Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

অপারেশন সাইক্লোন এবং আল কায়েদা সৃষ্টির নেপথ্যে আমেরিকা ও পাকিস্তান

“আমার শত্রুর শত্রু, আমার বন্ধু!”

– চাণক্য

এই উক্তিটি সবচেয়ে ভালো কারা প্রয়োগ করতে পেরেছে বলুন তো? অবশ্যই আমেরিকানরা! তারা এই উক্তিটিকে প্রতিষ্ঠিত করতে সফল হয়েছে। অসংখ্য উদাহরণের মধ্যে অপারেশন সাইক্লোন হতে পারে সবচেয়ে কুখ্যাত উদাহরণ। সোভিয়েত ইউনিয়ন আমেরিকার শত্রু, আর আফগান মুজাহিদিনরা হচ্ছে ‘ইউএসএসআর’ বা ‘ইউনাইটেড সোভিয়েত সোশ্যালিস্ট রিপাবলিক’ এর শত্রু। অতএব, সমীকরণে ফলাফল হচ্ছে, আফগান মুজাহিদিনরা আমেরিকার বন্ধু! এবং এই বন্ধুত্বের জন্য ১৯৭৯-৮৯ সাল পর্যন্ত, আমেরিকা অকাতরে সাহায্য করে গেছে তার ‘বন্ধুদের’, যাদের বিরুদ্ধে আজ তারাই লড়াই করছে, যাদেরকে আজ তারা সন্ত্রাসী এবং বিশ্বশান্তির জন্য হুমকি আখ্যা দিয়েছে! তারা কারা? উত্তরটা আপনার জানা আছে পাঠক, আল কায়েদা।

নূর মোহাম্মদ তারাকি; source: Pinterest

১৯৭৮ সালের ২৭ এপ্রিল। নূর মোহাম্মদ তারাকির নেতৃত্বে আফগানিস্তানের ক্ষমতা দখল করে কমিউনিস্টরা। তখন, তারাকির নেতৃত্বাধীন ‘পিপল’স ডেমোক্রেটিক পার্টি অব আফগানিস্তান’ বা পিডিপিএ’র মধ্যে আবার দুটি প্রধান দলাদলি ছিল। একটি হচ্ছে চরমপন্থী ‘খালক’, যার নেতৃত্বে ছিলেন হাফিজুল্লাহ আমিন। অপরটি মধ্যমপন্থী ‘পারশাম’, যার প্রধান ছিলেন তারাকি। তারাকির প্রচেষ্টায় এই দুই অংশই ইউএসএসআর এর সাথে ১৯৭৮ সালের ডিসেম্বরে একটি চুক্তি সই করে। এতে আফগানিস্তানের ব্যাপক সংস্কারের কথা উল্লেখ ছিল। এর পরপরই তারাকি আফগানিস্তানে ধর্ম নিরপেক্ষ শিক্ষা ও নানাবিধ সংস্কারের উদ্যোগ নেন। এই উদ্যোগে তারাকির সরকার বিরোধীদের ও রক্ষণশীল শ্রেণীর উপর ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চালায়। ধীরে ধীরে সংস্কার পরিপন্থী শ্রেণীর মধ্যে ক্ষোভ জমতে থাকে। এই ক্ষোভ একসময় জিহাদে রূপ নেয়, এবং তাদের পরিচয় হয় ‘আফগান মুজাহিদিন’ হিসেবে।

