''ফার্মগেট মোড়ে এভাবে আর কতদিন? পাকিস্তানি আর্মির ভোগান্তি আর ভালো লাগছে না। ওরা প্রত্যেককে ওই চেকপোস্টে ধরে ধরে তল্লাশি করে।''
চা খেতে খেতে বলছিল বদি। সবাই হু-হাঁ করে শুনে চায়ের কাপে চুমুক দিল।
কয়েক মুহূর্ত পিনতপন নিরবতা। এরপর বদিটা দৃঢ়তার সঙ্গে হঠাৎ বলে উঠল,
''ওই চেকপয়েন্ট উড়িয়ে দেওয়ার সময় এসেছে রে। সেটাও আজকালের মধ্যেই করতে হবে।''
১৯৭১ সালের জুলাইয়ের শেষ দিকের ঘটনা। মুক্তিযুদ্ধের পারদ তখন উত্তেজনার তুঙ্গে। পাকিস্তানি আর্মিদের ব্যূহ ভেদ করে ক্রমশ এগিয়ে যাচ্ছে বাংলার গেরিলা যোদ্ধারা। জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহ থেকে ঢাকার দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছে আরবান গেরিলা, তথা ‘ক্র্যাকপ্লাটুন’। এরই মধ্যে তাদের বেশকিছু সফল অপারেশন শেষ হয়েছে। কিন্তু এই ফার্মগেট চেকপয়েন্টটা খুব যন্ত্রণা দেয়। অস্ত্র আনা-নেওয়ায় বারবার বিপত্তি পোহাতে হয়।
এর পেছনে কারণও আছে। ফার্মগেট কৌশলগত কারণে বেশ গুরুত্বপূর্ণ। এখানে কেবল একটা চেকপয়েন্ট বসিয়ে মিলিটারিরা ময়মনসিংহ রোড, ইন্দিরা রোড, মানিক মিয়া এভিনিউ, গ্রিন রোড আর তেজগাঁও রোডে খুব সহজেই চোখ রাখতে পারে। শুধু তা-ই নয়, এই এলাকা দিয়ে যাতায়াত করা প্রতিটি বাঙালি মানুষ ও যানবাহন ধরে ধরে হয়রানি করে পাক হানাদার বাহিনীর সদস্যরা।
সবমিলিয়েই ক্র্যাকপ্লাটুনের গেরিলারা সিদ্ধান্ত নিল, এই চেকপোস্ট তো ওড়াতেই হবে; সঙ্গে পুরো এলাকায় ছড়িয়ে দিতে হবে আতঙ্কের স্ফুলিঙ্গ।
ক্র্যাকপ্লাটুনের গোপন আস্তানা ধানমণ্ডি ২৮ নম্বরে। সেখানেই হলো অপারেশন ফার্মগেটের যাবতীয় পরিকল্পনা। সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হলো আরও একটি ছোট্ট অপারেশন। সেটা হলো ফার্মগেটের দারুল কাবাব রেস্টুরেন্টে হামলা চালানো। কারণ পাকিস্তানি সামরিক হর্তাকর্তারা প্রায় প্রতিদিন সেখানে খেতে আসে। সঙ্গে থাকে বেশ কিছু রাজাকার আলবদর সদস্য। কোথায় কী হচ্ছে না হচ্ছে, কীভাবে মুক্তিবাহিনীকে আটকানো যায়, কিংবা এই ধরনের বিশেষ কিছু আলোচনাও ওই দারুল কাবাব রেস্টুরেন্টের 'সান্ধ্যকালীন বৈঠক' এর অংশ।
দুই একদিন পুরো এলাকা রেকি করার পর সবাই বসলো শেষ বৈঠকে। দুটো আলাদা দল তৈরি হলো। প্রথম গ্রুপ আক্রমণ চালাবে ফার্মগেট চেকপোস্টে, দ্বিতীয় গ্রুপ হামলা চালাবে দারুল কাবাব রেস্টুরেন্টে।
