Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

অপারেশন ডেজার্ট স্টর্ম: মার্কিন নেতৃত্বাধীন মিত্রবাহিনীর কুয়েতকে ইরাকমুক্ত করার যুদ্ধ

১৯৭৯ সালে ইরানে ইসলামী বিপ্লব মধ্যপ্রাচ্য ও আরব বিশ্বের জন্য এক যুগান্তকারী ঘটনা। ইরানে শিয়াপন্থীদের ক্ষমতাগ্রহণকে মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশ সমর্থন করেনি। ইরানের ইসলামী বিপ্লব মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশেও ইসলামপন্থীদের প্রভাবিত করতে পারে ভেবে অনেক দেশ ইরানের বিপ্লবকে নাকচ করার চেষ্টা করে। শিয়া সংখ্যাগরিষ্ঠ ইরাকে ইরানের মতো বিপ্লবের সম্ভাবনা ছিল, ফলে ইরাকের কাছে ইরানের ইসলামী বিপ্লব অসমর্থিত ছিল। এছাড়া শিয়া সংখ্যাগরিষ্ঠ ইরাকে ধর্মনিরপক্ষ ও সুন্নি-অধ্যুষিত বাথ পার্টির শাসনকে ইরানের বিপ্লবীরাও ভালো চোখে দেখেনি । 

১৯৭৯ সালে সাদ্দাম হুসাইন ক্ষমতায় আসার পর ইরানের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের ইচ্ছা প্রকাশ করেন, কিন্তু ইরানের বিপ্লবীরা তা নাকচ করে দেয়। এদিকে সৌদি আরবসহ কয়েকটি দেশ ইরানের বিরুদ্ধে জোর তৎপরতা চালাচ্ছিল।

সাদ্দামের ইরাকের মিশরকে হটিয়ে আরব বিশ্বের নেতা হওয়ার বাসনা ছিল এবং একইসাথে পার্সিয়ান গাল্ফের অধিপতি হওয়ার উচ্চাভিলাষ ছিল। আবার, ইরাকের সাথে ইরানের অটোমান আমল থেকেই সীমান্ত সমস্যা ছিল। সৌদিসহ পার্সিয়ান গাল্ফের কয়েকটি দেশের যোগসাজশে ইরাক ইরান আক্রমণ করে দেশটির তেলসমৃদ্ধ খোজেস্তান প্রদেশকে ইরাকের সাথে যুক্ত করার পরিকল্পনা করে। 

তৎকালীন ইরাকি প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হুসাইন; image source: nydailynews.com

পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ১৯৮০ সালের ২২ সেপ্টেম্বর ইরাক তার প্রতিবেশী দেশ ইরানে আক্রমণ করে বসে। আট বছর ধরে চলা এ রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে উভয় দেশের প্রচুর অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়। ইরাক যুদ্ধের ব্যয় নির্বাহের জন্য কুয়েত, আরব আমিরাত ও সৌদি আরব থেকে প্রচুর অর্থ ঋণ নিতে থাকে। এ যুদ্ধে ইরাকের প্রায় ৫৬১ বিলিয়ন ডলার অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়েছে। যুদ্ধ চলাকালে ইরাক কুয়েত থেকে প্রায় ১৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণ নেয়। যুদ্ধ শেষে তারা ব্যাপক অর্থনৈতিক সংকটে পড়ে। ঋণ শোধ করার জন্য ইরাক বিশ্ববাজারে তেলের দাম বাড়িয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এজন্য তারা কুয়েতকে বাজারে তেলের সরবরাহ কমিয়ে দেয়ার অনুরোধ করে।

ইরাকের এ অনুরোধ উপেক্ষা করে কুয়েত তেল উত্তোলন কমানোর পরিবর্তে বাড়িয়ে দেয়; ফলে সরবরাহ বেশি থাকায় দাম বৃদ্ধি পাবার পরিবর্তে বিশ্ববাজারে তেলের দাম কমে যায়। কুয়েতের এহেন আচরণ ইরাক গ্রহণ করতে পারেনি। তখন ইরাকি প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হুসাইন দাবি করেন, কুয়েত যুক্তরাষ্ট্রের যোগসাজশে বিশ্ববাজারে তেলের দাম কমিয়ে দিয়েছে এবং উন্নত প্রযুক্তির মাধ্যমে ইরাকের রুমালিয়া তেলক্ষেত্র থেকে অবৈধভাবে তেল উত্তোলন করছে। উল্লেখ্য, কুয়েত ও সৌদি আরবের তেলের সবচেয়ে বড় ক্রেতা ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। 