১৯৭৯ সালের ঘটনা। এবারও নাটকীয়তা শুরু হয় এপ্রিল মাসে। খালকের প্রধান হাফিজুল্লাহ আমিন, এপ্রিল থেকেই তারাকির বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করেন এবং ব্যাপক জনসমর্থন আদায় করতে সক্ষম হন। সেপ্টেম্বরে তারাকিকে নামিয়ে দিয়ে ক্ষমতায় জেঁকে বসেন আমিন। কিন্তু আমিন দেশে শান্তি বজায় রাখতে পারলেন না। সোভিয়েত ইউনিয়ন আমিনকে ক্ষমতালোভী ‘কসাই’ বলে আখ্যা দিল। তাছাড়া, সোভিয়েতদের মনে সন্দেহ ছিল যে, আমিন হয়তো সিআইএর পরিকল্পনার অংশ। ফলে, নিজেদের মিত্রদের স্বার্থে, ডিসেম্বরে আফগানিস্তান আক্রমণ করে সোভিয়েত ইউনিয়ন। তারা আমিনকে ক্ষমতাচ্যুত এবং হত্যা করে, পারশাম নেতা বাব্রাক কারমালকে ক্ষমতায় বসায়। কিন্তু চোখের সামনে একটি দেশে সোভিয়েত সমর্থিত কমিউনিস্ট সরকার প্রতিষ্ঠিত হবে, আর যুক্তরাষ্ট্র দর্শকের ভূমিকা পালন করবে, এ-ও কি সম্ভব? এই খেলায় না জড়ালে যে বিশ্ব রাজনীতিতে প্রভাব কমে যেতে পারে। আর এই খেলায় জড়ানোর উপায় কী? উপায় হচ্ছে পাকিস্তান!

আফগানিস্তানে সোভিয়েত সৈন্য; source: prezi.com

একটু পেছনে ফেরা যাক। ‘৭০ এর দশক থেকেই পাকিস্তানি গোয়েন্দাবাহিনী আমেরিকাকে গোপনে লবিং করতে থাকে, যেন আমেরিকা দক্ষিণ এশিয়ায়, বিশেষ করে আফগানিস্তানের ইসলামিক বিদ্রোহীদের সহায়তা করে। তবে পাকিস্তানের পারমাণবিক অস্ত্র কার্যক্রম এবং জুলফিকার আলী ভুট্টোর ফাঁসিকে কেন্দ্র করে পাকিস্তানের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কে চিড় ধরে। কিন্তু ১৯৭৯ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন আর আফগানিস্তানকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট অবস্থায় হাত গুঁটিয়ে বসে থাকাও চলে না। তাই তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার সিদ্ধান্ত নিলেন, পাকিস্তানের সাথে সম্পর্ক ভালো করতে হবে। সেই বছর ৩০ মার্চ, যুক্তরাষ্ট্রের ‘ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিল’ বা এনএসসি এর এক জরুরী মিটিং বসে। সে মিটিংয়ে, প্রতিরক্ষা বিভাগের প্রতিনিধি ওয়াল্টার সলোকম্ব প্রস্তাব উত্থাপন করেন যে, “আফগানিস্তানের চলমান মুসলিম বিদ্রোহ চালিয়ে নিতে পারলে যুক্তরাষ্ট্র লাভবান হবে। এই বিদ্রোহই আফগানিস্তানে রাশিয়াকে ঢুকতে দেবে না!” আর যায় কোথায়! কার্টার প্রশাসনের ভীষণ পছন্দ হলো এই পরিকল্পনা। মে মাস থেকে শুরু হলো আফগানিস্তানে বিদ্রোহী মুজাহিদিন নেতাদের সাথে আমেরিকার গোপন বৈঠক। অনুমান করুন তো এই বৈঠকের ব্যবস্থা কারা করে দিয়েছিল? আপনি ঠিক ধরতে পেরেছেন, পাকিস্তান!

