৩ ডিসেম্বর ১৯৭১; বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধকে আরেকটি পাক-ভারত যুদ্ধ হিসেবে বিশ্বের কাছে দেখানোর জন্য পাকিস্তান এয়ারফোর্স ভারতের বিভিন্ন জায়গায় বিমান চালায়। এই লেখার বিষয়বস্তু মূলত পাকিস্তান-ভারতের মধ্যকার নৌ-যুদ্ধ। তবে তৃতীয় ইন্দো-পাক যুদ্ধ কীভাবে শুরু হলো সেই সম্পর্কে দুই লাইন না লিখলেই নয়।
১৯৭১ সালের শেষের দিকে পূর্ব পাকিস্তানে মুক্তিবাহিনীর দুর্বার হামলায় বিপর্যস্ত পাকিস্তান সেনাবাহিনী একের পর এক এলাকার নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে। ভারতের সাহায্য পেয়ে আরো দুর্ধর্ষ হয়ে উঠেছে বাংলার দামাল ছেলেরা। তাদের গেরিলা হামলায় পাকিস্তানের রসদ সরবরাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। বাঙালি নৌ-কমান্ডোদের অপারেশন জ্যাকপট সফল হওয়ায় অচল হয়ে গেছে দেশের প্রধান সব নদী ও সমুদ্রবন্দর। কিলোফ্লাইট অপারেশনে আমাদের অকুতোভয় পাইলটরা হানাদার বাহিনীর তেলের রিজার্ভে হামলা চালিয়ে ধস নামিয়ে দিয়েছে।
এসব কারণে পাকিস্তানি হাইকমান্ড তাদের ঘনিষ্ঠ মিত্র যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের সরাসরি সাহায্য পেতে মরিয়া ছিল। কিন্তু জাতিসংঘের মাধ্যমে যুদ্ধবিরতি কার্যকর করতে হলে পাকিস্তানের দাবিকে সত্য প্রমাণ করতে হবে। তারা বিশ্ববাসীকে ধোঁকা দিতে প্রথম থেকেই আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে প্রথমে ভারতের ষড়যন্ত্রে কতিপয় বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীর অপকর্ম, পরবর্তী একে পাক-ভারত যুদ্ধ হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করছিল। এরই মধ্যে জেনারেল টিক্কা খান ভারতে হামলার প্রস্তাব দেন। ৩০ নভেম্বর ভারতে হামলার বিষয়ে চূড়ান্ত হয়। তারা ইসরায়েলের অপারেশনের ফোকাসের আদলে ভয়াবহ বিমান হামলা করে পশ্চিম ফ্রন্টে যুদ্ধ শুরু করতে চেয়েছিল।
এভাবেই ১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর শুরু হয় 'অপারেশন চেঙ্গিস খান', পাকিস্তান বিমান বাহিনী তিন ধাপে এই অপারেশন পরিচালনা করে। সন্ধ্যা পৌনে ছয়টায় ৩৬টি বিমান ভারতের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে। প্রথম ধাপে পান্থকোট ও দ্বিতীয় ধাপে অমৃত্সরে বিমান হামলা হয়। তৃতীয় ধাপের আম্বালা, আগ্রা, লুধিয়ানা, জয়সলমীর, যোধপুর, জমনগর, শ্রীনগর প্রভৃতি স্থানে ব্যাপক আক্রমণ চালায় পাকিস্তানি যুদ্ধবিমান। ভারত এ ধরনের হামলার আশঙ্কা আগে থেকেই করছিল। ফলে তাদের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী যুদ্ধ ঘোষণা করেন এবং রাতেই ২৩টি ভারতীয় যুদ্ধবিমান পাকিস্তানের ৮টি বিমানঘাঁটিতে পাল্টা আক্রমণ করে। পরবর্তী দুদিন আকাশে যুদ্ধ চলে দুই দেশের মধ্যে। এরই মধ্যে ৪ ডিসেম্বর রাতে পাকিস্তানের করাচি বন্দরে মিসাইল হামলা চালায় ভারতীয় নৌবাহিনী।
