Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন: সাফল্য ব্যর্থতার দোলাচলে কার্যকারীতা হারানো এক নাম

গত শতাব্দীর বিশ্ব রাজনীতি ছিল আপাদমস্তক ঘটনাবহুল। ইতিহাসের মোড় আর বিশ্ব রাজনীতির পট পরিবর্তন করে দেয়ার মতো অনেক ঘটনাই ঘটেছে ২০ শতকে। এর মধ্যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়টা বেশ গুরুত্বপূর্ণ, যখন বিশ্ব সবে রক্তস্নান থেকে মুক্তি পেয়ে বুক ভরে শ্বাস নেওয়ার চেষ্টা করছে, দেশে দেশে যখন ঔপনিবেশিক শাসন কাঠামো ভেঙে পড়ছে; আফ্রিকা, এশিয়া আর লাতিন আমেরিকায় যখন চলছে স্বাধীনতার সংগ্রাম, বিশ্ব যখন স্নায়ুযুদ্ধ নামক এক দীর্ঘস্থায়ী স্নায়ুক্ষয়ী রোগে আক্রান্ত, সেই উত্তেজনাকর পরিস্থিতিতে শুরু হয়েছিল ‘নন অ্যালাইনড মুভমেন্ট’ বা ‘ন্যাম’ নামক এক গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলন, যাকে বাংলায় বলা হয় জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন।

সূচনাকালে এই আন্দোলনের গতিপ্রকৃতি সরাসরি প্রভাবিত করে অনেক দেশের ঔপনিবেশিক কাঠামো ভাঙতে। এই আন্দোলনের প্রাথমিক সাফল্য ছিল ১০টির অধিক দেশের স্বাধীনতা। আর বিশ্ব শান্তি রক্ষায়ও এই আন্দোলনের রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।

বান্দুং সম্মেলন; Image Source: guraru.org

১৯৫৫ সালের ১৮-২৪ এপ্রিল ইন্দোনেশিয়ার বান্দুংয়ে অনুষ্ঠিত হয়েছিল ‘বান্দুং এশিয়ান আফ্রিকা কনফারেন্স’ নামে একটি কনফারেন্স। সেই কনফারেন্সে অংশ নেয় ঔপনিবেশিক যুগ পরবর্তী ২ মহাদেশের ২৯টি স্বাধীন দেশের নেতারা, যাদের উদ্দেশ্য ছিল তৎকালীন বিশ্ব রাজনীতির অবস্থা বিবেচনা করে করণীয় ঠিক করা এবং আন্তর্জাতিকভাবে নিজেদের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠা করা। এরকম সভা এর আগেও বেশ কয়েকবার হয়েছিল, যদিও বান্দুংয়ের সভাটিই ছিল ন্যাম গঠনের পথে সবচেয়ে বড় এবং প্রধান অগ্রগতি।

‘টেন প্রিন্সিপালস অব বান্দুং’ নামে পরিচিত ছোট ও বড় দেশের মধ্যকার সম্পর্কের ধরন বর্ণনা করা বিখ্যাত নীতিমালা এই কনফারেন্সেই ঘোষিত হয়েছিল। এই নীতিমালাগুলোই কিছুটা সংশোধন করে পরবর্তীতে জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের মূলনীতি হিসেবে গৃহীত হয়। ‘৯০ এর দশক পর্যন্ত এই নীতিমালাকে বলা হতো ন্যামের সারাংশ।

১৯৬০ সালের শুরুর দিকে ন্যাম গঠন আরো একধাপ এগিয়ে যায় জাতিসংঘের ১৫তম সাধারণ অধিবেশনে। সেখানে এশিয়া ও আফ্রিকার নতুন স্বাধীনতা প্রাপ্ত ১৭টি দেশকে নিয়মিত অধিবেশনে যোগদানের অনুমতি দেয়া হয়। আর এর পেছনে কলকাঠি নাড়েন মিশরের প্রেসিডেন্ট গামাল আবদুল নাসের, যুগোস্লাভিয়ার কমিউনিস্ট আন্দোলনের নেতা জোসেফ ব্রোজ টিটো, ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু, ঘানার কাওয়ামে ক্রুমাহ এবং ইন্দোনেশিয়ার রাষ্ট্রপতি আহমেদ সুকর্ণ।

