Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

বঙ্গভঙ্গ: পেছনের গল্প

ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসে বিতর্কিত ঘটনাগুলোর একটি হচ্ছে বঙ্গভঙ্গ ও বঙ্গভঙ্গ রদ। দীর্ঘদিন ধরে ঐক্যে থাকা বাংলার মুসলমান ও হিন্দু সমাজের মধ্যে এক বিভেদ সৃষ্টি করে দেয় এই ঘটনা। ধর্মীয় দাঙ্গা ছাড়াও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটও পরিবর্তিত হয়ে যায় বঙ্গভঙ্গ আর এর পরবর্তী ঘটনাগুলোর ফলাফল হিসেবে। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ কার্যকর হলেও বাংলাকে ভাগ করার চিন্তা কিন্তু ব্রিটিশরা অনেকদিন আগে থেকেই শুরু করেছিল। তবে শুধু প্রশাসনিক সুবিধার কথা ভেবে শুরু হলেও শেষপর্যন্ত বঙ্গভঙ্গ হয়ে দাঁড়ায় বাংলার হিন্দু, মুসলমান আর ব্রিটিশ শাসকদের ত্রিমুখী এক দ্বন্দ্ব। চলুন দেখে আসা যাক কবে থেকে বাংলাকে ভাগ করার পেছনের গল্প আর তার ফলাফল কোন দিকে মোড় নিয়েছিল সেই ইতিহাস।

পটভূমি

ভারতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনের প্রায় একশ বছরের দিকে ১৮৫৪ সালে বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা ও আসাম নিয়ে গঠিত হয় বাংলা প্রেসিডেন্সি। এ প্রেসিডেন্সি ছিল একজন লেফটেন্যান্ট গভর্নরের অধীনে। বাংলা প্রেসিডেন্সি গঠিত হলে এত বড় এলাকার প্রশাসনিক কাজকর্ম করা ছিল বেশ দুরুহ। বর্তমান বাংলাদেশ অঞ্চলের রাস্তাঘাটসহ যোগাযোগ ব্যবস্থা খুব একটা ভালো ছিল না। আসাম কিংবা উড়িষ্যার অবস্থাও খুব একটা সুবিধার ছিল না। কলকাতা আর এর আশেপাশের কিছু এলাকাই মূলত উন্নত ছিল। আর বাংলার অসংখ্য নদী আর বর্ষাকালের বৃষ্টি যোগাযোগ ব্যবস্থার পথে এক বড় বাঁধা হয়ে ছিল।

বঙ্গভঙ্গের পূর্বে অবিভক্ত বাংলা প্রদেশ; Source: Wikimedia Commons

নানাবিধ সমস্যার ফলে ১৮৬৬ সালে উড়িষ্যায় এক দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। ততদিনে ভারতের শাসনভার চলে গিয়েছিল সরাসরি ব্রিটেনের সরকারের উপর। ব্রিটিশ সরকারের ভারত সচিব স্যার স্ট্যাফোর্ড হেনরি নথকোর্ট এ দুর্ভিক্ষের কারণ অনুসন্ধানে একটি কমিটি গঠন করেন। সে কমিটির অনুসন্ধানে উঠে আসে প্রশাসনিক অসুবিধার কথা। আর এর সমাধান হিসেবে বাংলা প্রেসিডেন্সিকে বিভক্ত করার সুপারিশ করেন তিনি। ১৮৬৭ সালে বাংলার ছোট লাট উইলিয়াম গ্রে বাংলা প্রেসিডেন্সি বিভক্তির সুপারিশ করলেও বড় লাট লরেন্স এর বিরোধিতা করেন। বরং তিনি আসাম ও এর কাছাকাছি কিহু জেলাকে আলাদা করার প্রস্তাব করেন। বিহার ও উড়িষ্যাকে বাংলার সাথেই রাখার পক্ষে ছিলেন তিনি। তবে প্রশাসনিক সুবিধার জন্য বাংলাকে ভাগের চিন্তা ব্রিটিশরা বেশ আগে থেকেই শুরু করেছিল।

