Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

বিভিন্ন রাষ্ট্রের নিজস্ব ‘ভিয়েতনাম যুদ্ধ’ || পর্ব–১

‘ভিয়েতনাম সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র’ দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ায় অবস্থিত একটি একদলীয় এককেন্দ্রিক সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র। রাষ্ট্রটি জনবহুল, এবং এর বার্ষিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার বর্তমান বিশ্বের অধিকাংশ রাষ্ট্রের চেয়ে বেশি। কিন্তু রাষ্ট্রটি সবচেয়ে বেশি পরিচিতি অর্জন করেছে একটি মারাত্মক যুদ্ধক্ষেত্র হিসেবে। বস্তুত, ভিয়েতনাম এমন একটি যুদ্ধক্ষেত্র, যেখানে বর্তমান জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের ৫টি স্থায়ী সদস্য রাষ্ট্রই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে এবং এদের মধ্যে ৩টি রাষ্ট্র (ফ্রান্স, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীন) ভিয়েতনামিদের কাছে পরাজিত হয়েছে। অবশ্য ব্রিটেন ১৯৪৫–৪৬ সালে ভিয়েতনামে একটি সংক্ষিপ্ত সামরিক অভিযানে অংশ নিয়েছে, কিন্তু পরাজিত হয়নি। আর সোভিয়েত ইউনিয়ন ১৯৬০ ও ১৯৭০–এর দশকে ভিয়েতনামে উত্তর ভিয়েতনামের পক্ষে এবং দক্ষিণ ভিয়েতনামের (ও যুক্তরাষ্ট্রের) বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে, কিন্তু তারাও সেখানে পরাজিত হয়নি।

চার দশকের মধ্যে ভিয়েতনামি কমিউনিস্টরা উপনিবেশবাদী মহাশক্তি ফ্রান্স, বিশ্বের শীর্ষ সামরিক–অর্থনৈতিক শক্তি যুক্তরাষ্ট্র এবং সমাজতান্ত্রিক মহাশক্তি গণচীনকে যুদ্ধক্ষেত্রে পরাজিত করেছে। এর ফলে ‘ভিয়েতনাম’ শব্দটি কার্যত বড় মাত্রার সামরিক ব্যর্থতা বা বিপর্যয়ের প্রতিশব্দ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যখনই কোনো রাষ্ট্র তুলনামূলকভাবে দুর্বল কোনো প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনাকালে সামরিক ব্যর্থতা বা বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়, তখনই সেই যুদ্ধকে ঐ রাষ্ট্রের ‘ভিয়েতনাম’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। বস্তুত, আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ‘ভিয়েতনাম’ রূপকটি এত বেশি প্রচলন লাভ করেছে যে, ভিয়েতনাম যুদ্ধের আগে সংঘটিত সামরিক বিপর্যয়গুলোকেও বর্ণনা করার ক্ষেত্রেও অনেক বিশ্লেষক এই রূপক ব্যবহার করে থাকেন।

চলুন, জেনে নেয়া যাক, কোন রাষ্ট্রের জন্য কোন যুদ্ধ ছিল তাদের ‘ভিয়েতনাম’!

মূল ভিয়েতনাম যুদ্ধ: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভিয়েতনাম

