নেভাল ওয়ারফেয়ার; নাম শুনলেই কল্পনার দৃশ্যপটে ভেসে ওঠে বিশাল নীল জলরাশিতে কিছু যুদ্ধজাহাজের গোলা ছোড়াছুঁড়ি কিংবা একে অপরকে ডুবিয়ে দেয়ার চেষ্টা। পৃথিবীর ইতিহাসে নৌ-যুদ্ধগুলোর পটভূমি যেমন বর্ণিল, তেমনই রক্তক্ষয়ী। চলুন জেনে আসা যাক দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কিছু ঐতিহাসিক নৌ-যুদ্ধ সম্পর্কে, যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের ইউএসএস অ্যারিজোনা, আইওয়া, জাপানের ইয়ামাটো, যুক্তরাজ্যের ডিউক অফ ইয়র্কের মতো দানবীয় ব্যাটলশিপগুলো এক ধুন্ধুমার লড়াইয়ে নেমে পড়েছিল পৃথিবীর নীল সমুদ্রে।
ব্যাটল অফ কেপ মাতাপান
ইতালিয়ান নৌবাহিনী কর্তৃক ব্রিটিশ ইম্পেরিয়াল নেভির সাথে ১৯৪১ এর মার্চে সংঘটিত হওয়া এই যুদ্ধের প্রধান লক্ষ্য ছিল ভূমধ্যসাগরের দখল নেয়া। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে কৌশলগতভাবে এগিয়ে থাকার পরিকল্পনা করেন ইতালির সর্বাধিনায়ক বেনিতো মুসোলিনি। সেজন্য সবার আগে ঘরের পাশে ভূমধ্যসাগরের নিয়ন্ত্রণ নেয়াই ছিল কৌশলগতভাবে এগিয়ে থাকার নিয়ামক। আর ভূমধ্যসাগরের নিয়ন্ত্রণ ইতালির হাতে চলে আসার অর্থ একে একে ইউরোপের চাবি হিসেবে পরিচিত জিব্রাল্টার, সুয়েজ ও উত্তর আফ্রিকার বন্দরগুলোতে সরাসরি ঘাঁটি স্থাপন ও যোগাযোগ করতে পারবে ইতালি। সে লক্ষ্যে এগিয়ে যেতে ইতালির নৌবাহিনীর শ্রেষ্ঠ যুদ্ধজাহাজগুলোকে মোতায়েন করেন মুসোলিনি।
মার্চের শেষ সপ্তাহে গ্রিসের মাতাপান উপকূলের কাছে যুদ্ধজাহাজ 'ভেট্টোরিও ভেনেতো'র নেতৃত্বে ইতালিয়ান নৌ-শক্তিসমূহ অবস্থান নেয়। অন্যদিকে ব্রিটেনের হয়ে মেডিটেরিয়ান ফ্লিটের নেতৃত্বে ছিল দশম ও চতুর্দশ ডেস্ট্রয়ার ফ্লোটিলা। এই ফ্লোটিলার অধীনে বিমানবাহী রণতরী এইচএমএস ফরমিডেবলসহ ব্যাটলশিপ এইচএমএস গ্রেহাউন্ড ও এইচএমএস গ্রিফিনের মতো জাহাজ ছিল। ব্রিটিশ বাহিনীর সাথে যুক্ত হয় অস্ট্রেলিয়ান নৌবাহিনীও। মিত্রবাহিনীর পক্ষে ব্রিটিশ রয়্যাল নেভির অধিনায়ক স্যার এডমিরাল কানিংহাম ও ইতালিয়ান নেভির পক্ষে এডমিরাল লাচিনো এই যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন।
২৭ তারিখ ইতালিয়ান অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত হন ব্রিটিশ ভাইস অ্যাডমিরাল প্রিধম-উইপল। ২৮ তারিখ ভোরে 'ভেট্টোরিও ভেনেতো' প্রথম ব্রিটিশ ক্রুজার গ্রুপকে আক্রমণ করে। কিন্তু ভাইস অ্যাডমিরাল প্রিধম পাল্টা আক্রমণ না চালিয়ে দক্ষিণ-পূর্বে অগ্রসর হতে থাকেন। ফলে ইতালিয়ানরা ব্রিটিশ ক্রুজার গ্রুপকে তাড়া করার এক খেলায় মেতে ওঠে। তবে কয়েকশ আর্মর শেল নিক্ষেপ করেও ইতালিয়ানরা খুব একটা সুবিধা করতে পারেনি। কারণ তাদের ছিল অনুন্নত ফাইন্ডিং