ওভাল অফিসে মুজাহিদিন নেতাদের সাথে বৈঠকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট; source: simple.wikipedia.org

৬ এপ্রিল এবং ৩ জুলাই আরো দুটি বৈঠকের পর, বিদ্রোহীদের জন্য ৫ লক্ষ ডলার সহায়তা অনুমোদন করেন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার। এই কার্যক্রম পুরোটাই ছিল অত্যন্ত গোপনীয়। এর নামকরণ করা হয় ‘অপারেশন সাইক্লোন’। উল্লেখ্য, তখনো সোভিয়েত ইউনিয়ন, আফগানিস্তান আক্রমণ করেনি। আমেরিকা কেবল “আক্রমণ হতে পারে”, এরকম ধরে নিয়েই বিদ্রোহীদের অর্থায়ন শুরু করে! এই আশঙ্কার কথা পরবর্তীতে স্বীকার করেছিলেন তৎকালীন প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা বিগনিউ ব্রেজাজিনস্কি। তবে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অন্য অনেকেই আবার বলেছেন যে যুক্তরাষ্ট্রের প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিল পাকিস্তানের সাথে সম্পর্কোন্নয়ন। কিন্তু বিশ্লেষকরা প্রশ্ন তোলেন, সম্পর্কের উন্নতি ঘটাতে তাদের কথা মতো কিছু বিদ্রোহীদের অর্থ এবং অস্ত্র সহায়তা দিতে হবে? এমনকি এই কৌশল আদৌ কাজে লাগবে কিনা তা না জেনেও (যেহেতু তখনো রাশিয়া আক্রমণ করেনি)! অন্যদিকে, ১৯৭৮-৭৯ সাল পর্যন্ত আমেরিকার ইন্টেলিজেন্সের সামগ্রিক পর্যবেক্ষণের ফলও ছিল এই যে, রাশিয়া কোনোক্রমেই আফগানিস্তান আক্রমণ করবে না। এরপরও এই অর্থায়ন প্রকল্পের কী প্রয়োজনীয়তা ছিল তা অবশ্যই প্রশ্নবিদ্ধ।

শেষপর্যন্ত আফগানিস্তান আক্রমণ করলো সোভিয়েত ইউনিয়ন। আর মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিশ্ববাসীর সামনে মেকী ‘বিস্ময়’ প্রকাশ করলেন। পাশাপাশি রাশিয়াকে বিশ্বশান্তির জন্য হুমকি আখ্যায়িত করে, এই আক্রমণের সমুচিত জবাব দেয়ার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেন কার্টার। এদিকে আক্রমণের কয়েক মাসের মধ্যেই মার্কিন গোয়েন্দাদের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, আফগানিস্তান থেকে রাশিয়ার নজর বেলুচিস্তানের দিকেও যেতে পারে, এবং শেষপর্যন্ত বেলুচিস্তানকে পাকিস্তান থেকে আলাদা করে নতুন রাষ্ট্র করার দিকেও এগোতে পারে রাশিয়া! যদিও এই পর্যবেক্ষণকে পরবর্তীতে অনেক বিশ্লেষক ভিত্তিহীন বলে উড়িয়ে দেন, সে মুহূর্তে মার্কিন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় তা ‘অবশ্যম্ভাবী’ বলেই ধরে নিয়েছিল। এরই মাঝে, যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ায় অনুষ্ঠিতব্য অলিম্পিক বর্জন ঘোষণা করে। এই বর্জন, স্নায়ুযুদ্ধের পরিস্থিতিতে আমেরিকা-সোভিয়েত ইউনিয়ন সম্পর্কের তিক্ততা আরো বাড়িয়ে দেয়।

