Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

অটোমান সাম্রাজ্য, তরুণ তুর্কি দল এবং তিন পাশার শেষ পরিণতি

সুবিশাল অটোমান সাম্রাজ্যের শেষ পরিণতি হয়েছিল খুবই দুঃখজনক। গত শতাব্দীর শেষের দিকেই এই সাম্রাজ্যের বিদায়ঘন্টা বেজে গিয়েছিল। ফ্রান্স দখলে নিয়েছে তিউনিসিয়া, আলজেরিয়া; ব্রিটিশরা জেঁকে বসেছে সুদান আর মিশরে। অন্যদিকে আরবরা ঘন ঘন প্রবল দাবি জানাচ্ছে অটোমানদের হাত থেকে মুক্তির জন্য। উত্তরে, ককেশাসের ওপার থেকে শ্যোন দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে প্রবল রাশিয়া।

ওদিকে বলকান অঞ্চলে বুলগেরিয়া, সার্বিয়া আর গ্রিসের প্রবল চাপে ইউরোপ থেকে ক্রমেই গুটিয়ে যাচ্ছে অটোমানদের নিয়ন্ত্রণ। এহেন পরিস্থিতিতে তুর্কিরা মরিয়া হয়ে ওঠে আবার নিজেদের পরাক্রম ফিরিয়ে আনবার জন্য। এরই ফল হিসেবে বিদেশে নির্বাসিত কিছু তুর্কি গঠন করে ‘কমিটি অব ইউনিয়ন অ্যান্ড প্রগ্রেস’। তরুণ তুর্কি নামে পরিচিত এই দলটির সদস্যরা পরবর্তীকালে খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তবে আজকের আলাপ সেই ঘটনাবহুল সময় নয়, বরং তরুণ তুর্কি দলের অন্যতম তিন নেতাকে নিয়ে। তিন পাশা নামে পরিচিত এই ত্রিমূর্তি প্রথম মহাযুদ্ধে অটোমান সাম্রাজ্যের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।

প্রথম মহাযুদ্ধের সময় অটোমান সাম্রাজ্য; Image Source: SlidePlayer

পূর্বকথন

সুলতান দ্বিতীয় আব্দুল হামিদ চাইতেন, যেভাবেই হোক অটোমান সাম্রাজ্যকে পুনরায় গড়ে তুলতে। কিন্তু পশ্চাৎপদ খলিফা কাম সুলতানের বিপক্ষে লোক বড় কম ছিল না। ইউরোপীয় শিক্ষায় শিক্ষিত অনেক তুর্কি চাইতো সুলতানকে বাদ দিয়ে আধুনিক একটি সাম্রাজ্য গড়ে তুলতে। সেনাবাহিনীতেও তাদের বিপুল সমর্থন ছিল। ১৯০৮ সালে এই তরুণ তুর্কিরা প্রবল এক বিপ্লব গড়ে তুললে সুলতান আব্দুল হামিদ তাদের কিছু দাবি মেনে নেন। পার্লামেন্ট গঠন করা হয়। তরুণ তুর্কিরা সেখানে জাঁকিয়ে বসে। সুলতান হামিদ নামমাত্র প্রধান হিসেবে থাকেন।

সুলতান দ্বিতীয় আব্দুল হামিদ; Image Source: Daily Sabah

তবে তরুণ তুর্কিদের বিপক্ষেও অনেক লোক ছিল। তুরস্কের গোড়া মোল্লারা এসব আধুনিক নেতাদের পছন্দ করতেন না। তার ওপর আব্দুল হামিদ ছিলেন খলিফা। নামেমাত্র হলেও বিশ্বব্যাপী মুসলিমদের মধ্যে খলিফার প্রতি বাড়তি একটা আনুগত্য কাজ করতো। খলিফা আব্দুল হামিদ নিজেও যথেষ্ঠ চতুর ছিলেন। ব্রিটেন, ফ্রান্স, আরব আর রুশদেরকে শায়েস্তা করবার অভিপ্রায়ে তিনি খাতির জমিয়েছিলেন জার্মানির উচ্চাকাঙ্ক্ষী এবং হঠকারী কাইজার দ্বিতীয় উইলহেলমের সাথে। বিপুল অর্থব্যয়ে বানানো হচ্ছিলো বার্লিন-বাগদাদ রেলপথ। অটোমানদের পুনরায় শক্তিশালী করে তুলবার প্রয়াসেই এই ডামাডোল। তরুণ তুর্কিদের নেতারাও জার্মানিকে বিশেষ সম্ভ্রম আর মুগ্ধতার নজরে দেখতেন।