ইকুইপমেন্ট। ফলে ব্রিটিশদের তাড়া করা বাদ রেখে তারা উত্তরে প্রধান যুদ্ধজাহাজ ভেনেতোর নিকটে অগ্রসর হয়। সাথে সাথেই ভাইস অ্যাডমিরাল প্রিধম তার ক্রুজারসমূহের কোর্স চেঞ্জ করেন ও ইতালিয়ানদের অনুসরণ শুরু করেন। অন্যদিকে অ্যাডমিরাল কানিংহাম তার এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার ফরমিডেবল থেকে ভেনেতোর ওপর বিমান আক্রমণ চালান।
২৯ মার্চ ভোরে ব্রিটিশ জাহাজ জার্ভিসের টর্পেডো আক্রমণে ইতালিয়ান ব্যাটলশিপ জারা ও ফ্লুমে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। সেই সাথে মিত্রবাহিনী সার্চলাইট জ্বালিয়ে ইতালিয়ানদের দৃষ্টিভ্রম তৈরি করে কাছ থেকে শেল নিক্ষেপ করতে থাকে। ফলস্বরূপ দুটি ইতালিয়ান ডেস্ট্রয়ার ক্ষতিগ্রস্ত হয় ও অপর দুটি ধোঁয়া সৃষ্টি করে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। ২৯ তারিখ রাতে অ্যাডমিরাল কানিংহাম ইতালিয়ান হাইকমান্ডকে যুদ্ধ বন্ধের সিগনাল দেন। কানিংহাম ইতালিয়ান রেস্কিউ শিপ ও মেডিকেল ইমার্জেন্সি শিপগুলোকে যুদ্ধক্ষেত্রে আসার সুযোগ করে দেবেন সেই মর্মে ইতালি পরাজয় স্বীকার করে নেয়। মাতাপানে মিত্রবাহিনীর বিজয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ জয়ের অন্যতম একটি চাবিকাঠি। এই যুদ্ধের পর ভূমধ্যসাগরে ব্রিটেন তার ঘাঁটিসমূহে শক্ত অবস্থান গড়ে তোলে ও নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখে।
ব্যাটল অফ আটলান্টিক
অন্য অনেক যুদ্ধের মতো ক্লাইম্যাক্স আক্রমণের মাধ্যমে সমাপ্তি এই যুদ্ধের ছিল না। ১৯৩৯ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত প্রায় ৬ বছর ধরে মিত্রবাহিনী ও জার্মান নেভির মধ্যে এই যুদ্ধ চলমান থাকে। এই যুদ্ধে জার্মান ইউ-বোটগুলোর প্রধান লক্ষ্য ছিল ইউরোপগামী মার্চেন্ট শিপ ধ্বংস করা ও পরোক্ষভাবে আটলান্টিক মহাসাগরের ওপর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখা।
ইউ-বোট স্ট্র্যাটেজি ছিল দ্রুতগামী ও নির্ভুল আক্রমণে পারদর্শী। ফলে আটলান্টিক মহাসাগরে বাণিজ্যিক জাহাজ, পণ্যবাহী জাহাজ ও যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাটলশিপগুলোর প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়। এমনকি পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে বড় আর জটিলতম নৌ-যুদ্ধ হলো এই ব্যাটল অফ আটলান্টিক।
