Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website. The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

অপারেশন অ্যানাকোন্ডা: আফগান যুদ্ধে মার্কিনদের অন্যতম সফল সামরিক অভিযান

২০০২ সালের ফেব্রুয়ারি মাস। আফগান যুদ্ধ শুরু হয়েছে তখনো ১ বছরও হয়নি। বিশেষ বাহিনীর গোয়েন্দাদের কাছে তথ্য এলো যে, পাকিটিয়া প্রদেশের শাহীকোট উপত্যকায় জমা হচ্ছে তালেবান এবং বিশেষ করে আল কায়েদার যোদ্ধারা, প্রস্তুতি নিচ্ছে বড় অপারেশনের। ৯ কিলোমিটার লম্বা এবং ৫ কিলোমিটার চওড়া শাহীকোট উপত্যকার স্পষ্টত দুটি ভাগ রয়েছে। একটিকে বলা হয় উর্ধ্বস্থিত শাহীকোট, অপরটি নিম্নস্থিত শাহীকোট। গোয়েন্দা তথ্য অনুযায়ী যোদ্ধারা নিম্নস্থিত শাহীকোটে অবস্থান নিয়েছে। আরো গভীর পর্যবেক্ষণে যোদ্ধাদের আনুমানিক সংখ্যা ২০০-৩০০ এর মধ্যে আছে বলে জানা যায়। তবে যে ব্যাপারটি মার্কিন বাহিনীকে অধিকতর আকৃষ্ট করে তোলে, তা হচ্ছে সেখানে জালালুদ্দীন হাক্কানি কিংবা সাইফ রহমানের মতো ‘হাই ভ্যালু টার্গেট’এর উপস্থিতি থাকার সম্ভাবনা। দ্রুতই সিদ্ধান্ত হয়ে গেল শাহীকোট উপত্যকায় সামরিক অভিযান চালানোর।

শাহীকোট উত্যকার অবস্থান; source: connecticutmag.com

সব পরিকল্পনা ঠিক হলে এই অভিযানের নাম দেয়া হয় ‘অপারেশন অ্যানাকোন্ডা’। উপত্যকার অবস্থানের কারণে অত্যন্ত সাদামাটা একটি পরিকল্পনা সাজানো হয়। অপারেশন পরিচালনা করবে দুটি পৃথক দল ‘টিএফ হ্যামার’ এবং ‘টিএফ এনভিল’। হ্যামার গঠিত হয় ‘এএমএফ’ তথা ‘অ্যালাইড মোবাইল ফোর্স’ এবং মার্কিন যৌথ বাহিনীর সৈন্যদের নিয়ে। অন্যদিকে এনভিলে ছিল ‘এফও’ তথা ‘অ্যাডভান্সড ফোর্স অপারেশন’ এবং ১৮৭ রেজিমেন্টের সৈন্যরা।

পরিকল্পনাটি সহজ ভাষায় সংক্ষেপে বর্ণনা করলে এরূপ হয় যে, টিএফ হ্যামার শাহীকোটের উত্তর দিক থেকে প্রথমে আক্রমণ করবে। তারা আল কায়েদা যোদ্ধাদের পিছু হটিয়ে সেরখানখেল এবং মারজাক গ্রামের মধ্য দিয়ে নিয়ে যাবেন উপত্যকার শেষ প্রান্তে পলায়নের একমাত্র পথের দিকে। সেখানে পূর্বেই অবস্থান নিয়ে অপেক্ষা করবে টিএফ এনভিল। আল কায়েদা যোদ্ধারা পৌঁছুলে তারা আক্রমণ করবে। ফলে উভয় দিকের আক্রমণে কোণঠাসা হয়ে তারা আত্মসমর্পণ করবে অথবা যুদ্ধ চালিয়ে গেলে তাদের হত্যা করা হবে।

