Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website. The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

অপারেশন অ্যাটলাস: ব্রিটিশ ও ইহুদীদের বিরুদ্ধে জার্মান-আরব যৌথ অভিযান

১৯৪৪ সালের ৬ অক্টোবর। গভীর রাত। মার্কিন বিমান বাহিনীর কাছ থেকে দখল করা একটি বি১৭ ফ্লাইয়িং ফোরট্রেস বিমান জার্মানি থেকে উড়ে এলো ফিলিস্তিনের আকাশে। নিচে অবস্থিত পশ্চিম তীরের জেরিকোবাসী তখন গভীর ঘুমে অচেতন। তাদের অলক্ষ্যে বিমানটি থেকে প্যারাস্যুটে করে একের পর এক ঝাঁপিয়ে পড়ল পাঁচ কমান্ডো। তাদের লক্ষ্য, নাৎসি বাহিনীর হয়ে ব্রিটিশদের নিয়ন্ত্রণে থাকা ফিলিস্তিনের অভ্যন্তরে একটি গোপন তথ্য সংগ্রহ কেন্দ্র স্থাপন করা এবং সংগৃহীত গোয়েন্দা তথ্য রেডিওর মাধ্যমে নাৎসিদের হেড কোয়ার্টারে প্রেরণ করা। ‘অপারেশন অ্যাটলাস’ নামের দুঃসাহসী এই অভিযানের পাঁচ কমান্ডোর মধ্যে তিনজন ছিল জার্মান, আর বাকি দুজন ছিল আরব। আরব দুজনই ছিল জেরুজালেমের মুফতি আমিন আল-হুসেইনির অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সহযোগী। আর তাদের এই অপারেশনের পরিকল্পনাও করা হয়ে হয়েছিল মুফতির পরামর্শেই!

আমিন আল-হুসেইনি, ১৯২৯ সালে; Image Source: Wikimedia Commons

ফিলিস্তিনের জাতীয়তাবাদী নেতা হিসেবে মুফতি আমিন আল-হুসেইনির উত্থান এবং পরবর্তীতে তার জার্মানিতে আশ্রয় গ্রহণ ও হিটলারের সাথে মিত্রতা স্থাপনের প্রেক্ষাপট আমরা ইতোপূর্বে দুটি লেখায় আলোচনা করেছি। মূলত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে ঔপনিবেশিক ব্রিটিশদের হাত থেকে স্বাধীনতা লাভের আশায় এবং ইউরোপ থেকে ইহুদীদের গণহারে ফিলিস্তিনে প্রবেশ রোধ করার উদ্দেশ্যেই সেসময় মুফতি আমিন জার্মানির সাথে মিত্রতা স্থাপন করেছিলেন। যুদ্ধের অধিকাংশ সময় জুড়েই তিনি জার্মানিতে অবস্থান করেছিলেন এবং সেখানে থেকেই আরবদেরকে রেডিওতে ব্রিটিশ ও জায়নবাদী ইহুদীদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। ১৯৪৩-৪৪ সালের দিকে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে অনেকগুলো জার্মান-আরব যৌথ অপারেশন পরিচালিত হয়েছিল, যার কয়েকটিতে সম্পৃক্ততা ছিল মুফতি আমিনেরও। অপারেশন অ্যাটলাস ছিল সেরকমই একটি অপারেশন।

অপারেশন অ্যাটলাসের পাঁচ সদস্যের মধ্যে একজন ছিলেন মুফতি আমিনের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সহযোগী, হাসান সালামা। হাসান সালামা ছিলেন একেবারে শুরু থেকেই ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে এবং জায়নবাদী ইহুদীদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করা নেতাদের মধ্যে অন্যতম। ১৯৩৩ সালের আরব-ইহুদী দাঙ্গার সময় তিনি জাফ্ফার প্রতিবাদ মিছিলে অংশগ্রহণ করেছিলেন। পরবর্তীতে ১৯৩৬ সালে শুরু হওয়া আরব বিপ্লবেও তার ভূমিকা ছিল উল্লেখযোগ্য। এ সময় তিনি রেললাইন উড়িয়ে দেওয়া, ব্রিটিশদের টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা ধ্বংস করে দেওয়া, ইহুদীদের আক্রমণের বিরুদ্ধে সশস্ত্রভাবে লড়াই করা, তাদের উপর পাল্টা আক্রমণ করাসহ বিভিন্ন অপারেশনে নেতৃস্থানীয় ভূমিকা পালন করেছিলেন