১৯৩৯ এর আগস্টে যুদ্ধ শুরু হবার কিছুদিনের ভেতর জার্মান ইউ-বোট 'ডয়েচল্যান্ড' ব্রিটিশ যাত্রীবাহী জাহাজ 'এসএস এথেনিয়া'-তে হামলা চালিয়ে ডুবিয়ে দেয়। মূলত এই ঘটনার পরই কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ব্রাজিলের সম্মিলিত নৌবাহিনী জার্মান নৌবাহিনীর বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধের ঘোষণা দেয়। জার্মান সমরনায়কেরা এ বিষয়ে অবগত ছিলেন যে তাদের নৌ-শক্তি মিত্রবাহিনীর বিশাল রসদের কাছে কিছুই না। তাই তারা সাবমেরিনের সাহায্যে আকস্মিক আক্রমণ করে দ্রুত সরে পড়ার নীতি অবলম্বন করেন। আর এ কাজে প্রধান টার্গেটে পরিণত হয় বাণিজ্যিক জাহাজগুলো। পণ্য পরিবহন আটকানো মানে ব্রিটেন ও ফ্রান্সের রসদে টান পড়া আর এই সুযোগে জার্মান বিমানবাহিনী লন্ডন আক্রমণ করবে ও অন্যদিকে সাবমেরিনের ঝাঁক নিউ ইয়র্কে আক্রমণ চালিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের গর্ব মাটিতে মিশিয়ে দেবে- এটাই মূলত ছিল জার্মানদের কৌশল।
এমনকি একসময় বাণিজ্যিক জাহাজের এস্কর্ট হিসেবে নেভাল শিপ মোতায়েন করে আটলান্টিক পাড়ি দেয়ার ব্যবস্থাও করে মিত্রবাহিনী। ফলে টানা ৬ বছর ধরে চলা এই যুদ্ধে উভয়পক্ষের ব্যাপক প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতি হয়। শেষদিকে জার্মানরা স্থলভাগে কোণঠাসা হয়ে পড়লে স্বভাবতই আটলান্টিকের নিয়ন্ত্রণ সম্পূর্ণভাবে হারিয়ে ফেলে। এমনকি সেসময় দক্ষিণ আটলান্টিকে ব্রাজিলের নৌবাহিনীর কাছেও সম্মুখযুদ্ধে পরাজয় বরণ করে নাৎসি জার্মানির নৌসেনারা। কিন্তু এই জয়ের বিপরীতে মিত্রবাহিনীকে তার সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করতে হয়। প্রায় ৭২ হাজার সামরিক-বেসামরিক সদস্য, ৩,৫০০ এর বেশি মার্চেন্ট শিপ ও ১৭৫টি ব্যাটলশিপের সলিল সমাধি হয়েছে বিশাল আটলান্টিকের নীল জলরাশিতে।
ব্যাটল অফ দ্য কোরাল সি
১৯৪২ সালের মে মাসে যুক্তরাষ্ট্র ও অস্ট্রেলিয়ার সম্মিলিত নৌবাহিনীর সাথে জাপানের রয়্যাল নেভির মাঝে এই যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এটি বিশ্বের প্রথম ঐতিহাসিক নৌ-যুদ্ধ যেখানে এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার একে অপরের সাথে সম্মুখযুদ্ধে অংশ নেয়। যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন অ্যাডমিরাল চেস্টার ডব্লিউ নিমিত্জ, জেনারেল ম্যাকআর্থারের মতো সমরনায়কেরা।
মূলত দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা ও 'পোর্ট মোর্সবে'-তে ঘাঁটি স্থাপন করে অস্ট্রেলিয়া দখল করাই ছিল জাপানী নেভির প্রধান উদ্দেশ্য। অন্যদিকে দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরে কর্তৃত্ব বজায় রাখতে যুক্তরাষ্ট্রও এগিয়ে আসে। যুক্তরাষ্ট্রের এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার 'ইউএসএস লেক্সিংটন' ধ্বংসপ্রাপ্ত হলে জাপানীরা জয়ের পথে এগিয়ে যায়। কিন্তু পরবর্তীতে জাপানী এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার 'শোকাকু' নিজেও ক্ষতিগ্রস্ত হলে চাহিদামতো এয়ার সাপোর্ট না পেয়ে পিছু হটে জাপানের স্থলবাহিনী। ফলে, কৌশলগতভাবে ব্যাটল অফ দ্য কোরালে মিত্রবাহিনী জয় লাভ করে।