১৮৭ রেজিমেন্টের কয়েকজন সৈন্য; source: xn--b1amnebsh.ru-an.info

২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০০২; শাহীকোট উপত্যকা অঞ্চলে ঝড়ো আবহাওয়া, চলছে মুষলধারে বৃষ্টি। এই আবহাওয়ায় পথ চলাটাও বেশ কষ্টসাধ্য। তবে ব্যাপারটা একদিক থেক সুবিধাজনকই হলো। বজ্রপাতের গুড়ুম গুড়ুম শব্দে ঢাকা পড়লো চিনকুক বিমানগুলোর শব্দ, যেগুলো রাতের আঁধারে উপত্যকার উত্তর দিকে নামিয়ে দিয়ে গেল তিনটি এএফও কর্মকর্তাদের দল। দল তিনটির কোডনেম যথাক্রমে জুলিয়েট, ইন্ডিয়া এবং ম্যাকো। জুলিয়েট পূর্বে এবং ইন্ডিয়া দক্ষিণ-পশ্চিমের দুটি পৃথক গোপন স্থানে গিয়ে অবস্থান নিল। শেষোক্ত দল ম্যাকো চলে গেলো একেবারে দক্ষিণে। এই তিনটি দলেরই মূল কাজ ছিল পুরো অঞ্চল জুড়ে, পরদিন অভিযানে আসা সৈন্যদলের জন্য শক্তিশালী নেটওয়ার্কিং এর ব্যবস্থা করা।

মূল অভিযান শুরু হয় মার্চের ১ তারিখ। সেদিনের পরিকল্পনায় জুলিয়েট এবং ইন্ডিয়ার আগের অবস্থানেই থাকার পরিকল্পনা ছিল। দায়িত্ব ছিল নেভি সিলদের দল ম্যাকোর উপর, উপত্যকার সর্বোচ্চ স্থানে গিয়ে একটি পর্যবেক্ষণ ঘাটি স্থাপনের। কিন্তু, যথাস্থানে পৌঁছে ম্যাকোর সদস্যরা দেখলেন যে সেখানে বিদ্রোহীদের ৬ জনের একটি দল ইতোমধ্যেই অবস্থান করছে। পুরো এলাকা জুড়ে বিদ্রোহী যোদ্ধারা যেন সতর্ক না হয়ে যায়, সেজন্য সিদ্ধান্ত হলো সন্ধ্যা নামলেই আক্রমণ করে পর্যবেক্ষণের ক্যাম্পটি মুক্ত করা হবে। সেদিনের নাটকীয়তা বলতে এতটুকুই। সন্ধ্যায় ম্যাকোর সিল সদস্যরা ৬ জন বিদ্রোহীকে সহজেই হত্যা করতে সক্ষম হন এবং ক্যাম্পটি আয়ত্ত করেন।

টিএফ এনভিলের একাংশ; source: TripAdvisor

২ মার্চ; মধ্যরাতে টিএফ হ্যামার, শাহীকোট থেকে ৩০ মাইল দূরবর্তী মার্কিন সামরিক ঘাঁটি থেকে ট্রাক এবং অন্যান্য সামরিক যানে চড়ে শাহীকোটের দিকে রওনা দেয়। পথিমধ্যে অন্য কোনো বিপদ না ঘটলেও, খানাখন্দে ভরা পথ নিজেই একটি বিপদ হয়ে দাঁড়ায়। টিএফ হ্যামারে মোট সৈন্যসংখ্যার প্রায় ৮০ ভাগই ছিল আফগান সৈন্য। তাদের দুটি ট্রাক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে উল্টে যায় এবং একাধিক সৈন্য আহত হন। আহতদের ফেরত পাঠিয়ে টিএফ হ্যামার সকাল ৬টা বেজে ১৫ মিনিটের সময় শাহীকোট পৌঁছে। ৭.১০ মিনিটে তাদের অভিযান শুরু হওয়ার কথা। অর্থাৎ, হাতে ছিল ৫৫ মিনিট। এই সময়টুকুতে এফ-১৫ই বিমান এসে অন্তত ২০টি চিহ্নিত স্থানে গোলাবর্ষণ করার কথা, যেখানে শত্রুদের অবস্থান রয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। কিন্তু সাতটা বাজতে যখন মাত্র ১০ মিনিট বাকী, তখনো আকাশে বিমানের কোনো সাড়া শব্দ নেই। বিমান সহায়তা ছাড়া যে এই মিশন ‘সুইসাইড মিশন’ হবে, তা কারোরই অজানা ছিল না।