ইরান-ইরাক যুদ্ধের ফলে ইরাক কুয়েতের কাছে ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ে; image source: britannica.com

সাদ্দাম হুসাইন আরও দাবি করেন, ইরানের সাথে তার দেশ যে ভয়াবহ যুদ্ধে লিপ্ত ছিল, তার ফলে কুয়েত এবং সৌদি আরবসহ সমস্ত মধ্যপ্রাচ্যকে তিনি ইরানের হাত থেকে রক্ষা করেছেন। তাই কুয়েত এবং সৌদি আরবের কাছে ইরাকের যে ঋণ আছে, তা মওকুফ করা উচিত। তবে কুয়েত অবৈধ উত্তোলনের অভিযোগ অস্বীকার করে এবং ঋণ মওকুফ করতে অস্বীকৃতি জানায়। এদিকে অটোমান আমলে কুয়েত ইরাকের বসরা প্রদেশের অন্তর্ভুক্ত ছিল বলে ইরাক কুয়েতকে ইরাকের অংশ হিসেবে দাবি করে। এসব অজুহাতে ১৯৯০ সালের ২ আগস্ট, ইরাক তার তেলসমৃদ্ধ প্রতিবেশী কুয়েতে অতর্কিত হামলা করে এবং গাল্ফ ওয়ারের সূচনা হয়।

অল্পক্ষণের মধ্যেই কুয়েতি সেনারা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় এবং কুয়েতের আমির সপরিবারে সৌদি আরবে আশ্রয় নেন। কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই কুয়েতের সকল প্রতিরোধ ভেঙে পড়ে এবং সাদ্দাম হুসাইন কুয়েতকে ইরাকের ১৯ তম প্রদেশ হিসেবে ঘোষণা করেন। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের জরুরি অধিবেশনে এবং আরব লিগের জরুরি বৈঠকে ইরাককে কুয়েত থেকে সৈন্য অপসারণের আহ্বান জানানো হয়, কিন্তু ইরাক তা নাকচ করে দেয়। এমতাবস্থায় জাতিসংঘ ইরাকের উপর অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করে। একদিকে জাতিসংঘ ও বিশ্ব সম্প্রদায়ের সাথে ইরাকের দর কষাকষি চলতে থাকে, অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র সৌদি আরবের ভূমিতে তার সৈন্যসংখ্যা বাড়াতে থাকে। পার্সিয়ান গাল্ফে যুক্তরাষ্ট্র কয়েকটি যুদ্ধজাহাজও মোতায়েন করে। 

সৌদি আরবে অবস্থিত মার্কিন সৈন্যদের সাথে শুভেচ্ছা বিনিময় করছেন তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ এইচ ডব্লিউ বুশ; image source: nytimes.com 

সাদ্দামের একঘেয়ে আচরণ ও অটল সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৯০ সালের ২৯ নভেম্বর জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে ‘রেজল্যুশন ৬৭৮’ পাস হয়। এতে বলা হয়, ইরাককে ১৫ জানুয়ারি, ১৯৯১ তারিখের মধ্যেই কুয়েত থেকে সকল সৈন্য অপসারণ করতে হবে এবং তা না হলে জাতিসংঘ ইরাকের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান চালাতে বাধ্য হবে। ইরাক বলে, তারা তখনই কুয়েত থেকে সৈন্য অপসারণ করবে যখন সিরিয়া লেবানন থেকে এবং ইসরায়েল ফিলিস্তিনের পশ্চিম তীর, গাজা উপত্যকা এবং সিরিয়ার গোলান মালভূমি থেকে সেনাবাহিনী অপসারণ করে নেবে। যুক্তরাষ্ট্র এ প্রস্তাবের বিরোধিতা করে এবং দুই দেশের এই অনড় মনোভাবের কারণে কোনো আলোচনাই শেষপর্যন্ত সফলতার মুখ দেখেনি । 