হাসান সালামা; Image Source: Wikimedia Commons

ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর তীব্র অভিযানের মুখে আরব বিপ্লব ব্যর্থ হলে ১৯৩৯ সালে হাসান সালামা মুফতি আমিন আল-হুসেইনির সাথে প্রথমে লেবাননে এবং এরপর সেখান থেকে ইরাকে পালিয়ে যান। এ সময় তিনি বাগদাদের মিলিটারি কলেজ থেকে গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন করেন। ১৯৪১ সালে ব্রিটিশদের অনুগত সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার অভ্যুত্থানে তিনি অংশগ্রহণ করেন। পরবর্তীতে নতুন সরকারের বিরুদ্ধে ব্রিটিশদের অ্যাংলো-ইরাক যুদ্ধেও তিনি অংশগ্রহণ করেন। কিন্তু পরিস্থিতি প্রতিকূলে চলে যাওয়ায় মুফতির সাথে সাথে তিনি প্রথমে পারস্যে এবং পরবর্তীতে ইতালি হয়ে জার্মানিতে গিয়ে আশ্রয় নেন।

জার্মানিতে অবস্থানকালে হাসান সালামা মুফতির সিনিয়র সহকারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এ সময় তিনি জার্মানদের অধীনে কমান্ডো ট্রেনিং গ্রহণ করেন। তিনি জার্মান ফরেন ইন্টেলিজেন্স বিভাগ এএমটি৬ এর স্পেশাল কমান্ডো ইউনিটের সদস্য হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। কাজেই স্বাভাবিকভাবেই ১৯৪৪ সালে যখন অপারেশন অ্যাটলাসের পরিকল্পনা করা হয়, তখন যোগ্য এবং নিবেদিত সদস্য হিসেবে হাসান সালামাকে সেখানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। হাসান সালামা ছাড়া দ্বিতীয় যে আরব ঐ অপারেশনে অংশগ্রহণ করেছিল, তার নাম ছিল আব্দুল লতিফ। সালামার মতোই আব্দুল লতিফও ছিলেন মুফতি আমিনের ঘনিষ্ঠ এবং তাদের সাথে জার্মানিতে অবস্থানকারী। তিনি ছিলেন বার্লিন থেকে প্রচারিত মুফতির রেডিও অনুষ্ঠানের সম্পাদক

১৯৩৯ সালের আরব বিদ্রোহের সময় হাসান সালামা; Image Source: Wikimedia Commons

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষের দিকে মিত্রবাহিনী যখন জার্মানির কাছাকাছি পৌঁছে যায় এবং একদিকে রাইন নদী দিয়ে ও অন্যদিকে প্রুশিয়া দিয়ে জার্মানিতে প্রবেশের চেষ্টা করতে থাকে, তখন জার্মানরা মধ্যপ্রাচ্যে কিছু অপারেশন চালানোর পরিকল্পনা করে। তাদের লক্ষ্য ছিল মধ্যপ্রাচ্যকে অস্থিতিশীল করার মধ্য দিয়ে মিত্র বাহিনীর কিছু সৈন্যকে সেদিকে সরিয়ে নিতে বাধ্য করা, যেন তারা সহজে মিত্রবাহিনীর আক্রমণ প্রতিহত করতে পারে। এই অভিযানগুলোর অংশ হিসেবেই আয়োজন করা হয় অপারেশন অ্যাটলাসের। দায়িত্ব দেওয়া হয় উপরে বর্ণিত হাসান সালামা ও আব্দুল লতিফকে এবং সেই সাথে তিনজন জার্মানকে। এই তিনজন জার্মানই ছিল ফিলিস্তিন থেকে আসা সংখ্যালঘু টেম্পলার ধর্মীয় সম্প্রদায়ের অনুসারী, যারা পূর্ব থেকেই জায়নবাদীদের বিরোধী এবং নাৎসিদের প্রতি অনুগত ছিল।