১৯৫৫ সালের ১ নভেম্বর পুঁজিবাদী ও কমিউনিজমবিরোধী দক্ষিণ ভিয়েতনামকে কমিউনিস্ট উত্তর ভিয়েতনামের বিরুদ্ধে সহায়তা করার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ‘মিলিটারি অ্যাসিস্ট্যান্স অ্যাডভাইজরি গ্রুপ ভিয়েতনাম’ গঠন করে, এবং মার্কিন সরকারের ভাষ্যমতে, সেদিন থেকে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য ভিয়েতনাম যুদ্ধ শুরু হয়। এই যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের মূল উদ্দেশ্য ছিল ইন্দোচীনে কমিউনিজমের বিস্তার প্রতিহত করা, দক্ষিণ ভিয়েতনাম, লাওস ও কম্পুচিয়ার (বর্তমান কম্বোডিয়া) মার্কিনপন্থী ও কমিউনিজমবিরোধী সরকারগুলোকে কমিউনিস্ট উত্তর ভিয়েতনাম ও স্থানীয় কমিউনিস্ট মিলিট্যান্ট গ্রুপগুলোর হাত থেকে রক্ষা করা এবং সম্ভব হলে উত্তর ভিয়েতনামে কমিউনিজমের পতন ঘটানো। ১৯৭৫ সালের ৩০ এপ্রিলের মধ্যে কম্পুচীয় কমিউনিস্ট মিলিট্যান্টরা কম্পুচিয়ার রাজধানী নমপেন এবং উত্তর ভিয়েতনামি সৈন্যরা দক্ষিণ ভিয়েতনামের রাজধানী সায়গন (বর্তমান হো-চি-মিন সিটি) দখল করে নেয়। একই বছরে লাও কমিউনিস্ট মিলিট্যান্টরা লাওসের শাসনক্ষমতা দখল করে নেয়। এর মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য ভিয়েতনাম যুদ্ধের আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি ঘটে।

ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় উত্তর ভিয়েতনামি সশস্ত্রবাহিনীর একদল সৈন্য; Source: Wikimedia Commons

এই যুদ্ধ চলাকালে যুক্তরাষ্ট্র, দক্ষিণ কোরিয়া, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, তাইওয়ান (চীন প্রজাতন্ত্র), থাইল্যান্ড ও ফিলিপিন্স দক্ষিণ ভিয়েতনামি সরকারের পক্ষে যুদ্ধ করে, এবং পার্শ্ববর্তী লাও ও কম্পুচীয় সরকারদ্বয়কে তাদের নিজ নিজ রাষ্ট্রে চলমান গৃহযুদ্ধে সহায়তা করে। কিন্তু এই যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র ও তাদের মিত্ররা পরাজিত হয়, এবং দক্ষিণ ভিয়েতনাম, লাওস ও কম্পুচিয়ার সরকারত্রয়ের পতন ঘটে সেখানে কমিউনিস্ট শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়।

মার্কিন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রদত্ত তথ্য অনুযায়ী, এই যুদ্ধ চলাকালে অন্তত ৫৮,২৮১ জন মার্কিন সৈন্য নিহত এবং ৩,০৩,৬৪৪ জন মার্কিন সৈন্য আহত হয় (যাদের মধ্যে ১,৫৩,৩৭২ জন গুরুতরভাবে আহত হয়েছিল)। তদুপরি, এই যুদ্ধে অন্তত ১,৫৮৪ জন মার্কিন সৈন্য নিখোঁজ হয় এবং ৭৭৮ জন মার্কিন সৈন্য উত্তর ভিয়েতনামি সৈন্য/ভিয়েত কং মিলিট্যান্টদের হাতে বন্দি হয়। সর্বোপরি, এই যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র অন্তত ৯,৯২৯টি সামরিক আকাশযান হারায়, যেগুলোর মধ্যে ছিল ৩,৭৪৪টি বিমান, ৫,৬০৭টি হেলিকপ্টার এবং ৫৭৮টি ড্রোন।

এর পাশাপাশি এই যুদ্ধ চলাকালে অন্তত ৩,১৩,০০০ দক্ষিণ ভিয়েতনামি সৈন্য নিহত ও ১১,৭০,০০০ দক্ষিণ ভিয়েতনামি সৈন্য আহত হয়, এবং প্রায় ১০ লক্ষ দক্ষিণ ভিয়েতনামি সৈন্য উত্তর ভিয়েতনামি সৈন্য ও ‘ভিয়েত কং’ মিলিট্যান্টদের হাতে বন্দী হয়। তদুপরি, যুদ্ধ চলাকালে দক্ষিণ ভিয়েতনাম অন্তত ১,৮৯৫টি যুদ্ধবিমান ও হেলিকপ্টার হারায়। একই সময়ে লাওসের সশস্ত্রবাহিনীর অন্তত ১৫,০০০ সদস্য কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চলাকালে নিহত হয়। কম্পুচীয় সশস্ত্রবাহিনীর ক্ষয়ক্ষতির সঠিক পরিমাণ জানা যায়নি।

ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় একদল মার্কিন ও দক্ষিণ ভিয়েতনামি সৈন্য; Source: US Army Heritage and Education Center/Wikimedia Commons

তদুপরি, এই যুদ্ধে অন্তত ৫,০৯৯ জন দক্ষিণ কোরীয় সৈন্য নিহত, ৪ জন দক্ষিণ কোরীয় সৈন্য নিখোঁজ এবং ১৪,২৩২ জন দক্ষিণ কোরীয় সৈন্য আহত হয়। অন্তত ৫০০ জন অস্ট্রেলীয় সৈন্য এই যুদ্ধে নিহত এবং ৩,১২৯ জন অস্ট্রেলীয় সৈন্য আহত হয়। ৩৫১ জন থাই সৈন্য এই যুদ্ধে নিহত হয় এবং ১,৩৫৮ জন থাই সৈন্য আহত হয়। এর পাশাপাশি অন্তত ৩৭ জন নিউজিল্যান্ডার, ২৫ জন তাইওয়ানি ও ৯ জন ফিলিপিনো সৈন্য এই যুদ্ধে নিহত হয়, এবং ১৮৭ জন নিউজিল্যান্ডার ও ৬৪ জন ফিলিপিনো সৈন্য এই যুদ্ধে আহত হয়। সর্বোপরি, এই রাষ্ট্রগুলো যুদ্ধ চলাকালে প্রায় ৬০০টি যুদ্ধবিমান ও হেলিকপ্টার হারায়।

সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র রাষ্ট্রগুলো ভিয়েতনাম যুদ্ধে বিপুল ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়। মার্কিন সরকারের হিসেব অনুযায়ী, এই যুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় ১.০২ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয় হয়, এবং এটি ছিল এই যুদ্ধে তাদের প্রত্যক্ষ ব্যয়ের পরিমাণ মাত্র। এত বিপুল পরিমাণ সামরিক ও আর্থিক ক্ষয়ক্ষতির পরেও যুক্তরাষ্ট্র এই যুদ্ধে পরাজিত হয় এবং দক্ষিণ ভিয়েতনাম, লাওস ও কম্পুচিয়ায় মার্কিনপন্থী সরকারগুলোকে ক্ষমতাচ্যুত করে কমিউনিস্টরা শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সংঘটিত অন্য কোনো যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র এত বিপুল পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়নি। এজন্য ‘ভিয়েতনাম’ বড় মাত্রার সামরিক ব্যর্থতা/বিপর্যয়ের প্রতীক হিসেবে বিশ্বব্যাপী পরিচিতি লাভ করে।

অবশ্য ভিয়েতনাম যুদ্ধে/দ্বিতীয় ইন্দোচীন যুদ্ধে বিজয়ী পক্ষ অর্থাৎ কমিউনিস্টদের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণও কোনো অংশে কম ছিল না। ভিয়েতনামি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রদত্ত তথ্য অনুযায়ী, এই যুদ্ধ চলাকালে উত্তর ভিয়েতনামি সশস্ত্রবাহিনী ও দক্ষিণ ভিয়েতনামভিত্তিক কমিউনিস্ট মিলিট্যান্ট গ্রুপ ‘ভিয়েত কং’য়ের অন্তত ৮,৪৯,০১৮ জন সদস্য নিহত, প্রায় ৩ লক্ষ সদস্য নিখোঁজ এবং প্রায় ৬ লক্ষ সদস্য আহত হয়। তদুপরি, যুদ্ধ চলাকালে উত্তর ভিয়েতনাম অন্তত ১৫৯টি যুদ্ধবিমান ও ২টি হেলিকপ্টার হারায়। লাওসভিত্তিক কমিউনিস্ট মিলিট্যান্ট গ্রুপ ‘পাথেট লাও’ এবং কম্পুচিয়াভিত্তিক কমিউনিস্ট মিলিট্যান্ট গ্রুপ ‘খেমার রুজ’ও এই যুদ্ধে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়, কিন্তু তাদের ক্ষয়ক্ষতির সঠিক পরিমাণ নির্ধারণ করা যায়নি।