অপারেশন ট্রাইডেন্ট
মুক্তিবাহিনীকে সাহায্য করায় ভারতের উপর হামলা হতে পারে এমনটা অনুমান করেছিলেন ভারতীয় এডমিরালরা। তাই যুদ্ধ যদি শুরু হয়েই যায় তবে ভারতীয় নৌবাহিনী কীভাবে পাকিস্তানের উপর হামলা করবে সেই পরিকল্পনা আগেই তারা করে রেখেছিলেন। ১৯৬৫ সালের যুদ্ধে অপারেশন দ্বারকাতে পাকিস্তানের হাতে মার খাওয়ার দুঃখ তখনও তারা ভুলতে পারেননি। সেদিন নিজেদের দুর্বলতা ও কৌশলগত কারণে হামলার জবাব দেয়নি ভারত। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের কারণে তৃতীয় ইন্দো-পাক যুদ্ধ শুরু হতেই এডমিরাল সর্দারীলাল মাথুরদাস নন্দা নৌবাহিনীকে ব্যবহার করে পুরো করাচি বন্দরকে অকেজো করার পরিকল্পনা করেন। ভারতীয় হাইকমান্ড দেরি না করে এই অপারেশন প্ল্যান অনুমোদন করে। ফলে যুদ্ধ শুরুর পরের রাতেই এই অপারেশন শুরু হয়।
উল্লেখ্য, ১৯৬৫ সালের যুদ্ধের পর পরই ভারতীয় নৌবাহিনীতে ডিফেন্স বাজেট বাড়িয়ে দেয়া হয়। বিদ্যমান যুদ্ধজাহাজগুলোর ব্যাপক সংস্কার ছাড়াও বেশ কিছু নতুন যুদ্ধজাহাজ সংযুক্ত হয়। ১৯৭১ সালের শুরুতে শক্তি বৃদ্ধির অংশ হিসেবে ইন্ডিয়ান নেভিতে যোগ হয় সোভিয়েত ইউনিয়নের ৮টি OSA II Class ফাস্ট অ্যাটাক ক্রাফট (FAC)। এ ধরনের জাহাজগুলো আকারে ছোট কিন্তু জাহাজ বিধ্বংসী মিসাইল বহন করে। ভারত এগুলোকে 'বিদ্যুৎ ক্লাস মিসাইল বোট' হিসেবে নামকরণ করে।
ফাস্ট অ্যাটাক ক্রাফট শ্রেণীর জাহাজগুলো মূলত স্পিডবোট এবং যুদ্ধজাহাজের সমন্বয়। এগুলোর সবচেয়ে বড় শক্তি হলো মিসাইল ও গতি।
শুরু হলো যুদ্ধযাত্রা
১৯৭১ সালের ৪ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় তিনটি বিদ্যুৎ ক্লাস মিসাইল বোট করাচি বন্দরে হামলার উদ্দেশ্যে রওনা হয়। এগুলোর নাম ছিল যথাক্রমে আইএনএস বীর, আইএনএস নিপাত ও আইএনএস নির্ঘাত। এদের এসকর্ট করার জন্য ছিল দুটি আর্নালা ক্লাস এন্টি-সাবমেরিন ওয়ারফেয়ার করভেট (ফ্রিগেটের চেয়ে ছোট শ্রেণীর যুদ্ধজাহাজ) এবং একটি অয়েল ট্যাংকার শিপ। প্রসঙ্গত, পাকিস্তানি সাবমেরিন বহরকে, বিশেষত পিএনএস গাজী ও পিএনএস হাঙ্গরকে, ভয় করতো ভারতীয় নৌবাহিনী। এজন্যই এন্টি-সাবমেরিন অস্ত্রে সজ্জিত দুটো যুদ্ধজাহাজ মিসাইল বোটগুলোকে পাহারা দিয়ে পাকিস্তানের জলসীমায় পৌঁছে দেয়।
করাচি বন্দর থেকে ৪৬০ কিলোমিটার দূরে এই ফ্লিট পৌঁছে যায় সন্ধ্যার আগেই। সেখানেই ট্যাংকার জাহাজ থেকে রিফুয়েলিং করতে শুরু করে। এত দূরে নোঙর করার কারণ ছিল যাতে পাকিস্তান এয়ারফোর্সের নাগালের বাইরে থাকা যায়। ভারতীয়রা রাতের অপেক্ষা করছিল। অপারেশনটি রাতে করার মূল কারণ ছিল রাতে মেরিটাইম স্ট্রাইক (যুদ্ধজাহাজের উপর আক্রমণ) করার মতো কোনো বিমান তখন পাকিস্তানের কাছে ছিল না। তাই ভারতীয় ফ্লিটকে লক্ষ্য করে বিমান হামলার কোনো ভয় ছিল না। রাত নামার সঙ্গে সঙ্গে নিপাত, নির্ঘাত আর বীর পাকিস্তানের করাচি বন্দরের দিকে আলাদা পথে পরিকল্পনা মোতাবেক এগোতে থাকে। তিনটি বোটেই চারটি করে অ্যান্টিশিপ মিসাইল ছিল।