যা হোক, ইরানে চলমান জিম্মি সংকট সমাধানকল্পে কার্টার প্রশাসনের উদ্ধার অভিযান ‘অপারেশন ঈগল ক্ল’ ব্যর্থ হবার প্রভাব পড়ে সে বছর প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে। জিমি কার্টার হেরে যান রোনাল্ড রিগ্যানের কাছে। কিন্তু রিগ্যান এসে বরং কার্টার প্রশাসনের অপারেশন সাইক্লোন প্রোগ্রামকে আরো বিস্তৃত আকারে চালাতে শুরু করেন। রিগ্যানের ‘যেকোনো সোভিয়েত বিরোধী পক্ষকে সহায়তা’র নীতি পরবর্তীতে ‘রিগ্যান ডক্ট্রিন’ নামে পরিচিত হয়। তিনি অর্থায়ন বাড়ানোর পাশাপাশি মুজাহিদিনদের গেরিলা প্রশিক্ষণ দেয়ার ব্যবস্থা করেন! সিআইএ’র প্যারামিলিটারি অফিসারদের নিযুক্ত করা হয় সকল অস্ত্র সহায়তা, লজিস্টিক ব্যবস্থাপনা এবং প্রশিক্ষণের জন্য। তবে এসব কাজে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কাজ করে পাকিস্তানের গোয়েন্দাবাহিনী ‘ইন্টার সার্ভিসেস ইন্টেলিজেন্স’ বা আইএসআই। যুক্তরাষ্ট্রের দেয়া অর্থ এবং অস্ত্র, বিদ্রোহীদের মাঝে সরবরাহ করা সহ প্রশিক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় গোপন স্থান নির্ধারণ এবং দুই পক্ষের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপন, সবই করতো আইএসআই।

(বাঁ থেকে) গুলবুদিন হেকমাতিয়ার, সিআইএ কর্মকর্তা রিচার্ড কার এবং ইউনুস খালিস; source: nauandeshi.com

এই গোপন অর্থায়নে সৌদি আরবকেও নিজেদের সমপরিমাণ অর্থ সহায়তা দিতে রাজি করে যুক্তরাষ্ট্র। আর ব্রিটিশ গোয়েন্দা সংস্থা এমআই-৬ এবং এসএএস-ও যোগ দেয় সিআইএ’র বিদ্রোহী প্রশিক্ষণ কার্যক্রমে। যুদ্ধ শেষ হবার পরও আরো তিন বছর চলে এই প্রশিক্ষণ কার্যক্রম। ১৯৭৯-৯২ সাল পর্যন্ত, সিআইএ প্রায় ১ লক্ষাধিক বিদ্রোহীকে গেরিলা প্রশিক্ষণ দেয়। এ সময় তারা পাকিস্তান সরকারের সরাসরি সহায়তায়, আরব দেশগুলো থেকে তরুণ যুবকদের, আফগান ‘মুজাহিদিন’দের সাথে ‘সোভিয়েত বর্বর’ বাহিনীর বিরুদ্ধে ‘জিহাদে’ নামার অনুপ্রেরণা দেয়! এই অনুপ্রেরণা আরব দেশগুলোর যুবকদের চুম্বকের মতোই আকৃষ্ট করে। সিআইএ ডিরেক্টর উইলিয়াম কেসি সহ মার্কিন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অনেক হর্তাকর্তাকেই তখন, ঘন ঘন আফগান-পাকিস্তান সীমান্ত এলাকাগুলোতে দেখা যেত।

বিদ্রোহী মুজাহিদিনদের বড় নেতাদের, বিশেষভাবে গুলবুদিন হেকমাতিয়ারকে আমেরিকা প্রায়ই আমন্ত্রণ জানায়, হোয়াইট হাউজে প্রেসিডেন্ট রিগ্যানের সাথে বৈঠকের জন্য। হেকমাতিয়ার নিজে না গিয়ে, বিদ্রোহীদের কমান্ডার ইউনুস খালিসকে পাঠিয়ে দেয়। ইউনুসের সাথে বৈঠকে প্রেসিডেন্ট রিগ্যান ইসলামের প্রতি আমেরিকার ‘আন্তরিকতা’র কথা ব্যক্ত করেন। আর স্বীয় ধর্মের প্রতি মার্কিন প্রেসিডেন্টের ‘আন্তরিকতা’ দেখে খুশিতে গদগদ হয়ে খালিস সর্বসমক্ষে রিগ্যানকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করার আমন্ত্রণ পর্যন্ত জানায়! খালিস পরে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচারের সাথেও বৈঠক করেছিলেন। ১৯৮৬ সালের শুরুর দিকে এয়ারক্রাফট মিসাইল এবং অন্যান্য ভারী অস্ত্রশস্ত্রের বেশ বড় একটি চালান আফগানিস্তানে পাঠায় যুক্তরাষ্ট্র।