ঠিক সাতটার সময় আকাশে উড়ে আসে দুটি এফ-১৫ই বিমান এবং মাত্র ৬টি বোমা ফেলেই সেগুলো চলে যায়! অন্যদিকে, হ্যামারের আফগান সৈন্যদের ইউনিট যে দিক দিয়ে প্রবেশ করবে, সেদিকে কোনো বোমাই পড়লো না! এই ঘটনা নিয়ে পরবর্তীতে অনেক বিতর্ক হয়েছে। এফ-১৫ই বিমানের পাইলটেরা বলেছেন, ছয়টি বোমা ফেলার পরই তাদেরকে থামতে বলা হয়। অনেক বিশ্লেষক তাই এ ঘটনাকে নিছক একটি যোগাযোগ বৈকল্য অভিহিত করেছেন। যা-ই হোক, পরিকল্পনা অনুযায়ী মিশন না আগানোয় হতাশ আফগান সৈন্যরা যথাসময়ে সামনে এগোতে শুরু করেন। তবে প্রত্যাশার চেয়ে বেশি সংখ্যক (বিমান হামলার পর এক-তৃতীয়াংশ বেঁচে থাকবে বলে ধারণা ছিল) আল কায়েদা যোদ্ধার মোকাবিলা করতে গিয়ে প্রাণ হারান ৪০ এর অধিক আফগান সৈন্য।

এসি-১৩০ যুদ্ধ বিমান; source: military.wikia.com

সকাল আটটার দিকে উপত্যকার সর্বদক্ষিণে, বিদ্রোহীদের পলায়নের পথে অবতরণ করতে শুরু করে ১৮৭ রেজিমেন্টের সৈন্যরা। চিনকুক বিমানগুলো যখন তাদের নামিয়ে দিয়ে চলে যাচ্ছে, তখন সকলকে হতভম্ব করে দিয়ে একযোগে আক্রমণ করে বসে আল কায়েদা যোদ্ধারা। তারা অ্যান্টি-এয়ারক্রাফট গান ‘যেপিইউ-১’ দ্বারা অনবরত গোলা ছুড়তে শুরু করলে বিধ্বস্ত হয় দুটি চিনকুক হেলিকপ্টারই। তাছাড়া, বিদ্রোহীদের সংখ্যা দেখেও বিস্মিত হন ১৮৭ রেজিমেন্টের সৈন্যরা। যেখানে ধারণা করা হয়েছিল পুরো এলাকায় বিদ্রোহীর সংখ্যা হবে ২০০ থেকে ৩০০, সেখানে সংখ্যাটা মনে হচ্ছিল হাজারের অধিক!

যা হোক, আল কায়েদা যোদ্ধাদের সাথে রেজিমেন্ট সৈন্যদের সাথে প্রচণ্ড রকমের গোলাগুলি শুরু হয়। তাদের সাথে ছিল অ্যালাইড ফোর্সের সদস্যরা, মূলত জার্মান, অস্ট্রেলিয়ান, কানাডিয়ান এবং আফগান। হঠাৎ সকলকে স্তব্ধ করে দিয়ে, এক কোণে অবস্থান নেয়া রেজিমেন্টের কমান্ডারদের উপর গিয়ে আঘাত হানে বিদ্রোহীদের একটি আরপিজির গোলা। চোখের পলকে ছিন্নভিন্ন হয় ১০ জন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার দেহ, রেজিমেন্ট হয়ে পড়ে নেতৃত্ব শূন্য! কিন্তু সিনেমার নায়কের নাটকীয় আগমনের মতোই, দৃশ্যপটে আবির্ভাব ঘটলো সার্জেন্ট রোপেলের, যিনি কিনা নেতৃত্বের দায়িত্বটা কাঁধে নিয়ে নিলেন। ১০/১২ জন্য সৈন্যকে সাথে নিয়ে তিনি ক্ষিপ্র গতিতে পরিখাগুলোর মধ্য দিয়ে গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে সামনে এগিয়ে গেলেন, এবং কয়েক মিনিটের ব্যবধানে শত্রুদের পিছু হটালেন, অভীষ্ট স্থানে নিজেদের অবস্থান সংহত করলেন! এই সাহসীকতার জন্য পরবর্তীতে ‘গেলান্টারি’ মেডাল পান রোপেল। এরপর ধীরে ধীরে সে স্থান থেকে পিছু হটে উপত্যকার ভেতরে চলে যায় জীবিত যোদ্ধারা। ‘এক্সিট পয়েন্ট’ দখলে আসার সংবাদ পেতেই শুরু হয় ম্যাকোর তৎপরতা। এই দলের দুটি ইউনিট ম্যাকো-৩০ এবং ম্যাকো-২১, দুটি এমএইচ-৪৭ বিমানে চড়ে রওনা হয়ে যায় ৩,০০০ মিটার উঁচু ঠাকুরগর পর্বতে অবজারভেশন ক্যাম্প স্থাপনের জন্য।