এদিকে ইরাকি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে কোয়ালিশন গঠন হতে থাকে। বাংলাদেশসহ প্রায় ৩৯টি দেশ এর অন্তর্ভুক্ত হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এটিই ছিল বিশ্বের বৃহত্তম কোয়ালিশন। মার্কিন আর্মির জেনারেল নরম্যান শোয়ার্জকফ এ কোয়ালিশন ফোর্সের কমান্ডার হিসেবে নিযুক্ত হন। জোটের ৯,৫৬,৬০০ সৈন্যের মধ্যে ৬,৯৭,০০০ বা ৭৩ শতাংশ ছিল মার্কিন সৈন্য। নিরাপত্তা পরিষদের দেওয়া সময়সীমার মধ্যে ইরাক সৈন্য প্রত্যাহার না করায় ১৯৯১ সালের ১৭ জানুয়ারি মার্কিন নেতৃত্বাধীন মিত্রবাহিনী পৃথিবীর ইতিহাসে অন্যতম আলোচিত ‘অপারেশন ডেজার্ট স্টর্ম’ শুরু করে ।

১৭ জানুয়ারি সকাল থেকে শুরু করে পরবর্তী কয়েক সপ্তাহ মিত্রবাহিনী সৌদি আরবের মাটি থেকে ইরাকের মাটিতে প্রতিদিন প্রায় সহস্রাধিক বিমান হামলা পরিচালনা করে। কোনো কোনো দিন আড়াই হাজারের বেশি বিমান হামলা পরিচালিত হয়েছে। মিত্রবাহিনীর প্রাথমিক লক্ষ্য ছিল ইরাকের বিমানবাহিনীর ধ্বংস নিশ্চিত করা, যাতে ইরাক পুনরায় বিমান হামলা করতে না পারে। যুদ্ধের প্রথম সপ্তাহে ইরাকের ৩৮টি মিগ সিরিজের বিমান ভূপতিত করা হয়। মিত্রবাহিনী খুব দ্রুতই তাদের লক্ষ্য অর্জন করে। মিত্রবাহিনীর আধুনিক যুদ্ধবিমানের সামনে ইরাকের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা মাথা তুলে দাঁড়াতেই পারেনি। একের পর এক বিমান হামলায় ইরাকের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গুঁড়িয়ে যেতে থাকে। মিত্রবাহিনী একইসাথে ইরাকের সামরিক স্থাপনা, বন্দর, পাওয়ার প্ল্যান্ট, তেল শোধনাগারে হামলা চালাতে থাকে। কয়েক সপ্তাহের মধ্যে মিত্রবাহিনী ইরাকের মাটিতে ৮৮,৫০০ টনের বেশি বোমা নিক্ষেপ করে। 

ইরাকের বিমান বাহিনীর এ অবস্থার পর ইরাকের হাতে একমাত্র অস্ত্র ছিল তাদের স্কাড মিসাইলগুলো। ইরাক সৌদি আরবে আমেরিকান সামরিক ঘাঁটিগুলো উদ্দেশ্য করে অনেকগুলো স্কাড মিসাইল উৎক্ষেপণ করে। তবে মিত্রবাহিনী ইরাকের হামলা রুখে দেয়। ইরাক মিত্রবাহিনীর তেমন কোনো ক্ষতিসাধন করতে পারেনি। একপর্যায়ে ইরাক ইসরায়েলে আক্রমণ করে বসে। এ আক্রমণের বিষয়টি আগেই স্পষ্ট ছিল। জেনেভায় যুক্তরাষ্ট্র-ইরাক শান্তি আলোচনার সময় একজন সাংবাদিক ইরাকের উপ-প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী তারিক আজিজকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, “জনাব পররাষ্ট্রমন্ত্রী, যদি যুদ্ধ শুরু হয়, আপনারা কি ইসরায়েল আক্রমণ করবেন?” উত্তরে তারিক আজিজ বলেছিলেন, “অবশ্যই হ্যাঁ”। 

ইরাক সৌদি আরব ও ইজরায়েলে স্কাড মিসাইল নিক্ষেপ করে; image source: gulfwar1991.blogspot.com