তরুণ তুর্কিদের মধ্যে আবার নানা কোন্দল ছিল। এদের মধ্যে একটা অংশ পরে ‘ফ্রিডম অ্যান্ড অ্যাকর্ড’ পার্টি গঠন করে। দুই অংশের মধ্যে মারামারি লেগেই থাকতো। ১৯১৩ সালে ফ্রিডম অ্যান্ড অ্যাকর্ড পার্টিকে ক্ষমতা থেকে হটিয়ে তুরস্ক তথা ক্ষয়িষ্ণু অটোমান সাম্রাজ্যের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয় এই আলোচ্য তিন পাশা। এদের নেতৃত্বেই অটোমান সাম্রাজ্য প্রথম মহাযুদ্ধে প্রবেশ করে। এই তিন পাশাকেই আর্মেনীয় গণহত্যার জন্য দায়ী করা হয়। ক্ষমতালোভী এবং অসম্ভব উচ্চাকাঙ্ক্ষী এই পাশাদের নেতা ছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং প্রধান উজির/প্রধান মন্ত্রী তালাত পাশা। যুদ্ধমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেন এনভার পাশা আর শেষজন, জামাল পাশা ছিলেন নৌমন্ত্রী। ১৯১৮ সাল পর্যন্ত পাঁচটা বছর অটোমান সাম্রাজ্যে তাদের ছিল একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ।

তিন পাশার বিরুদ্ধে সবথেকে বড় অভিযোগ ছিল এই যে, তাদের নেতৃত্বে লক্ষ লক্ষ আর্মেনীয়, গ্রিক আর আসিরীয়কে হত্যা করা হয়। উল্লেখ্য, এই তিন জাতিগোষ্ঠীর লোকেরাই ধর্মে খ্রিস্টান এবং অটোমানদের চিরশত্রু; রাশিয়া আর গ্রিস তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিল। প্রথম মহাযুদ্ধের সময় একের পর এক হারের মুখে পড়ে পাশারা বারংবার দোষ চাপিয়ে দেন এসব সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর ওপরে এবং হাজারে হাজারে তাদেরকে হত্যা করেন।

আর্মেনীয় গণহত্যা; Image Source: The Independent

প্রথম মহাযুদ্ধে লজ্জাজনক পরাজয়ের জন্য তিন পাশাকে আধুনিক তুরস্কে যতই গালমন্দ করা হোক না কেন, তারা যে অত্যন্ত রোমাঞ্চকর চরিত্র ছিলেন তাতে কোনো সন্দেহ নেই। দেখা যাক তিন পাশা কেমন নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, আর দেখা যাক তাদের শেষ পরিণতিই বা কী হলো। 

তালাত পাশা

১৮৭৪ সালে মেহমেত তালাত জন্মগ্রহণ করেন। তার শুরুর জীবন ছিল সাদামাটা। ডাকবিভাগে দীর্ঘদিন চাকরি করবার পরে তরুণ তুর্কি আন্দোলনে জড়িত থাকবার সুবাদে তার দ্রুত পদোন্নতি ঘটতে থাকে। কিছুকাল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছিলেন।

তালাত পাশা; Image Source: Wikimedia Commons

পাশাদের নেতৃত্বে অটোমান সাম্রাজ্য প্রথম মহাযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। ১৯১৭ সালে তালাতকে প্রধান মন্ত্রীর দায়িত্ব দেওয়া হয়। তবে রুশ আর ব্রিটিশদের অগ্রগতি রুখতে তিনি ব্যর্থ হন এবং ১৯১৮ সালে নিজ দায়িত্বে ইস্তফা দেন। জার্মান সাবমেরিনে চড়ে পালিয়ে যাওয়ার সপ্তাহখানেকের মধ্যে ইস্তাম্বুলের পতন ঘটে। সুলতান হামিদ তার পুরনো শত্রুকে খুঁজে বের করবার জন্য প্রবল হম্বিতম্বি শুরু করেন। তালাত পাশার বিরুদ্ধে প্রধান অভিযোগ ছিল যে তার পরিকল্পনায় আর্মেনীয়, গ্রিক এবং আসিরীয় হত্যাযজ্ঞ সংঘটিত হয়। ১৯১৯ সালে তাকে তার অনুপস্থিতিতেই মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়।