ঠাকুরগরে মার্কিন সৈন্যরা অবতরণ করেই আফগানদের মেশিনগানের তোপের মুখ পড়েন (কাল্পনিক ছবি); source: airsoft.ua

৪ মার্চ রাত ৪টা; পাহাড়ের উপর কোনো প্রাণের অস্তিত্ব না দেখে অবতরণের প্রস্তুতি নিতে থাকে আমেরিকান নেভি সিল এবং বিশেষ বাহিনীর সদস্যদের দুটি দল, ম্যাকো-২১ এবং ম্যাকো-৩০। ভূমির প্রায় কাছাকাছি আসতেই ম্যাকো-২১ এর হেলিকপ্টারে আঘাত করে একটি আরপিজি। বিমান থেকে নীচে পড়ে যান সিল সদস্য রোবার্টস। আর বিমানটি আকাশে ইতস্তত ঘুরতে ঘুরতে পর্বত চূড়া থেকে ৪ কিলোমিটার দূরের পাদদেশে গিয়ে কোনোমতে অবতরণ করে। এদিকে রোবার্টসকে রক্ষা করতে তৎক্ষণাৎ ম্যাকো-৩০ এর সদস্যরা পর্বত চূড়ায় অবতরণ করেন। কিন্তু শত্রুপক্ষের ভারী গোলাবর্ষণে মুহূর্তে প্রাণ হারান সারজেন্ট শ্যাপম্যান, আহত হন আরো ৩ জন। ফলে রোবার্টসকে রেখেই পর্বতচূড়া থেকে কিছুটা নীচে অবস্থান নিতে বাধ্য হয় ম্যাকো-৩০।

১ ঘন্টার মধ্যেই দূরে অবতরণ করা ম্যাকো-২১ দল পৌঁছে যায় চূড়ায় এবং যোগ দেয় ম্যাকো-৩০ এর সাথে। তবে শত্রুপক্ষের মেশিনগানের অনবরত গুলির বাঁধা পেরিয়ে তাদের পক্ষে সামনে এগোনো সম্ভব হচ্ছিল না। এরই মাঝে বাগ্রাম বিমানঘাঁটি থেকে একটি এসি-১৩০ এবং একটি সিএইচ-৪৭ বিমান উড়ে আসছিল ঠাকুরগরের দিকে, অ্যামবুশের কবলে পড়া দল দুটিকে রক্ষা করতে। প্রথমে এসি বিমানটি পর্বত চূড়ার উপর দিয়ে উড়ে গিয়ে শত্রুদের অবস্থানে গোলাবর্ষণ করবে এবং কিছুক্ষণ পর সিএইচ বিমানটি এসে তাদেরকে উদ্ধার করবে, উদ্ধার পরিকল্পনাটি ছিল এমনই। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে যোগাযোগের সমস্যার কারণে এসি বিমানের পাইলট বুঝতে পারেননি গোলা ছাড়ার নির্দেশ। ‘লোকেশন নট কনফার্মড’ ভেবে তিনি গোলাবর্ষণ না করেই ফিরে যান! এর কিছুক্ষণ পর যখন সিএইচ বিমানটি উড়ে আসে পর্বত চূড়ায়, মুহূর্তেই তা জেপিইউ এবং আরপিজির আঘাতে ধ্বংস হয়!