উত্তর ভিয়েতনামে মোতায়েনকৃত সোভিয়েত সামরিক উপদেষ্টারা একটি মার্কিন ‘বি–৫২ স্ট্র‍্যাটোফোর্ট্রেস’ বোমারু বিমানের ধ্বংসাবশেষ পরীক্ষা করছে; Source: Sergei Varyukhina/Wikimedia Commons

যুদ্ধ চলাকালে চীন, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও উত্তর কোরিয়া গোপনে ইন্দোচাইনিজ কমিউনিস্টদের (এবং বিশেষ করে উত্তর ভিয়েতনামকে) সহায়তা প্রদান করে। যুদ্ধ চলাকালে এই রাষ্ট্রগুলোর সৈন্যরা গোপনে কমিউনিস্টদের পক্ষে যুদ্ধে অংশ নেয়, কিন্তু তাদের অংশগ্রহণের মাত্রা ছিল যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় বহুলাংশে সীমিত। এই যুদ্ধে অন্তত ১,৪৪৬ জন চীনা সৈন্য নিহত ও ৪,২০০ জন চীনা সৈন্য আহত হয়, এবং অন্তত ১টি চীনা বিমান ভূপাতিত হয়। এর পাশাপাশি ১৬ জন সোভিয়েত সৈন্য এবং ১৪ জন উত্তর কোরীয় সৈন্য এই যুদ্ধে নিহত হয়।

সর্বোপরি, এই যুদ্ধের ফলে ৬,২৭,০০০ থেকে ২০,০০,০০০ বেসামরিক ভিয়েতনামি নিহত হয় এবং ১৯৭৫ সালে ভিয়েতনাম যুদ্ধের অবসানের পর দক্ষিণ ভিয়েতনাম, লাওস ও কম্পুচিয়ার প্রায় ৩০ লক্ষ বেসামরিক মানুষ শরণার্থীতে পরিণত হয়। তদুপরি, লাওসের গৃহযুদ্ধে ২০,০০০ থেকে ৬২,০০০ মানুষ নিহত হয় এবং কম্পুচিয়ার গৃহযুদ্ধে ২,৭৫,০০০ থেকে ৩,১০,০০০ মানুষ নিহত হয়। এদের মধ্যে সামরিক ও বেসামরিক উভয় ধরনের মানুষই ছিল, কিন্তু এদের বেশিরভাগই ছিল বেসামরিক ব্যক্তি।

চীনা–ভিয়েতনামি যুদ্ধ: গণচীনের ভিয়েতনাম

১৯৭৯ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি চীন তার দক্ষিণাঞ্চলীয় প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভিয়েতনামের ওপর আক্রমণ চালায়, এবং এর মধ্য দিয়ে চীনা–ভিয়েতনামি যুদ্ধ শুরু হয়। এই যুদ্ধে চীনের মূল উদ্দেশ্য ছিল কম্পুচিয়া থেকে সৈন্য প্রত্যাহারের জন্য ভিয়েতনামকে বাধ্য করা এবং সম্ভব হলে ভিয়েতনাম ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যেকার মৈত্রীতে ফাটল ধরানো। ভিয়েতনামের উত্তরাঞ্চলে প্রায় এক মাসব্যাপী প্রচণ্ড যুদ্ধের পর চীনারা ভিয়েতনাম থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হয় এবং পরবর্তী এক দশকব্যাপী কম্পুচিয়ায় ভিয়েতনামের সামরিক উপস্থিতি বজায় থাকে। তদুপরি, এই যুদ্ধের পর ভিয়েতনাম আরো সুদৃঢ়ভাবে সোভিয়েত প্রভাব বলয়ের অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়ে।

চীনা–ভিয়েতনামি যুদ্ধের সময় ভিয়েতনামে সৈন্যরা অগ্রসরমান চীনা সৈন্যদের ওপর গোলাবর্ষণ করছে; Source: STR/AFP/Getty Images via Business Insider

