Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

ওএসএস থেকে সিআইএ: আমেরিকার গোয়েন্দা সংস্থার ইতিহাস

১৯৪২ সাল, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দাবানল তখন ছড়িয়ে পড়েছে এশিয়া-ইউরোপ ব্যাপী। এমনই এক গ্রীষ্মের সন্ধ্যায় ওয়াশিংটনের একটি রাজসিক বাড়ীতে মুখোমুখি বসে আছেন দুই বৃদ্ধ। এদের একজন প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অসামান্য বীরত্বের জন্য ‘ওয়াইল্ড বিল’ খ্যাতি পাওয়া আমেরিকান যোদ্ধা উইলিয়াম জে ডোনোভান। দেশের প্রতি কর্তব্যের ডাকে, ওয়াল স্ট্রীটে আইন ব্যবসা ছেড়ে, ডোনোভান আবার ইউনিফর্ম গায়ে ফিরে এসেছেন, হাতে তুলে নিয়েছেন সদ্য প্রতিষ্ঠিত সংস্থা অফিস অফ স্ট্র্যাটেজিক সার্ভিস (ওএসএস) এর দায়িত্ব।

ওয়াইল্ড বিল ডোনোভান; Image Source: quatationof.com

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আমেরিকার কৌশলগত লড়াই পরিচালনার জন্য গঠিত হয়েছিল ‘ওএসএস’। ডোনোভান এ সময় উপলব্ধি করেন, কেবলমাত্র প্রচলিত পদ্ধতিতে যুদ্ধের মাধ্যমে জার্মান ও জাপানীজদের ঠেকানো সম্ভব নয়। এর জন্য চাই গোপন গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক, অন্তর্ঘাতমূলক যুদ্ধ, দেশগুলোর অভ্যন্তরে কোন্দল বাড়ানো আর সর্বোপরি গোপন মিশনের জন্য উপযুক্ত অস্ত্র ও প্রযুক্তি। আর এ সব কিছুর মূল দায়িত্ব ন্যাস্ত করার জন্য তিনি হাজির হয়েছিলেন স্ট্যানলি প্লাট লোভলের কাছে, যিনি এ মুহূর্তে তার সামনে বসে ওয়াইনের গ্লাসে চুমুক দিচ্ছেন।

লোভল একজন সফল রাসায়নিক বিজ্ঞানী ও ব্যবসায়ী,  নিজের ‘লোভল কেমিক্যাল কোম্পানী’-এর প্রেসিডেন্ট হিসেবে তার নামে পেটেন্ট রয়েছে সত্তরটিরও বেশি। ইতোপূর্বে প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট যখন বিখ্যাত সব বিজ্ঞানী ও ইঞ্জিনিয়ারদের নিয়ে অস্ত্র তৈরীর জন্য ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড রিসার্চ কমিটি গঠন করেছিলেন, লোভল ছিলেন সেই কমিটির অন্যতম একজন সদস্য।

সপ্তাহখানেক আগেই, লোভলকে ওএসএস এর ‘গবেষণা ও উন্নয়ন’ বিভাগের দায়িত্ব নেয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন ডোনোভান। ডোনোভান বলেছিলেন

আমি এ গোপন যুদ্ধের জন্য প্রয়োজনীয় সব ধরণের অস্ত্র চাই, যতধরণের কূটকৌশল আছে সব প্রয়োগ করতে চাই, আর এসব কিছু উদ্ভাবন করবে তুমি। 

প্রস্তাবটা পেয়ে প্রথমে উৎসাহে লাফিয়ে উঠেছিলেন লোভল। তার সামনে যেন হাজির হয়েছে শার্লক হোমস উপাখ্যানের জিম মরিয়ার্টি হওয়ার সুযোগ। মরিয়ার্টির মতো তিনিও হবেন এক গোপন অন্ধকার জগতের মাষ্টারমাইণ্ড, বিশ্বব্যাপী পরিচালনা করবেন এক নীরব যুদ্ধ।

স্ট্যানলি প্লাট লোভল; Image Source: cgliberty.com

কিন্তু কয়েক দিন পেরিয়ে গেলে তার উৎসাহেও ভাটা পড়তে শুরু করে, দ্বিধা দ্বন্ধ জড়িয়ে ধরে তাকে। সেসব ব্যাখ্যা করতেই আজ ডোনোভান এর কাছে হাজির হয়েছেন তিনি। এতটা বিস্তৃত পরিসরে গুপ্তচরবৃত্তির ধারণাটি আমেরিকাতে নতুন, নতুন লোভলের কাছেও। আমেরিকানরা জাতিগত ভাবে বহির্মুখী। তারা গোপনে বা কূটচালের মাধ্যমে কোনো কিছু করার চেয়ে, শক্তি ও তাকতের মাধ্যমে তা সম্পন্ন করতে ভালোবাসে। লোভলের দ্বিধার জায়গাটা এখানেই। তার মনে হচ্ছিল জিম মরিয়ার্টি একদমই আন-আমেরিকান এবং গোয়েন্দা সংস্থার ধারণাটি আমেরিকানদের নীতির সাথে যায় না।