এই পাঁচজন নেতার হাত ধরেই মূলত গড়ে ওঠে ন্যাম, যাদের আমরা ন্যামের প্রতিষ্ঠাতা বলে জানি। বান্দুং সম্মেলনের ৬ বছর পর আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মপ্রকাশ করে জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন তথা ন্যাম। ১৯৬১ সালের সেপ্টেম্বরে সার্বিয়ার রাজধানী বেলগ্রেডে অনুষ্ঠিত হয় ন্যামের প্রথম শীর্ষ সম্মেলন যেখানে অংশ নেয় ২৫টি দেশ। আমলাতান্ত্রিক জটিলতা এড়াতে পরবর্তীতে ন্যামকে একটি আন্দোলন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়, কোনো সংগঠন হিসেবে নয়।

ন্যামের প্রতিষ্ঠাকালীন রাষ্ট্রনেতাগণ; Image Source: news.okezone.com

কায়রো সম্মলনে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, আন্তর্জাতিক অঙ্গণে ন্যাম নিষ্ক্রিয় হয়ে থাকবে না। জোট নিরপেক্ষ দেশগুলো পরস্পরকে স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব ধরে রাখায়, দেশ হিসেবে শক্তিশালী হওয়ায়, জাতিবিদ্বেষ দূরীকরণ, বৃহৎ শক্তির চাপে পরে বহুপক্ষীয় সামরিক চুক্তি করায় বাধ্য হওয়া থেকে রক্ষা করা, সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াই, উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে লড়াই, আন্তর্জাতিক সম্পর্কে যেকোনো ধরনের অবরোধ হুমকি এড়ানো, জাতিসংঘকে শক্তিশালী করা, শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ইত্যাদি ছিল ন্যামের প্রাথমিক লক্ষ্য।

প্রতিটি ক্ষেত্রে ন্যামের সদস্য দেশগুলোর স্বার্থকেই সর্বাগ্রে প্রাধান্য দেয়ার লক্ষ্য নির্ধারিত হয়। তবে ন্যামের সর্বপ্রধান লক্ষ্যই হচ্ছে আপেক্ষাকৃত কম শক্তিশালী সদস্য দেশগুলোকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে শেখানো, বহির্শক্তির প্রভাব থেকে রক্ষা করা এবং দেশের আভ্যন্তরীণ ব্যাপারে অন্যদেশের হস্তক্ষেপ বন্ধ করা। ৭০/৮০’র দশকে বিশ্ব অর্থনীতির কাঠামো বদলে ফেলার লক্ষ্য নিয়েও কাজ করে ন্যাম। অন্যান্য ব্যাপার জানার পূর্বে বান্দুং সম্মেলনে গৃহীত ন্যামের ১০টি মূলনীতি জেনে নেওয়া যাক।

১. মৌলিক মানবাধিকারগুলোর প্রতি সম্মান রাখা এবং জাতিসংঘের লক্ষ্য ও নীতিমালার প্রতি অনুগত হওয়া।
২. প্রত্যেক দেশের সার্বভৌমত্ব এবং আভ্যন্তরীণ অখন্ডতার প্রতি সম্মান প্রদর্শন।
৩. সকল বর্ণের মানুষের প্রতি এবং ছোট কিংবা বড়, শক্তিশালী কিংবা দুর্বল, সকল জাতির প্রতি সমান সম্মান প্রদর্শন।
৪. অন্য দেশের আভ্যন্তরীণ ব্যপারে মধ্যস্থতা কিংবা হস্তক্ষেপ করার চেষ্টা না করা।
৫. প্রত্যেক দেশের একক বা সংঘবদ্ধ সামরিক সক্ষমতার প্রতি সম্মান দেখাতে হবে।
৬. যেকোনো পরাশক্তি দেশের সাথে সম্মিলিত সামরিক চুক্তি করা যাবে না, যা আদতে তাদের সামরিক সক্ষমতা বৃদ্ধি করে।
৭. যেকোনো দেশের রাজনৈতিক স্বাধীনতা বা অখন্ডতার বিরুদ্ধে কোনো শক্তি প্রয়োগ বা কোনো পক্ষকে সহায়তা করা বা কোনোরূপ হুমকি দেয়া যাবে না।
৮. জাতিসংঘের সনদ অনুযায়ী যেকোনো আন্তর্জাতিক সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধান।
৯. পারস্পারিক স্বার্থ-সহযোগীতা সামনে রেখে কাজ করা।
১০. আন্তর্জাতিক আইন এবং নিয়ম কানুনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যখন ঔপনিবেশিক শাসন ব্যবস্থা ভেঙে পড়লো, পরাজয় হলো ফ্যাসিবাদের, তখন বিশ্ব মোটামুটি দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে গেল। এক ব্লকে রইলো পুঁজিবাদ, অন্য ব্লকে সমাজতন্ত্র। সামরিকভাবেও হয়ে গেলো দুটি ব্লক। ন্যাটো আর ওয়ারস প্যাক্ট। এ অবস্থায় দুই ব্লকের রেষারেষিতে হুমকির সম্মুখীন ছিল মূলত কম শক্তির দেশগুলোই, বিশেষ করে এশিয়া আর আফ্রিকার সদ্য স্বাধীনতা প্রাপ্ত অনুন্নত দেশগুলো। এই দেশগুলোর স্বকীয়তা, স্বাধীনতা আর অখণ্ডতা টিকিয়ে রাখার জন্য একই পতাকাতলে আসা জরুরী ছিল।