তালাত জার্মানিতে পালিয়ে গিয়েছিলেন। সেখানে বসেই তুরস্কে আবার আরেকটা জাতীয়তাবাদী আন্দোলন গড়ে তোলবার পাঁয়তারা করছিলেন। তবে সেসব করার আগেই, ১৯২১ সালে সঘোমন তেহলিরিয়ান নামের এক আর্মেনীয় ঘাতকের একটি গুলিতে তালাত পাশা চিরকালের জন্য স্তব্ধ হয়ে যান।

জামাল পাশা

আহমেদ জামাল পাশা ছিলেন দক্ষ প্রশাসক। দীর্ঘদিন সেনাদলে চাকরি করবার পরে জামাল পাশা তরুণ তুর্কিদের মধ্যে শীর্ষস্থানীয় নেতা হয়ে ওঠেন। তারই নির্দেশে অটোমান নৌবাহিনী কৃষ্ণসাগরে রুশীদের ওপরে হামলা চালায়। অটোমানরা জার্মানির পক্ষ নেওয়ায় ব্রিটিশ আর রুশ উভয়েই ঝাঁপিয়ে পড়ে। জামাল পাশা ইরাকে ব্রিটিশদেরকে আচ্ছারকম পর্যুদস্ত করেন। তবে পরে যুদ্ধে হেরে পালান। জার্মান উপদেষ্টা আর সেনা কমান্ডারদের সাথে মাঝেমধ্যেই তার ভয়ানক মতবিরোধ হতো। জামালকে সিরিয়ার নিয়ন্ত্রণ দেওয়া হয়। তবে তার সুয়েজ খাল দখলের দুটো প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। ব্রিটিশরা লেবানন আর প্যালেস্টাইনে ক্রমেই আগুয়ান হতে থাকলে জামাল পাশা প্রথমে ইস্তাম্বুল এবং পরে জার্মানি পালিয়ে যান। অত্যন্ত নিষ্ঠুর এবং যেকোনো মূল্যে কার্যসিদ্ধি করবার চেষ্টা চালাতেন বলে জামাল পাশাকে অনেকেই ভয় পেত। তবে ক্ষয়িষ্ণু অটোমান সেনাদল নিয়েই তিনি উল্লেখযোগ্য প্রতিরোধ গড়েছিলেন। 

জামাল পাশা; Image Source: Alchetron

১৯২২ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের জর্জিয়ার তিফলিস সফরে যান জামাল পাশা। সেখানেই আর্মেনীয় গুপ্তঘাতকেরা তাকে হত্যা করে। উল্লেখ্য, রাজনৈতিক আর সামরিক জীবনের শুরুর দিকে জামাল পাশার সাথে মুস্তাফা কামাল আতাতুর্কের ঘনিষ্ঠতা ছিল, যদিও পরে তারা একে অপরের প্রতিপক্ষ হয়ে পড়েন।

এনভার পাশা

তিন পাশার মধ্যে সবথেকে জবরদস্ত ছিলেন এনভার পাশা। তুর্কি বাবা আর আলবেনীয় মায়ের সন্তান এনভার মাত্র ২৫ বছর বয়সেই মেজর জেনারেল হয়ে বসেন। ১৯১১ সালে ইতালী অটোমান লিবিয়া দখল করে নিলে এনভারের প্রতিপক্ষ, ফ্রিডম অ্যান্ড অ্যাকর্ড পার্টি ক্রমে ক্ষমতাশালী হয়ে ওঠে। পরের বছর বলকান দেশগুলোর হাতে অটোমানরা বেধড়ক মার খেলে ফ্রিডম অ্যান্ড অ্যাকর্ড পার্টিও জনপ্রিয়তা হারায়। এই সুযোগে এনভার ১৯১৩ সালে পাল্টা এক অভ্যুত্থানে ক্ষমতা দখল করেন। ঐ বছরই বুলগারদের হাত থেকে আদ্রিয়ানোপল দখল করে নিয়ে এনভার রীতিমতো মহানায়ক হয়ে ওঠেন। প্রথম মহাযুদ্ধে অটোমানদের অংশগ্রহণের ব্যাপারে এনভারই সবথেকে আগ্রহী ছিলেন।