চীনা সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে এই যুদ্ধে তাদের সামরিক ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ প্রকাশ করেনি। চীনা সশস্ত্রবাহিনীর প্রদত্ত তথ্য অনুযায়ী, এই যুদ্ধে ৬.৯৫৪ জন চীনা সৈন্য নিহত ও ১৪,৮০০ থেকে ৩১,০০০ জন চীনা সৈন্য আহত হয়, এবং ২৩৮ জন চীনা সৈন্য ভিয়েতনামিদের হাতে বন্দি হয়। কিন্তু ভিয়েতনামি সরকারের বক্তব্য অনুসারে, এই যুদ্ধে প্রায় ৪৮,০০০ চীনা সৈন্য নিহত হয়। অবশ্য পশ্চিমা বিশ্লেষকরা চীনা সশস্ত্রবাহিনী ও ভিয়েতনামি সরকারের প্রদত্ত তথ্য সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। তাদের হিসেব অনুযায়ী, এই যুদ্ধে প্রায় ২৬,০০০ চীনা সৈন্য নিহত এবং প্রায় ৩৭,০০০ চীনা সৈন্য আহত হয়। তদুপরি, এই যুদ্ধ চলাকালে চীনারা ৪২০টি ট্যাঙ্ক ও আর্মার্ড পার্সোনেল ক্যারিয়ার (এপিসি) এবং ৬৬টি ভারী মর্টার ও কামান হারায়।

সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে, চীন চীনা–ভিয়েতনামি যুদ্ধে স্বল্প সময়ের মধ্যে বিপুল ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়। চীনা সরকারের হিসেব অনুযায়ী, এই যুদ্ধে চীনের প্রায় ৩৪৫ কোটি (বা ৩.৪৫ বিলিয়ন) ইউয়ান ব্যয় হয়, এবং এটি ছিল এই যুদ্ধে তাদের প্রত্যক্ষ ব্যয়ের পরিমাণ মাত্র। এত বিপুল পরিমাণ সামরিক ও আর্থিক ক্ষয়ক্ষতির পরেও চীন কার্যত এই যুদ্ধে পরাজিত হয় এবং এই যুদ্ধ শুরুর পশ্চাতে তাদের যেসব লক্ষ্য ছিল, সেগুলোর কোনোটিই তারা অর্জন করতে পারেনি। অবশ্য ভিয়েতনাম থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করে নেয়ার পর চীনা সরকার এই যুদ্ধে নিজেদেরকে বিজয়ী বলে ঘোষণা করে, কিন্তু কার্যত এই ঘোষণার কোনো মূল্য ছিল না। বস্তুত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সংঘটিত অন্য কোনো যুদ্ধে চীন এত বিপুল ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়নি। এজন্য রাজনৈতিক ও সামরিক বিশ্লেষকরা ১৯৭৯ সালে সংঘটিত চীনা–ভিয়েতনামি যুদ্ধকে ‘চীনের ভিয়েতনাম’ (Chinese Vietnam) হিসেবে অভিহিত করে থাকেন।

অন্যদিকে, ভিয়েতনামি সরকারও আনুষ্ঠানিকভাবে এই যুদ্ধে তাদের সামরিক ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ প্রকাশ করেনি। চীনা সরকারের বক্তব্য অনুসারে, এই যুদ্ধে ৪২,০০০ থেকে ৫৭,০০০ ভিয়েতনামি সৈন্য ও প্রায় ৭০,০০০ ভিয়েতনামি মিলিশিয়া সদস্য নিহত হয়, এবং ১,৬৩৬ জন ভিয়েতনামি সৈন্য চীনাদের হাতে বন্দি হয়। কিন্তু পশ্চিমা বিশ্লেষকরা চীনা সরকারের প্রদত্ত তথ্য সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। তাদের হিসেব অনুযায়ী, এই যুদ্ধে প্রায় ৩০,০০০ ভিয়েতনামি সৈন্য নিহত এবং প্রায় ৩২,০০০ ভিয়েতনামি সৈন্য আহত হয়। তদুপরি, এই যুদ্ধ চলাকালে ভিয়েতনামিরা ১৮৫টি ট্যাঙ্ক ও এপিসি, ২০০টি ভারী মর্টার ও কামান এবং ৬টি মিসাইল লঞ্চার হারায়।

চীনা–ভিয়েতনামি যুদ্ধের সময় একজন ভিয়েতনামি সৈন্য একজন বন্দি চীনা সৈন্যকে পাহারা দিচ্ছে; Source: Bettman/Getty Images via Business Insider