তারই প্রেক্ষাপটে ২৯ দেশের সম্মেলন হয় বান্দুংয়ে। প্রত্যেক দেশের নেতা পৃথক রাজনৈতিক কাঠামো আর পন্থায় বিশ্বাসী হলেও তারা সকলে একটি বিষয়ে এক হতে পেরেছিলেন যে, বিশ্বযুদ্ধ শেষ হবার পর পৃথিবী উপনিবেশ থেকে মুক্তি পেতে শুরু করেছে ঠিকই, কিন্তু একই সাথে নতুন এক উপনিবেশবাদের শুরুও হয়ে গিয়েছিল। আর তা হলো, রাজনৈতিক উপনিবেশিকরণ। এই রাজনৈতিক দুই ব্লকের উপনিবেশ থেকে মুক্তি পেতে অপেক্ষাকৃত কম শক্তির দেশগুলো সিদ্ধান্ত নেয় যে, তারা সবরকম জোটের বাইরে থাকবে। আর তা থেকেই উদ্ভব এই জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের।

বান্দুং সম্মেলনে অংশ নেওয়া রাষ্ট্রগুলো; Image Source: commons.wikimedia.org

তৃতীয় বিশ্বের যেসকল দেশ তখনো স্বাধীনতার জন্য লড়াই করে যাচ্ছিল, তাদের প্রতি প্রথম থেকেই উচ্চ স্বরে নিজেদের সমর্থন প্রকাশ করে গেছে ন্যাম। সেকারণে দুই মেরুতে রূপ নেওয়া বিশ্ব রাজনীতির ঝক্কি-ঝামেলা থেকে রেহাই পেতে অনুন্নত কিংবা উন্নয়নশীল দেশগুলো স্বতঃস্ফূর্তভাবে যোগ দিতে থাকে ন্যামে।

৮০’র দশকে পৌঁছাতে পৌঁছাতে এশিয়া আর আফ্রিকার অধিকাংশই ‘জোট নিরপেক্ষ’ দেশে পরিণত হয়। এসময় ন্যাম তাদের কার্যাবলী কেবল রাজনীতি থেকে সরিয়ে নিয়ে অর্থনৈতিক আর সামাজ দিকগুলো নিয়েও কাজ শুরু করে। কিন্তু ৯০’র দশকের প্রাক্বালে সোভিয়েত ইউনিয়নের ভেঙে যাওয়ায়, অর্থাৎ সমাজতান্ত্রিক ব্লকের বিলোপ ন্যামের অস্তিত্বের পাশে প্রশ্নচিহ্ন এঁকে দেয়। কেননা ন্যামের জন্মই হয়েছিল দুই ব্লকের মেরুকরণ থেকে দূরে থাকা।

কিন্তু ব্লকই যদি না থাকে, তাহলে আন্দোলনের যৌক্তিকতা কোথায়? অনেকেই এসময় ন্যামের শেষ দেখতে শুরু করেছিলেন। কিন্তু এক ব্লকের পতনের পরই সকলের উপলব্ধি হতে শুরু করে যে, মেরুকরণের শেষ এখনো হয়নি, কেবল একমুখীই হয়েছে। বিশ্ব রাজনীতি দ্বিমেরু থেকে সরে এখন এক মেরুর কর্তৃত্বের অন্তর্গত হতে চলেছে বলেই ধারণা করা হলো। ফলে ন্যামের প্রাসঙ্গিকতাও রয়ে গেল।