রাত পৌনে এগারোটায় প্রথম শিকারটি করে আইএনএস নির্ঘাত। করাচি বন্দর থেকে ১৩০ কিলোমিটার দূরে সে পেয়ে যায় তার প্রথম শিকার পিএনএস খাইবারকে। পাকিস্তান নেভির এই ব্যাটল ক্লাস ডেস্ট্রয়ারটি অপারেশন দ্বারকাতে অংশ নিয়ে ভারতে গোলাবর্ষণ করেছিল। দেরি না করে একটি অ্যান্টিশিপ মিসাইল ফায়ার করে আইএনএস নির্ঘাত। জাহাজের রাডার মিসাইলটিকে ভুল করে বিমান বলে ধরে নেয় এবং এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম সক্রিয় হয়ে ওঠে। কিন্তু এটি হামলা ঠেকাতে ব্যর্থ হয়। মিসাইলটি জাহাজের ডানপাশে আঘাত করে এবং বয়লার রুম ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে যায়।
ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন জাহাজটি তখন আগুন নেভাতে হিমশিম খাচ্ছিল। এরই মধ্যে রেডিওর মাধ্যমে করাচিতে নৌবাহিনীর হেডকোয়ার্টারে মেসেজ পাঠানো হয়, "Enemy aircraft attacked in position 020 FF 20. No. 1 boiler hit. Ship stopped"। মেসেজে তারা পজিশন সম্পর্কে ভুল তথ্য দেয়ায় উদ্ধারকারী জাহাজ পৌঁছাতে দেরি হয়। এরই মধ্যে নাবিকরা জাহাজটি ডুবে যাওয়ার হাত থেকে রক্ষা করে। সেটি বুঝতে পেরে আইএনএস নির্ঘাত দ্বিতীয়বারের মতো মিসাইল ফায়ার করে। এবার প্রচণ্ড বিস্ফোরণে ডুবে যায় পিএনএস খাইবার। এতে থাকা ২২২ জন নাবিক নিহত হয়।
এরপরের হামলাটি করে আইএনএস নিপাত। করাচি বন্দর থেকে ৪৮ কিলোমিটার দূরে থাকতে সে তার রাডারে দুটো টার্গেট পেয়ে যায়। এর একটি ছিল বেসামরিক জাহাজ এমভি ভেনাস চ্যালেঞ্জার এবং অপরটি ডেস্ট্রয়ার পিএনএস শাহজাহান। এই জাহাজটিও দ্বারকা হামলায় অংশ নিয়েছিল। ভারতীয় গোয়েন্দাদের কাছে খবর ছিল, ভেনাসে করে প্রচুর পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র পূর্ব পাকিস্তানে যাচ্ছে এবং একে এসকর্ট (পাহারা) করছে যুদ্ধজাহাজ পিএনএস শাহজাহান। তাই রাত এগারোটায় জাহাজ দুটি লক্ষ্য করে একই সাথে দুটি SS-N-2 অ্যান্টিশিপ মিসাইল ফায়ার করা হয় যায়।
ভেনাস চ্যালেঞ্জারে অ্যান্টিশিপ মিসাইল আঘাত করার সঙ্গে সঙ্গে ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটে। জাহাজে প্রচুর গোলাবারুদ থাকায় সেকেন্ডারি এক্সপ্লোশনের সাথে সাথেই জাহাজটি ডুবতে শুরু করে। অন্য মিসাইলটি শাহজাহানে সফলভাবে আঘাত করে। জাহাজটি মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হলেও তখনও ডোবেনি। তবে সেটি পাল্টা জবাব দেয়ার ক্ষমতা হারায়। ফলে ক্যাপ্টেন বাধ্য হয়েই পালিয়ে যান। পরবর্তীতে মেরামতের অযোগ্য হয়ে যাওয়ায় পিএনএস শাহজাহানকে স্ক্র্যাপ করা হয়।