রেঞ্জার্সদের উদ্ধারকারী দল নিয়ে শাহীকোটের দিকে উড়ে যাচ্ছে দুটি চিনকুক বিমান; source: commons.wikimedia.org

এই গোলাগুলির মধ্য দিয়েই রাত পেরিয়ে ভোরের আলো ফুটতে শুরু করলো। কিন্তু বিদ্রোহীদের কবল থেকে নিরপদে বেরিয়ে আসবার কোনো উপায় খুঁজে পাচ্ছিল না ম্যাকো-২১ ও ৩০। সকাল ছয়টা নাগাদ তাদের সহায়তার জন্য পর্বত চূড়ায় পৌঁছায় রেঞ্জারদের একটি ‘কুইক রিঅ্যাকশন টিম’। দুর্ভাগ্য রেঞ্জারদেরও পিছু নেয়। বিমানের দরজাতেই মাথায় গুলিবিদ্ধ হন সার্জেন্ট ফিলিপ। বিমানের প্রোপেলারে আরপিজির আঘাতে বিমানটি আছড়ে পড়ে ভূমিতে। মারা যান আরো তিনজন। ক্রমাগত মৃত্যুর মিছিলে যোগ দিতে থাকে নতুন নতুন নাম। উদ্ধার করতে এসে উদ্ধারকারীরাই বিপদে পড়ে যান! ভারী মেশিনগানের গুলির আওতায় ধীরে ধীরে এগোতে থাকে আল কায়েদা যোদ্ধারা। এক কোণে আটকে থাকা সৈন্যরা তখন সবদিক থেকে পর্যুদস্ত হয়ে আশাহীন।

এরকম অবস্থায় আরো একবার সিনেম্যাটিক নাটকীয়তা ঘটলো! প্রথম যে চিনকুক বিমানটি ধরাশায়ী করেছিল বিদ্রোহীরা, সেটি থেকে তিনজন সৈন্য নিরাপদে বেরিয়ে একটি বাঙ্কারে লুকিয়ে ছিলেন। বিদ্রোহীরা ধীরে ধীরে সামনে এগোতে থাকলেও, তাদের অবস্থান গোপনই থেকে যায়। সকাল প্রায় ৮টা নাগাদ সুযোগ বুঝে একযোগে গুলি ছুঁড়তে শুরু করেন এই তিনজন। থেমে যায় আল কায়েদা যোদ্ধাদের মেশিনগান, অপ্রত্যাশিত আক্রমণে দিশেহারা হয়ে পড়েন অনেকে। আর এই সুযোগে ম্যাকো-২১/৩০ এবং উদ্ধার করতে আসা রেঞ্জাররা পুনরোদ্দমে আক্রমণ করেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই পৌঁছে যায় দুটি এসি বিমান, যেগুলোর গোলাবর্ষণে ঝাঁঝরা হয়ে যায় আল কায়েদা যোদ্ধাদের ক্যাম্প। ‘ব্যাটেল অব ঠাকুরগর’ এ জয় হয় মার্কিন বাহিনীর, মারা যায় অধিকাংশ আল কায়েদা যোদ্ধা। তবে, সিল অফিসার রোবার্টসকে আর পর্বতচূড়ায় খুঁজে পাওয়া যায়নি। ধারণা করা হয়, তাকে আল কায়েদা সদস্যরা তুলে নিয়ে গিয়েছিল।

হেলিকপ্টারের জানালা থেকে পড়ে যাওয়া নেইল সি রোবার্টস; source: zpravy.idnes.cz

৫-১০ মার্চ পর্যন্ত মার্কিন যোদ্ধারা ঠাকুরগর এর আশেপাশের অঞ্চল সহজেই নিজেদের নিয়ন্ত্রণে আনে। ১০ মার্চ মেজর হিলফার্টি ঘোষণা দেন যে আসল যুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে। ৪ শতাধিক মার্কিন সৈন্য ফিরে যায় বাগ্রাম ঘাঁটিতে। ১২ মার্চ শাহীকোট উপত্যকা ত্যাগ করে ১৮৭ রেজিমেন্টের সকল ক্লান্ত সৈন্যরা। তাদের পরিবর্তে সেদিনই সন্ধ্যায় শাহীকোট পৌঁছে যায় মার্কিন যৌথ বাহিনীর একটি দল। পরবর্তী ছয়দিন যাবত পুরো উপত্যকায় চিরুনি তল্লাসি চালায় মার্কিন এবং আফগান বাহিনী। এ সময় ছোটখাট কিছু গোলাগুলির ঘটনা ঘটলেও, মার্কিন যৌথ বাহিনী এবং মিত্র বাহিনীর আর কোনো হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। ১৮ মার্চ জেনারেল টমি ফ্র্যাংকস অপারেশন অ্যানাকোন্ডাকে ‘কমপ্লিট সাকসেস’ হিসেবে অভিহিত করে অভিযানটির সমাপ্তি ঘোষণা করেন।