ব্যাটল অফ মিডওয়ে
ইম্পেরিয়াল জাপানী নেভি ও মার্কিন নৌবাহিনীর মধ্যে ১৯৪২ সালের জুনে প্রশান্ত মহাসাগরের মিডওয়ে দ্বীপের দখল নিয়ে এই যুদ্ধ সংঘটিত হয়। পার্ল হারবারে আক্রমণের ছয় মাসের মাথায় পুনরায় হারবারের পার্শ্ববর্তী মিডওয়েতে হামলা চালায় জাপান। জাপানের ইচ্ছা ছিল প্রশান্ত মহাসাগরে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করা। কিন্তু এই ইচ্ছার বিপরীতে বাধা ছিল যুক্তরাষ্ট্রের প্রশান্ত মহাসাগরীয় ফ্লিট। আর এই ফ্লিটের প্রধান ঘাঁটি ছিল পার্ল হারবার ও মিডওয়ে। ফলে মিডওয়ের দখল নেয়া মানে কার্যত পুরো প্রশান্ত মহাসাগরের দখল নেয়া।
এমনকি বলা হয়, জাপান যদি মিডওয়ের দখল নিতে পারতো তবে পুরো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ফল ওলট-পালট হবার সম্ভাবনাও ছিল। সুতরাং, জাপান-যুক্তরাষ্ট্র উভয়ের কাছেই এই দ্বীপ ও পার্ল হারবারেরর ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখা ছিল খুবই জরুরি। মিডওয়ের যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র কিছুটা ভাগ্যের সহায়তাও পেয়েছে বলতে হবে। কারণ জাপানী আক্রমণের খবর কোড অ্যানালাইসিস করে তারা আগেই জানতে পারে। এই সংকেতটি ফ্লিট রেডিও ইউনিট প্যাসিফিক বা Station HYPO-এর রেডিও সিগনাল কালেক্টরে ধরা পড়ে। এটি ছিল একটি JN-25b কোড, যা অ্যানালাইসিস করে জানা যায় জাপানী নেভি 'AF' নামের একটি জায়গায় হামলা চালাতে যাচ্ছে। পরবর্তীতে আরো একটি সংকেত রেডিও অপারেটিং সিস্টেমে ধরা পড়লে ইউএস ইন্টেলিজেন্স অফিসাররা আক্রমণের সম্ভাব্য তারিখ ও স্থান সম্পর্কেও অবগত হয়ে যান।
জুনের ৪ তারিখ ভোরে ইউএস এয়ারফোর্সের বিমান আগেই বেরিয়ে পড়ে জাপানী অবস্থান সম্পর্কে জানতে। একই সময়ে ৬৭টি ডাইভ বম্বার ও ২০টি ফাইটার জেটের সমন্বয়ে মিডওয়ের দিকে ধেয়ে আসে প্রথম জাপানী আক্রমণ। কিন্তু জাপানী নেভি আক্রমণ চালানোর আগেই যুক্তরাষ্ট্র জাপানী অবস্থানে আক্রমণ চালিয়ে বসে। আগে থেকে প্রস্তুত থাকা ইউএসএস হর্নেট, ইউএসএস এন্টারপ্রাইজ ও ইউএসএস ইয়র্কটাউন একইসাথে বিমান ও টর্পেডো হামলা করে জাপানী অবস্থানে। এর কিছু সময় পর জাপানের অন্য জাহাজ থেকে ইয়র্কটাউনে হামলা চালানো হয় এবং দ্বিতীয় আক্রমণের পরেই ইয়র্কটাউন অকেজো হয়ে যায়। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র কৌশলগতভাবে এগিয়ে থাকায় নিজেরা একটি ক্যারিয়ার হারানোর বিনিময়ে জাপানের ৩টি ক্যারিয়ার ডুবিয়ে দেয় প্রায় কাছাকাছি সময়ের ব্যবধানে।