৮ আগস্ট, ১৯৭১। অপারেশন শুরু হবে ঠিক সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায়। দুটি দল একসঙ্গে দুই জায়গায় অপারেশন চালাতে হবে। ১৯৬৫ মডেলের সবুজ রঙের টয়োটা গাড়িতে উঠে চেকপোস্টের দিকে এগোতে থাকলেন সামাদ, বদি, স্বপন, মায়া, পুলু আর চুলুরা। সঙ্গে তিনটির মতো ভারতীয় স্টেনগান, একটা চাইনিজ এলএমজি। আরও আছে একটা ভারতীয় গ্রেনেড আর দুটি ফসফরাস গ্রেনেড।
এমনিতে ওই চেকপোস্টে বেশিরভাগ সময়ে ১০-১৪ জনের মতো সৈন্য পাহারায় থাকেই। ওপাশের সড়ক-দ্বীপের তাঁবুর সৈন্যদের ধরে এই হিসেব। সবকিছু মাথায় নিয়েই নিউ ইস্কাটন রোড ধরে এগোতে থাকলো ‘দ্য ঢাকা বয়েজ’। তৎকালীন পাক মোটর আর এখনকার বাংলা মোটর ক্রসিংয়ে এসে সবাই একটু নড়েচড়ে বসলো। দেখতে দেখতে গাড়ি এসে পড়লো দারুল কাবাব রেস্টুরেন্টের সামনে। ক্র্যাকপ্লাটুনের গাড়ি সেটা পার হয়ে চেকপোস্টের দিকে এগিয়ে গেল। কাছাকাছি আসতেই দেখা গেল পাক হানাদার বাহিনীর সৈন্যরা দুটো বেবিট্যাক্সি তল্লাশী করছে।
পুলুর তো মাথায় হাত। আজ ডিউটিতে মাত্র তিনজন আছে! মন খারাপ করে ও বাকিদের বলল, ''দ্যাখো, আজ শুধু তিনজন গার্ড আছে।''
ওর কথায় কেউ কান দিল না। যার যার দায়িত্ব নিয়ে সে সে ভাবছে। পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী, গাড়ি থামানো হলো হলিক্রসের গেটে। একটা ল্যাম্পপোস্টেও বাল্ব নেই। ঘুটঘুটে অন্ধকারে পুরো পরিবেশটা কেমন যেন মৃতুপুরীর মতো মনে হয়। কে জানতো, একটু পরে সত্যিই মৃত্যুপুরীতে পরিণত হবে পুরো এলাকা!
ঠিক মৃত্যুপুরীর দিগন্তের মতোই ঠান্ডা মেজাজে গাড়ি থেকে নেমে পড়লো সবাই। কেবল রয়ে গেলেন সামাদ। সবাইকে বললেন, ‘আল্লাহ তোমাদের সহায় হোন।’
গাড়ি থেকে নেমে একটু দৌড়ে গিয়ে যার যার পজিশনে সবাই জায়গা করে নিল। ফায়ারিংয়ের শুরুটা হলো সামনে থেকে। একটু আগেই একজনকে তল্লাশি করে ছেড়েছে তিন সৈন্য। নিজেদের মধ্যে গল্পে মশগুল। একজন সিগারেট বের করতে পকেটে হাত বাড়িয়েছে, এমন সময় মাঝেরজন লুটিয়ে পড়লো। দুই পাশে থাকা দুজনেই দুটো ফায়ারের শব্দ শুনেছিল। কিন্তু কিছু বুঝে ওঠার আগেই পড়ে গেল কলাগাছের মতো।
এই যে তিনজনের শেষ যাত্রা, সঙ্গে সঙ্গে দু'পাশ থেকে পুরো এলাকা কাঁপিয়ে ত্রাহি ত্রাহি ব্রাশ ফায়ার শুরু করলেন স্বপন, বদি আর মায়া। লক্ষ্য সৈন্যদের তাঁবু। মোটা কাপড়ের তাঁবু ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল, ভিতর থেকে গুলির শব্দ ছাপিয়ে উড়ে এল আর্তনাদ।
