহকর্মীদেরকে নিয়ে উইমেন জার্নালিস্টস উইদাউট চেইনস নামক সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। ২০০৭ সাল থেকে তারা বিভিন্ন গণতান্ত্রিক সংস্কার এবং নারী অধিকারের জন্য রাজধানী সানা’তে সাপ্তাহিক অবস্থান কর্মসূচী পালন করতে থাকেন। এজন্য কারমানকে একাধিকবার কারাবরণ করতে হয়।

২০১১ সালে আরব বসন্ত শুরু হলে তাওয়াক্কুল কারমান রাজধানী সানা’তে ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে শান্তিপূর্ণ মিছিলের আয়োজন করেন। কিন্তু সরকার তাকে গ্রেপ্তার করলে প্রতিবাদে মিছিলে আরও তীব্র আকার ধারণ করে। শেষ পর্যন্ত সরকার তাকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। কারমান দ্রুত ইয়েমেনের প্রতিবাদের অন্যতম প্রধান নেত্রী হিসেবে আবির্ভূত হন। তিনি আরব বসন্তের অনুকরণে সৃষ্ট এই আন্দোলনকে জেসমিন আন্দোলন নামে আখ্যায়িত করেন। তার নেতৃত্বে প্রেসিডেন্ট আলি আব্দুল্লাহ সালেহের পদত্যাগের দাবিতে হাজার হাজার মানুষ মাসের পর মাস ধরে সানা’ ইউনিভার্সিটি চত্বরে শান্তিপূর্ণ অবস্থান কর্মসূচী পালন করে। আন্দোলনের সময় তিনি ‘আয়রন ওম্যান’, ‘মাদার অফ রেভোলিউশন’ প্রভৃতি উপাধি অর্জন করেন।

২০১১ সালে তাওয়াক্কুল কারমানকে অন্য দুইজনের সাথে যৌথভাবে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়। সে সময় তার বয়স ছিল মাত্র ৩২ বছর। মালালার পূর্ব পর্যন্ত তিনিই ছিলেন সর্বকনিষ্ঠ নোবেল পুরস্কার বিজয়ী। তিনি একই সাথে প্রথম, এখন পর্যন্ত একমাত্র আরব নারী, যিনি নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। নোবেল কমিটি জানায়, শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে নারীদের অংশগ্রহণ এবং নারী অধিকার নিশ্চিত করার জন্য তার অহিংস আন্দোলনের স্বীকৃতি হিসেবে তাকে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছে।

মালালা ইউসুফজাই (২০১৪)

মালালা ইউসুফজাই; Source: blog.malala.org

মালালা ইউসুফজাই একজন পাকিস্তানী নারী শিক্ষা আন্দোলন কর্মী। তার জন্ম ১৯৯৭ সালে, পাকিস্তানের খাইবার পাখতুঙ্ক্ষা প্রদেশে। ২০০৯ সালে তার বয়স যখন মাত্র ১১ বছর, তখনই তিনি বিবিসির উদ্যোগে এবং তার বাবার সহযোগিতায় ছদ্মনামে উর্দুভাষী একটি ব্লগে তালেবানের অধীনে তাদের জীবনযাপনের অভিজ্ঞতা লিখতে শুরু করেন। তালেবান সে সময় তাদের এলাকা সোয়াত উপত্যকা দখল করে নিয়েছিল এবং মেয়েদের স্কুলে যাওয়া বন্ধ সহ বিভিন্ন কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করছিল।

মালালা নিউইয়র্ক টাইমস সাংবাদিক অ্যাডাম বেলিক নির্মিত একটি ডকুমেন্টারিতে অংশগ্রহণ করার পর আন্তর্জাতিক পরিচিতি লাভ করতে শুরু করেন। সেই কিশোর বয়সেই তিনি ধীরে ধীরে তিনি নারী শিক্ষার পক্ষে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে এবং সভায় বক্তব্য দিতে শুরু করেন। তিনি সাংবাদিক হামিদ মীরের সঞ্চালনায় ক্যাপিটাল নামক টক শোতেও অংশগ্রহণ করেন। ২০১১ সালে নোবেল বিজয়ী মানবাধিকার কর্মী ডেসমন্ড টুটু তাকে আন্তর্জাতিক যুব শান্তি পুরস্কারে ভূষিত করেন। সে বছরই তিনি পাকিস্তানের জাতীয় যুব শান্তি পুরস্কার অর্জন করেন।

মালালার পুরস্কার অর্জন © Odd Anderson

মালালার গণমাধ্যমে সক্রিয় উপস্থিতি তালেবানদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তারা বুঝতে পারে, ছদ্মনামে তালেবান শাসনের বিরুদ্ধে ব্লগ লেখা মেয়েটি আসলে মালালা। ফলে মালালার উপর অব্যাহতভাবে হুমকি আসতে থাকে। ২০১২ সালের ৯ই অক্টোবর, যখন তিনি বাসে করে স্কুল থেকে বাসায় ফিরছিলেন, তখন তালেবানরা বাস থামিয়ে তাকে খুঁজে বের করে এবং তার মাথায় গুলি করে। উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে ব্রিটেনে নিয়ে যাওয়া হয় এবং একাধিক জটিল অস্ত্রোপচারের পর তিনি সেরে ওঠেন।

মালালাকে হত্যাচেষ্টার ঘটনাটি আন্তর্জাতিকভাবে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে। ২০১৩, ২০১৪ এবং ২০১৫ সালে টাইম ম্যাগাজিন তাকে বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের মধ্যে একজন হিসেবে ফিচার করে। দেশে বিদেশে তিনি অনেক পুরস্কার এবং সম্মাননা পান। ২০১৪ সালে তিনি ভারতের কৈলাস সত্যার্থীর সাথে যৌথভাবে নোবেল শান্তি পুরস্কার লাভ করেন। তার নোবেল প্রাপ্তি অবশ্য বেশ বিতর্কের জন্ম দেয়। কারণ, নোবেল অর্জনের পূর্বে নারী শিক্ষার জন্য বা শান্তির জন্য মালালার যতটুকু কাজ ছিল, সেটুকু আসলে খুব বেশি না। কিন্তু তালেবানদের আক্রমণের শিকার হওয়ার কারণেই তিনি বেশি আলোচিত হয়েছেন এবং পুরস্কার লাভ করেছেন।

ফিচার ইমেজ-  huffpost.com

Related Articles