এর পরের টার্গেটে আঘাত হানে আইএনএস বীর। সমুদ্রে পেতে রাখা নেভাল মাইন অপসারণের দায়িত্বে থাকা মাইন-সুইপার শিপ পিএনএস মুহাফিজকে রাত ১১:২০ মিনিটে আঘাত করে একটি SS-N-2 অ্যান্টিশিপ মিসাইল। এই হামলার খবর হেডকোয়ার্টারে পাঠানোর আগেই ডুবে যায় এবং ৩৩ জন নাবিক নিহত হয়।
এদিকে আইএনএস নিপাত করাচি বন্দরের দিকে এগিয়ে যায় ২৬ কি.মি দূর থেকে তার অবশিষ্ট দুটো মিসাইল ফায়ার করে। উল্লেখ্য, এ ধরনের মিসাইল দিয়ে যুদ্ধজাহাজের পাশাপাশি বড় ধরনের উপকূলীয় টার্গেটেও হামলা করা সম্ভব। আইএনএস নিপাতের প্রথম মিসাইলটি লক্ষভ্রষ্ট হয়, তবে দ্বিতীয়টি বন্দরের বিশাল তেলের ট্যাংকারে আঘাত করে। এই বিস্ফোরণে বন্দরের ব্যাপক ক্ষতি হয়, জ্বালানি তেলের কারণে আগুন বেশ ভয়াবহ আকার ধারণ করে।
এই অপারেশনের মাধ্যমেই দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে প্রথম অ্যান্টিশিপ মিসাইলের সফল প্রয়োগ হয়। পাকিস্তানিরা আক্রমণের ভয়াবহতায় কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে। প্রাথমিক ধাক্কা সামলিয়ে পাকিস্তান নৌবাহিনীর অবশিষ্ট যুদ্ধজাহাজগুলো পাল্টা ধাওয়া শুরু করে। কিন্তু ততক্ষণে ভারতীয় মিসাইল বোটগুলো প্রচন্ড গতি তুলে করাচি বন্দর এলাকা ত্যাগ করে। রাতের মধ্যেই ফ্লিটের সবগুলো জাহাজ অপারেশন শেষে নিরাপদে ভারতীয় সীমায় পৌঁছে যায়।
এ ঘটনার পর পাকিস্তানিরা মারাত্মক ক্ষিপ্ত হয়ে পড়ে। কিন্তু ভারতীয় নজরদারি এড়িয়ে তাদের বন্দরে পাল্টা হামলা করা প্রায় অসম্ভব। তাই তাদের সাবমেরিন বহরকে গোপন মিশনে পাঠানো হয়। পাকিস্তানি বিমান ও নৌবাহিনী সম্মিলিতভাবে তাদের জলসীমা পাহারা দিতে শুরু করে। উত্তেজনার পারদ এতটাই তুঙ্গে ছিল যে পাকিস্তানি যুদ্ধবিমান তাদেরই যুদ্ধজাহাজ পিএনএস জুলফিকারকে ভুলক্রমে ভারতীয় যুদ্ধজাহাজ মনে করে আক্রমণ করে ক্ষতিগ্রস্ত করে ফেলে। সেই ঘটনা না হয় 'অপারেশন পাইথন'-এর জন্য তোলা থাক। পাকিস্তানি তেলের রিজার্ভ ও জাতীয় অর্থনীতির চাকা থমকে দিতে ভারত চারদিনের ব্যবধানে আবারও হামলা করে করাচি বন্দরে। এরই মধ্যে ৪ ডিসেম্বর রাতেই পাকিস্তানি সাবমেরিন গাজী ভারতীয় এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার ডুবাতে গিয়ে নিজেই ডুবে যায়। সেই সম্পর্কে বিস্তারিত আসছে পরবর্তী পর্বেই!
এই সিরিজের অন্যান্য পর্ব
This Bengali article discusses about Operation Trident.
Reference:
1. Operation Trident,1971: How Indian Navy Pulled Off One Of Its Greatest Victories
2. A Leaf From History: When The War Began
3. Navy Day 2020: Why India remembers Operation Trident every year on December 4