সর্বোপরি, ভিয়েতনামি সরকারের প্রদত্ত তথ্য অনুযায়ী, এই যুদ্ধ চলাকালে অন্তত ১,০০,০০০ বেসামরিক ভিয়েতনামি নিহত হয় এবং যুদ্ধের ফলে ভিয়েতনামি শিল্প ও কৃষিখাত ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়। অর্থাৎ, যুক্তরাষ্ট্র ও চীনকে ‘তাদের ভিয়েতনাম’ (বিপর্যয়) প্রদান করতে গিয়ে ভিয়েতনামিদেরকেও কম ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়নি।

কম্পুচীয়–ভিয়েতনামি যুদ্ধ: ভিয়েতনামের ভিয়েতনাম

১৯৭৫ সালের ১ মে ভিয়েতনাম ও কম্পুচিয়ার (বর্তমান কম্বোডিয়া) মধ্যে সীমান্ত সংঘর্ষ শুরু হয় এবং প্রায় সাড়ে তিন বছরব্যাপী তীব্র সীমান্ত সংঘর্ষের পর ১৯৭৮ সালের ২১ ডিসেম্বর ভিয়েতনাম কম্পুচিয়ার ওপর আক্রমণ চালায়। তারা কম্পুচিয়ার ‘খেমার রুজ’–নিয়ন্ত্রিত ‘গণতান্ত্রিক কম্পুচিয়া’ সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে এবং তদস্থলে ‘গণপ্রজাতন্ত্রী কম্পুচিয়া’ নামক একটি ভিয়েতনামি–নিয়ন্ত্রিত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে। কিন্তু ‘গণতান্ত্রিক কম্পুচিয়া’র প্রবাসী সরকার ভিয়েতনামি ও ভিয়েতনামি–নিয়ন্ত্রিত কম্পুচীয় সৈন্যদের বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধ পরিচালনা করতে থাকে এবং কম্পুচিয়ার প্রতিবেশী থাইল্যান্ডের সঙ্গে ভিয়েতনাম ও কম্পুচিয়ার সীমান্ত সংঘর্ষ শুরু হয়। প্রায় এক দশকব্যাপী যুদ্ধের পর ১৯৮৯ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর নাগাদ ভিয়েতনাম কম্পুচিয়া থেকে নিজেদের সমস্ত সৈন্য প্রত্যাহার করে নেয় এবং এর মধ্য দিয়ে কম্পুচীয়–ভিয়েতনামি যুদ্ধের অবসান ঘটে।

১৯৭৫ থেকে ১৯৭৮ সালের মধ্যে সংঘটিত কম্পুচীয়–ভিয়েতনামি সীমান্ত সংঘর্ষের ফলে অন্তত ১০,০০০ ভিয়েতনামি সৈন্য নিহত হয়। পরবর্তীতে ১৯৭৯ থেকে ১৯৮৯ সালের মধ্যে ‘গণতান্ত্রিক কম্পুচিয়া’র যোদ্ধাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ১৫,০০০ থেকে ২৫,৩০০ জন ভিয়েতনামি সৈন্য নিহত ও প্রায় ৩০,০০০ ভিয়েতনামি সৈন্য আহত হয়। অবশ্য মার্কিন পত্রিকা ‘দ্য লস অ্যাঞ্জেলেস টাইমসে’র ভাষ্য অনুসারে, এই যুদ্ধে অন্তত ৫৫,০০০ ভিয়েতনামি সৈন্য নিহত এবং প্রায় ৫৫,০০০ ভিয়েতনামি সৈন্য আহত হয়। এই যুদ্ধে ভিয়েতনামের পক্ষে থাকা কম্পুচীয় মিলিট্যান্ট এবং পরবর্তীতে ‘গণপ্রজাতন্ত্রী কম্পুচিয়া’র সৈন্যদের ক্ষয়ক্ষতির সঠিক পরিমাণ নির্ধারণ করা সম্ভব হয়নি।

১৯৮৯ সালের সেপ্টেম্বরে কম্পুচিয়া থেকে ভিয়েতনামে প্রত্যাবর্তনের পর একদল ভিয়েতনামি সৈন্য; Source: Kraipit Phanvut/AFP via Asia Times

সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে, ভিয়েতনাম কম্পুচীয়–ভিয়েতনামি যুদ্ধে বিপুল ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়। সামরিক ক্ষয়ক্ষতির পাশাপাশি এই যুদ্ধ ভিয়েতনামের অর্থনীতির ওপর মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এত বিপুল পরিমাণ সামরিক ও আর্থিক ক্ষয়ক্ষতির পরেও ভিয়েতনাম এই যুদ্ধে পুরোপুরি বিজয়ী হতে পারেনি। অবশ্য সামরিকভাবে ভিয়েতনাম এই যুদ্ধে পরাজিত হয়নি এবং তারা যখন কম্পুচিয়া থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করে নেয়, তখন তাদের সৃষ্ট কম্পুচীয় সরকারই রাষ্ট্রটির ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিল (কার্যত এখনো ভিয়েতনামিদের সৃষ্ট কম্পুচীয় সরকারের নেতারাই কম্বোডিয়ার শাসনক্ষমতায় অধিষ্ঠিত)। কিন্তু ভিয়েতনামকে যে কম্পুচিয়া থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করে নিতে হয়েছে এবং তারা যে পশ্চিমা ও চীনা–সমর্থিত ‘গণতান্ত্রিক কম্পুচিয়া’র যোদ্ধাদের পুরোপুরি ধ্বংস করতে পারেনি, এই বিষয়টির কারণে এবং এই যুদ্ধে ভিয়েতনামের বিপুল পরিমাণ সামরিক ও আর্থিক ক্ষয়ক্ষতিকে বিবেচনায় রেখে সামরিক–রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা (এবং মার্কিন পত্রিকা ‘দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট’) এই যুদ্ধকে ‘ভিয়েতনামের ভিয়েতনাম’ (Vietnamese Vietnam) হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন।

অন্যদিকে, ১৯৭৫-৭৮ সাল পর্যন্ত সময়ে সংঘটিত কম্পুচীয়–ভিয়েতনামি সীমান্ত সংঘর্ষের ফলে অন্তত ১৫,০০০ কম্পুচীয় সৈন্য নিহত হয়। পরবর্তীতে ১৯৭৯-৮৯ সাল পর্যন্ত সময়ে ভিয়েতনামি ও ‘গণপ্রজাতন্ত্রী কম্পুচিয়া’র সৈন্যদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে হতাহত ‘গণতান্ত্রিক কম্পুচিয়া’র যোদ্ধাদের সঠিক সংখ্যা নির্ধারণ করা সম্ভব হয়নি। একই সময়ে ভিয়েতনাম ও ‘গণপ্রজাতন্ত্রী কম্পুচিয়া’র সৈন্যদের সঙ্গে সীমান্ত সংঘর্ষের ফলে অন্তত কয়েক হাজার থাই সৈন্য হতাহত হয়।

সর্বোপরি, ১৯৭৫-৭৮ সালের মধ্যে সংঘটিত কম্পুচীয়–ভিয়েতনামি সীমান্ত সংঘর্ষের সময় অন্তত ৩০,০০০ বেসামরিক ভিয়েতনামি নিহত হয় এবং একই সময়ে কম্পুচিয়ার অভ্যন্তরে ‘খেমার রুজ’ কর্তৃক পরিচালিত গণহত্যায় ১৫ থেকে ২০ লক্ষ বেসামরিক মানুষ নিহত হয়। পরবর্তীতে ১৯৭৯-৮৯ সালের মধ্যে সংঘটিত কম্পুচীয়–ভিয়েতনামি যুদ্ধের সময় প্রায় ২,০০,০০০ বেসামরিক কম্পুচীয় নিহত হয় এবং যুদ্ধের ফলে সৃষ্ট দুর্ভিক্ষের কারণে আরো বহু বেসামরিক কম্পুচীয় প্রাণ হারায়। অর্থাৎ, কম্পুচিয়ায় ভিয়েতনাম তাদের নিজেদের ‘ভিয়েতনাম’ (বিপর্যয়) পেয়ে যায়, কিন্তু এই বিপর্যয়ের মানবিক মূল্য ছিল অপরিসীম।

Related Articles