ওএসএস-এর বিষয়ে যে একমাত্র লোভলই দ্বিধায় ভুগছিলেন তা নয়, বিরোধীতা এসেছিল অন্যান্য দিক থেকেও। এক সিনেটর তো বলেছিলেন “ডোনোভান এখন আমেরিকার গেস্টাপো বাহিনীর প্রধান হতে যাচ্ছেন।” সংবাদ মাধ্যমগুলোও নিয়মিত তিরষ্কার করে যাচ্ছিল ওএসএস-কে নিয়ে। কিন্তু ডোনোভান ওসবকে পাত্তা দেননি। তবে লোভলের মনে প্রত্যয় যোগানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা করলেন তিনি এবং তাকে বোঝাতেও সক্ষম হলেন যে এটি ‘আন-আমেরিকান’ পদ্ধতি হলেও, তারা সফল হলে এতে আমেরিকানরাই সবচেয়ে খুশী হবে।

লোভলকে রাজী করানোর পর, তাদের হাত ধরে গোয়েন্দা জগতের দ্য গ্রেট গেমে ওএসএস-এর যাত্রা শুরু হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইংল্যান্ড ছিল আমেরিকার মিত্র শক্তি। গোয়েন্দা নেটওয়ার্কের দিক দিয়ে ইংল্যান্ড তখন অ্যামেরিকার চেয়ে অনেকটা এগিয়ে। তাই ‘ওএসএস’ সিদ্ধান্ত নিল ইংল্যান্ডের, স্পেশাল অপারেশন এক্সিকিউটিভ (এসওই) এর সাথে একত্রে কাজ করার।

Image Source: pbs.twimg.com

ওএসএস এবং এসওই’র মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। সেখানে দু পক্ষের দায়িত্ব সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করা হয় এবং কার্যক্রম চালানোর জন্য দেশও নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়। ওএসএস এর দায়িত্বে ছিল চীন, মাঞ্চুরিয়া, কোরিয়া, অষ্ট্রেলিয়া, ফিনল্যান্ড ও আটলান্টিক দ্বীপগুলো। অন্যদিকে এসওই এর দায়িত্বে ছিল ভারত, পূর্ব আফ্রিকা, বলকান, মধ্যপ্রাচ্য। এছাড়া পশ্চিম ইউরোপও প্রধানত ব্রিটিশদের দায়িত্বেই ছিল।

ব্রিটিশদের সহায়তায় ডোনোভান একদমই শূন্য থেকে সংগঠনটিকে বিশ্ব সেরা গোয়েন্দা সংস্থা হিসেবে গড়ে তোলার সংকল্পে মাঠে নামেন। তার পরিচিত গন্ডি থেকে অভিজাত লোকজন, যাদের তখন বিভিন্ন দেশে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা ছিল, তাদের নিয়োগ দেয়া হলো। নিয়োগ দেয়া হলো অভিবাসীদের, বা অভিবাসীদের প্রথম, দ্বিতীয় প্রজন্মকে যাতে বিভিন্ন দেশ সম্পর্কে ভালো ধারণা নেয়া যায়।

ব্রিটিশরা এসব আমেরিকানদের তাদের অভিজ্ঞতার আলোকে প্রশিক্ষিত করে তুলতে শুরু করে আর আমেরিকা সরবরাহ করে অত্যাধুনিক সব প্রযুক্তি। অল্প সময়ের মধ্যেই আনকোরা ওএসএস সদস্যরা ব্রিটিশদের কাছ থেকে এ পঙ্কিল জগতের কর্মকৌশল আয়ত্ব করে নিতে সমর্থ হয় এবং নিজেদের দক্ষতা প্রদর্শন করতে শুরু করে।

ওএসএস এর প্রশিক্ষণ; Image Source: archives.gov

এদিকে লোভল তার গবেষণা ও উন্নয়ন (আরএন্ডডি) বিভাগ নিয়ে কাজ শুরু করে দিয়েছেন পুরোদমে। এর লক্ষ্য ছিল প্রয়োজনীয় সব ধরণের গোপন যন্ত্র, রাসায়নিক পদার্থের উদ্ভাবন, উন্নয়ন ও পরীক্ষা নিরীক্ষা করা। তাদের তৎপরতায় অচিরেই আমেরিকানরা ব্রিটিশদের থেকে উল্লেখযোগ্য পার্থক্য প্রদর্শন করা শুরু করে। ব্রিটিশদের এসওই ছিল একটি বেসামরিক প্রতিষ্ঠান, তাদের সশস্ত্র সংস্থা, ‘সিক্রেট ইন্টিলিজেন্স সার্ভিস (এসআইএস)’ ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি সংস্থা। অন্যদিকে ওএসএস একই সাথে গোয়েন্দা ও সশস্ত্র সামরিক সংস্থা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।