অপারেশন অ্যানাকোন্ডা প্রকৃতপক্ষেই মার্কিন বাহিনীর জন্য একটি বড় সাফল্য ছিল। ‘টোরা বোরা’ অভিযানের পর (যে অভিযান থেকে ওসামা বিন লাদেন অল্পের জন্যে জীবন নিয়ে পালিয়েছিলেন) সেখান থেকে পলায়ন করা অধিকাংশ আল কায়েদা যোদ্ধা এই শাহীকোট উপত্যকায় আশ্রয় নিয়েছিলেন। অ্যানাকোন্ডার পর পুরো পাকিটিয়া প্রদেশেই আল কায়েদার প্রভাব কমে যায়। ২ থেকে ১৮ তারিখ পর্যন্ত চলা অভিযানে মোট আটজন মার্কিন সেনা মৃত্যুবরণ করেন, যাদের ৭ জনই ঠাকুরগরের যুদ্ধে মারা যান। অন্যদিকে অন্তত অর্ধশতাধিক আফগান সৈন্য মারা যান যুদ্ধের বিভিন্ন দিনে। অন্যদিকে আল কায়েদা যোদ্ধাদের হতাহতের প্রকৃত সংখ্যাটা অজানা। মার্কিনদের দাবি, প্রায় ৮ শতাধিক আল কায়েদা যোদ্ধা নিহত হয়েছে এবং পাকিস্তান পালিয়ে গিয়েছে ২ শতাধিক। আবার আল কায়েদার দাবি একেবারেই বিপরীত! তাদের দাবি অনুযায়ী, ২০০ যোদ্ধা নিহত হয়েছে এবং পাকিস্তান পালিয়েছে ৫ শতাধিক। ফলে, শাহীকোট উপত্যকায় আসলে মোট কতজন আল কায়েদা যোদ্ধা ছিলেন, সে ব্যাপারটিও অস্পষ্ট হয়ে যায়!

একজন তালিবান সৈন্যের মৃতদেহ; source: globalECCO

যদিও কোনো হাই ভ্যালু টার্গেট এই অভিযানে ধরা পড়েনি, তথাপি মার্কিন এবং আফগান সৈন্যদের এই অভিযানটি পাকিটিয়া প্রদেশের অবস্থা অনেকটাই স্থিতিশীল করতে সক্ষম হয়। অপারেশনের বর্ণনায় যে সকল তথ্য উপাত্ত রয়েছে, সেগুলোর অধিকাংশই বিতর্কিত। মার্কিন সেনাবাহিনী এবং আল কায়েদার কোনো তথ্যেই মিল নেই! এমনকি পরবর্তী সময়ে মিত্র বাহিনীর কর্মকর্তাদের (অস্ট্রেলিয়ান, জার্মান) দেয়া অনেক তথ্যও মার্কিনদের তথ্যের সাথে মেলেনি! অন্যদিকে, যুদ্ধের বিভিন্ন পর্যায়ের বর্ণনাগুলো যুদ্ধক্ষেত্রে উপস্থিত সৈন্যদের সাক্ষাৎকার থেকে পেয়েছিল বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম। অনেক বিশ্লেষক, সেগুলোকে কোনো ক্ষেত্রে অতিরঞ্জিত অভিহিত করেছেন! তবে, যেহেতু বিশ্ব মিডিয়ায় আমেরিকান সেনাবাহিনীর সরবরাহকৃত তথ্যই অধিক প্রচারিত এবং গৃহীত হয়েছে, সেহেতু এই লেখায় সেসব তথ্যই ব্যবহার করা হয়েছে।

ফিচার ছবি: solo-wallpapers.com

Related Articles