ইরাকের এ আক্রমণের উদ্দেশ্য ছিল ইসরায়েলকে এ যুদ্ধে যুক্ত করা, যাতে ইরাক অন্যান্য আরব দেশের সহযোগিতা ও সমর্থন আদায় করতে পারে। ইরাকের মিসাইল হামলায় ইসরায়েলের দুজন বেসামরিক নাগরিক নিহত হয় এবং প্রায় ২৩০ জন নাগরিক আহত হয়। ইসরায়েল যুক্তরাষ্ট্রের অনুরোধে প্রতি-আক্রমণ করেনি এবং মিত্রবাহিনীর সাথেও অংশগ্রহণ করেনি। ফলে ইরাকের পরিকল্পনা কাজে দেয়নি । 

প্রথম স্কাড মিসাইল আক্রমণের পাঁচ ঘণ্টা পর ইরাকের রাষ্ট্রীয় রেডিওতে সাদ্দাম হুসাইনের একটি বক্তব্য প্রচার করা হয়, যেখানে তিনি ঘোষণা করেন, “দুর্দান্ত লড়াই, আসল যুদ্ধ শুরু হয়েছে।” ইরাকের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংস করার পরিকল্পনার অংশ হিসেবে মিত্রবাহিনী ইরাকের যোগাযোগব্যবস্থা ধ্বংস জরুরি বলে বিবেচনা করে। তারা ইরাকের যোগাযোগব্যবস্থা সম্পূর্ণ বিকল করে দেয়। এতে সাদ্দাম হুসাইন ও তার প্রশাসনের কোনো নির্দেশ যুদ্ধরত সৈন্যদের কাছে পৌঁছাতে পারছিল না। 

যুক্তরাষ্ট্র, ইসরায়েল ও মধ্যপ্রাচ্যের মার্কিন সামরিক ঘাঁটিগুলোতে তাদের প্যাট্রিয়ট এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম লঞ্চ করে। সাত সপ্তাহের এ যুদ্ধে ইরাক ইসরায়েলে ৪২টি স্কাড মিসাইল আক্রমণ করে। একইভাবে সৌদি আরবে ৪৪টি মিসাইল নিক্ষেপ হয়। একটি মিসাইল বাহরাইনে এবং একটি কাতারে হামলা করে। মিসাইলগুলো সামরিক ও বেসামরিক উভয় স্থাপনায় নিক্ষেপ করা হয়। এসব আক্রমণে একজন সৌদি বেসামরিক নাগরিক নিহত এবং ৬৫ জন আহত হয়। তবে কাতারে ও বাহরাইনে কোনো হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। ১৯৯১ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি, সৌদি আরবের দাহরানে মার্কিন সামরিক ঘাঁটিতে একটি স্কাড মিসাইল আঘাত হানে। এতে ২৮ জন মার্কিন সৈনিক নিহত এবং শতাধিক সৈন্য আহত হয় । 

১৯৯১ সালের ২৯ জানুয়ারি ইরাকি বাহিনী ট্যাঙ্ক এবং পদাতিক বাহিনী নিয়ে সৌদি শহর খফজিতে আক্রমণ করে। মাত্র দুদিন পর কাতারি বাহিনী ও মার্কিন মেরিন সমর্থিত সৌদি ন্যাশনাল গার্ড ইরাকিদের তাড়িয়ে দিয়ে খফজির যুদ্ধ শেষ করে। এ যুদ্ধে মিত্রবাহিনী ব্যাপক আর্টিলারি ফায়ার ব্যবহার করে। উভয়পক্ষই হতাহতের শিকার হয়েছে, যদিও ইরাকি বাহিনীতে মিত্রবাহিনীর চেয়ে অনেক বেশি মৃত এবং বন্দী ছিল। এ যুদ্ধে একইসাথে দুটি পৃথক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ১১ জন আমেরিকান সৈন্য নিহত হয়। একটি ইরাকি সার্ফেস টু এয়ার ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় মার্কিন এসি-৩০০ গানশিপ গুলিবিদ্ধ হলে অতিরিক্ত ১৪ জন মার্কিন বিমানসেনা মারা যায়। এছাড়া যুদ্ধের সময় দুজন মার্কিন সেনা বন্দী হয়। 