১৮৭২ সালে ভারতের প্রথম আদমশুমারি অনুষ্ঠিত হয়। সে আদমশুমারি অনুসারে বাংলা প্রেসিডেন্সির জনসংখ্যা ছিল ৬ কোটি ৭০ লক্ষ। বর্তমান সময়ের হিসেবে এ জনসংখ্যা তেমন গুরুত্ব বহন না করলেও প্রায় দেড়শ বছর আগে এই বিশাল এলাকার প্রশাসনিক কাজ চালানোর জন্য এ জনসংখ্যা বেশ বড়ই ছিল। ফলে তখনকার ছোট লাট ক্যাম্বেল আবারো প্রশাসনিক অসুবিধার কথা তুলে বাংলাকে ভাগ করার সুপারিশ করেন। তার সুপারিশেই ১৮৭৪ সালে আসামকে বাংলা থেকে আলাদা করা হয়। আসামের সাথে বাংলা ভাষী তিনটি জেলা- সিলেট, কাছাড় ও গোয়ালপাড়াও বাংলা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। বিচ্ছিন্ন এ অংশের দায়িত্ব দেয়া হয় একজন চিফ কমিশনারের উপর।

উড়িষ্যা দুর্ভিক্ষ; Source: Shri Ashok Panda Exhibition

১৮৯৬ সালে আসামের চিফ কমিশনার উইলিয়াম ওয়ার্ড ঢাকা, ময়মনসিংহ ও চট্টগ্রামকে আসামের অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব করেন। মনে রাখা উচিৎ, সেময়ে এ জেলাগুলো বর্তমান বাংলাদেশের এই জেলাগুলো থেকে বেশ বড় ছিল। সেসময়ের জেলাগুলোকে ভেঙে পরবর্তীতে আরো জেলা হয়েছে। কিন্তু ওয়ার্ডের প্রস্তাব বাস্তবায়িত হয়নি, বরং তার উত্তরসুরী হেনরি কটন এর বিরোধিতা করেন। এছাড়াও চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী শ্রেণী ও বাংলা আইন পরিষদের বিরোধিতাও এ প্রস্তাব বাস্তবায়ন হতে দেয়নি।

তবে সবকিছু পাল্টে যায় যখন ১৮৯৮ সালে লর্ড কার্জন ভারতের বড় লাট হিসেবে দায়িত্ব নেন। প্রায় তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে চলে আসা বাংলা প্রেসিডেন্সির অসুবিধার ইতিহাস বিবেচনা করে তিনি বঙ্গভঙ্গের পরিকল্পনা হাতে নেন, তবে সরকারিভাবে শুরুতেই কোনো ঘোষণা দেয়া হয়নি। ১৯০১ সালে মধ্য প্রদেশের চিফ কমিশনার অ্যান্ড্রু ফ্রেজার উড়িয়া ভাষাভাষী অঞ্চলের পুনর্গঠনের জন্য প্রস্তাব করেন। একইসাথে বাংলা প্রদেশকে বিভক্ত করার যৌক্তিকতা নিয়েও তিনি সুপারিশ করেন। এছাড়া ঢাকা ও ময়মনসিংহকে আসামের অন্তর্ভুক্ত করে দিলে বাংলা প্রদেশের প্রশাসনিক কাজের সুবিধার কথাও উল্লেখ করেন।

লর্ড কার্জন; Source: Wikimedia commons

১৯০২ সালে বাংলা প্রদেশের সীমানা পুনর্নির্ধারণের গুরুত্ব ব্রিটিশ সরকারের কাছে জানান লর্ড কার্জন। ১৯০৩ সালে স্বরাষ্ট্র সচিব হাবার্ট রিজলে চট্টগ্রাম, ঢাকা ও ময়মনসিংহ জেলাকে বাংলা থেকে আলাদা করে আসামের সাথে যুক্ত করে আসামের চিফ কমিশনারের অধীনে ন্যস্ত করার প্রস্তাব দেন। কেন্দ্রীয় সরকার সে প্রস্তাব অনুমোদনও করে। কিন্তু সরকারের এ সিদ্ধান্ত প্রকাশিত হলে সরকারি ও বেসরকারি উভয় মহলেই অসন্তোষ দেখা দেয়। সরকারের এ সিদ্ধান্ত বাংলার মুসলিম ও হিন্দু উভয় ধর্মের লোকেরাই বিরোধিতা করে শুরতে। নবাব সলিমুল্লাহ মতো প্রভাবশালী নেতা বঙ্গভঙ্গের বিরোধিতা করেন। কিন্তু ব্রিটিশ সরকার এ পরিকল্পনাকে বাস্তবায়নে পুরোদমে নিজেদের নিয়োজিত করে। পূর্ব বাংলার জনগণকে নিজেদের পক্ষে টানতে বড় লাট ১৯০৪ সালে ঢাকা, ময়মনসিংহ ও চট্টগ্রাম সফর করেন।

মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ পূর্ব বাংলাকে নিজের পক্ষে টানতে লর্ড কার্জন ঢাকাকে রাজধানী করে মুসলিমদের সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধির ঘোষণা দেন। সেই সাথে একজন লেফটেন্যান্ট গভর্নর, পৃথক আইন পরিষদ ও রাজস্ব বোর্ডের ঘোষণাও দেন কার্জন। প্রথমদিকে পূর্ব বাংলার মুসলিমরা বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে থাকলেও বিভিন্ন সুবিধার কথা চিন্তা করে বেশিরভাগই পক্ষে চলে যায়। নবাব সলিমুল্লাহও বঙ্গভঙ্গের পক্ষে অবস্থান নিয়ে জনমত গঠনে ভূমিকা রাখেন। জমিদার, আইনজীবী ও কিছু ব্যবসায়ী ছাড়া মুসলমানদের অধিকাংশই বঙ্গভঙ্গের পক্ষে অবস্থান নেন। তবে আসামের চিফ কমিশনার হেনরি কটন নিজেও এ প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন। এসব পক্ষ-বিপক্ষ মতের মধ্যেই ১৯০৫ সালের ৯ জুন ভারত সচিব ব্রডরিক এ পরিকল্পনা অনুমোদন করেন ও ১০ জুলাই সরকারি গেজেট হিসেবে তা প্রকাশিত হয়।

বঙ্গভঙ্গের কারণ

পটভূমি পড়লে মনে হতেই পারে শুধুমাত্র প্রশাসনিক সুবিধার জন্যই বিশাল বাংলা প্রদেশকে ভেঙে দুই ভাগ করা হয়েছিল। একদিক থেকে প্রশাসনিক কারণ অবশ্যই একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ ছিল। কিন্তু এর সাথে জড়িত ছিল রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক আর সামাজিক কারণ। চলুন জেনে নেয়া যাক এ কারণগুলোর কিছু বিস্তারিত তথ্য। আর জন্য ফিরে যেতে হবে একটু পেছন দিকে।

মুর্শিদকুলী খান সম্রাট আওরঙ্গজেবের সময়ে ১৭০০ সালে বাংলার দেওয়ান হিসেবে বাংলায় নিয়োগ পান। সে সময় বাংলার রাজধানী ছিল ঢাকা। কিন্তু ১৭০৪ সালে মুর্শিদকুলী খান রাজধানী ঢাকা থেকে পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদে নিয়ে যান। সঠিকভাবে বলতে গেলে তিনিই নিজের নামে মুর্শিদাবাদের গোড়াপত্তন করেন। ঢাকায় নিরাপত্তার অভাবে ও কেন্দ্রের সাথে দূরত্বের অজুহাতে তিনি রাজধানী পরিবর্তন করেন। আর মুর্শিদকুলী খানের এই রাজধানী পরিবর্তন পরবর্তীতে দুই বাংলার মাঝে এক অসম অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থার সৃষ্টি করে। চাইলে বঙ্গভঙ্গের ‘বাটারফ্লাই ইফেক্ট’ হিসেবে মুর্শিদকুলী খানের এই রাজধানী পরিবর্তনকেও বলা যায়।

মুর্শিদকুলী খান; Source: Wikimedia Commons

ঢাকা থেকে রাজধানী পশ্চিমবঙ্গে যাবার পর থেকেই ঢাকাসহ পূর্ববঙ্গের উন্নয়ন কমে যেতে থাকে। ইংরেজ শাসনামলে রাজধানী মুর্শিদাবাদ থেকে চলে যায় কলকাতায়। ফলে ব্যবসা-বাণিজ্য, উন্নয়নসহ সব দিক থেকেই পূর্ব বাংলা পিছিয়ে যেতে থাকে। রাজধানীর উপর নির্ভরশীল ভূস্বামী, ব্যবসায়ীসহ অনেকেই ঢাকা ছেড়ে কলকাতায় যাওয়া শুরু করে। ফলে ঢাকা ও পূর্ব বাংলার যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতিও প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। জনসংখ্যা বেশি হলে সরকার এ অঞ্চলের জন্য খুব বেশি খরচ করতে আগ্রহ দেখাতো না মোটেও। যোগাযোগ ব্যবস্থা খারাপ হবার কারণে প্রশাসনিক ব্যবস্থাও খারাপ হতে থাকে দিনে দিনে। ফলে ডাক ব্যবস্থা, রাজস্ব আদায় ও আইন শৃঙ্খলা ব্যবস্থারও অবনতি ঘটতে থাকে প্রতিনিয়ত। চুরি, ডাকাতি ও বিভিন্ন বেআইনি কার্যকলাপ সাধারণ ঘটনায় পরিণত হতে শুরু করে পূর্ব বাংলায়। ফলে সরকারেরও বেশ সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছিল। ফলে সরকার পূর্ব বাংলাকে আলাদা প্রদেশ করে এর উন্নতি করার একটি পদক্ষেপ নিতে চেয়েছিল।