ন্যামের ১৬তম সম্মেলনে বিশ্বনেতারা; Image Source: outlookafghanistan.net

কিছু বাধা বিপত্তি আর সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন আজকের দিনেও যথেষ্ট প্রাসঙ্গিক এবং কার্যকর। ২১ শতকে এসে যেন এর মূলনীতি আর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যে পরিবর্তন না আসে, সেজন্য সদস্য দেশগুলো পুনরায় অঙ্গীকারবদ্ধ হয় হাভানায় অনুষ্ঠিত ন্যামের ১৪তম শীর্ষ সম্মেলনে। দুই ব্লক নেই বলেই ন্যামের প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে যায়নি।

বরং উন্নত দেশগুলোর পরস্পরের সাথে নানাবিধ অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক আঁতাতের জন্য ন্যাম ২১ শতকে এসে আগের চেয়েও বেশি প্রাসঙ্গিক হয়েছে বলেই মনে করেন সদস্য দেশগুলোর নেতারা। তবে আধুনিক বিশ্বের নানাবিধ পরিবর্তনের সাথে তাল মেলাতে নিজেদের প্রাথমিক উদ্দেশ্যগুলোও নবায়ন করে ন্যাম। উদ্দেশ্যগুলো এক নজরে দেখে নেয়া যাক।

  • জাতিসংঘের মতো বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠানের শক্তিকাঠামো বহুমুখীকরণ।
  • আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে উন্নয়নশীল দেশগুলোর সাধারণ স্বার্থ রক্ষার জন্য জাতিসংঘকে একটি সাধারণ প্ল্যাটফর্ম হিসেবে ব্যবহার করা।
  • উন্নয়নশীল দেশগুলোর মাঝে একতা, সংহতি আর সহযোগীতার নীতি প্রচার করা।
  • জাতিসংঘের নীতি নিয়ম মেনে সকল আন্তর্জাতিক সংঘাত মোকাবিলা করা কিংবা আন্তর্জাতিক শান্তি রক্ষায় কাজ করা।
  • আন্তর্জাতিক আইনের ভিত্তিতে সকল দেশের মধ্যে বন্ধুত্ব ও সহযোগীতার পরিবেশ তৈরি করা।
  • ধনী দরিদ্র সকল দেশের মিলিত অংশগ্রহেণে টেকসই উন্নয়নের নীতি গ্রহণ করা।
  • অর্থনৈতিক সাম্য প্রতিষ্ঠায় কাজ করা।
  • যেকোনো ধরনের কর্তৃত্ববাদী আচরণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা।
  • আন্তর্জাতিক শান্তির বিরুদ্ধে হুমকিগুলোর বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়ে লড়াই করা।
  • জাতিসংঘকে আরো অধিক গণতান্ত্রিক করে তোলা যেন যেকোনো সিদ্ধান্তে সকলের সমানাধিকার থাকতে পারে।
  • বৈষম্যহীনভাবে বিশ্বে পরমাণু অস্ত্রের নিরস্ত্রীকরণের জন্য কাজ করে যাওয়া।
  • নির্দিষ্ট কিছু মানদণ্ডের ভিত্তিতে কোনো দেশকে সন্ত্রাসী রাষ্ট্র হিসেবে উল্লেখ করার মতো ব্যাপারগুলো বন্ধ করা।
  • পারমাণবিক শক্তি উৎপাদনে আন্তর্জাতিক সমন্বিত উদ্যোগের ব্যবস্থা করা।

বিভিন্ন বিষয়ে ন্যামের ব্যর্থতাগুলো বেশ চোখে পড়ার মতো। প্রতিষ্ঠার অর্ধশতাধিক পেরিয়ে গেলেও ন্যাম এখনো বিশ্বে তেমন কার্যকরী ও প্রভাবশালী অবস্থান তৈরি করতে পারেনি। ন্যামের প্রতিষ্ঠাকালীন নেতা জওহরলাল নেহেরু আর গামাল আবদুল নাসের স্নায়ুযুদ্ধের সময় একাধিকবার নিজেদের সমর্থন পরিবর্তন করেছেন এবং কোনো শক্ত অবস্থান নিতে ব্যর্থ হয়েছেন।