খফজির যুদ্ধে একটি ট্যাঙ্কের ধ্বংসাবশেষ; image source: alchetron.com

এ যুদ্ধে সৌদি ও কাতারি বাহিনীর মোট ১৮ জন নিহত হয়। খফজিতে ইরাকি বাহিনীর প্রায় ৬০ থেকে ৩০০ জন নিহত এবং ৪০০ জন বন্দী হয়। এক তথ্যমতে, এ যুদ্ধে ইরাকি বাহিনীর ক্ষয়ক্ষতির মধ্যে ৩৫৭টি ট্যাঙ্ক, ১৪৭টি সাঁজোয়াযান এবং ৮৯টি মোবাইল আর্টিলারি রয়েছে। এ বিষয়ে ইরান-ইরাক যুদ্ধে লড়াই করা এক ইরাকি সেনা মন্তব্য করেছিলেন, তার ব্রিগেড আট বছর ধরে ইরানের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের চেয়ে খফজিতে মিত্রবাহিনীর বিমান হামলায় সামনে ৩০ মিনিট যুদ্ধে বেশি কষ্ট সহ্য করেছে। খফজির এই যুদ্ধটি অপারেশন ডেজার্ট স্টর্মে মিত্রবাহিনীর অন্যতম সেরা সাফল্য ছিল।

১৯৯১ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি, ইরাক একটি সোভিয়েত প্রস্তাবিত যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়। ছয় সপ্তাহের একটি প্রস্তাবিত সম্পূর্ণ যুদ্ধবিরতি কার্যকরের জন্য ইরাককে তার সৈন্যদের কুয়েত আক্রমণের পূর্বের অবস্থানে প্রত্যাহার করে নিয়ে যেতে বলা হয় এবং যুদ্ধবিরতি পর্যবেক্ষণ করতে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদকে আহ্বান জানানো হয়। মিত্রবাহিনী এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। তারা ইরাককে সেনা প্রত্যাহারের জন্য ২৪ ঘণ্টা সময় দেয় এবং বলে, ইরাকি বাহিনী পশ্চাদপসরণ করলে আক্রমণ করা হবে না। ২৩ ফেব্রুয়ারি এক যুদ্ধে ৫০০ ইরাকি সেনাকে বন্দী করা হয়। ২৪ ফেব্রুয়ারি ব্রিটিশ ও মার্কিন বাহিনী ইরাক-কুয়েত সীমান্ত অতিক্রম করে ইরাকে প্রবেশ করে। 

এরপর শুরু হয় গ্রাউন্ড ক্যাম্পেইন। গ্রাউন্ড ক্যাম্পেইনে হওয়া কয়েকটি যুদ্ধ আমেরিকান সামরিক ইতিহাসের বৃহত্তম ট্যাঙ্ক যুদ্ধগুলোর মধ্যে অন্যতম। দ্য ব্যাটল অ্যাট সেভেন্টি থ্রি ইস্টিং, নরফোক এবং মদিনা রিজের যুদ্ধগুলো মার্কিনীদের কাছে পৃথক ঐতিহাসিক তাৎপর্য বহন করে। অপারেশন ডেজার্ট স্টর্মের যুদ্ধগুলোর মধ্যে মদিনা রিজের যুদ্ধ অন্যতম। কেউ কেউ এ যুদ্ধকে অপারেশন ডেজার্ট স্টর্মের বৃহত্তম ট্যাঙ্ক যুদ্ধ বলে মনে করেন। মদিনা রিজ যুদ্ধের সময় ইরাকি রিপাবলিকান গার্ডের একটি সাঁজোয়া ব্রিগেডকে ধ্বংস করতে মার্কিন সেনাবাহিনীর সেকেন্ড ব্রিগেড ও প্রথম আর্মার্ড ডিভিশনের ট্যাঙ্কারগুলোর মাত্র ৪০ মিনিট লাগে। যুদ্ধটি খুবই সংক্ষিপ্ত হলেও অত্যন্ত তীব্র এবং একতরফা ছিল, কারণ মার্কিনীদের সামনে ইরাকিরা দাঁড়াতেই পারেনি । 