পরদিন ভোরে জাপানী অ্যাডমিরাল নাগুমো দ্বিতীয়বার হামলা করেন মিডওয়েতে। অন্যদিকে ইউএসএস এন্টারপ্রাইজের রাডারে জাপানী ফ্লিটের অবস্থানও নিশ্চিত হয়ে পড়ে। পরবর্তী দুদিন আক্রমণ ও পাল্টা আক্রমণের ভেতর দিয়েই চলতে থাকে। কিন্তু ইউএস নেভির প্রায় নির্ভুল টর্পেডো আক্রমণে দিশেহারা হয়ে পড়ে জাপানীরা। জুনের ৬ তারিখে জাপানী নেভির অধিনায়ক অ্যাডমিরাল ইয়ামামোটো তার অবশিষ্ট ফ্লিটকে সরে আসার নির্দেশ দেন। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের বিজয় নিশ্চিত হয় এই যুদ্ধে।
এই যুদ্ধে জাপানী নেভি প্রায় ৩,০০০ সদস্য, ৩০০ এয়ারক্রাফট ও ৪টি ক্যারিয়ার হারায়। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের ১৪৫টি এয়ারক্রাফট ও ১টি ক্যারিয়ার ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। মিডওয়ে ব্যাটল ইউএস নেভির ইতিহাসে অন্যতম ঐতিহাসিক যুদ্ধজয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, যুক্তরাষ্ট্র মিডওয়ের দখল হারিয়ে ফেললে জাপান পুরো প্রশান্ত মহাসাগরের নিয়ন্ত্রণ নিতে পারত, যা পারতপক্ষে বিশ্বযুদ্ধের ফল ঘুরিয়ে দেওয়ার মতো কার্যকর হতো।
ব্যাটল অফ ফিলিপাইন সি
ফ্লিট ক্যারিয়ারসমূহের মধ্যে সরাসরি যুদ্ধের শেষ লড়াই ছিল ব্যাটল অফ ফিলিপাইন। এই যুদ্ধজয়ের জন্য জাপান তার সর্বশক্তি প্রয়োগ করে। ১৯৪৪ সালের জুন মাসে জাপান ৫টি এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ারকে ফিলিপাইন সমুদ্রে পাঠায় ঐ অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের নৌশক্তিকে চিরতরে ধ্বংস করার জন্য। বিপরীতে যুক্তরাষ্ট্রের পঞ্চম নৌবহরের সাতটি ক্যারিয়ার এই যুদ্ধে অংশ নেয়।
এরিয়াল অ্যাটাক, সাবমেরিন অ্যাটাক, কাউন্টার অ্যাটাক ও প্রতিদিন ভোররাতে একের পর এক আক্রমণে জাপানের বেশ ক্ষয়ক্ষতি হয়। জাপানিরা তাদের ৩টি ক্যারিয়ার হারিয়ে কার্যত তাদের নৌশক্তি অনেকটাই দুর্বল হয়ে যায়। অন্যদিকে ইউএসএস সাউথ ডেকোটার সামান্য ক্ষতি ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের বাকি ৬টি ক্যারিয়ারই বহাল তবিয়তে ফেরত আসে। এন্টি এয়ারক্রাফট গানের মাধ্যমে জাপানের ব্যাপক সংখ্যক যুদ্ধবিমানকে সাগরে বিধ্বস্ত করে যুক্তরাষ্ট্রের নৌসেনারা। ব্যাটল অফ ফিলিপাইনে পরাজয়ের পর জাপান ঐ অঞ্চলে তার কর্তৃত্ব হারিয়ে ফেলে। এর পাশাপাশি গুয়ামে শক্ত বিমান ও নৌঘাঁটি স্থাপন করে যুক্তরাষ্ট্র।
ব্যাটল অফ লিত গাল্ফ
ব্যাটল অফ ফিলিপাইন সি-তে পরাজয়ের পর একই বছরের অক্টোবরে ফিলিপাইনের মার্কিন নৌঘাঁটি ও প্যাসিফিক এরিয়া পুনরায় নিজের দখলে নিতে আরেকটি সামরিক আগ্রাসন চালায় জাপান। এবারও এয়ার ও নেভাল অ্যাটাক একসাথে চালিয়ে মার্কিন সামরিক ঘাঁটি উচ্ছেদের পরিকল্পনা করা হয়। কিন্তু ততদিনে গুয়াম ও ফিলিপাইনে বেশ শক্ত অবস্থান নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।