একইসাথে দুই বাংলায় অর্থনৈতিক বৈষম্য ছিল অনেক বেশি। কলকাতা ছিল অবিভক্ত বাংলার মূল কেন্দ্র। কলকাতা শুধু বাংলা প্রদেশ নয়, বরং পুরো ভারতে ব্রিটিশ শাসনের রাজধানী ছিল। ফলে ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকান্ড ছিল কলকাতাকেন্দ্রিক আর পূর্ব বাংলা পর্যন্ত সেগুলো খুব কমই পৌঁছাতে পারত। পূর্ব বাংলার কাঁচামাল দিয়ে শিল্প কারখানা গড়ে উঠতে থাকা কলকাতা ও এর আশেপাশের অঞ্চলে, লাভের বেশিরভাগই যেত কলকাতার বণিক শ্রেনীর পকেটে। আর অর্থনৈতিক দীনতায় দিন কাটাত পূর্ব বাংলার কৃষকরা। পূর্ব বাংলার পাট দিয়ে বেশিরভাগ পাটকল গড়ে ওঠে হুগলি নদীর তীরে। ব্যাপারটা অনেকটা পাকিস্তান আমলে পূর্ব পাকিস্তানের পাট দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের উন্নয়নের মতো ছিল।

কৃষিভিত্তিক পূর্ব বাংলার জমিদাররা বেশিরভাগই স্থায়ী নিবাস গড়ে রাজধানীতে। আর তাদের প্রতিনিধিরা খাজনার জন্য নির্যাতন চালাত পূর্ব বাংলার নিরীহ কৃষকদের উপরে। কষ্ট করত পূর্ব বাংলার কৃষকরা আর ফল ভোগ করত কলকাতার জমিদাররা। অর্থনৈতিক সংকটের কারণে পূর্ব বাংলার লোকেরা শিক্ষাতেও এগোতে পারত না। ফলে কলকাতার লোকেরা সহজে চাকরি পেলেও অবহেলিত পূর্ব বাংলার লোকেরা চাকরি পেত না সহজে। চট্টগ্রামের সুপ্রাচীনকাল থেকে সমুদ্রবন্দর থাকলেও ব্রিটিশ আমলে এর উন্নয়নে কোনো কাজই করা হয়নি বলতে গেলে। বরং রাজধানী কলকাতার বন্দরের লাভ কমে যাবে চিন্তা করে সরকার ও ব্যবসায়ী শ্রেণী চট্টগ্রাম বন্দরকে পুরোপুরি অবহেলা করেছিল। ঢাকা থেকে কর আদায় করে সে কর দিয়ে উন্নয়ন হতো কলকাতা, উড়িষ্যা আর বিহারে। রেল ব্যবস্থার উন্নয়নও ছিল পশ্চিমকেন্দ্রিক। ঢাকার মতো প্রাচীন ও গুরুত্বপূর্ণ শহরের সাথে ছিল না রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা। এসব অর্থনৈতিক অবহেলা প্রতিনিয়ত পূর্ব বাংলার জনগণ ও ব্যবসায়ীদের পশ্চিম বাংলা বিরোধী করে তুলছিল।

১৭০২ সালে ডাচ জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দরে ভেড়ানোর আঁকা ছবি; Source: SCHENK, P.

প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক সুবিধার জন্য পূর্ব বাংলাকে গুরুত্ব দেয়ার দরকার অপরিহার্য হলে বঙ্গভঙ্গের পেছনে কাজ করেছিল কিছু রাজনৈতিক ব্যাপারও। ব্রিটিশ শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষিত হওয়া শিক্ষিত সমাজ একসময় নিজেদের পরাধীনতার কষ্টটা অনুভব করতে থাকে। ফলে বাঙালি জাতীয়তাবাদের সৃষ্টি হয় আর এর কেন্দ্র ছিল কলকাতা। বাংলাকে বিভক্ত করে এই জাতীয়তাবাদকে দুর্বল করার কথা যে ব্রিটিশরা একেবারেই ভাবেনি সেটা মোটেই বিশ্বাসযোগ্য না। এছাড়া সরকারি চাকরিতে ব্রিটিশদের তুলনায় দেশীয়দের বৈষম্য বাঙালিদের ক্ষুব্ধ করে রেখেছিল অনেক দিন ধরেই। আর সবশেষে ব্রিটিশরা এমন এক চাল চালে যা ভারতবর্ষের ইতিহাসে এর আগে কেউই সরাসরি চালে নি। হিন্দু-মুসলিম বিভেদ তৈরি করে ভারতীয়দের ঐক্য নষ্ট করে ব্রিটিশদের সুবিধা করা।