একজন সৈন্যও সেদিন বাঁচেনি। তার ওপর আবার পুলু সেখানে ছুঁড়ে দিল গ্রেনেড। স্বপন হামলা বন্ধের নির্দেশ দিতেই সবাই সাথে সাথে ছুটে গেল গাড়ির দিকে।
পুরো ঘটনা ঘটতে সময় লেগেছিল মাত্র ৯২ সেকেন্ড। অন্যদিকে, ক্র্যাকপ্লাটুন সদস্যরা গুলি ছুঁড়েছিল ৯৬ রাউণ্ড। পাক বাহিনীর সঙ্গে কাবাব রেস্টুরেন্টে থাকা ৬ জন রাজাকারও সেদিন প্রাণ হারিয়েছিলো মুক্তিবাহিনীর আক্রমণে। ক্র্যাকপ্লাটুনের অন্যতম সদস্য চুলুর এক সাক্ষাতকারে অপারেশন পরবর্তী ঘটনা সম্পর্কে বলেছেন,
''সফল আক্রমণ পরিচালনা করে চোখের পলকে সামাদ ওয়ার্কশপে পৌঁছে। জামান ভাই ও আনোয়ার ভাইয়ের হেফাজতে আর্মসসহ গাড়ি রেখে ফিরে যান বাড়িতে। কভার গাড়ি নিয়ে আমরা গুলশানের শেলটারে পৌঁছাই। পরে জানতে পেরেছিলাম এই অপারেশনে ১ জন অফিসারসহ মোট ১৭ জন পাকসেনা নিহত হয়েছিলো।''
এভাবেই ঢাকার ছয় যুবক সফলভাবে শেষ করেছিলেন অপারেশন ফার্মগেট, যার মাধ্যমে দিগ্বিদিক হারিয়ে আরও বিপাকে পড়েছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী, একটু একটু করে মুক্তির স্বাদ পেয়েছিল বাংলার মানুষ। এ কথা না বললেই নয় যে, অপারেশনের পরের কয়েকদিন ঢাকায় অবস্থানরত পাক হানাদার বাহিনীর সদস্যরা আতঙ্কে দিন পার করেছে। প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাত দিয়ে জানা যায়, অপারেশন ফার্মগেট শেষে পাক বাহিনী বালতি বালতি পানি ঢেলে রক্ত পরিস্কার করেছিল।
অপারেশন ফার্মগেটের ২১ দিনের মাথায় ২৯ আগস্ট ধরা পড়েন অপারেশন ফার্মগেটের মূল পরিকল্পনাকারী বদিউল আলম। ঢাকা কলেজের তৎকালীন প্রফেসর জালাল উদ্দিনের বাসায় ফরিদ, জাফর আর পারভেজদের সঙ্গে তাশ খেলছিলেন বদি। এটা ছিল মূলত তার আড্ডার জায়গা। প্রায়ই আসতেন। কিন্তু এই আড্ডার জায়গাতেই কাল হলো তার। বেলা সাড়ে ১১ টার দিকে পাক হানাদারদের একটি দল এসে হঠাৎ ঘেরাও করে প্রফেসর জালাল উদ্দিনের বাড়ি। টের পেয়ে ঘরের জানালা গলে পালাবার চেষ্টাও করেছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা বদি। কিন্তু শেষতক পেরে ওঠেননি। ধরা পড়ে যান তিনি। তাকে টেনে হেঁচড়ে নিয়ে যায় পাক বাহিনীর হায়েনারা। স্বাধীন বাংলাদেশে বীর বিক্রম উপাধিতে ভূষিত হন তিনি। কিন্তু সেই যে গেলেন, আর ফেরেননি বদি।
This is an artile based on 1971 liberation war urban guerrilla group Crack Plaoon Oparetion, 'Opartion Firmgate'. Necessary link has been hyperlinked.
Feaure Photo- Daily Star