অপারেশনের মূল দায়িত্ব দেওয়া হয় কার্ট ওয়াইল্যান্ডকে। কার্ট ওয়াইল্যান্ড ছিলেন ফিলিস্তিনে জন্মগ্রহণকারী জার্মান টেম্পলার সম্প্রদায়ের অনুসারী। তিনি ১৯৩৮ সালে হিটলার ইয়ুথের ফিলিস্তিনি শাখার প্রধান ছিলেন। পরবর্তীতে ফিলিস্তিন থেকে বহিষ্কৃত হয়ে তিনি নাৎসি বাহিনীতে যোগ দেন এবং ধীরে ধীরে মেজর পদে উন্নীত হন। অপারেশনের বাকি দুজন জার্মান সদস্যের একজন ছিলেন ওয়ার্নার ফ্রাঙ্ক এবং অন্যজন ছিলেন ফ্রেডেরিখ ডাইনিঞ্জার। ওয়াইল্যান্ডের মতোই তারাও ছিলেন ফিলিস্তিনি-জার্মান টেম্পলার।  এর মধ্যে ফ্রাঙ্ক প্যালেস্টাইন হিটলার ইয়ুথের সদস্য হওয়ার অভিযোগে ফিলিস্তিন থেকে বহিষ্কৃত হয়েছিলেন, অন্যদিকে ডাইনিঞ্জার আরব বিপ্লবে অংশ নেওয়ার অভিযোগে গ্রেপ্তার হয়ে পরে ফিলিস্তিন ত্যাগ করেছিলেন।

অপারেশনের দ্বিতীয় আরব সদস্য আব্দুল লতিফ; Image Source: Wikimedia Commons

অপারেশন শুরু হয় ১৯৪৪ সালের ৬ অক্টোবর। দখল করা একটি মার্কিন বি১৭ ফ্লাইয়িং ফোরট্রেস বিমানে করে জার্মানি থেকে ফিলিস্তিন পর্যন্ত উড়ে আসে অপারেশনের সদস্যরা। বিমানটি পরিচালনা করছিল জার্মান বিশেষ বাহিনী লুফটওয়াফে কেজি ২০০ এর সদস্যরা। পশ্চিম তীরের জেরিকো শহরের উপর আসার পর প্যারাস্যুটে করে একে একে ঝাঁপ দেয় তিন জার্মান এবং দুই আরব সদস্য। তাদের সাথে ছিল সাবমেশিনগান, ডিনামাইটসহ বিভিন্ন ধরনের বিস্ফোরক, রেডিও, কপি মেশিন, একটি জার্মান-আরবি অভিধান এবং ৫,০০০ পাউন্ড সমমূল্যের বিভিন্ন দেশীয় মুদ্রা ও স্বর্ণমুদ্রা। তাদের উদ্দেশ্য ছিল একটি ঘাঁটি স্থাপন করে ব্রিটিশদের সম্পর্কে গোয়ন্দা তথ্য সংগ্রহ করে জার্মানিতে প্রেরণ করা এবং অর্থ ও স্বর্ণের বিনিময়ে আরবদেরকে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নিয়োগ করা।

কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষভাগের অক্ষশক্তির অন্যান্য অপারেশনের মতোই এক্ষেত্রেও ভাগ্য অপারেশন অ্যাটলাসের প্রতি সুপ্রসন্ন ছিল না। অপারেশনে অংশগ্রহণকারী সদস্যদের প্যারাস্যুটগুলো জেরিকোর ভিন্ন ভিন্ন স্থানে গিয়ে পতিত হয়। তাদের সাথে থাকা অস্ত্র এবং যন্ত্রপাতি বহন করা বাক্সগুলোও ছড়িয়ে ছিটিয়ে ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় পড়ে। ব্রিটিশরা পূর্ব থেকেই পদত্যাগকারী জার্মান গোয়েন্দাবাহিনীর সদস্য এরিখ ভার্মিরেনের দেওয়া তথ্য থেকে এরকম একটি সম্ভাব্য অপারেশনের কথা জানতে পেরেছিল। ৮ অক্টোবর যখন তারা স্থানীয়দের কাছ থেকে জেরিকোর পাহাড়ি অঞ্চলে এক বাক্স স্বর্ণমুদ্রা পাওয়ার কথা জানতে পারে, তখনই তারা বুঝতে এটাই সেই অপারেশন। ফলে তারা সতর্ক হয়ে যায় এবং অপারেশন অ্যাটলাসের সদস্যদের সন্ধানে বিশাল অভিযান শুরু করে