এনভার পাশা; Image Source: deviantart.com

এনভার দক্ষ সেনানায়ক ছিলেন বটে, তবে তিনি অটোমান সেনাদলের শীর্ষ নেতৃত্ব ছেড়ে দেন জার্মানদের হাতে। যুদ্ধে অটোমানরা চরম নাজেহাল হয়। ককেশাসে এনভারের নব্বই হাজার সৈন্যকে কচুকাটা করে রুশেরা। তীব্র অসন্তোষের মধ্যেই যুদ্ধমন্ত্রী এনভার পাশা ককেশাসে আবার অভিযানের পরিকল্পনা করতে থাকেন। ততদিনে বলশেভিক বিপ্লবের কল্যাণে রাশিয়া আর যুদ্ধে তেমন মনোযোগী নয়। এই সুযোগে এনভার ককেশাসের অনেকটা অঞ্চল দখল করে নেন। তবে বিপুল ক্ষয়ক্ষতির বিনিময়ে এই সাফল্য তেমন কোনো অর্জন ছিল না, কেননা ততদিনে যুদ্ধ থামাবার দেনদরবার শুরু হয়ে গিয়েছে। ১৯১৮ সালে এনভার জার্মানি পালিয়ে যান।

অটোমান সেনাদল; Image Source: The National

পাশাদের অবর্তমানে তুরস্কে প্রধান ব্যক্তিত্ব হয়ে ওঠেন মুস্তাফা কামাল। তিনি এনভারকে অত্যন্ত বিপদজনক জ্ঞান করতেন। তুরস্কে ফিরতে না পেরে এনভার লেনিনের সাথে খাতির জমান। লেনিন তাকে বলশেভিক নিয়ন্ত্রিত সুবিশাল তুর্কিস্তান প্রজাতন্ত্রে (বর্তমান উজবেকিস্তান, কাজাখস্তান, তুর্কমেনিস্তান, কিরগিজস্তান আর তাজিকিস্তান) পাঠান। সেখানে তখন বুখারা আর খিভার আমীরের নেতৃত্বে চলছে বাসমাচি বিদ্রোহ

লেনিন কিন্তু এনভারের চালাকিটা ধরতে পারেননি। এনভার বিদ্রোহ দমন তো করলেনই না, উল্টো বাসমাচিদের দলে যোগ দিয়ে পাল্টা সোভিয়েতদের আক্রমণ করা শুরু করলেন। তার আসল উদ্দেশ্য ছিল অসংখ্য তুর্কি ভাষাভাষি গোষ্ঠী অধ্যুষিত মধ্য এশিয়াকে নিয়ে একটি শক্তিশালী দেশ গড়ে তোলা। তবে এনভারের উদ্ধত আচরণের কারণে বুখারার আমিরের সাথে সম্পর্ক দ্রুতই খারাপ হতে থাকে। ১৯২২ সালে লাল ফৌজের হামলায় এনভারের মৃত্যু হয়। এনভারের অন্যান্য তুর্কি সাঙ্গপাঙ্গরা আরো কয়েক বছর নিস্ফলা যুদ্ধ চালিয়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়।

১৯৯৬ সালে এনভার পাশার মরদেহ ইস্তাম্বুলে ফেরত আনা হয়।

Description: This is a Bangla article about the end of three pashas, known for their notorious rule of the Ottoman Empire during the 1913-1918 period.

References:

Finkel, Caroline (2005), Osman's Dream, John Murray Publishers, United Kingdom.

McMeekin, Sean (2010), The Berlin-Baghdad Express, Harvard University Press Cambridge, Massachusetts.

Featured Image: Orient XXI

Related Articles