ব্রিটিশদের থেকে ওএসএস এর প্রযুক্তি উদ্ভাবনের পন্থাও ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। ব্রিটিশরা সম্পূর্ণ গোপনে সরকারী গবেষণাগারে নিজস্ব প্রযুক্তি উদ্ভাবন করতো। কিন্তু লোভল নিজেদের গবেষণাগারে অসাধারণ সব বিজ্ঞানী ও ইঞ্জিনিয়ারদের নিয়োগ দেয়ার পাশাপাশি, বিভিন্ন ব্যক্তিগত কোম্পানী থেকে তাদের প্রয়োজনীয় গিয়ার বানিয়ে নিতেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তীকালের একজন বিজ্ঞানী ও ব্যবসায়ী হওয়ার সুবাদে লোভল নিজস্ব দক্ষতা, অভিজ্ঞতা ও নেটওয়ার্ক কাজে লাগিয়ে এ বিভাগে অসাধারণ সব সাফল্য আনতে শুরু করেন। প্রতিষ্ঠার মাত্র তিন বছরের মধ্যে, লোভলের দল ২৫টি বিশেষ ধরনের অস্ত্র, অন্তর্ঘাতের জন্য উপযুক্ত ১২টি অস্ত্র এবং বিশেষ রেডিও, নথি গোপন করার বিশেষ প্রযুক্তি সহ আরো বিভিন্ন প্রযুক্তি উদ্ভাবন করে।

চীনে কমান্ডোদের প্রশিক্ষণ দেয়া ওএসএস সদস্যরা; Image Source: history.army.mil

১৯৪৪ সাল নাগাদ বিশ্বব্যাপী ওএসএস এর নেটওয়ার্ক ছড়িয়ে পড়ে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে তাদের ভূমিকা ছিল অসামান্য। গুপ্তচরবৃত্তির মাধ্যমে শত্রুপক্ষের তথ্য সংগ্রহ, অন্তর্ঘাতমূলক যুদ্ধ পরিচালনাতো ছিল নিয়মিত কাজ। এছাড়া তারা জার্মানি ও জার্মানির দখল করা দেশগুলোতে ‘নাৎসি বিরোধী’ দলগুলোকে একাট্টা করে আন্দোলন পরিচালনা করে। জাপানে জাপানী গেরিলা দলগুলোকে প্রশিক্ষণ দেয়। চীন ও বার্মায় ও তাদের ভূমিকা ছিল উল্লেখযোগ্য। এসবের বাইরে বিভিন্ন প্রোপাগান্ডা ছড়ানোর কাজটাও তারা ভালোভাবেই করতো।

তবে এটি যেহেতু শুধু যুদ্ধের জন্য গঠন করা প্রতিষ্ঠান ছিল, তাই যুদ্ধের পর এর অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়ে। কিন্তু ডোনোভান যুদ্ধের পরও পরাজিত শত্রুর ওপর নজরদারি জারি রাখার গুরুত্ব ভালোই টের পাচ্ছিলেন। এটি সরকারি কর্মকর্তাদের বোঝানোর জন্য তিনি প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টের কাছে একটি স্মারকলিপি পেশ করেন। কিন্তু শান্তি চলাকালীন সময়ে গোয়েন্দা সংস্থার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করার মতো লোক তখন খুব বেশী ছিল না ওয়াশিংটনে। রুজভেল্ট এ বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত দেননি।

ন্যাশনাল সিকিউরিটি এক্ট এ স্বাক্ষর; Image Source: historyclick.com

পরবর্তীতে প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যানের কাছে এ প্রস্তাব যায়। ১৯৪৫ সালের ২০ সেপ্টেম্বর ট্রুম্যান ‘ওএসএস’ কে ভেঙ্গে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। ওএসএস ভেঙ্গে গেলেও সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়নি। এর কয়েকটি ইউনিট বিভিন্ন সংস্থার অধীনে চলে যায়। অবশ্য অধিকাংশ বিজ্ঞানী ও ইঞ্জিনিয়াররা ফিরে গিয়েছিলেন ব্যক্তিগত কোম্পানীগুলোতে।

এরপর এর পরবর্তী বছর আমেরিকা বুঝতে পারে, যুদ্ধ শেষ হয়েও আসলে শেষ হয়নি। সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে স্নায়ুযুদ্ধ সমাগত। আর এর জন্য গোয়েন্দা সংস্থার বিকল্প নেই। এর ফলে ১৯৪৭ সালে ট্রুম্যান ন্যাশনাল সিকিউরিটি এক্ট এ স্বাক্ষর করেন, এর মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা করা হয় সেন্ট্রাল ইন্টিলিজেন্স এজেন্সি বা সিআইএ। মূলত ওএসএস এর কাঠামো নিয়েই আবার যাত্রা শুরু করে সিআইএ। শুরু হয় একের পর এক থ্রিলার উপন্যাসকেও হার মানিয়ে দেয়া উপাখ্যানের।

Related Articles