আমেরিকার সরবরাহকৃত উন্নত এন্টি এয়ারক্রাফট মিসাইল; source: theatlantic.com

৮৬’র অস্ত্রের চালান মুজাহিদিনদের যুদ্ধে নতুন মাত্রা যোগ করে। সরবরাহকৃত মিসাইল এতই উন্নত ছিল যে, সেগুলো ব্যবহার করে রাশিয়ান অত্যাধুনিক হেলিকপ্টারগুলো অনায়াসেই ভূপাতিত করতে পারতো বিদ্রোহী যোদ্ধারা। আর এর ফলে সোভিয়েত ইউনিয়নের জন্য যুদ্ধ পরিস্থিতির অবনতি ঘটে দ্রুত। ১৯৮৭ সালের শেষ দিকেই তারা আফগানিস্তান থেকে সৈন্য প্রত্যাহারের ঘোষণা দেয়। ১৯৮৯ এর ১৫ ফেব্রুয়ারির মধ্যে আফগানিস্তান সম্পূর্ণরূপে সোভিয়েত সেনামুক্ত হয়। কিন্তু তখন আবার আমেরিকা পড়ে গেছে অন্য সমস্যায়। রাশিয়াকে হটানোর নেশায় বুদ হয়ে তারা অনেক বেশি মিসাইল সরবরাহ করেছিল আফগানিস্তানে। ফলে যুদ্ধ শেষে মার্কিন প্রশাসন এই চিন্তায় পড়ে যে, এই মিসাইল না আবার মার্কিন বিরোধী কোনো সন্ত্রাসী সংগঠনের হাতে চলে যায়! এই ভাবনায় ১৯৯০ সালে সিআইএ একটি গোপন ‘বাই-ব্যাক’ অভিযান চালায় এবং বিপুল পরিমাণ মিসাইল চড়া মূল্যে কিনে নেয়। এমনও শোনা যায় যে, একেকটি মিসাইলের প্রকৃত মূল্যের দ্বিগুণ-তিনগুণ মূল্যে সেগুলো কিনে নেয় আমেরিকা!

যুক্তরাষ্ট্রের অর্থায়ন দুটি প্যাকেজে বিভক্ত ছিল। ১৯৮১-৮৭ সালে প্রথম ছয় বছরের প্যাকেজে ৩.২ বিলিয়ন ডলার অর্থ সরবরাহ করে যুক্তরাষ্ট্র। ১৯৮৭-৯৩ সালের দ্বিতীয় প্যাকেজে আরো বরাদ্দ করা হয় ৪.২ বিলিয়ন ডলার। এই অর্থ ঠিক অর্ধেক করে অর্থনৈতিক এবং সামরিক খাতে ব্যয় করার সিদ্ধান্ত হয়। মাঝে পাকিস্তানের কাছে ১.২ বিলিয়ন ডলার মূল্যে বিক্রয় করে ১৬টি বিমান। তবে পুরো সময় জুড়ে সিআইএ’র প্যারামিলিটারি ও নিজেদের অন্যান্য সামরিক এবং গোয়েন্দা বাহিনীর ব্যয় মিলিয়ে মোট ২০ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছিল আমেরিকা!

আমেরিকানদের পাতা ফাঁদে পা দেয়ার পর গোঁড়া আফগান মুজাহিদিনরা প্রথম ধাক্কাটা খায় রাশিয়ান সৈন্য প্রত্যাহারের সাথে সাথে। কেননা, রাশিয়ার আফগানিস্তান ত্যাগই ছিল আমেরিকানদের মূল লক্ষ্য। লক্ষ্য পূরণের সাথে সাথে নিজেদের সামরিক সহায়তা কমাতে শুরু করে আমেরিকা। ১৯৯০ সালে পাকিস্তানকে পারমাণবিক অস্ত্রহীন দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দিতে অস্বীকার করে এবং কিছু অবরোধ আরোপ করে যুক্তরাষ্ট্র। ফলে পাকিস্তানের সাথে আমেরিকার সম্পর্কে ফাটল ধরে এবং দ্বিতীয় প্যাকেজের অর্থায়ন বাঁধাগ্রস্ত হয়। তবে তার আগে অবশ্য দ্বিতীয় প্যাকেজের অধিকাংশ অর্থই ব্যয় করা হয়ে গিয়েছিল।