পূর্ব বাংলায় প্রচুর হিন্দু থাকলেও লর্ড কার্জন তার পূর্ব বাংলা সফরে মুসলমানদের ঐক্যের উপরেই জোর দেন বেশি। ধর্মকে সরাসরি ব্যবহার করা দুই বাংলাতেই নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। পূর্ব বাংলায় মুসলমানদের মধ্যে হিন্দু বিদ্বেষী মনোভাব বাড়তে থাকে। এছাড়া পূর্ব বাংলায় প্রচুর হিন্দু থাকলেও তাদের অধিকাংশই ছিলেন নিচু বর্ণের হিন্দু। অন্যদিকে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়দের মতো উঁচু বর্ণের হিন্দুরা থাকতেন কলকাতায়। ফলে মুসলমানদের সাথে সাথে পূর্ব বাংলার হিন্দুরাও নিজেদের সুবিধার কথা ভেবে বঙ্গভঙ্গের পক্ষেই অবস্থান নেন।

বঙ্গভঙ্গের বাস্তবায়ন

১৯০৫ সালের ১৬ অক্টোবর বঙ্গভঙ্গ বাস্তবায়িত হয়। লর্ড কার্জনের পরিকল্পনা অনুযায়ী আসাম, চট্টগ্রাম, ঢাকা, রাজশাহী, ত্রিপুরা, মালদহ ‘পূর্ব বাংলা ও আসাম’ প্রদেশ গঠিত হয়। এ প্রদেশের রাজধানী হয় ঢাকা। স্যার ব্যামফিল্ড ফুলার পূর্ব বাংলা ও আসাম প্রদেশের ছোট লাট (গভর্নর) হিসেবে নিয়োজিত হন। অন্যদিকে পশ্চিমবঙ্গ, বিহার ও উড়িষ্যা নিয়ে গঠিত হয় বাংলা প্রদেশ, যার রাজধানী কলকাতাতেই থেকে যায়। মজার ব্যাপার পূর্ব বাংলার ৩ কোটি ১০ লক্ষ মানুষের মাঝে মুসলমান ছিল ১ কোটি ৮০ লক্ষ আর হিন্দু ছিল ১ কোটি ২০ লক্ষ। অন্যদিকে বাংলা প্রদেশের ৫ কোটি ৪০ লক্ষ লোকের মাঝে হিন্দু ছিল ৪ কোটি ২০ লক্ষ আর মুসলমান ছিল ৯০ লক্ষ। বাংলা প্রদেশ হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও পূর্ব বাংলায় হিন্দু-মুসলিম প্রায় সমানই ছিল। ফলে শুধু মুসলমানদের সুবিধার জন্যই বঙ্গভঙ্গ হয়েছিল সেটি ভাবা নিতান্তই বোকামি হবে। তবে সরকার মুসলমানদের পাবলিক সেন্টিমেন্ট ব্যবহার করে পূর্ব বাংলার জনগণকে বঙ্গভঙ্গের পক্ষে আনতে।

বঙ্গভঙ্গের পরে দুই প্রদেশ; Source: Wikimedia Commons

বঙ্গভঙ্গের পর দুই প্রদেশে সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। পূর্ব বাংলার জনগণ স্বাগত জানালেও অপর বাংলা মোটেও মেনে নিতে পারেনি ব্রিটিশ সরকারের এই সিদ্ধান্ত। বঙ্গভঙ্গের পরবর্তী ঘটনা থাকছে পরবর্তী পর্বে।

তথ্যসূত্র

১. ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ ও পূর্ববঙ্গে প্রতিক্রিয়া, মুনতাসির মামুন

২. বাংলাদেশের ইতিহাস (১৯০৫-১৯৭১), ড. আবু মোঃ দেলোয়ার হোসেন

৩. Bengal Electoral Politics and Freedom Struggle 1832-1947, Gautum Chattopadhyay

৪. The New Province of Eastern Bengal and Assam, M. K. U. Molla

৫. The History of Bengal, Volume II, Sir Jadunath Sarkar

ফিচার ইমেজ- The Quint

Related Articles