মার্কিন মেরিন কর্পস কুয়েত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরেও তার ইতিহাসের অন্যতম সেরা ট্যাঙ্ক যুদ্ধটি করেছিল। মার্কিন তৃতীয় আর্মার্ড ডিভিশনও অবজেক্টিভ ডরসেটে একটি গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধ করে, যেটি নরফোকের যুদ্ধের স্থান থেকে কাছাকাছি অবস্থানে ছিল। মার্কিন তৃতীয় আর্মার্ড বিভাগ ইরাকি বাহিনীর সাথে এ যুদ্ধের সময় প্রায় ৩০০ ইরাকি যুদ্ধযান ধ্বংস করে দেয়। মার্কিন নেতৃত্বাধীন জোটের বিরুদ্ধে যুদ্ধগুলোর সময় ইরাকি বাহিনীর তিন হাজারেরও বেশি ট্যাঙ্ক এবং দু’হাজারের বেশি বিভিন্ন রকমের যুদ্ধযন্ত্রের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।

নরফোকের যুদ্ধের একটি মানচিত্র; image source: 16thinfassn.org

অপারেশন ডেজার্ট স্টর্মের সর্বশেষ যুদ্ধ নরফোকের যুদ্ধে মিত্রবাহিনী ও ইরাকি ডিভিশন একে অপরের বিরুদ্ধে লড়াই করে। ইরাকি অভিজাত রিপাবলিকান গার্ড বিভাগসহ আরো আটটি ইরাকি ডিভিশন চারটি মার্কিন ও ব্রিটিশ বিভাগের সাথে যুদ্ধে লড়ে। যুদ্ধটি একটি বিশাল আর্টিলারি এবং রকেট বোমা হামলা দিয়ে শুরু হয়, যেটি প্রায় ২০ হাজার আর্টিলারি এবং রকেট রাউন্ড গুলি চালিয়ে ২২ ইরাকি ব্যাটালিয়ন ও কয়েকশো আর্টিলারি ধ্বংস করে। ট্যাঙ্ক এবং অ্যাপাচি হেলিকপ্টারগুলো ইরাকিদের প্রতিরোধের মধ্য দিয়ে তাদের ধ্বংস করে এগিয়ে যায়। যুদ্ধে তাওয়াকালনা রিপাবলিকান গার্ড বিভাগ এবং আরও ১০টি ইরাকি বিভাগ পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যায়।

১৯৯১ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি থেকে ইরাক কুয়েত থেকে তাদের সৈন্য প্রত্যাহার করতে শুরু করে। ইরাকে ফিরে আসার পূর্বে এসব সৈন্য কুয়েতের বেশ কিছু তেলক্ষেত্রে আগুন ধরিয়ে দেয়। ২৭ ফেব্রুয়ারি কুয়েত-ইরাক হাইওয়ে দিয়ে ফেরতরত ইরাকি সৈন্যের বিশাল বহর লক্ষ্য করে মিত্রবাহিনী পুনরায় বিমান হামলা শুরু করে। এ হামলা এতটাই তীব্র ছিল যে তাতে কয়েক হাজার ইরাকি সেনার প্রাণহানি ঘটে এবং তারপর থেকে রাস্তাটি ‘হাইওয়ে অভ ডেথ’ নামে পরিচিত হয়। 

গ্রাউন্ড ক্যাম্পেইন শুরু হওয়ার ১০০ ঘণ্টা পর ১৯৯১ সালের ২৮শে ফেব্রুয়ারি, তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ এইচ ডব্লিউ বুশ যুদ্ধবিরতি এবং একইসঙ্গে কুয়েতের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। এরই সাথে শেষ হয় ইরাকের ওপর চালানো ৩৯ দেশের মিত্রবাহিনীর প্রায় ছয় সপ্তাহব্যাপী অপারেশন ডেজার্ট স্টর্ম। ১৯৯১ সালের ১০ মার্চ যুক্তরাষ্ট্র তাদের সৈন্যদের প্রত্যাহার করতে শুরু করে। ১৯৯১ সালের ১৫ মার্চ কুয়েতের আমির শেখ জাবের আল-আহমদ আল-সাবাহকে  মার্কিন নেতৃত্বাধীন মিত্রবাহিনী পুনরায় ক্ষমতায় বসায়। 

Related Articles