অথচ এর প্রাথমিক নীতিই ছিল দ্বিমেরুর বিশ্বে কোনো মেরুকে সমর্থন না করা। ন্যামের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা হচ্ছে, এর সদস্য রাষ্ট্রগুলো সবসময়ই পশ্চিমা ব্লকগুলোর সাথে লিয়াজো বজায় রেখে চলেছে, যা সরাসরি ‘জোট নিরপেক্ষ’ কথাটার সাথেই সাংঘর্ষিক। ইন্দো-চীন যুদ্ধের সময় ভারত পশ্চিমাদের সামরিক সহায়তা দু’হাত ভরে নিয়েছে। মিশর আমেরিকার সাথে বিশাল আকারের অর্থনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তোলে।

যুগোস্লাভিয়ার ভাঙন খুব একটা প্রভাব না ফেললেও, সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর কার্যকারীতা হারাতে শুরু করে ন্যাম। সমালোচকরা তো একে রাষ্ট্রনেতাদের একপ্রকার দেখা সাক্ষাৎ আর কুশল বিনিময়ের প্রক্রিয়া বলে অভিহিত করতে শুরু করেন। ২১ শতকে এসে ন্যামের নীতিমালা নবায়ন করার নামে কেবল নতুন বোতলে পুরাতন মদই ঢালা হয়েছিল। এর সদস্য সংখ্যাও ১২০ ছাড়িয়েছে, অথচ কার্যকারীতা আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে কমে গেছে।

Image Source: balcanicaucaso.org

এত সব ব্যর্থতার মাঝে ন্যামের সাফল্যের তালিকাও ছোট নয়। ভিয়েতনাম যুদ্ধ বন্ধে পরোক্ষ অবদান, একাধিক রাষ্ট্রের উপনিবেশ থেকে বেরিয়ে আসায় সরাসরি অবদান, আরব-ইজরায়েল দ্বন্দ্বের শান্তিপূর্ণ সমাধানে ভূমিকা, দরিদ্র সদস্য দেশগুলোর সাথে ধনী দেশগুলোর অর্থনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন, সদস্য দেশগুলোতে পরাশক্তিদের সামরিক ঘাঁটির সংখ্যা হ্রাস, ইরাক-ইরান যুদ্ধ বন্ধে সহায়তা, পারমাণবিক অস্ত্র নিরস্ত্রীকরণে ভূমিকা, নিউক্লিয়ার ফ্রি জোন তৈরি, তুলনামূলক কম শক্তির রাষ্ট্রগুলোকে আত্মবিশ্বাসী করে তোলা, জাতিসংঘকে শক্তিশালীকরণ সহ প্রভৃতি ক্ষেত্রে নির্ণায়ক ভূমিকা পালন করেছে ন্যাম।

তবে সবদিক বিবেচনা করলে ন্যামকে ততটা কার্যকরী বলা চলে না। ভেনেজুয়েলার বর্তমান প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরো এর সেক্রেটারি জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। ২০১৬ সালে তিনি দায়িত্ব গ্রহণের পর ন্যামকে নতুন করে ঢেলে সাজানোর কথা বললেও তা ফাঁকা বুলি হয়েই আছে। বর্তমানে ন্যাম তথা জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন এমন একটি পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, এর কেবল অস্তিত্বই রয়েছে। তবুও পরাশক্তিদের কর্তৃত্ববাদী রাজনৈতিক আচরণের মাঝে ক্ষুদ্র দেশগুলোকে মাথা তুলে দাঁড়ানোর সাহস জুগিয়েছিল এই আন্দোলনই।

এক সময়ের প্রভাব আর কার্যকারীতা এখন শুধুই ইতিহাস হলেও সকলেরই আশা যে, বিশ্ব রাজনীতিকে গুটিকয়েক জাতির স্বার্থোদ্ধারের হাতিয়ার হওয়া থেকে বিরত করতে আগের চেয়ে আরো কার্যকর রূপে আবার জেগে উঠবে ন্যাম।

ফিচার ছবি: ssc cgl

Related Articles