জাপানীরা যুক্তরাষ্ট্রের তৃতীয় নৌবহরের জন্য একটি ফাঁদ পাতে। তাদের পরিকল্পনা ছিল যখন তৃতীয় নৌবহর ফাঁদে পা দিয়ে এগিয়ে যাবে তখন জাপানের ফার্স্ট অ্যাটাক ফোর্স উত্তর দিক থেকে এগিয়ে এসে আক্রমণ চালাবে এবং সেকেন্ড ও থার্ড অ্যাটাক ফোর্স দক্ষিণ দিক থেকে মিন্দানাও সাগর অতিক্রম করে মিন্দানাও উপকূলে হামলা করবে। তৃতীয় নৌবহর ফাঁদে পা দিয়ে সরে যাওয়ার পর ২৩ তারিখ সপ্তম নৌবহরের একটি সাবমেরিনের কাছে জাপানের ফার্স্ট অ্যাটাক ফোর্সের অবস্থান প্রকাশ হয়ে পড়ে। ফলে সম্ভাব্য ক্ষতি অনেকাংশে এড়াতে সক্ষম হয় যুক্তরাষ্ট্র।
ঐদিন ভোররাতে ফার্স্ট অ্যাটাক ফোর্সের ডেস্ট্রয়ারের ওপর টর্পেডো আক্রমণ চালায় সাবমেরিনটি। এরপর ২৫ তারিখ বড় ধরনের তিনটি যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এই যুদ্ধের ভেতর ইউএসএস প্রিন্সটন ও জাপানের একটি ফ্লিট ক্যারিয়ার ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। কিন্তু জাপান সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। প্রায় সবক'টি ক্যারিয়ারের পাশাপাশি দেশের শ্রেষ্ঠ নৌ যোদ্ধাদের হারায় দেশটি। ফলে প্যাসিফিক অঞ্চলে পুনরায় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় বিফল হয় তারা। যেসকল যুদ্ধ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরিণতি নির্ধারণে ভূমিকা রেখেছে, ব্যাটল অফ লিত গাল্ফ সেগুলোর অন্যতম।
মূলত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যতগুলো বড় ধরনের নৌ-যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে তার প্রায় প্রতিটিতেই মিত্রবাহিনী বিজয় অর্জন করেছে। আর মিত্রবাহিনীর এই কৃতিত্বের অন্যতম ভাগীদার হলেন তৎকালীন ইউএস নেভির প্রশান্ত মহাসাগরীয় ফ্লিটের অধিনায়ক, ফ্লিট অ্যাডমিরাল চার্লস ডব্লিউ নিমিত্জ। ১৯৪৫ সালের ২রা সেপ্টেম্বর তার উপস্থিতিতেই মিত্রবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে জাপান। কৌশলগতভাবে প্রতিটি নৌ-যুদ্ধই অনেক বড় ভূমিকা রেখেছিল বিশ্বযুদ্ধে। কিছু গুরুত্বপূর্ণ ও ঐতিহাসিক নৌ-যুদ্ধ মিত্রবাহিনী জয়লাভ করতে না পারলে আজকে হয়তো আমরা বিশ্বযুদ্ধের ভিন্ন ইতিহাস পড়তাম।
আরো জানতে পড়ুন বই, কিনুন অনলাইনে- দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ
This Bengali article discuses about some of the notable sea battles of the second world war.
Reference:
1. Here's how 10 of the largest and most important naval battles in modern history played out