অপারেশনের দুই জার্মান সদস্য কার্ট ওয়াইল্যান্ড (বামে) এবং ওয়ার্নার ফ্রাঙ্ক (ডানে); Image Source: Wikimedia Commons

দলনেতা কার্ট ওয়াইল্যান্ড, ওয়ার্নার ফ্রাঙ্ক এবং আব্দুল লতিফ পাশাপাশি স্থানে অবতরণ করেছিলেন। তারা একটি পাহাড়ের গুহায় আত্মগোপন করেন। মুফতি আমিন আল-হুসেইনির পরামর্শ অনুযায়ী তারা নাফিদ এবং আলি বে আল-হুসেইনি নামক স্থানীয় দুজন নেতার সাথে যোগাযোগ করেন। কিন্তু তৎকালীন পরিস্থিতি বিবেচনা করে ঐ দুই নেতা তাদেরকে কোনো রকম সাহায্য করতে রাজি হয়নি। ফলে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিতে পারার আগেই মাত্র দশদিনের মাথায়, অক্টোবরের ১৬ তারিখে স্বর্ণমুদ্রার সূত্র ধরে ট্রান্সজর্ডানিয়ান ফ্রন্টিয়ার ফোর্স তাদেরকে খুঁজে বের করে এবং গ্রেপ্তার করে

আরেক জার্মান সদস্য ডাইনিঞ্জার সঙ্গীদের গ্রেপ্তারের সংবাদ জানতে পেরে আত্মগোপনে চলে যান এবং প্রায় দেড় বছর পর নিজ পরিবারের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করতে গিয়ে গ্রেপ্তার হন। একমাত্র হাসান সালামাই শেষপর্যন্ত গ্রেপ্তার এড়িয়ে থাকতে পেরেছিলেন, যদিও তিনিও অপারেশনের মূল লক্ষ্যের কিছুই বাস্তবায়ন করতে পারেননি। প্যারাস্যুটে করে নামার সময়ই তিনি আহত হয়েছিলেন। আহত অবস্থায় তিনি জেরুজালেমে গিয়ে আশ্রয় নেন। সঙ্গীরা সবাই গ্রেপ্তার হয়ে যাওয়ায় তার একার পক্ষে আর কিছু করার ছিল না। তবে তার যুদ্ধ অবশ্য সেখানে শেষ হয়নি। ১৯৪৭-৪৮ সালের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধে তিনি জাইশ আল-জিহাদ আল-মুকাদ্দাসের একজন কমাণ্ডার হিসেবে আবির্ভূত এবং পরবর্তীতে ইরগুনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে গিয়ে শহীদ হন।

১৯৪১ সালের নভেম্বরে হিটলারের সাথে মুফতি আমিন আল-হুসেইনি; Image Source: Wikimedia Commons

অপারেশন অ্যাটলাসের উদ্দেশ্য সম্পর্কে বিকল্প একটি মত পাওয়া যায়। কিছু কিছু ইহুদী ইতিহাসবিদ দাবি করেন, এই অপারেশনের প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিল তেল-আবিবের পানির কুয়ায় বিষ মিশিয়ে দিয়ে ফিলিস্তিনের ইহুদীদেরকে হত্যা করা। তাদের দাবি অনুযায়ী, মুফতি আমিনের পরামর্শে এর সদস্যদের কাছে দশ বাক্স বিষাক্ত পাউডার দেওয়া হয়েছিল, যার প্রতিটি ২৫,০০০ মানুষকে হত্যা করতে সক্ষম ছিল। তাদের মতে, এই অপারেশন ছিল মূলত হিটলারের সাথে মুফতির সম্মিলিত ইহুদী গণহত্যা কার্যক্রমেরই একটি অংশ। তবে তাদের এই দাবি নিয়ে অনেক ইতিহাসবিদই সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। এবং এখন পর্যন্ত কোনো জার্মান অথবা ব্রিটিশ নথিপত্র থেকে এরকম কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।

ফিচার ইমেজ- Wikimedia Commons

Related Articles