মার্কিন অস্ত্রে সজ্জিত মুজাহিদিনরা; source: jacobinmag.com

আমেরিকার এই গোপন অভিযান অপারেশন সাইক্লোনের প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী। প্রথমত, আফগানিস্তানে ১৪ হাজার সোভিয়েত সৈন্য মারা যায়। আহত হয় আরো ৫০ হাজার সৈন্য। এই ব্যর্থ অভিযানের পরোক্ষ প্রভাবেই ভেঙে যায় সোভিয়েত ইউনিয়ন। এটাই ছিল আমেরিকার সবচেয়ে বড় সাফল্য। কিন্তু পাকিস্তানকে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে ব্যবহার করা ছিল যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম ভুল। প্রচুর পরিমাণে অস্ত্র (গুজব ছিল প্রায় অর্ধেক) বিদ্রোহীদের কাছে না গিয়ে পৌঁছে যায় করাচিতে। সেখানে স্থানীয় বাজারে চলে অস্ত্রের রমরমা ব্যবসা। আর অপরিণামদর্শী পাকিস্তানি সরকারের এই ভুলের মাশুল দেয় সমগ্র করাচিবাসী। কয়েক বছরের মাঝেই করাচি হয়ে ওঠে বিশ্বের অন্যতম উগ্র সন্ত্রাসের শহর। অন্যদিকে পাকিস্তান অর্থ সহায়তার দিক দিয়েও পক্ষপাতিত্ব করে। নিজেদের মিত্র উগ্র ইসলামিক সংগঠনগুলোর মাঝে তারা অর্থের সিংহভাগ বন্টন করে।

যুক্তরাষ্ট্রের এই গোপন অপারেশন ছিল ইতিহাসের সবচেয়ে সমালোচিত গোপন অপারেশনগুলোর একটি। তাদের এই অর্থ সহায়তা এবং প্রশিক্ষণ প্রদানই আল কায়েদার মতো নৃশংস জঙ্গি গোষ্ঠীর সৃষ্টি করেছে। যদিও সরাসরি আল কায়েদার প্রতিষ্ঠাতা ওসামা বিন লাদেনের সাথে মার্কিন এই অপারেশনের কোনো সম্পর্ক পাওয়া যায় না। তথাপি গুলবুদিন হেকমাতিয়ার লাদেনেরই একজন বন্ধু ছিল। শুধুমাত্র যুদ্ধকালীন সময়েই হেকমাতিয়ার ১০ হাজারের অধিক সাধারণ মানুষ হত্যা করে। আর সোভিয়েত সৈন্যরা দেশ ছাড়লে, সিআইএ দ্বারা প্রশিক্ষিত অধিকাংশ বিদ্রোহী লাদেনের তৈরি সংগঠনে যোগ দেয়। এভাবেই গড়ে ওঠে সন্ত্রাসী সংগঠন আল কায়েদা। পরবর্তীতে অনেক সিআইএ কর্মকর্তাই সরাসরি অস্বীকার করেছেন যে, অপারেশন সাইক্লোনের সাথে আল কায়েদার উত্থানের কোনো যোগ নেই। কিন্তু অধিকাংশ বিশ্লেষকই এই দাবি উড়িয়ে দেন। আর এই অপরিণামদর্শী অভিযানের ফলাফল আজ আমাদের সকলেরই জানা।

ফিচার ছবি: sputniknews.com

Related Articles